09/12/2024
লেখক Monija Rahman -এর ওয়াল থেকে নেওয়া লেখা।
‘এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’ নিয়ে লিখেছেন
সুলতানা আক্তার
………………………………………………………………………..
ভিন্নস্বাদের গদ্যগ্রন্থ
মনিজা রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির মত জটিল বিষয়ে অধ্যায়নকালেই সে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখি শুরু করে। তার ভাষায় টিউশনি করার হাত থেকে বাচার জন্য ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে লিখে কিছু উপার্জন করাই ছিল তার লক্ষ্য। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই তার প্রবল ক্রীড়া অনুরাগের বিষয়টি আমি জানি। ক্রীড়া বিষয়ক সকল তথ্য উপাত্ত স্কুল জীবন থেকেই তার মগজে গাথা থাকত। সাংবাদিকতার লেখনির বাইরে সে যখন ফেসবুকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি শুরু করে তখন আমি তাকে নতুন করে চিনতে শুরু করি। তার লেখনি প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হতে থাকে আর আমরাও আমাদের মধ্যকার কারও শক্তিশালী লেখিকা হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার ধারাবাহিক অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি। মুগ্ধ হয়ে তার লেখিকা সত্ত্বার ক্রমান্নোতি দেখে বিস্মিত না হয়ে গৌরববোধ করতে থাকি।
অনেক বছর ধরেই মনিজা আমেরিকার নিউইয়র্কে বসবাস করছে। সেখানে প্রতিনিয়ত প্রবাসী বাংলাদেশীদের যাপিত জীবন, সুখঃ-দুঃখ, ভালোবাসা, সংগ্রামসহ খুঁটিনাটি অনেক কিছু দেখার ও জানার সুযোগ তার হয়েছে এবং হচ্ছে। তার অন্তঃদৃষ্টি দিয়ে সেসকল দেখার এবং অনুভব করার অভিজ্ঞতা এবং তার নিজের উপলব্ধিগুলোকেই সে ছোট গল্প আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে ‘এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’ বইটিতে। এতে মোট পনেরটি ছোট গল্প রয়েছে। মনিজা তার গভীর পর্যবেক্ষণ দিয়ে শিল্পির আচড়ে সেগুলো তুলে এনেছে। মনিজা রহমান একজন সুলেখক। তিনি চমৎকার গদ্য লেখেন তা পাঠক স্বীকার করবেন। বিশেষ করে ‘এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’ বইটির গল্পগুলো ভিন্নমাত্রার।
পয়লাতে আমরা তার চরিত্রগুলোকে চিনতে চেষ্টা করব। পনেরটি গল্পের ভেতরে বেশিরভাগই গল্পই জীবনযুদ্ধে খানিকটা সুবিধে পাওয়া বা অর্জন করে নেওয়া বা ভাগ্যচক্রে আমেরিকায় পাড়ি জমানোর ফলে নিদেনপক্ষে বাংলাদেশের সমাজে মধ্যবিত্তের তকমা পাওয়া মধ্যবিত্তদেরকে নিয়ে রচিত। এরা তবে কারা? এরা কেউ নিম্ন মধ্যবিত্ত কর্মজীবি থেকে আমেরিকার রাজনীতিতে স্থান করে নেওয়া সফল তারকা যার সূচনা হয়েছিল তার শৈশবকালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একটি ছোট কিন্তু তাতপর্যপূর্ণ আবেগময়ী ঘটনা থেকে।
আমরা দেখি পারিবারিক ভিসায় আমেরিকায় যাওয়া এক নারী হঠাত আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলে তার সুবাদে আমেরিকায় যাওয়া তার জীবনসংগীর বদলে যাওয়া, ভাষা দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সহপাঠীর মনোজগতের ভাবনা, ধর্মীয় পার্থক্যের কারনে পরিবারের মেনে না নেওয়ার আশংকায় ভালোবাসাকে বিসর্জন দেয়া এবং পরে আবার তা ফিরে পাওয়া, সতের বছর অবৈধ থাকার পরে বাদল এর সেই সারেং এর মত দেশে বৌয়ের কাছে ফিরে যাওয়ার আবেগময় আকুতি, ধার করা খালাম্মার আর্থ-সামাজিক টানাপোড়েন, স্পার্ম ডোনারের মাধ্যমে জন্ম নেয়া লোরেনকে নিয়ে মা ও নানীর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারের অবধারিত মানসিক চাপে আরও ভেঙ্গে পড়া ফ্রাংকো এবং আনিকার জীবন বাস্তবতা, গলাকাটা পাসপোর্ট সংক্রান্ত অপরাধে বাবার ডিপোর্ট এবং শেলীর জীবনের দূর্যোগ এইরকম সব উপাখ্যান নিয়েই সাজানো হয়েছে গল্পগ্রন্থটি।
‘এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’ গল্পটির শিরোনামকেই এই বইয়ের শিরোনাম করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় গল্পকার কি তীব্রভাবে তার শেকড়কে এখনো আকড়ে রেখেছেন। লেখকের অনুভুতিগুলোই যেন এই গল্পের আফসানা এবং আলিভিরার জবানীতে উপস্থাপিত হয়েছে। প্রবাসীদের শেকড়ের যে টান তা ভীষণ আবেগ নিয়ে এই গল্পে তুলে আনা হয়েছে। আমি নিজেও একসময় কিছুদিন জার্মান প্রবাসী ছিলাম। সেই নাড়ীর টানে আমিও প্রবাসে থাকতে পারিনি সেভাবে। আমেরিকা প্রবাসী আলিভিরা যখন তার শেকড়ের জায়গায়, বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বৃষ্টিস্নাত রাস্তায় পা হড়কে পড়ে যায়, তখন ব্যাথায় না কাতরিয়ে প্রবল কান্নার মাঝে সে বলছে, “ আম্মা এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া আসা করতো। কত কষ্ট করে লেখা পড়া করেছেন। কলেজে পড়েছেন আরও দূরে গিয়ে। এত কষ্ট করে পড়াশুনা করেও আম্মা আমাদের বড় করতে গিয়ে নিজের জন্য সারাজীবন কিছুই করেননি।“ এক বছর আগে প্রয়াত তার মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গ্রামে এসেছিল আমেরিকা প্রবাসী আলিভিরা আর ঢাকা থেকে আফসানা। আফসানা কান্না জড়ানো কন্ঠে স্বগোক্তি করে “ কেন মানুষ বড় হয়ে যায় ! কেন সে চিরকাল মায়ের হাত ধরে থাকতে পারেনা!”
প্রবাস জীবনে নিকট আত্মীয়ের সান্নিধ্য না পাওয়ার যে বেদনা তা মর্মস্পর্শী কিন্তু সরল ভাষায় তুলে এনেছে মনিজা। অসাধারণ! মনিজার সাবলীল ও সহজভাবে গল্প বলার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে। প্রতিটি গল্পে সে লেখকের যেসকল দৃষ্টিভংগী এবং ধারনা উচ্চারণ করেছেন তা আপনাকে ভাবাবে। বস্তুতপক্ষে, বাংলাদেশিরা, এই নয়া কর্মযোগের বৈশ্বিক ব্যবস্থাতে, নানান দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের মাঝে স্বল্প শিক্ষিত রয়েছে, শিক্ষিতরাও রয়েছে। তারা একই পরিস্থিতে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করতে পারে বলেই আমরা দেখি। এ কারণে আমরা দেখি, স্বল্প সময়ের জন্য বিদেশে বসবাসরত মানুষ অথবা অভিবাসন প্রত্যাশীরা আলাদা বাস্তবতাতে পড়ে যান। ‘এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’ গল্পগ্রন্থটি বিভিন্ন বাস্তবতার আলোকপাত করেছে। আমরা ভাবি, যারা বিদেশে কাজ করতে যান বা অভিবাসন ঘটাতে যান তারা আসলে সেখানে বসে বসে মাস্তি করেন আর দেশে কাড়ি কাড়ি টাকা পাঠান পরিবারদের কাছে। কিন্তু আমরা তাদের যুদ্ধের গল্পটা, আবেগের গল্পটা, সুখঃ-দুঃখের গল্পটা জানি না। ‘এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’ গল্পগ্রন্থটি তেমনই একটা টিকে থাকবার গল্প। যেটি একখানা সুখপাঠ্য বই। পড়তে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। এতই গতিময় তার গদ্যভাষা!
আমেরিকার গল্প হলেও তার মাঝে তুমুলভাবে বাংলাদেশ লুকিয়ে আছে যা সব গল্পের মনোলোগে ছড়িয়ে আছে ছত্রে ছত্রে। তবুও শেষবিচারে এটা বাংলাদেশের গল্প হয়ে ওঠে না কেননা সব প্রবাসী বাংলাদেশীই সেখানকার সমাজে অনেকখানিই একীভূত− সে শেকড় ছড়িয়ে বসেছে সেখানে, তার মাঝে যদিও বিদেশ-বসবাসের কারণে রয়েছে টানাপোড়েনও। তা হবেই বা কেন? অজস্র শুভকামনা তার জন্য। মনিজা বরাবরই মনুষ্যজীবনের গভীর মনস্তাত্বিক বিষয় নিয়ে গল্প লিখেন। সেখানে মানুষের মনোজাগতিক বিষয়ই কেবল নয়, আরও থাকে চরিত্রগুলোকে আর্থ-সামাজিক পেক্ষিতে বসাবার সুক্ষ্ণ যত কাজ। এবারের বইতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমরা ভাবি যে একজন লেখকের মূল কাজ হলো, তিনি কতটুকু বাস্তবতাকে তুলে আনতে পারলেন। সেই নিক্তিতেই আমরা একজন লেখকে বিচার করে থাকি।
গল্পের বিষয় ও তার বর্ণণার দিক থেকে মনিজা যে ডিটেইলিং করেছেন তা বাস্তবতাকে স্পষ্ট করেছে বরঞ্চ। এতে করে যেটা হয়েছে যে তিনি যা বলতে চান তার বিভিন্ন মাত্রা সম্পর্কে তিনি আগেভাগেই আমাদেরকে একটা ধারণা দিয়ে মজলিস শুরু করেন− জীবন একমাত্রিক নয় মোটেই! তারপর ধীরেসুস্থে শুরু হয় তার অ্যাখ্যানের বয়ান। আর তার জন্য তিনি যে ভাষা তৈরি করে নিলেন তা বহমান সাহিত্যিক ভাষা তো বটেই, তার মাঝে প্রবন্ধের নৈর্ব্যাক্তিক ভাষাও চালু রয়েছে অনেকখানেই। এটা নতুন একটা উত্তর-আধুনিক ধারার বিস্তরণ বলেই আমরা মনে করি। গদ্যভাষা নিয়ে এমন পরীক্ষা-নীরিক্ষাকে আমরা স্বাগত জানাই। এভাবে মনিজা কখনও নির্মোহভাবে, কখনও মোহ নিয়েই, আমাদের সামনে বাস্তবতার বিভিন্ন মাত্রা তুলে ধরেছেন। এ কাজটা তিনি তার আগের গল্পের বইগুলোতেও করেছেন বটে। পরিশেষে আমরা বলব, মনিজার বর্তমান গল্পগ্রন্থটি তার আগের গল্প আর উপন্যাসের ধারাবাহিকতাতেই রচিত হয়েছে। দারুন বিষয় যেটা, মধ্যবিত্তভিত্তিক ভাবালুতা আধিক্যের পরেও, তার গল্পগুলো আবারও আমাদেরকে, আখ্যানের দিক থেকে, ভিন্ন স্বাদ দিয়েছে। এমন বৈচিত্র্যই আমরা একজন কথাশিল্পীর কাছ থেকে প্রত্যাশা করে থাকি।