16/10/2024
"তারার আলোয় লেখা এক ভালোবাসা"**
একটি ছোট্ট শহর, যেখানে পাহাড় ঘেরা সবুজ প্রান্তর ও একটি ঝকঝকে নদী বয়ে যায়, সেখানে থাকতো এক তরুণী মায়া। তিনি ছিলেন একজন শিল্পী, যার আঙুল সবসময় রঙে মাখা থাকতো, আর চুল এলোমেলো করে খোঁপা বেঁধে রাখতেন। তার দিনগুলি ক্যানভাসে রঙ আর তুলি দিয়ে কেটে যেত, কিন্তু রাতগুলো ছিল নিঃসঙ্গ। শহরটি মানুষের ভিড়ে পূর্ণ হলেও মায়ার মনে সবসময় কিছু একটা অভাব অনুভূত হতো, এমন কিছু যা তার শিল্পও পূরণ করতে পারত না।
এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়, যখন সূর্য আকাশকে গোলাপি ও কমলা রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছিল, মায়া নদীর ধারে বসে কিছু অনুপ্রেরণা খুঁজতে গেলেন। তিনি নদীর ঢেউ আঁকছিলেন, তখন তার নজরে পড়লো নদীর অপর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন লোক—লম্বা, চুপচাপ, আকাশের দিকে তাকিয়ে। তিনি ছিলেন শহরের নতুন কেউ, যাকে মায়া আগে কখনো দেখেননি। তার উপস্থিতি মায়াকে আকর্ষণ করল, এবং অজান্তেই, তিনি নদীর পরিবর্তে লোকটির ছবি আঁকতে শুরু করলেন।
কয়েকদিন ধরে, মায়া সেই একই স্থানে ফিরে আসেন, এবং প্রতিদিন লোকটিও সেখানে থাকতেন, নিরবতায় দাঁড়িয়ে। তিনি মনে মনে যেন অন্য জগতে হারিয়ে থাকতেন, যেমনটা মায়া তার নিজের জগতে হারিয়ে যেতেন। মায়া কৌতূহলী হলেও, লজ্জায় তাকে কিছু বলতে পারেননি। তিনি কেবল তার স্কেচবুকেই সেই লোকটিকে আঁকতেন—তার গভীর চিন্তিত মুখ, বাতাসে উড়তে থাকা চুল।
এক সন্ধ্যায়, লোকটি আর সেখানে ছিল না। হতাশ হয়ে মায়া যখন তার জিনিসপত্র গুছিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তার কাঁধে একটি মৃদু টোকা অনুভব করলেন। ঘুরে দেখলেন, লোকটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
“তুমি কি আমাকে আঁকছিলে?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তার কণ্ঠ নরম, কৌতূহলে পূর্ণ।
মায়া লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন, কিছুক্ষণের জন্য তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না। তিনি শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন, তার হৃদয় দ্রুততায় দৌড়াচ্ছিল।
লোকটি হাসলেন। “আমি অর্জুন,” তিনি বললেন, পাশে বসে পড়লেন। “আমি তোমাকে এখানে প্রতিদিন দেখেছি। কথা বলার ইচ্ছে ছিল।”
সেই সন্ধ্যা তারা একসাথে কাটালেন, তাদের কথোপকথন নদীর মতো মসৃণভাবে বয়ে গেল। অর্জুন ছিলেন একজন যাযাবর, এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ঘুরে বেড়াতেন, তার ক্যামেরার লেন্স দিয়ে পৃথিবীকে ধারণ করতেন। তিনি শহরে এসেছিলেন শহরের কোলাহল থেকে দূরে একটু শান্তি খুঁজতে। কিন্তু তিনি যা খুঁজে পাননি তা হলো মায়া।
দিন গড়িয়ে দিনে, তাদের বন্ধন আরও গভীর হলো। মায়া যখন আঁকতেন, অর্জুন তার ফটোগ্রাফ তুলতেন, আর নীরব মুহূর্তগুলোতে তারা একে অপরের স্বপ্ন আর ভয়ের গল্প শেয়ার করতেন। মায়া তাকে তার শিল্পকর্ম দেখাতেন, আর অর্জুন তার তোলা ছবি দেখাতেন। একসাথে তারা একে অপরের জগতের সৌন্দর্য আবিষ্কার করলেন, যে জগৎ তারা এতদিন অনুভবই করতে পারেননি।
এক সন্ধ্যায়, তারা যখন তারার নিচে বসেছিলেন, অর্জুন মায়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি জানো, আমি কখনো কোথাও নিজেকে ঠিক অনুভব করিনি, যতক্ষণ না আমি এখানে এসেছি। যতক্ষণ না আমি তোমাকে পেয়েছি।”
মায়ার হৃদয় আবেগে ভরে উঠল। তিনি কখনো ভালোবাসার প্রথম দর্শনে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু এটি যেন ভাগ্য ছিল। তিনি তার কাছাকাছি হেঁটে গিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “তুমি সবসময় এখানেই ছিলে। তুমি শুধু সেটা জানতে না।”
সেই মুহূর্তে, তারার আলোয় তাদের প্রথম চুম্বন হলো—নরম ও মিষ্টি, যেন পুরো মহাবিশ্ব তাদের একত্রিত করার জন্য কাজ করেছে। নদী একটি মৃদু সুর বাজাল, আর হাওয়া তাদের ভালোবাসাকে নদীর ওপারে নিয়ে গেল।
সেই দিন থেকে, মায়া আর অর্জুন আর কখনো আলাদা হননি। তারা একসাথে পাহাড়ের চূড়া আর বনভূমি আবিষ্কার করতেন, এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা ফিরে যেতেন সেই নদীর ধারে, যেখানে তাদের ভালোবাসার গল্প শুরু হয়েছিল। মায়া নতুন আবেগ নিয়ে আঁকতে শুরু করলেন, তার শিল্পকর্ম ভালোবাসার রঙে ভরে উঠল, আর অর্জুনের ফটোগ্রাফগুলো তার চোখের মায়াবী কোমলতা ধরে রাখল।
তাদের ভালোবাসা ছিল নিঃশব্দ, তবুও এটি শহরের প্রতিটি কোণে প্রতিধ্বনিত হতো। এটি এমন এক ভালোবাসা যা বড় কোনো প্রদর্শনে নয়, বরং ছোট ছোট মুহূর্তে গড়ে উঠেছিল—যেমন হাসির ভাগাভাগি, গোপন কথা, এবং একে অপরের হৃদয়ে নিজেদের বাসা খুঁজে পাওয়ার শান্ত স্বস্তি।
বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু মায়া আর অর্জুনের ভালোবাসার উজ্জ্বলতা কখনো ম্লান হয়নি। তাদের ভালোবাসা যেন ছিল চিরন্তন, তারাদের আলোয় লেখা এক গল্প। এবং যখনই তারা নদীর দিকে তাকাতো, সেই জাদুকরী সন্ধ্যার কথা মনে পড়তো, যখন দুজন পথ হারানো আত্মা একে অপরকে খুঁজে পেয়েছিল, আর ভালোবাসা তাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি হয়ে উঠেছিল।