22/02/2017
আর্যরা আমদের পূর্বপুরুষ বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের মুখে বার বার পর্যদুস্ত হয়ে 'অসুর' তকমা দিয়েছিল। আর্যরা 'দেবতা' আর দ্রাবিড়রা 'অসুর', এই পরিচয়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা দীর্ঘদিন যাবত পরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় দেখা যায় 'অসুরদের' মূল পরিচয়ে কোন পরিবর্তন হয়নি, সময়ে সময়ে হয়ত 'দেবতাদের' দল ভারি হয়েছে...
প্রথমেই বলে রাখি এই পোষ্টের উদ্দেশ্য কোন ধর্মীয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক গোষ্ঠি বা দলের সমর্থন বা বিরুদ্ধাচরণ নয়, বরং নিছকই অনেকের কাছে অজানা কিছু তথ্য শেয়ার করা...
কলকাতার লেখক ভবানীচরণ বন্দোপধ্যায় পলাশীর যুদ্ধকে অভিহিত করেছেন 'দেবাসুর সংগ্রাম' হিসেবে। বর্ণহিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থসমূহে 'দেবাসুর সংগ্রাম' একটু বহুল ব্যবহৃত শব্দ। আর্যরা আমদের পূর্বপুরুষ বঙ্গ-দ্রাবিড়দের প্রতিরোধের মুখে বার বার পর্যদুস্ত হয়ে 'অসুর' তকমা দিয়েছিল। আর্যরা 'দেবতা' আর দ্রাবিড়রা 'অসুর', এই পরিচয়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা দীর্ঘদিন যাবত পরিচিত ছিল। কালের পরিক্রমায় দেখা যায় 'অসুরদের' মূল পরিচয়ে কোন পরিবর্তন হয়নি, সময়ে সময়ে হয়ত 'দেবতাদের' দল ভারি হয়েছে। প্রাচীন ঐতিহ্যের সূত্র ধরেই প্রাচীন আর্যদের অধ:স্তন পুরুষ ভবানীচরণ বন্দোপধ্যায়রা বাংলার নতুন যুগের প্রতিরোধ সংগ্রামের বীর নায়ক নবাব সিরাজউদ্দোলাকে 'অসুর' আখ্যায়িত করেছেন,তাদের চোখে পলাশীর 'দেবতা' হল ইংরেজরা।
ইতিহাসে দুর্গাপূজা সর্বপ্রথম পালিত হয় অত্যাচারী রাজা কংসনারায়ণের দ্বারা ষোড়শ শতাব্দীতে ধনরত্নের দাপট দেখানোর উদ্দেশ্যে। তখন হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা টাকার খেলা দেখানোর জন্য এই দুর্গাপূজা নামক মচ্ছবে লিপ্ত হতো। কিন্তু এটা ছিলো বাসন্তী (চৈত্র মাসের) দুর্গাপূজার ইতিহাস, (আশ্বিন মাসের) শারদীয় নয়। শারদীয় দূর্গা পূজা নামক উৎসবের প্রথম সৃষ্টি ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর। পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দস্যুদের এক সংবর্ধনা দিতে চেয়েছিলো বাংলার কতিপয় বিশ্বাসঘাতক হিন্দু। মূলত ঐ সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকেই আজ এই ‘শারদীয় দূর্গা পূজা’র সৃষ্টি। উল্লেখ্য পলাশীর যুুদ্ধে যারা বাংলার সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিলো নবকৃষ্ণ নামক এক হিন্দু। নবকৃষ্ণ পেশায় ছিলো মুন্সি এবং আরবী,ফার্সী, ইংরেজী, সংস্কৃত সহ অনেক ভাষা জানতো। পলাশী চক্রান্তে মূলত এই নবকৃষ্ণই ক্লাইভের দোভাষী হিসাবে কাজ করেছিলো। এই নবকৃষ্ণ না থাকলে ক্লাইভ এত সহজ ভাবে এবং দ্রুত দেশীয় জমিদার ও রাজাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো না, পারতো না বাংলা দখল করতে। পলাশীর যুদ্ধের পর বৃটিশরা মুর্শিদাবাদের ৫০ কোটি টাকা লুন্ঠন করেছিলো। ভাগের বাটোয়ারা অনুযায়ী নবকৃষ্ণ পেয়েছিলো আট কোটি টাকা। পলাশী যুদ্ধের পর বিশ্বাসঘাতক নবকৃষ্ণ চেয়েছিলো ক্লাইভকে সংবর্ধনা দিতে। কিন্তু সে সময় কলকাতায় বড় কোন গির্জা ছিলো না। তাই নবকৃষ্ণ এক ফন্দি আটলো। সে বাড়িতে ৪দিন দিন ব্যাপী এক পার্টি দিতে চাইলো, যা সেকলের কাছে পরিচিত ছিল কোম্পানীর পূজো হিসেবে। যা আজও শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজো বলে টিকে আছে। কালক্রমে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান পরিণত হয় শারদীয় দূর্গা পূজা রূপে। তাই দেশপ্রেমিকরা এই পুজোকে ‘বেইমানের পুজো’ বলে আখ্যা দিতো৷ বঙ্কিমচন্দ্রও জানত যে লর্ড ক্লাইভের আমলেই দুর্গার সৃষ্টি। সে এও জানত যে ওটা ইংরেজদেরই কারসাজি। “বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্রুপ করিয়া লিখিয়াছিল যে, পরে দুর্গাপূজার মন্ত্রও ইংরাজিতে পঠিত হইবে।” (তথ্যসূত্র : এ এক অন্য ইতিহাস- গোলাম আহমদ মোর্তজা, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৩২-৩৪) পূজা নামক এ অনুষ্ঠানগুলোতে মদ-বাইজি এবং বারবাণিতাদের অবাধ আয়োজন থাকতো। সাথে ব্রিটিশদের জন্যে থাকতো গোমাংস সহযোগে ডিনার। উনবিংশ শতকে নবকৃষ্ণের দেখা দেখি সব পুজোতেই মদ্যপান, নারী এবং গোমাংস সহযোগে উদ্যোম পার্টি করা হতো ব্রিটিশদের নিয়ে। দুর্গাপুজোর জনপ্রিয়তার এটাই মূল কারন যে তা বৃটিশদের পৃষ্ঠপোষকাতে তাদের উমেদারদের জন্যেই জনপ্রিয় হয়েছে। ১৮৪০ সাল পর্যন্ত এই ট্রাডিশন বজায় ছিল। অনেক ব্রিটিশ নিজেরাই পুজো দিতো-পার্টি দিতো। শেষে পুজোর সময় বারবানিতা এবং বাইজিদের নিয়ে এত টানাটানি এবং টানাটানি থেকে রেষারেশি,মারামারি হতে লাগল, কোম্পানী আইন করে, বৃটিশদের দূর্গাপুজো থেকে বিরত করে। দূর্গা পূজা যদি হিন্দুদের ধর্মীয় পূজাই হতো তবে সারা ভারত জুড়ে তার অস্তিত্ব মিলতো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে শুধু বঙ্গতেই এই পূজার অস্তিত্ব মিলছে। তার মানে ইতিহাস অনুসারে এটা হিন্দুদের কোন ধর্মীয় অনু্ষ্ঠান নয়, বরং ব্রিটিশদের মনোরঞ্জনে বাংলার বিশ্বাসঘাতক হিন্দুদের সৃষ্টি করা একটি পার্টি মাত্র, যা ২০০ বছর ব্রিটিশ দাসত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্বাস কতিপয় বিশ্বাসঘাতক হিন্দু ও যবন খ্রিস্টানদের বানানো এ পূজা কিছুতেই কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হতে পারে না। তাই এ পূজা বর্জন করাই খাটি হিন্দুত্বের লক্ষণ হওয়ার কারণ বলে মনে করি।
(পড়তে পারেন: ১৯৯৭-এর ৫ই অক্টোবর তারিখের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে ‘ক্লাইভের দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধ।)
রাধারমন রায় লিখেছেন :
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর রণাঙ্গনে মীর জাফরের বেইমানির দরুন ইংরেজ ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজউদোলার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যারা উল্লাসিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানীর জয়কে তারা হিন্দুদের জয় বলে মনে করলেন। ক্লাইভের পরামর্শেই তারা পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব করার আয়োজন করলেন। আগে এদেশে বসন্তকালে চালু ছিল দুর্গাপূজো আর শরৎকালে ছিল নবপত্রিকাপূজো। দুর্গাপুজোর সাথে জড়িয়ে ছিল মূর্তির ব্যপার, আর নবপত্রিকার পূজোর সাথে জড়িয়ে ছিল নটি উদ্ভিদের ব্যপার। ১৭৫৭ সালেই নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দুর্গাপুজোর মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালন করলেন। এরপর ফি বছর শরৎকালে দুর্গাপূজো করে তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করছেন আর অন্যান্য হিন্দু জমিদার বা ব্যবসায়ীদেরও তা পালন করতে উৎসাহিত করছেন। শোনা যায়, শরৎকালীন দুর্গাপূজো যেবছর প্রবর্তিত হয়েছিল, সেই ১৭৫৭ সালেই কৃষ্ণচন্দ্র এবং নবকৃষ্ণ দু'জনেই লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছিলেন। নবকৃষ্ণ টাকা পেয়েছিলেন সিরাজউদ্দোলার গুপ্ত কোষাগার লুট করে আর কৃষ্ণচন্দ্র টাকা পেয়েছিলেন ক্লাইভের প্রত্যক্ষ কৃপায়। ক্লাইভ যে উৎসাহিত করেছিলেন তাঁর প্রমাণ হচ্ছে নবকৃষ্ণের বাড়িতে পূজো অনুষ্ঠানে ক্লাইভের সপরিষদ উপস্থিতি। নবকৃষ্ণের পুরনো বাড়িতে ঠাকুর দালানটি ১৭৫৭ সালে খুবই তড়িঘড়ি করে করা হয়েছিল। তিনি ভালো করেই জানতেন, সাচ্চা সাহেব ক্লাইভ ধর্মে খ্রীস্টান, মনে মনে মূর্তি পূজার ঘোর বিরোধী। অতএব স্রেফ দুর্গা ঠাকুরকে দেখিয়ে মন ভরানো যাবেনা। তাই তিনি বাঈ নাচের,মদ মাংসের ব্যবস্থা করেছিলেন। দুর্গাপূজোর নামে ক্লাইভ পূজো করতে চেয়েছিলেন। পরে কলকাতার বাবুদের মধ্যে এই রকম সাহেবপূজো নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ হয়। (রাধা রমন রায়: কলকাতা বিচিত্রা,পৃষ্ঠা ২৫৩-২৮৩; দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড,২১ ঝামপুর লেন, কলকাতা)
শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের হাতে পড়ে দুর্গাপূজোর কি অবস্থা হয় তা নিম্নরুপঃ
..but the most amazing act of worship was performed by the East India Company itself: in 1765 it offered a thanksgiving Puja, no doubt as a politic act to appease its Hindu subjects, on obtaining the "Diwani of Bengal". And it is reported that even the Company auditor-general John Chips organized Durga Puja at his Birbhum office. In fact, the full official participation of the British in the Durga Puja continued till 1840, when a law was promulgated by the government banning such participation.(Sukanta Chaudhuri, ed. Calcutta: the Living City, Vol. 1: The Past)
এখন আসল কথায় আসি, পলাশীতে সিরাজউদ্দোলার পরাজয়ে এই উৎসব কেন? এ বিজয় কার বিজয়? তার জবাব ভবানীচরণের জবানীতেই পাওয়া যায়। তার ভাষায়, পলাশীর লড়াইয়ের ফলে উঠে এসেছে 'হর্ষের অমৃত" আর "বিষাদের হলাহল"। হর্ষের অমৃত পান করে কলকাতা হয়েছে 'নিরুপমা ও সর্বদেশখ্যাতা' আর "বিষাদের হলাহল" কার ভাগ্যে জুটল তা অবশ্য বলেননি ভবানীচরণ, কিন্তু একথা পরিষ্কার যে "বিষাদের হলাহল" গিলতে হয়েছিল ঢাকা আর মুর্শিদাবাদকেই...।