20/12/2024
শিখে রাখুন কাজে লাগবে🙏
পুস্তক প্রকাশনা, পারসোনাল ব্লগ ও আবৃত্তি
শিখে রাখুন কাজে লাগবে🙏
"এখন তুমি কোথায় আছো,
কেমন আছো, পত্র দিও"
মির্জা গালিব এর বিখ্যাত ৪টি উক্তি-
゚
ধূসর জগতে কোনো কিছুই চির স্বস্তির নেই
কোনো পথ নেই অতি- সোজা
বৃষ্টি থেমে গেলে পথিকের ছাতাটাও বোঝা।
ছবিটি থেকে আর কি কি শেখার আছে আপনার মতামত দিন 🫴
゚viralシ
📖পদ্মজা (পর্ব :৫)📝
– ইলমা বেহরোজ
আজ যেন শুধু মোড়ল বাড়ির মাথার ওপরেই সূর্য উঠেছে। সকাল থেকে আত্মীয় আপ্যায়নের প্রস্তুতির তোড়জোড় চলছে। সবাই ঘেমে একাকার। বাড়ির প্রতিটি মানুষ ব্যস্ত। মোর্শেদ হিমেল ও প্রান্তকে নিয়ে বাজার করে ফিরেছেন সূর্য ওঠার মাথায়। লাহাড়ি ঘরের পাশে বড়ো উনুন করা হয়েছে। সাধারণ চালের পরিবর্তে সুগন্ধি, সিদ্ধ চালের ভাত রান্না করা হয়েছে; সেই সঙ্গে রাজহাঁস আর দেশি মুরগি। বাড়িজুড়ে রমরমা ব্যাপার। একদিন আগের ঘটনা ধামাচাপা পড়েছে পঁচানব্বই ভাগ। ছোটো ছোটো দরিদ্র ছেলেমেয়েরা খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে ছুটে এসেছে মোড়ল বাড়ি। সবার মধ্যেই নতুন উত্তেজনা, নতুন অনুভূতি। শুধু পূর্ণা এখনো সেদিনের ঘটনা থেকে বেরোতে পারছে না, চিত হয়ে শুয়ে আছে ঘরে। মনজুরা আর শিউলির মাকে কাজে সাহায্য করছিল পদ্মজা। হেমলতা ধমকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। পদ্মজা ঘামে ভেজা কপাল মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করে। পূর্ণার দুচোখ জলে নদী যেন! পদ্মজা বিছানার ওপর পা তুলে বসে। বোনের উপস্থিতি টের পেয়ে, হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছল পূর্ণা।
পদ্মজা কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল, ‘চোখের জল কী শেষ হয় না?’
পূর্ণা নিরুত্তর। পদ্মজা অভিজ্ঞ স্বরে বলল, ‘দেখ পূর্ণা, এসব মনে রাখলে তোরই ক্ষতি। দেখছিস না, আমি অল্প সময়ের ব্যবধানে সব ভুলে হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষদের জন্য রান্নাবান্না করছি। তুইও ভুলে যা। তোর বন্ধুরা আসছে। তুই নাকি তাদের ধমকে দিয়েছিস? এটা কিন্তু ঠিক না। ‘
পূর্ণা পদ্মজার দিকে তাকাল। দৃষ্টি ভীষণ শীতল। পদ্মজাকে বলল, ‘সত্যি ভুলতে পেরেছ আপা?’
পদ্মজা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘ভুলিনি। কিন্তু সহ্য করতে পেরেছি। তোর মতো চোখের জল অপাত্রে ঢালছি না।’
পূর্ণা উঠে বসে, একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে দায়সারাভাবে বলল, ‘তুমি অনেক শক্ত আপা। আমি খুব দুর্বল, ভুলতে পারছি না।’
পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। পূর্ণার গাঁ ঘেঁষে বসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘গতকাল রাতে কী হয়েছে জানিস?’
‘কী হয়েছে?’
পদ্মজা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘তোর নায়ক ভাইয়ের চিঠি আম্মার হাতে পড়েছে।’
পূর্ণা আঁতকে উঠে বলল, ‘সে-কী! কখন? কীভাবে?’
‘আর বলিস না! সেদিন তুই নানাবাড়ি ছিলি। তখন চিঠি দুইটা বের করেছিলাম। বারান্দার ঘরে বালিশের নিচে রেখে দিই। আর মনে নেই 1 এরপরেই অঘটন ঘটে। এরপর দিন বিচার বসল। চিঠির কথা ভুলেই গেলাম। বারান্দার ঘরে ছিলাম রাতে তবুও মনে পড়েনি। আর আম্মা পেয়ে গেল।’
উত্তেজনা-ভয়ে পূর্ণার গলা শুকিয়ে গেছে। প্রশ্ন করল, ‘আম্মা কী বলছে?’
পদ্মজা ঠোঁট দুটি উলটে কী যেন ভাবে। এরপর ব্যথিত স্বরে বলল, ‘তেমন কিছুই না। এজন্যই আরো ভয় হচ্ছে।’
‘কিছুই না?’
‘কখন হলো এসব—জিজ্ঞাসা করেছে। আমি বললাম, তুমি যা বলবে তাই হবে। এরপর আম্মা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।’
‘তারপর?’
‘বলল, ঘুমা গিয়ে। শেষ।’
দুই বোন একসঙ্গে চিন্তায় পড়ে গেল। কপাল ভাঁজ করে কিছু ভাবতে শুরু করে। পূর্ণা বলল, ‘আম্মা তোমার মুখ দেখে বুঝে গেছে তুমি লিখন ভাইকে ভালোবাস না।’
পদ্মজা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘মনে হয়।
পূর্ণা খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘লিখন ভাই এত সুন্দর, তোমাকে এত ভালোবাসে তবুও কেন ভালোবাসোনি আপা? লিখন ভাইয়ের চিঠি তো ঠিকই সময় করে করে পড়তে। বিয়ে করতে কী সমস্যা?’
‘আম্মা দিলে তো করবই। সমস্যা নেই।’
‘তোমার এই ন্যাকার কথা আমার ভালো লাগে না আপা।’
পূর্ণার রেগে কথা বলা দেখে পদ্মজা হেসে ফেলল।
পদ্মজা পূর্ণার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘গতকাল রাতে আম্মা আব্বাকে কতটা ভালোবাসে আমাকে বলেছে। প্রথম দেখেই নাকি আপন- আপন লেগেছিল। আব্বার জন্য আম্মা দিনকে রাত, রাতকে দিন মানতেও রাজি ছিলো। এতটা ভালোবাসত! আমার তেমন কোনো অনুভূতি হয়নি তোর নায়ক ভাইয়ের জন্য। প্রথম প্রথম কোনো পুরুষের চিঠি পেয়েছিলাম, সবকিছু নতুন ছিল। তাই একটা ঘোরে গিয়ে নতুন অনুভূতির সাক্ষাৎ পাচ্ছিলাম। আম্মার ভালোবাসার কথা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে আমি উনাকে ভালোবাসিনি। সবটা মোহ ছিল। দূরে যেতেই উবে গেছে। তবে উনি খুব অসাধারণ একজন মানুষ। আম্মা উনার হাতে আমাকে তুলে দিলে কোনো ভুল হবে না। কিন্তু এটা এখন কল্পনাতীত। পরিস্থিতি পালটে গেছে। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
পদ্মজার এত কথা উপেক্ষা করে পূর্ণা কটমট করে বলল, ‘তোমার কী কালাচাঁদরে দেখলে আপন আপন লাগে?’
পদ্মজা চোখ ছোটো ছোটো করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কালাচাঁদ কে?
পূর্ণা মিনমিনিয়ে বলল, ‘তোমার হবু জামাই,’ তারপরই গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আমিও কালা। কিন্তু আপা, তোমার জন্য লিখন ভাইয়ের মতো সুন্দর জামাই দরকার।’
পদ্মজা এক হাতে কপাল চাপড়ে বলল, ‘এখনও লিখন ভাই! যা তোর সঙ্গে তোর নায়কের বিয়ে দিয়ে দেব। এখন আয়, ঘর থেকে বের হ। মুক্তা, সোনামণি, রোজিনা এসেছে। তোর সঙ্গে কথা বলবে। আয় বলছি…আয়।’
পূর্ণাকে টেনে নিয়ে বন্ধুদের মাঝে বসিয়ে দিল পদ্মজা। ঘরে এসে আয়নায় নিজেকে দেখে থমকে দাঁড়াল, ছুঁয়ে দেখল গালের দাগটা। সে কী সত্যি নির্মম, নিষ্ঠুর মুহূর্তটি সহ্য করে নিয়েছে? না, করেনি। বুকের ভেতরটা খুব জ্বলে। এই অপমান মেনে নিতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে মরে যাচ্ছে সে। কিন্তু আম্মা বা পূর্ণাকে সেটা বুঝতে দেয়া যাবে না। পদ্মজা দ্রুত চোখের জল মুছে একা হাসার চেষ্টা করল।
সূর্য মামার রাগ কমেছে। তাই মোড়ল বাড়ির মাথার ওপর থেকে সরে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সদর ঘর ভরতি মানুষ। হাওলাদার বাড়ির মহিলারা এসেছে। যদিও তাদের আরো আগে আসার কথা ছিল। নানা কারণে তারিখ পিছিয়ে দিতে হয়েছে। হাওলাদার বাড়ির বউদের গ্রামবাসী শেষবার তাদের বিয়েতেই দেখেছে। আবার দেখার সুযোগ হওয়াতে দল বেঁধে মানুষ এসেছে। লোকমুখে শোনা যায়, হাওলাদার বাড়ির মেয়ে-বউদের সারা অঙ্গে সোনার অলংকার ঝলমল করে। মগা-মদনসহ আরো দুজন ভৃত্য মোড়ল বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। পদ্মজাকে শাড়ি পরাচ্ছেন হেমলতা। পদ্মজা এর আগে কখনো শাড়ি পরেনি। পূর্ণা-প্রেমা ছোটো হয়েও পরেছে। পদ্মজার কখনো ইচ্ছে করেনি। তাই সে হেমলতাকে বলল, ‘প্রথম শাড়ি তুমি পরাবে।’
শাড়ি পরানো শেষে, চোখে কাজল এঁকে দেন হেমলতা। ঠোঁটে লিপিস্টিক দিতে গিয়েও দিলেন না। মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করে চুল খোঁপা করতেই, পূর্ণা ছুটে আসে। হাতে শিউলি ফুলের মালা।
হেমলতা মৃদু ধমকের স্বরে বললেন, ‘এতক্ষণ লাগল!’
হেমলতার কথা বোধহয় পূর্ণার কানে গেল না।
পূর্ণা চাপা উত্তেজনা নিয়ে
তা আপাকে কী সুন্দর লাগছে!’
পদ্মজা লজ্জা পেল, চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ল লাল আভা। হেমলতা পদ্মজার খোঁপায় ফুলের মালা লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শুধু রূপে চারিদিক আলোকিত করলে হবে না, গুণেও তেমন হতে হবে।’
পদ্মজা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। তখন হুড়মুড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হয় লাবণ্য। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জাপটে ধরে। এক নিশ্বাসে বলে উঠে, ‘আল্লাহ, পদ্ম তুই আমার ভাবি হবি। আমার বিশ্বাসই হইতাছে না। মনে হইতাছে স্বপ্ন দেখতাছি। ইয়া…মাবুদ, শাড়িতে তোরে পরি লাগতাছে। তোর রূপ দেখে বাড়ির সবাই অজ্ঞান হয়ে যাবে দেহিস।’
পদ্মজা কী বলবে ভেবে পেল না, শুধু হাসল। হেমলতা পদ্মজার মাথার ঘোমটা টেনে দিয়ে লাবণ্যকে বললেন, ‘তোমার সইকে নিয়ে যাও।’
পদ্মজা হেমলতার হাতে হাত রেখে অনুরোধ করে বলল, ‘আম্মা, তুমিও এসো।’
হেমলতা হেসে পদ্মজার মাথায় এক হাত রেখে বললেন, ‘কয়দিন পর থেকে এরাই তোর আপন। মা পাশে থাকবে না।’
পদ্মজার চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে। ছলছল চোখ নিয়ে সে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। পদ্মজাকে নতুন বউ রূপে দেখে হেমলতার বুকে ঝড় বইছে। মেয়েটা কয়দিন পর আলাদা হয়ে যাবে। দুই মাস আগে হলে তিনি সাত রাজার ধনের বিনিময়েও মেয়ের বিয়ে দিতেন না। তিনি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, ‘আমি আসছি। লাবণ্য যাও তো নিয়ে যাও। পূর্ণা তুইও যা।’
লাবণ্য পদ্মজাকে নিয়ে যায়। পদ্মজার বুক ধড়ফড় করছে। মায়ের যেন কী হয়েছে! সে পেছন ফিরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে, তিনি দ্রুত তা মুছে ফেললেন।
সদর ঘর কোলাহলময় ছিল। পদ্মজা ঢুকতেই সব চুপ হয়ে গেল। লাবণ্য পদ্মজাকে ছেড়ে ভারী আনন্দ নিয়ে বলল, ‘আম্মা, কাকিম্মা, ভাবি, আপারা—এই যে পদ্মজা। আমার নতুন ভাবি।’
পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। অলংকারে জ্বলজ্বল করা পাঁচ জন নারীকে দেখে যেন চোখ ঝলসে গেল। সবাই তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা চোখ নামিয়ে ফেলল। তখন কোত্থেকে আবির্ভাব হলো আমিরের সদর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল পদ্মজা, হবু বউকে দেখে থমকে গেল সে। পদ্মজার পরনে খয়েরি রংয়ের জামদানি শাড়ি। শাড়িতে কোনো মেয়েকে এত সুন্দর মনে হতে পারে এর আগে কখনো অনুভব করেনি আমির। আমিরের লজ্জা খুব কম। সে উপস্থিত গুরুজনদের উপেক্ষা করে পদ্মজাকে বলল, ‘মাশাআল্লাহ। দিনের বেলা চাঁদ উঠে গেছে।’
লজ্জায় পদ্মজার রগে রগে কাঁপন ধরে। এত লজ্জাহীন মানুষ কী করে হয়! আমিরের মা ফরিনা ধমকের স্বরে বললেন, ‘বাবু, এইনে বয় আইসসা।’
আমির পদ্মজার ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। হেমলতা সদর ঘরে প্রবেশ করতেই আমির ধড়ফড়িয়ে উঠল। ছুটে এসে হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। হবু শাশুড়ির প্রতি আমিরের এত দরদ দেখে ফরিনা খুব বিরক্ত হলেন। পাশ থেকে ফরিনার জা আমিনা ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘মেয়ের রূপ আগুনের হলকা। বাবু এইবার হাত ছাড়া হইলো বলে।’
আমিনার মন্ত্র ফরিনার মগজ ধোলাই করতে পারল না। পদ্মজার রূপে তিনি মুগ্ধ। আমির কালো বলে তিনি ছোটো থেকেই আমিরকে বলতেন, ‘বাবু, তোর জন্যি চান্দের লাহান বউ আনাম।’
সেই কথা রক্ষার পথে। তিনি শুধু পছন্দ করছেন না শাশুড়ির প্রতি আমিরের এত দরদ! কী দরকার ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ে ধরে সালাম করার? আমির হেমলতাকে ভক্তির সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘ভালো আছেন?’
হেমলতা মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘ভালো আছি। যাও গিয়ে বসো।’
আমির বাধ্যের মতো মায়ের পাশে গিয়ে বসল। মজিদ মাতব্বর, মোর্শেদের সঙ্গে বাইরে আলোচনা করছেন। আর কোনো পুরুষ আসেনি বাড়িতে। তারা বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। মুহূর্তে পদ্মজার সারা অঙ্গ সোনার অলংকারে পূর্ণ হয়ে উঠল। রূপ বেড়ে গেল লক্ষ গুণ, যার কোনো সীমা নেই। যার সঙ্গেই পদ্মজা কথা বলেছে, সেই এগিয়ে এসে বালা নয়তো হার পরিয়ে দিচ্ছে।
কী অবাক কাণ্ড!
সবাই আড্ডা দিচ্ছে। তবে চুপ করে বসে আছে পদ্মজা। কেউ প্রশ্ন করলে জবাব দিচ্ছে। লাবণ্য একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘রানি আপা, বাড়ির পেছনে যাইবা?’
রানি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘যাব।’
তার খুশির কারণ লাবণ্য কিছুটা ধরতে পেরেছে। রানির একজন প্ৰেমিক আছে। তাই শুধু সুযোগ খোঁজে দেখা করার। যেখানেই দাওয়াত পড়ে সেখানেই তার প্রেমিক উপস্থিত হয়। লাবণ্য সবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পদ্মজা-পূর্ণা, রানিকে নিয়ে বাড়ির পেছনে যায়। রানি বাড়ির পেছনে এসেই ছুটে যায় ঘাটের দিকে, সেই মুহূর্তেই একটা নৌকা এসে ভেরে সেখানে। নৌকায় কে ছিল দেখা যাচ্ছে না। রানি নৌকায় উঠে পড়ে। শোনা যায়, কারো সঙ্গে সে বিরতিহীন ভাবে কথা বলছে। পূর্ণা লাবণ্যকে প্রশ্ন করল, ‘লাবণ্য আপা, রানি আপা কার সঙ্গে কথা বলে?’
‘আবদুল ভাইয়ের সঙ্গে।’
‘কোন আবদুল?’
‘যার কথা ভাবছিস।’ কথা শেষ করে লাবণ্য চোখ টিপল। পূর্ণা অবাক হয়ে বলল, ‘মাস্টারের সঙ্গে!’
লাবণ্য হাসে। রানি এগিয়ে আসে। লাবণ্য বলল, ‘কথা শেষ?’
‘হ, চইলা গেছে।’
রানি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাশাআল্লাহ, তুমি এত সুন্দর। আমার কোলে নিয়া আদর করতে মন চাইতাছে।
পদ্মজা মুচকি হেসে বলল, ‘আপনি খুব শুকনো। আমাকে কোলে নিতে পারবেন না।’
‘শুকনা হইতে পারি। শক্তি আছে।’
রানির কথা বলার ঢংয়ে সবাই হেসে উঠল। পূর্ণা পেছনে ফিরে দেখে আমির আসছে। সে তাৎক্ষণিক পদ্মজার কানে কানে বলল, ‘আপা তোমার কালাচাঁদ আসছে।’
পদ্মজা পূর্ণাকে চোখ রাঙিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কীসব কথা! উনার বোনরা আছে।’
আমির সেখানে এসেই বোনদের আদেশ করল, ‘লাবণ্য-রানি যা এখান থেকে।’
আমিরের আদেশ শুনে রানি-লাবণ্য খুব বিরক্ত হলো। রানি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, ‘দাভাই, থাকি না।’
আমির চোখ রাঙিয়ে ধমকের স্বরে বলল, ‘যেতে বলছি যা।’
লাবণ্য বিরক্তিতে, ইস বলে পদ্মজাকে বলল, ‘আয় অন্যখানে যাই।’
‘পদ্মজা থাকুক। তোরা যা।’
আমিরের কথা শুনে বেশি চমকাল পদ্মজা। লাবণ্য ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, ‘কেন? কেন?’
পদ্মজা-পূর্ণা অন্যদিকে ফিরে আছে। আমির দৃষ্টি কঠোর করতেই লাবণ্য-রানি চলে যায়। পূর্ণা চলে যেতে চাইলে পদ্মজা পূর্ণার হাত চেপে ধরে। পূর্ণা পদ্মজার হাত ছাড়িয়ে, ধীরকণ্ঠে বলল, ‘একা থেকে তোমার কালাচাঁদের ভালোবাসা খাও।’
‘ছি।’
পূর্ণা ছুটে চলে গেল। আমির পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াতেই পদ্মজা বলল, ‘বিয়ের আগে গুরুজনদের না জানিয়ে এভাবে একা কথা বলা ঠিক নয়।’
‘কী হবে?’
পদ্মজা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘কলঙ্ক লাগবে।’
‘আর কী বাকি আছে?’
‘পরিমাণ না বাড়ানোই ভালো।’
পদ্মজার কথা বলতে একটুও গলা কাঁপেনি। বাড়ির ভেতর চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই আমির পদ্মজার এক হাত থাবা দিয়ে ধরে আবার ছেড়ে দিল। পদ্মজা ছিটকে সরে গেল দূরে।
আমির বলল, ‘তুমি সত্যি একটা পদ্ম ফুল, পদ্মবতী। এজন্যই লিখন শাহর মতো সুদর্শন যুবক তোমার প্রেমে পড়েছে।’
দেখা হওয়ার পর এই প্রথম পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। পরপরই চোখের দৃষ্টি সরিয়ে ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল। আমির অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এবার আত্মীয় বিদায়ের পালা। যাওয়ার পূর্বে লাবণ্য একটা কাগজ পদ্মজার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘দাভাই দিছে।’
ঘুমাবার আগে পদ্মজা কাঁপা হাতে কাগজটির ভাঁজটি খুলল। কাগজটিতে যত্ন করে লেখা—
সারা অঙ্গ কলঙ্কে ঝলসে যাক
তুই বন্ধু শুধু আমার থাক।
২১
বাড়ির সব কাজ শেষ করে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ঘরে ঢুকলেন হেমলতা। মোর্শেদ সবেমাত্র শুয়েছেন। হেমলতা বিছানার এক পাশে কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
মোর্শেদ হেমলতার দিকে ফিরে ধীরকণ্ঠে বললেন, ‘ধানের মিলটা পাইয়া যাইতাছি।’ গলা দুর্বল হলেও খুশিতে চোখ চকচক করছে।
হেমলতা মৃদু হেসে বললেন, ‘মাতব্বর কী যৌতুক দিচ্ছেন?’
মোর্শেদ হেসে বললেন, ‘সে কইতে পারো। সে আমারে কী কইছে জানো?’
‘কী?’
‘কইল, শুনো মোর্শেদ…আইচ্ছা আগে হুনো আমি কিন্তু শহুরে ভাষায় কইতে পারুম না। আমি আমার গেরামের ভাষায় কইতাছি।’
মোর্শেদের কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেমলতা আওয়াজ করে হাসলেন। বললেন, ‘যেভাবে ইচ্ছে বলো।’
মোর্শেদ খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘কইল, হুনো মোর্শেদ, তোমার এই মোড়ল বাড়ি হইতাছে একটা বিল। যে বিলে একটাই পদ্ম ফুল আছে। এই পদ্ম ফুলডার জন্যই এই বিলটা এত সুন্দর। আর আমি সেই পদ্ম ফুলডারে তুইললা নিয়া যাইতাছি। এই বিলে পদ্ম ফুলডার চেয়ে দামি সুন্দর আর কিছু নাই। তাই আমার আর কিছু লাগব না। বিনিময়ে আমি এই খালি বিলডারে ধানের মিল দিয়ে দিলাম। বুঝলা লতা? মাতব্বর মানুষটা সাক্ষাৎ ফেরেশতা। মন দয়ার সাগর।’
হেমলতা ছোটো করে বললেন, ‘হুম।’
পরমুহূর্তেই বললেন, ‘একটা প্রশ্ন করার ছিল।’
মোর্শেদ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান। হেমলতা উঠে বসে বললেন, ‘লিখনকে মনে আছে? সে কি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল?’
মোর্শেদ লেশমাত্র অবাক হলেন না। দায়সারাভাবে বললেন, ‘এতদিনে জানলা? আমি মনে করছি কবেই জাইন্যা ফালাইছ।’
‘আমি তো আর সবজান্তা নই। আমাকে বলোনি কেন?’
‘বইললা কী হইত? ছেড়ি বিয়া দিতা? আর ছেড়াড়া নায়ক। কত ছেড়ির লগে ঘষাঘষি করে। ছেড়িগুলাও নষ্টা। নষ্টাদের সঙ্গে চলে এই ছেড়ায়।’
মুখ খারাপ করো না। ছেলেটার মধ্যে আমি তেমন কিছু দেখিনি। তুমি আমাকে জানাতে পারতে। নিশ্চিন্তে ছেলেটা সুপাত্র। বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে, সে মা-বাবা নিয়ে আসলে আমি ফিরিয়ে দিতাম না। থাক…এসব কথা। এখন বলেও লাভ নেই। পদ্মজার মন স্থির আছে। পরিস্থিতি আর ভাগ্য সেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখানেই গা ভাসিয়ে চলুক। ঘুমাও এখন। ভোরে উঠে গোলাপ ভাইয়ের বাড়িতে যেয়ো। কত কাজ বাকি! বাড়ির বড়ো মেয়ের বিয়ে কী সামান্য কথা!
হেমলতা কথা বলতে বলতে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়েন, ঘুমিয়েও পড়লেন কিছুক্ষণের মাঝে।
সকাল থেকে পূর্ণার দেখা নেই। তাকে খুঁজতে খুঁজতে ঘাটে চলে গেল পদ্মজা। পূর্ণা সিঁড়িঘাটে বসে উদাস হয়ে কিছু ভাবছে। পদ্মজা পা টিপে হেঁটে এলো। পূর্ণা তখনো বোনের উপস্থিতি টের পায়নি। পদ্মজা পাশে বসে, তাও পূর্ণা টের পেল না। পদ্মজা ধাক্কা দিতেই, পূর্ণা চমকে তাকাল।
বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘ভয় পেয়েছি আপা।’
‘উদাস হয়ে কী ভাবছিস?’
‘কিছু না।’
‘আবার ওইসব ভাবছিস! কতবার না করলে শুনবি বল তো?’
পূর্ণা নতজানু হয়ে রইল। ক্ষণকাল পার হওয়ার পর ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘নিজের ইচ্ছায় মনে করে কষ্ট পেতে আমার ইচ্ছে করে না। কিন্তু মনে পড়ে যায়।’
‘চেষ্টা তো করবি। আর ভুলতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই 1 অমানুষগুলোও তাদের শাস্তি পেয়েছে। একটু নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা কর।’
পূর্ণা চোখের জল মুছে আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘আম্মা তিনজনকে কী করে মারল আপা? আমাদের আম্মা খুনি?’
পূর্ণার মুখ চেপে ধরল পদ্মজা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আর কখনো এটা বলবি না।’
‘কিন্তু আমি জানতে চাই, কী করে আম্মা খুন করল?’
‘জানি না।’
‘আম্মাকে জিজ্ঞাসা করবে?’
পদ্মজা ভাবল। এরপর বলল, ‘করব। তবে আজ না অন্য একদিন।’
‘বিয়ে করে তো চলেই যাবে।’
পদ্মজা অভিমানী চোখে তাকাল পূর্ণার দিকে। বলল, ‘আর কী আসব না? ফিরে যাত্রা আছে। আবার কয়দিন পর পর এমনিতেও আসব।’
‘তাহলে কালাচাঁদের সঙ্গে বিয়েটা সত্যিই হচ্ছে?’
‘তুই কী মিথ্যে ভাবছিস?’
পূর্ণা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল। বলল, ‘লিখন ভাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে।’
লিখন নামটা শুনে পদ্মজা অপ্রতিভ হয়ে উঠল। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে। এই অনুভূতির কোনো মানে নেই, সে কোনো অপরাধ করেনি…তবুও ভাবলেই কী যেন হয় ভেতরে!
পদ্মজা প্রসঙ্গ পালটাতে বলল, উনাকে…মানে মাতব্বরের ছেলেকে পছন্দ না তাই কালা বলিস, ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু চাঁদ কেন বলিস বুঝলাম না!’
পূর্ণা আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকাল। যান্ত্রিক স্বরে জানাল, ‘পাতিলের তলার মতো কালা হয়ে আমার চাঁদের মতো সুন্দর বোনকে বিয়ে করবে বলেই কালাচাঁদ ডাকি। নয়তো কালা পাতিল ডাকতাম। আবার দরদ দেখিয়ে বলো না, উনি তো এত কালা না, শ্যামলা।’ কথা শেষ করে পূর্ণা ঠোঁট বাঁকাল।
পদ্মজা শব্দ করে হাসতে শুরু করল। কিছুতেই তার হাসি থামছে না। পূর্ণা পদ্মজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তুমি খুব কঠিন আপা। খুব ধৈর্য তোমার, ঠিক আম্মার মতো।’
পদ্মজা হাসি থামিয়ে পূর্ণার দিকে তাকাল। সময়টা শুধু দুই বোনের পদ্মজা স্নেহার্দ্র কণ্ঠে শুধাল, ‘আর তুই ঠিক আম্মার বাহ্যিক রূপের জোড়া পৰ্ব।’
প্রান্ত-প্রেমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নদীর ঘাটে। পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলল, ‘বড়ো আপা, দুলাভাই আসছে।’
আমির আসার সংবাদ পেয়েই খিড়কি দিয়ে পদ্মজা নিজের ঘরে চলে গেল। এই লোকটা এত বেহায়া আর নির্লজ্জ! গতকাল নাকি সকাল-বিকাল বাড়ির সামনে ঘুর ঘুর করেছে। আজ একেবারে বাড়িতে! বিয়ের তো আর মাত্র তিন দিন বাকি। এতটুকু সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না?
পদ্মজা কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে, ‘এ কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আল্লাহ!’ উঠানে হেমলতা ছিলেন। আমির বাড়ির ভেতর ঢুকেই হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। নতজানু হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ‘কেমন আছেন আম্মা?’
হেমলতার চক্ষু চড়কগাছ! আমিরের সঙ্গে মগা এসেছে। মগার হাতে মাছের ব্যাগ, মাথায় ঝুড়ি। তাতে মশলাপাতি সঙ্গে শাকসবজি। বিয়ের আগে এত বাজার আবার আম্মা ডাকা হচ্ছে! অপ্রত্যাশিত ব্যাপার স্যাপার! হেমলতা ঢোক গিলে ব্যাপারটা হজম করে নিলেন। ধীরেসুস্থে বললেন, ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? বাড়ির সবাই ভালো আছে?’
‘জি, জি। সবাই ভালো।’
আমির মগাকে ইশারা করতেই মগা বারান্দায় মাছের ব্যাগ, মাথার ঝুড়ি রেখে দিল।
হেমলতা ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বললেন, ‘এতসব বিয়ের আগে আনার কী দরকার ছিল? পাগল ছেলে।’
আমির হেসে নতজানু অবস্থায় ইতস্ততভাবে বলল, ‘এমনি।’
‘যাও, ঘরে গিয়ে বসো।’
‘আম্মা…’
হেমলতা চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমির দ্রুত বলল, ‘আম্মা, ক্ষমা করবেন। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে।’
হেমলতা বুঝতে পারছেন না, ছেলেটা কী চাচ্ছে! তিনি আগ্রহান্বিত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কোনো দরকার ছিল?’
‘আ…আসলে আম্মা। পদ্মজার সঙ্গে একটু কথা ছিল।’
আমির উসখুস করছে। হাত-পা নাড়াচ্ছে এদিক-ওদিক, কিন্তু চোখ মাটিতে স্থির। হেমলতা আমিরকে ভালো করে পরখ করে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা যাও, পদ্মজা ঘরে আছে নয়তো ঘাটে।’
অনুমতি পেয়ে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে ঘরের দিকে চলে গেল আমির। হেমলতা তার যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে ভাবছেন, ‘ছেলেটার সঙ্গে এখনও চোখাচোখি হয়নি। সবসময় মাথা নত করে রাখে। কিন্তু কথাবার্তায় তো মনে হচ্ছে, এই ছেলে মোটেও লাজুক নয়, তিনি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে রাখলেন। পরে ভাবলেন: হয়তো গুরুজনদের সামনে মাথা নিচু করে রাখা ছোটোবেলার স্বভাব। ভালো অভ্যাস!
হেমলতা মুচকি হেসে লাহাড়ি ঘরের দিকে এগিয়ে যান।
পদ্মজার ঘরের শেষ প্রান্তে একটি বারান্দা আছে। বারান্দা পেরোলেই বাড়ির পেছনের দরজা। আমির আসছে শুনে ঘর আর বারান্দার মাঝ বরাবর দরজায় পর্দা টানিয়ে দিল পদ্মজা। আমির হন্তদন্ত হয়ে ঘরের দিকে, পর্দার অন্যপাশে দাঁড়াল। পদ্মজা দাঁড়াল বারান্দার দিকে। পর্দার কাপড় পাতলা ও মসৃণ। তাই পদ্মজার অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আমির। তিরতির করে বাতাস বইছে। সেই বাতাসে পদ্মজার কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো অবাধ্য হয়ে উড়ছে।
আমির ডাকল, ‘পদ্মজা?’
‘হু?’ পদ্মজা লজ্জায় কথা বলতে পারছে না।
‘কেমন আছো?’
‘ভালো। আপনি?’
‘ভালো।’
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। পদ্মজা বলল, ‘কী বলবেন বলুন।’
সঙ্গে সঙ্গে আমির বলল, ‘মায়াভরা চোখগুলো দেখার সৌভাগ্য কী হবে?’ আমিরের কণ্ঠে আকুতি! তৃষ্ণা! পদ্মজার পীড়া লাগছে। বেহায়া মানুষ বড়োই বিপজ্জনক। সে পালানোর জন্য পা বাড়াতেই আমির হই হই করে উঠল, কসম লাগে পালাবে না।’
পদ্মজা মাথার ওড়না টেনে নিয়ে বলল, ‘প্রয়োজনীয় কথা থাকলে বলে চলে যান।’
‘তাড়িয়ে দিচ্ছো?’
‘ছি, না।’
‘তোমায় না দেখলে আজ আর প্রাণে বাঁচব না। রাতেই ইন্না লিল্লাহ…’
‘রসিকতা করবেন না। কাউকে না দেখে কেউ মরে না।’
‘পদ্মবতীর রূপ যে পুরুষ একবার দেখেছে সে যদি বার বার না দেখার আগ্রহ দেখায় তাহলে সে কোনো জাতেরই পুরুষ না। একবার দেখা দাও। কসম লাগে…’
‘বার বার কসম দিয়ে ঠিক করছেন না।’
‘আচ্ছা, কসম আর কসম দেব না। একবার দেখা দাও।’
পদ্মজার দুই ঠোঁট হাঁ হয়ে গেল। কী বলে মানুষটা! কসম করেই বলছে আর কসম দিবে না। আমির ধৈর্যহারা হয়ে বলল, ‘পদ্মবতী অনুরোধ রাখো…’
‘এভাবে বলবেন না। নিজেকে ছোটো লাগে।’
‘পর্দা সরাব?’
পদ্মজা ঘামছে। বাতাসে অস্বস্তি, নিশ্বাসে অস্বস্তি। তবুও সায় দিল 1 আমির পর্দা সরিয়ে খুব কাছ থেকে পদ্মজাকে দেখতে পেল। কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। সিঁথির মাঝ অবধি ঘোমটা টেনে রাখা।
পদ্মজা চোখ তুলে তাকাতেই আমির বলল, ‘জীবন ধন্য।’
আমিরের কথা বলার ভঙ্গি দেখে পদ্মজা হাসি সামলাতে পারল না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসল। আমির বলল, ‘এ মুখ প্রতিদিন ভোরে দেখব। আর প্রতিদিনই জীবন ধন্য হবে। এমন কপাল কয়জনের হয়!
পদ্মজা কিছু বলল না। আমির আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার হাতে খুন হয়ে যাই।’
পদ্মজা চমকে উঠল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘আপনি পাগল।’
আমির কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোমার উপস্থিতি আমার নিশ্বাসের তীব্রতা কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে টের পাচ্ছো?’
পদ্মজা দূরে সরে গেল। মনে মনে বলল, ‘আল্লাহ আমি পাগল হয়ে যাব। এ কার পাল্লায় পড়লাম। জ্ঞানবুদ্ধি, লাজলজ্জা কিছু নেই।’
অথচ মুখে বলল, ‘পেয়েছি। এবার আসি।
আমিরকে কিছু বলতে না দিয়ে পদ্মজা বারান্দা ছাড়ল।
বাড়ির পেছনে মগাকে পেয়ে তার পথ আটকে বলল, ‘মগা ভাই।’
মগা সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘জে, ভাবিজান।’
মগার মুখে ভাবি ডাক শুনে পদ্মজা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না। বিরক্তি লুকিয়ে বলল, ‘লিখন শাহর কথা আপনি উনাকে বলেছেন?’
‘উনিটা কে?’
‘আপনার আমির ভাই।
‘জে, ভাবিজান।’
মগার অকপট স্বীকারোক্তি! পদ্মজা এ নিয়ে আর কথা বাড়াল না। মগাকে পাশ কেটে চলে গেল। মগা দৌড়ে এসে পদ্মজার পথ রোধ করে দাঁড়ায়, ফিসফিসিয়ে গোপন তথ্য দিল: আগামী দুই দিনের মধ্যে লিখন শাহ আসছে। তার বাবা-মাকে নিয়ে। খবরটা মগা গত সপ্তাহ পেয়েছে।
সংবাদটি পেয়ে পদ্মজার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। ঢোক গিলে নিজেকে আশ্বস্ত করল: আমি তো কথা দেইনি বিয়ে করার। কখনো চিঠিও দিইনি। লিখন শাহ নিরাশ হলে এটা তার দোষ নয়, লিখন শাহর ভাগ্য। তবুও পদ্মজার খারাপ লাগছে। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।
জীবনে আবার কি নতুন কিছু ঘটতে চলেছে? বুক ধড়ফড় করছে।
ঘাটের সিঁড়িতে ঝিম মেরে বসে রইল পদ্মজা।
২৩
মোড়ল বাড়ির আনাচে-কানাচে আত্মীয়স্বজনদের উচ্চরব। পদ্মজা বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে আছে। ঘরে দুষ্টু রমণী আছে কয়েকজন নিজেদের মধ্যে রসিকতা করছে, উচ্চস্বরে হাসছে। অথচ এরাই বিপদের সময় পাশে ছিল না। ভীষণ গরম পড়েছে। পদ্মজার পরনে সুতার কাজ করা সুতি শাড়ি। গরমে শুধু ঘামছে না, বমিও পাচ্ছে। প্রেমা পদ্মজার পাশে বসে ছিল।
প্রেমাকে ফিসফিসিয়ে বলল পদ্মজা, ‘এই বনু? আম্মাকে গিয়ে বলবি লেবুর শরবত দিতে?’
প্রেমা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল শরবত আনতে। হেমলতা রান্নাঘরে ছিলেন। প্রেমা লেবুর শরবতের কথা বললে তিনি বললেন, ‘তুই যা আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
লেবু গাছ থেকে সবেমাত্র ছিঁড়ে আনা পাকা লেবুর শরবত বানিয়ে পদ্মজার ঘরের দিকে গেলেন তিনি। গিয়ে দেখেন, পদ্মজা বিছানার এক পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ছটফট করছে।
ঘরভরতি অনেক মানুষ। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সবাই অন্য ঘরে যাও। পদ্মজাকে একা ছাড়ো।’
হেমলতার এমন আদেশে অনেকের রাগ হলেও চুপচাপ বেরিয়ে গেল। তিনি দরজা বন্ধ করে শরবতের গ্লাস পদ্মজার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘সবসময় মুখ বন্ধ রাখা ভালো না। যারা বিপদে পাশে থাকে না, তাদের জন্য বিন্দুমাত্র অসুবিধার মুখোমুখি হবি না। গরমে তো শেষ হয়ে যাচ্ছিস। জানালার পাশটাও অন্যরা ভরাট করে রেখেছিল। ভালো করেই সরতে বলতি।’
পদ্মজা মায়ের কথার জবাব না দিয়ে এক নিশ্বাসে লেবুর শরবত শেষ করল। এবার একটু আরাম লাগছে। আলনার কাপড়গুলো অগোছালো। সকালেই তো ঠিক ছিল। নিশ্চয় মেয়েগুলোর কাজ। হেমলতা আলনার কাপড় ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী নিয়ে এত চিন্তা করছিস?’
পদ্মজা কিছু না বলে বিছানায় আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে থাকল। পদ্মজার অস্বাভাবিকতা দেখে হেমলতা চিন্তায় পড়ে যান, ‘বলবি তো?’ পদ্মজা বিচলিত হয়ে বলল, ‘আম্মা উনি বোধহয় আজ আসবেন।’
‘উনি? উনি কে? আমির?’
না আম্মা। লিখন শাহ যে, উনি।’
হেমলতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘কপালে যা আছে তাই তো হবে। ভাবিস না। আমি আছি, সব সামলে নেব। লিখনকে আমি বুঝাব।’
হেমলতার কথা শেষ হতেই পদ্মজা ভেজা কণ্ঠে বলল, উনি খুব কষ্ট পাবেন আম্মা।’
হেমলতা অবাক হয়ে তাকালেন পদ্মজার দিকে। পদ্মজা এত ব্যাকুল কেন হচ্ছে? তিনি কী পদ্মজার অনুভূতি চিনতে ভুল করেছেন? নাকি শুধুমাত্র কারো মন ভাঙবে ভেবে পদ্মজার এত ব্যাকুলতা? হেমলতা দোটানায় পড়ে গেলেন। পদ্মজার জীবনে এ কেমন টানাপোড়নের আবির্ভাব হলো! এই মুহূর্তে পদ্মজাকে বুঝতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। ওদিকে হানি ডাকছে। হেমলতার বড়ো বোন হানি, গতকাল ঢাকা থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে এসেছে। হেমলতা দরজার দিকে পা বাড়ানোর আগে বলে গেলেন, আমার নোংরা অতীত আজ তোকে শুনাব। বাকি সিদ্ধান্ত তোর। যা চাইবি তাই হবে। মনে রাখিস, যা চাইবি তাই পাবি।’
পদ্মজা কিছু বলার পূর্বেই হেমলতা চলে গেলেন। পদ্মজার বুকের ভেতর অপ্রতিরোধ্য তুফান শুরু হয়। মায়ের অতীত জানার জন্য কত অপেক্ষা করেছে সে। আজ যখন সেই সুযোগ এলো…তার ভয় হচ্ছে খুব। কেন হচ্ছে জানে না; কিন্তু হচ্ছে। হাত-পায়ের রগে রগে শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে।
ভ্যানগাড়িতে চড়ে অলন্দপুরের আটপাড়ায় ঢুকল লিখন শাহ। সঙ্গে বাবা-মা এবং বোন। বাবা শব্দর আলী, মা ফাতিমা বেগম এবং বোন লিলি।
শব্দর আলী চশমার গ্লাস দিয়ে গ্রামের খেত দেখছেন আর বার বার বলছেন, ‘এই তো আমার দেশ। এই তো আমার বাংলাদেশ।’
ফাতিমা ভীষণ বিরক্ত ভ্যানে চড়ে। উনার ইচ্ছে ছিল কোনো মন্ত্রীর মেয়েকে ঘরের বউ করে আনবেন। অথচ পুত্রের নাকি পাত্রী পছন্দ হয়েছে গ্রামে। লিখনের জেদের কাছে হেরে গ্রামে আসতেই হলো।
লিখনের পরনে ছাইরঙা শার্ট। চোখে সানগ্লাস। উত্তেজনায় রীতিমতো তার হাত-পা কাঁপছে। এমন একটা দিন নেই, যেদিন পদ্মজার কথা ভেবে শুরু হয়নি। এমন একটা রাত নেই, যে রাতে পদ্মজাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হয়নি। সময়ের ব্যবধানে পদ্মজাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। প্রায়ই স্বপ্নে দেখে, পদ্মজা গৃহবধূর মতো তার ঘরে কোমরে আঁচল গুঁজে কাজ করছে।
কখনো বা অপরূপ সুন্দরী পদ্মজাকে ঘুমের ঘোরে ঠিক বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কল্পনার পদ্মজাকে নিয়ে সে সংসার পেতেছে। এবার হয়তো সত্যিই সেই সংসার হতে চলেছে। লিখন আনমনে হেসে উঠল। মনে
পড়ে যায় পদ্মজাকে প্রথম দেখার কথা। সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে অদ্ভুত ঝড় শুরু হয়। কী মায়াবী, কী স্নিগ্ধ একটা মুখ! তার চেয়েও সুন্দর পদ্মজার ভয় পাওয়া, লজ্জায় পালানোর চেষ্টা করা, পরপুরুষের ভয়ে আতঙ্কে থাকা। লিখন আওয়াজ করে হেসে উঠল। ফাতিমা আর শব্দর অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। লিলির এসবে খেয়াল নেই। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। লিখন মা-বাবাকে এভাবে থাকাতে দেখে খুক খুক করে কাশল। বলল, ‘সুন্দর না গ্রামটা? বুঝছো আব্বু, এই গ্রামটা এত সুন্দর যে আগামী বছর আবার আরেকটা সিনেমার জন্য এখানে আসতে হবে।’
শব্দর আলী প্রবল আনন্দের সঙ্গে বললেন, ‘সে ঠিক বলেছিস। মন জুড়িয়ে যাচ্ছে দেখে। চারিদিকে গাছপালা-নদী, পথঘাটও খুব সুন্দর, সাজানো। এখানে একটা বাড়ি বানালে কেমন হয়?’
লিখন গোপনে দীর্ঘশ্বাস লুকাল। তার বাবা যখন যেখানে যান, তখন সেখানেই বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখেন। কখনোই বানানো হয় না। ফাতিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তা আমরা উঠছি কার বাড়ি? তোর পছন্দ করা মেয়ের বাড়ি নাকি অন্য কোথাও?’
মায়ের চোখেমুখে বিরক্তি দেখে লিখনের হাসি পেল। বলল, ‘তোমাকে রাগলে এত ভালো লাগে আম্মু।’
ফাতিমা আড়চোখে ছেলের দিকে তাকান। প্রশংসা শুনতে তিনি বেশ পছন্দ করেন। লিখনের মুখে প্রশংসা শুনে একটু নিভলেন, ‘হয়েছে, আর কতক্ষণ?’
‘পাঁচ মিনিট। অলন্দপুরের মাতব্বর বড়ো মনের মানুষ। আমাকে নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে দেখেন। যতদিন ছিলাম প্রতিদিন খোঁজ নিয়েছেন। নিজের একজন লোককে আমার সহায়ক হিসেবেও দিয়েছিলেন! উনার বাড়িতেই উঠব।’
লিলি চোখ-মুখ বিকৃত করে বলল, ‘অন্যের বাড়িতে উঠব! উফ।’
‘মারব ধরে। অন্যের বাড়ি তোর কাছে, আমার কাছে না। মজিদ চাচার বউ ফরিনা চাচি এত ভালো রাঁধেন! আমাকে নিজের হাতে বেশ কয়েকবার খাইয়ে দিয়েছেন। উনার একটাই ছেলে। ঢাকায় ব্যাবসা সামলাচ্ছে। তার সঙ্গে অবশ্য সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু ফরিনা চাচি সারাক্ষণ ছেলে-ছেলে করতেন। আম
উম্মে কুলসুম পপি ; আলোচিত ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর || The First Female Agri Influencer UMMA KULSUM POPI .
পর্দার মধ্যে থেকেও যে ভালো কনটেন্ট তৈরী করা যায় তা উনিই শিখিয়েছেন বাংলাদেশের নারীদের, তাই আমরা অশ্লীলকে না বলি শালীনতাকে সাপোর্ট করি।
📖পদ্মজা (পর্ব :৪)📝
– ইলমা বেহরোজ
ভোর বেলার সূর্য উদয়ের সময় চার পাশে ছড়িয়ে পড়ল মৃদু সূর্যালোক। ট্রেনের জানালা দিয়ে সূর্যের আগুনরঙা আলো পদ্মজার মুখশ্রী ছুঁয়ে যাচ্ছে। ফজরের নামাজ পড়ে ট্রেনে উঠেছে তারা। গন্তব্য অলন্দপুর। পদ্মজার মেট্রিক শেষ হলো আজ তিন দিন। হেমলতার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল পদ্মজা। পুরো দেড় মাস পর পূর্ণা-প্রেমা-প্রান্তর দেখা পাবে। খুশিতে আত্মহারা সে।
মাঝে একটু জিরিয়ে ফের চলছে ট্রেন। হেমলতা জানালার বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখছেন। কারণে-অকারণে তিনি এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। শুষ্ক চক্ষুদ্বয় যখন-তখন সজল হয়ে উঠে। কিছুতেই বারণ মানে না, নীল আকাশের বুকে যেন সেদিন রাতের স্মৃতি আকার নিয়ে ভেসে উঠল। ছেলেটার বয়স তেইশ-চব্বিশ বছর হবে। অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। দেখতে-শুনতে বেশ ভালো। হেমলতা পদ্মজাকে আড়াল করে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কে তুমি?’
ছেলেটি হেমলতার কথার ধরনে বিব্রতবোধ করল।
ইতস্তত করে বলল, ‘মুহিব, মুহিব হোসেন।’
হেমলতার টনক নড়ল। তিনি সাবধানে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বারেক হোসেন তোমার বাবা?’
মুহিব ভদ্রভাবে বলল, ‘জি।’
হেমলতা কী যেন বলতে চেয়েছিলেন, পারলেন না। তার আগেই মুহিব অপরাধী স্বরে বলল, ‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি আসছি।’ এরপরই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। সেদিন আর রাত জাগা হলো না। ছাদ থেকে নেমে গেল মা-মেয়ে। গোপন বৈঠকে একবার বাধা পড়লে আলোচনা চালিয়ে যেতে আর মন সায় দেয় না। অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যায়।
পরদিন জানা গেল—মুহিব তার পিতার সঙ্গে রাগ করে ঢাকা ছেড়ে চাচার বাড়ি উঠেছে। এখনকার ছেলে-মেয়েদের ক্ষমতা খুব। তারা খুব সহজ কারণে মা-বাবার সঙ্গে রাগ করে দূরে সরে যেতে পারে। হেমলতা অবজ্ঞায় কপাল কুঞ্চিত করতে সঙ্কোচবোধ করলেন না। পরে অবশ্য বুঝেছেন, মুহিব খুবই ভালো ছেলে। নম্র, ভদ্র, জ্ঞানী। মেধাবী ছাত্র, বিএ পড়ছে। সবচেয়ে ভালো গুণ হলো, মুহিবের নজর সৎ। হেমলতা চোখের দৃষ্টি চিনতে ভুল করেন না। ঠিক সতেরো দিন পর বারেক হোসেন ছেলেকে নিতে আসেন। যেদিন আসেন পরদিন রাতেই হেমলতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। মুহিবের বউ হিসেবে পদ্মজাকে নিতে চান। হেমলতা অবাক হোন। মুহিব মনে মনে পদ্মজার প্রতি দুর্বল, অথচ তিনি একটুও বুঝতে পারেননি!
নিঃসন্দেহে মুহিব পাত্র হিসেবে উপযুক্ত। মুহিবের বড়ো দুই ভাই—মুমিন ও রাজীব। দুজনই চাকরিজীবী। মুমিন বিয়ে করে বউকে ডাক্তারি পড়াচ্ছে। বউয়ের পড়াশোনার সমর্থনে আছে পুরো পরিবার। বোঝা যাচ্ছে, পরিবারের প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক, ভাবনা উচ্চ মানের। বারেক হোসেন বিয়ের প্রস্তাবের সঙ্গে এটিও বলেছেন, ‘আমার মেয়ে নেই। ছেলের বউরাই আমার মেয়ে। আপনার মেয়ের যতটুকু ইচ্ছে পড়বে। কোনো বাধা নেই।’ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ
হেমলতা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন না। তিনি আনন্দ সাথে জবাব দিলেন, ‘পদ্মজা আইএ শেষ করুক। এরপরই না হয়।’
বারেক হোসেন হেসে বললেন, ‘তাহলে এটাই কথা রইল।’
স্মৃতির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন হেমলতা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। গলাটা কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি পান করলেন।
অলন্দপুর।
প্রেমা-প্রান্ত বাড়ির বাইরে সড়কে পায়চারি করছে। পূর্ণা গেটের আড়াল থেকে বার বার উঁকি দিয়ে দেখছে দূরের পথ। হেমলতা ও পদ্মজাকে আনতে মোর্শেদ যে সেই কখন গঞ্জে গেলেন, এখনো আসছেন না! পুরো দেড় মাস পর মা-বোনের সাক্ষাৎ পাবে তারা। হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছে। মিনিট পাঁচেক পর কাঁচা সড়কের মোড়ে মোর্শেদের পাশে কালো বোরখা পরা দুজন মানুষকে দেখা যায়। পূর্ণা লাজলজ্জা ভুলে আগে আগে ছুটতে থাকে। পেছনে প্রান্ত এবং প্রেমা। দৌড়ে গিয়ে মা-বোনকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে প্রবল কণ্ঠে কেঁদে উঠল পূর্ণা। হেমলতা পূর্ণাকে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। মাঝে মাঝে একটু বাড়াবাড়ি করা দোষের নয়। পদ্মজার চোখ বেয়েও টপটপ করে জল পড়ছে। প্রায় প্রতিটা রাত সে ভাই-বোনদের কথা মনে করেছে। বিশেষ করে পূর্ণাকে মনে পড়েছে বেশি। মনে হচ্ছে, কত শত বছর পর দেখা হলো! পদ্মজাকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পূর্ণা। প্রতিটি দিন সে বাড়ির আনাচে-কানাচে পদ্মজার শূন্যতা অনুভব করেছে। পূর্ণা অশ্রুসিক্ত চোখ মেলে বোনের দিকে তাকাল। এরপর আবার জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, আমার এত আনন্দ হচ্ছে! আগে কখনো এমন হয়নি।
পদ্মজার কোমল হৃদয়, পূর্ণার ভালোবাসা দেখে বিমোহিত হয়ে উঠল সে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলল, ‘আমার সোনা বোন। আর কাঁদিস না।’আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
পূর্ণা দ্রুত চোখের জল মুছে প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘আপা, আমি তোমার পছন্দের চিংড়ি মাছ দিয়ে লতা রেঁধেছি।’
পদ্মজা অবাক চোখে তাকাল। এদিকে এক বোনের প্রতি আরেক বোনের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে হেমলতা প্রশান্তিদায়ক সুখ অনুভব করছেন। আনন্দে বাকহারা হয়ে পূর্ণার দুই গালে চুমো দিল পদ্মজা। মোর্শেদ দৃশ্যটি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন, মানুষজনকে আসতে দেখে তাড়া দিলেন, ‘দেহো মাইয়াডির কারবার। মানুষ আইতাছে। আর হেরা রাস্তায় কান্দাকাটি লাগাইছে। হাঁট, সবাই হাঁট।’
আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে সবাই খেতে বসে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চার ভাই-বোন আশ্রয় নিলো ঘাটে। এই ঘাট হচ্ছে তাদের বৈঠকখানা। দেড় মাসে কী কী হলো, না হলো সব পূর্ণা বলছে। প্রেমা পূর্ণার নামে বিচার দিল। প্রান্ত প্রেমার নামে বিচার দিল। প্রান্ত কেন বিচার দিল তা নিয়ে আবার বাকবিতণ্ডা লাগিয়ে দিল প্রেমা। সে কী কাণ্ড! তুমুল ঝগড়ায় লিপ্ত হয় দুজন। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে বিচার নিয়ে ছোটো দুজন গেল হেমলতার কাছে।
তখন পদ্মজা শুষ্ককণ্ঠে পূর্ণাকে বলল, জানিস পূর্ণা, আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’
পূর্ণা ভীষণ চমকাল। চমকিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে? কার সঙ্গে?’
‘যে বাড়িতে ছিলাম ওই বাড়ির ছেলের সঙ্গে। বিএ পড়ছে। আমার আইএ শেষ হলে বিয়ের তারিখ পড়বে।’
‘আপা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আম্মার না ইচ্ছে তোমাকে অনেক পড়াবে। তোমার চাকরি হবে।’
পদ্মজা চুপ থাকল ক্ষণকাল। তারপর বলল, ‘আম্মার কী যেন হয়েছে। পালটে গেছেন।’
‘কী রকম?’
‘আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বেশিরভাগ কথা এড়িয়ে যান। আমার ভবিষ্যত নিয়ে আগের মতো আগ্রহ দেখান না। আমি কথা তুললে এড়িয়ে যান। গল্প করেন না। আম্মা আগের মতো নেই পূর্ণা।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে পদ্মজার গলা কিঞ্চিৎ কাঁপল।
‘কী বলছ!’
‘সত্যি।’
‘কিছু হয়েছে ওখানে?
‘না। আমি যতটুকু জানি তেমন কিছুই হয়নি।’
পূর্ণা সীমাহীন আশ্চর্য হয়ে চিন্তায় ডুবে গেল। পদ্মজা শূন্যে তাকিয়ে রইল। লিখন শাহ নামে মানুষটার কথা মনে পড়ছে। তিনি যখন শুনবেন এই খবর, সহ্য করতে পারবেন? সত্যি ভালোবেসে থাকলে সহ্য করতে কষ্ট হবে নিশ্চয়ই। পূর্ণা দ্বিধাভরে প্রশ্ন করল, ‘আপা, লিখন ভাইয়ের কী হবে?’
পদ্মজা ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকাল। বলল, ‘আমি তাকে বলেই দিয়েছি, আম্মা যা বলবেন তাই হবে।’
পূর্ণার মনজুড়ে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। তার আপার মতো সুন্দরীকে শুধুমাত্র লিখন শাহর পাশেই মানায়। লিখন শাহ আর পদ্মজাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখল সে।
সব স্বপ্নে গুড়ো-বালি!
পূর্ণা কাতর কণ্ঠে বলল, ‘লিখন ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে না হলে আমি কষ্ট পাব খুব।’
‘আমি তো আম্মার কথার বাইরে যেতে পারব না।’
পূর্ণা গলার স্বর খাদে এনে বলল, ‘যদি লিখন ভাই রাজি করাতে পারে?’ পদ্মজা অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। সেই দৃষ্টি যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে, হওয়ার নয়! পূর্ণা কপাল কুঁচকে ফেলল। বিরক্তিতে বলে উঠল, ‘ধ্যাত! ভালো লাগছে না।’
বাতাসটা গরম ঠেকছে, ক্রমশ বেড়ে চলেছে মাথাব্যথা। এত এত গাছগাছালি চারিদিকে, তবুও এতটুকুও শীতলতা নেই। হেমলতা আলমারির কাপড় গুছিয়ে বিছানার দিকে তাকালেন। মোর্শেদ এই রোদ ফাটা দুপুরে কখন থেকে ঝিম মেরে বিছানায় বসে আছেন। মুখখানা বিমর্ষ, চিন্তিত 1 হেমলতা প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কী হয়েছে?’
মোর্শেদ তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। হেমলতা তাকিয়ে রইলেন জবাবের আশায়। ক্ষণকাল সময় নিয়ে মোর্শেদ বললেন, ‘বাসন্তী এই বাড়িত থাকবার জন্য আইতে চায়।’
হেমলতার চোখ দুটি ক্রোধে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল।
তিনি নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার ইচ্ছে হলে নিয়ে এসো। বাড়ি তো তোমার।’
মোর্শেদ চকিতে তাকালেন। তিনি ভেবেছিলেন হেমলতা রাগারাগি করবে। মোর্শেদের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ রূপ নিলো। কিড়মিড় করে হেমলতাকে বললেন, ‘আমি তারে চাই না।’
হেমলতা ঠাট্টা করে হাসলেন। বললেন, ‘বিশ বছর সংসার করে এখন তাকে চাও না! আমি হলে মামলা ঠুকতাম।’
মোর্শেদ আহত মন নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তার চোখ দুটিতে অসহায়ত্ব স্পষ্ট। হেমলতা নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখান থেকে সরে পড়েন। মোর্শেদ তখন কপট রাগ নিয়ে নিজে নিজে আওড়ান, ‘বাসন্তী আমারে ডর দেহায়! মা*ডারে খুন করতে পারলে জীবনে শান্তি পাইতাম।’
হেমলতা দরজার ওপাশ থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে মোর্শেদকে পরখ করছেন। রাগে ছটফট করছেন মোর্শেদ। বাসন্তীর প্রতি তার এত রাগ কেন?
হেমলতা পুনরায় ঘরে এসে বললেন, ‘ভালোবাসার মানুষকে এভাবে গালি দিয়ে ভালোবাসা শব্দটির সম্মান খুইয়ে দিয়ো না।’
‘আমি তারে কোনোকালেও ভালোবাসি নাই। বাসলে তোমারে বাসছি।’ হেমলতা ভীষণ অবাক হয়ে তাকালেন। চোখের তারায় জ্বলজ্বল করে কিছু একটা যেন ছুটতে শুরু করে।
ভোঁতা অনুভূতিগুলো মুহূর্তে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে। মোর্শেদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। তিনি বিছানা থেকে নেমে গটগট পায়ে বেরিয়ে যান। হেমলতা মোর্শেদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকেন ঝাপসা চোখে।
মানুষটার থেকে এই একটি শব্দ শোনার জন্য একসময় কত পাগলামি করেছেন, কত কেঁদেছেন। আকুতি-মিনতি করেছেন। মোর্শেদের মুখে ভালোবাসার সত্য স্বীকারোক্তি শুনে হেমলতার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। বয়সটা কম হলে আজ তিনি অনেক পাগলামি করতেন, অনেক!
পূর্ণার গা কাঁপানো জ্বর। তাই পূর্ণাকে নানাবাড়ি রেখেই পদ্মজা বাড়ি ফিরল সঙ্গে এলো হিমেল-প্রান্ত-প্রেমা। তিন ভাইবোন মিলে বাড়িজুড়ে ছোটাছুটি করে লাউ, শিম, লতা, পুঁইশাক বন্দোবস্ত করল। বাজার থেকে মাছ নিয়ে এলো হিমেল। বাড়িতে শুঁটকি ছিল। আজ হেমলতা আর মোর্শেদ ফিরবেন। তাই এত আয়োজন। দুই দিন আগে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। হেমলতার বড়ো বোন হানির মেজো মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। হানি বলেছেন, হেমলতা না গেলে তিনি বিয়ের তারিখ ঠিক করবেন না। তাই বাধ্য হয়ে হেমলতা গেছেন। তবে পদ্মজার শুরু থেকে খটকা লাগছে। তার মা তাকে রেখে পাশের এলাকায় যেতেও আপত্তি করেন। আর আজ দুই দিন ধরে তিনি মাইলের পর মাইল দূরে পদ্মজাকে ছাড়া রয়েছেন! অবশ্য এসব এখন ভাবার সময় নয়। পদ্মজা যত্ন করে কয়েক পদের রান্নার প্রস্তুতি নিলো। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। পরিবেশ ঠান্ডা, স্তব্ধ। এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। প্রান্ত-প্রেমা উঠান জুড়ে মারবেল খেলছে। হিমেল শুধু দেখছে, মাঝে মাঝে প্রবল কণ্ঠে হেসে হাত তালি দিচ্ছে। রান্না শেষ হলো বিকেলে প্রেমা, প্রান্ত ও হিমেলকে খাবার বেড়ে দেয় পদ্মজা।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বলল, ‘মামা, তুমি আর প্রান্ত গিয়ে পূর্ণাকে নিয়ে আসো। সন্ধ্যা হয়ে যাবে একটু পর। আম্মা-আব্বাও চলে আসবে।’
হিমেল-প্রান্ত বের হতেই পেছন পেছন ছুটে গেল প্রেমা। পদ্মজা একা হয়ে গেল। রান্নাঘর গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ, বাতাস বইছে প্রবলবেগে। বাতাসের দাপটে পদ্মজার চুল ও ওড়না উড়ছে। পরিবেশ অন্ধকার হচ্ছে ধীরে ধীরে। তার মনটা কু গাইতে লাগল। সে এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে গেটের দিকে বারংবার তাকিয়ে দেখছে, কেউ এলো কি না! যতক্ষণ কেউ না আসবে শান্তি মিলবে না। বিকট শব্দ তুলে কাছে কোথাও বজ্রপাত পড়ল। ভয়ে পদ্মজার আত্মা শুকিয়ে যায়। চারিদিক কেমন গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে! ঘোমটা টেনে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। বিকট বজ্রপাত, দমকা হাওয়া সঙ্গে বড়ো বড়ো ফোঁটার বৃষ্টি, যেন প্রলয়ঙ্কারী ঝড় বইছে। লাহাড়ি ঘরের মাথার ওপরে থাকা তাল গাছগুলো অবাধ্য বাতাসের তেজে একবার ডানে আরেকবার বাঁয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। পদ্মজার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল আতঙ্কে, ছুটে গেল নিজের ঘরে। বিছানার উপর কাঁচুমাচু হয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। টিনের চালে ধুমধাম শব্দ হচ্ছে। পদ্মজা অনবরত প্রার্থনা করে যাচ্ছে, যেন বৃষ্টি কমে যায়।
কিন্তু বৃষ্টির বেগ কমার বদলে উলটো বাড়ল! এতসব শব্দ ভেদ করে আরেকটি শব্দ এসে থেমে গেল পদ্মজার কানের কাছে, সদর ঘরে কিছু একটা পড়েছে। ভয় পদ্মজাকে আরো বেশি করে গ্রাস করে ফেলল।
পরক্ষণেই খুশিতে সে আওড়াল, ‘আম্মা এসেছে?’
বিছানা থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে সদর ঘরে যায় পদ্মজা। ঘরটা অন্ধকারে তলিয়ে আছে। জানালা দিয়ে আসা ঈষৎ আলোয় দেখল একজন পুরুষের অবয়ব। সঙ্গে সঙ্গে তার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে পড়ল। জায়গায় স্তব্ধ হয়ে গেল দুটো পা।
পদ্মজা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘কে আপনি? খালি বাড়িতে কেন ঢুকেছেন? কোনো জবাব এলো না। পদ্মজা অনুরোধ করে ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘বলুন না, কে আপনি?’
একটি ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দুটি গভীর কালো চোখ বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে।
শীতল-স্পষ্ট কণ্ঠে চোখের মালিক বলল, ‘আমির হাওলাদার।’
পুরুষালী কণ্ঠটি শুনে আরো ভড়কে গেল পদ্মজা। রগে-রগে, বরফের মতো ঠান্ডা আর সূক্ষ্ম কিছু একটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এক হাত দরজায় রেখে, পদ্মজা আকুতি করে বলল, ‘আপনি চলে যান। কেন এসেছেন?’
উত্তরের আশায় না থেকে পদ্মজা দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল, ভেতরে ঢুকেই লাগিয়ে দিল দরজা। তার মস্তিষ্ক জমে গেছে, কাজ করছে না। লোকটা যদি সম্মানে আঘাত করে বা গ্রামের মানুষ যদি দেখে ফেলে খালি বাড়িতে অচেনা পুরুষের সঙ্গে…কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সে আর ভাবতে পারছে না।
করাঘাত শুনে পদ্মজা ঘরের সব আসবাবপত্র ঠেলেঠুলে দরজার কাছে নিয়ে এলো। শরীর কাঁপছে, মাটিতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। দুই হাত মাথায় রেখে আর্তনাদ করে ডাকল, ‘আম্মা, কোথায় তুমি? আমি খুব একা, আম্মা। আম্মা…।’
১৬
টিনের চালে ঝুম ঝুম শব্দ। বৃষ্টির এই ছন্দ অন্যবেলা বেশ লাগলেও এই মুহূর্তে ভয়ংকর ঠেকছে পদ্মজার কাছে। একেকটা বজ্রপাত আরো বেশি ভয়ানক করে তুলেছে পরিবেশ। সে কাঁচুমাচু হয়ে ফোঁপাচ্ছে।
বৃষ্টির শব্দ একটু কমলে কিছু কথা ভেসে আসে বাতাসে, ‘আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আমাকে ভয় পাবেন না। বিপদে পড়ে এই বাড়িতে উঠেছি। বিশ্বাস করুন।’
পদ্মজা কান্না থামিয়ে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। দরজার ওপাশ থেকে আমির নামের মানুষটি বলছে, ‘দরজা খুলুন। বিশ্বাস করুন আমাকে। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসেনি। ভয় পাবেন না।’
পদ্মজা একটু নড়েচড়ে বসল। আমির আবার বলল, ‘শুনছেন?’
ঢোক গিলে কথা বলার চেষ্টা করল পদ্মজা। কী অদ্ভুত, কথা আসছে না! খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করতে চাইল সে। বলল, ‘আ…আমি দরজা খুলব না।’
ক্ষণকাল কোনো উত্তর এলো না, শুধু বৃষ্টির ধ্বনি শোনা গেল। একসময় পুরুষালি কণ্ঠটি বলল, ‘আচ্ছা, খুলতে হবে না। দয়া করে আপনি শুধু ভয় পাবেন না।’
‘আপনি চলে যান।’
বৃষ্টিটুকু থামতে দিন। হঠাৎ বৃষ্টির জন্যই তো আপনার বাড়িতে ওঠা। আমার বৃষ্টিতে সমস্যা হয়।’
আমিরের মুখে স্পষ্ট শুদ্ধ ভাষা শুনে পদ্মজা অনুমান করে নিলো, লোকটি শিক্ষিত। কথাবার্তা শুনে ভালো মানুষ মনে হচ্ছে, তবুও সাবধানের মার নেই। সে দরজা খুলল না, বিছানায় গিয়ে বসল; আগের থেকে ভয় কিছুটা কমেছে।
আমিরের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘শুনছেন?’
পদ্মজা জবাব দিল, ‘বলুন।’
‘আপনার নাম কী? ডাকনাম বলুন।’
‘পদ্মজা।’
‘সুন্দর নাম। আমার নাম জিজ্ঞাসা করবেন না?’
‘জানি।’
আমির অবাক হওয়ার ভান ধরে প্রশ্ন করল, ‘কীভাবে? আমাকে চিনেন?’
‘না, কিছুক্ষণ আগেই নাম বললেন।’
‘তখন তো ভয়ে কাঁপছিলেন, নামও শুনেছেন!
আমিরের কণ্ঠে রসিকতা। পদ্মজা মৃদু হাসল, কেন হাসল জানে না। আমির পুনরায় বলল, ‘শুনছেন?’
‘শুনছি।’
‘আপনি কি এরকমই ভীতু?’
‘সাহসিকতা প্রমাণ করানোর জন্য এখন বের হতে বলবেন, তাই তো?’
ওপাশ থেকে গগন কাঁপানো হাসির শব্দ ভেসে আসে। আমির হাসতে হাসতে বলল, ‘বেশ কথা জানেন তো।’
চলমান প্রসঙ্গ এড়িয়ে পদ্মজা বলল, বৃষ্টি কমলেই কিন্তু চলে যাবেন!’
‘তাড়াতে হবে না। বৃষ্টি কমলে নিজে থেকেই চলে যাব।’
কষ্ট নিবেন না। খালি বাড়ি তো, তাই বলছি।’
‘বাকিরা কোথায়? এটা মোর্শেদ কাকার বাড়ি না?’
‘জি।’
‘উনার ধানের মিল তো এখন আমার আব্বার দখলে। ছুটিয়ে নিবেন কবে?’
পদ্মজা অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আপনি মাতব্বর কাকার ছেলে?’
‘অবাক হলেন মনে হচ্ছে?’
‘মাতব্বর কাকার ছেলের নাম তো বাবু!’
আমির হেসে বলল, ‘আমার ডাকনাম বাবু। এই নামে আম্মা আর আব্বা ডাকে। ভালো নাম আমির।’
পদ্মজা আর কথা দীর্ঘ করল না। বজ্রপাত থেমেছে, বৃষ্টি রয়ে গেছে। আমির জিজ্ঞাসা করল, ‘বাকিরা কোথায়?’
‘আম্মা-আব্বা ঢাকা। আজ ফেরার কথা ছিল। আর আমার দুই বোন আর ভাই নানাবাড়ি। বোধহয় বৃষ্টির জন্য আসতে পারছে না।’
‘এখনো আমাকে ভয় পাচ্ছেন?’
‘একটু, একটু।’
‘এটা ভালো। অচেনা মানুষকে একেবারেই বিশ্বাস করতে নেই।
বাসন্তী ভ্যান থেকে নেমে সামনে এগোলেন। মোর্শেদের বাড়িটা তিনি চেনেন না। তাই কোনদিকে যেতে হবে বুঝে উঠতে পারছেন না। এদিকে আকাশের অবস্থা ভালো না। রাস্তাঘাটেও মানুষ নেই। ঝড়ো হাওয়া বইছে। আরো কিছুটা পথ হাঁটার পর আচমকা ঝড় শুরু হলো। তিনি দৌড়ে একটা বাড়িতে উঠে পড়েন। রমিজ আলি বারান্দায় বসে হুঁকা টানছিল। সিল্কের শাড়ি পরনে, পেট উন্মুক্ত, লম্বা চুলের বেণুনীতে ধবধবে সাদা বাসন্তীকে দেখে সে অবাক হয়ে এগিয়ে এলো। বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘কেডা আপনে? কারে চান?’
বাসন্তী কেঁপে উঠলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে রমিজকে দেখে লম্বা করে হেসে বললেন, ‘হুট কইরা মেঘখান আইয়া পড়ল তো।’
‘তো আপনে কার বাড়িত যাইতেন?’
‘মোর্ছেদের বাড়ি।’
রমিজ আলি বিরক্তি নিয়ে সরে গেল। ঘরের ভেতর থেকে চেয়ার এনে দিয়ে বলল, ‘মোর্শেইদদার কী লাগেন আপনে?’
বাসন্তী চিন্তায় পড়ে যান। গ্রামের মানুষ তো জানে না তার আর মোর্শেদের সম্পর্ক কী! এখন জানানোটা কতটা যুক্তিসংগত হবে? সেকেন্ড কয়েক ভাবার পর যুক্তি মিলল। গ্রামবাসীকে বলা উচিত। নয়তো নিজের অধিকার তিনি কখনো পাবেন না। একমাত্র গ্রামবাসীরাই পারবে তার জায়গাটা শক্ত করে দিতে। বাসন্তী রমিজ আলির চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তার বউ লাগি। পরথম বউ। তার লগে আমার বিছ বছরের ছম্পর্ক।’
রমিজ আলির চক্ষুদ্বয় যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। মোর্শেদের বউ! বারকয়েক চোখ পিটপিট করল সে, ‘কী বললেন? কার বউ?’
‘মোর্ছেদ, মোর্ছেদের বউ।’
মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার মতো আনন্দ হতে থাকে রমিজের। সে প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘হের পরের বউয়ে জানে?’
‘না।’
‘থাহেন কই আপনে?’
‘রাধাপুর।’
‘লুকাইয়া রাখছিল বিয়া কইরা?’
‘হ। এখন মোৰ্ছেদ আমারে তালাক দিতে চায়। আমার সঙ্গে ছংছার করতে চায় না। তাই আমি আমার অধিকার নেয়ার জন্য আইছি। আমি তার বাড়িতে থাকবার চাই। আপনেরা আমারে ছাহায্য করেন। গ্রামবাছী ছাড়া মোর্ছেদ আমারে জায়গা দিব না।’
রমিজ আলি প্রবল বৃষ্টি, আর বজ্রপাতকে হটিয়ে বাহাদুরের মতো বলে উঠল, ‘আপনের জায়গা করে দেওন আমরার কাম। আপনি চিন্তা কইরেন না। মেঘডা কমতে দেন। এরপর খালি দেহেন কী হয়!’
বাসন্তীর চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অবশেষে একটা ভরসা পাওয়া গেল। রমিজ আলির প্রতিশোধের নেশা পেয়েছে। মোর্শেদ তাকে কত কটু কথা বলেছে, অবজ্ঞা করেছে, অপমান করেছে। এইবার তার পালা। প্রতিটি অপমান ফিরিয়ে দেয়ার শপথ করেছে সে অনেক আগেই। বাসন্তীকে ভরসা দিয়ে সে বলল, ‘আপনি বইয়া থাহেন। আমি আরো কয়জনরে লইয়া আইতাছি।’
রমিজ আলি খুশিতে গদগদ হয়ে বেরিয়ে গেল লোকবল আনতে। ছইদ, রজব, মালেক, কামরুলকে নিয়ে ফিরে এলো। সবার হাতে হাতে ছাতা। কামরুল আটপাড়া এলাকার মেম্বার। গ্রামে কোনো অনাচার হলে তা দেখার দায়িত্ব তার। তাই তিনি মাথার উপর বজ্রপাত, ঝড় নিয়েই ছুটে এসেছেন।
পদ্মজা উসখুস করছে। টয়লেটে যাওয়া প্রয়োজন। প্রস্রাবের বেগ ক্রমাগত বাড়ছে। এভাবে আর কতক্ষণ থাকা যায়। সাহসও পাচ্ছে না বের হওয়ার। ঘরে পায়চারি করল কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো। এরপর কাঁচি কোমরে গুঁজে আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিয়েই দরজা খুলল। আচমকা দরজা খোলার আওয়াজ শুনে আমির চমকে তাকাল। আকাশ থেকে কালো মেঘের ভাব কেটে গেছে অনেকটা। সন্ধ্যার আজান পড়ছে। সালোয়ার, কামিজ পরা পদ্মজাকে দেখে মুহূর্তে হৃদস্পন্দন থমকে গেল তার। পদ্মজা ওড়না টেনে নিলো নাক অবধি। কাঁপা পায়ে আমিরের পাশ কেটে গেল। আমিরের চোখ স্থির। নিশ্বাস এলোমেলো। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। পদ্মজা যখন ফিরছিল ঘরে, আমির ডাকল, ‘পদ্মজা?’
পদ্মজা দাঁড়াল। মানুষটা খারাপ হলে এতক্ষণে আক্রমণ করত। যেহেতু করেনি, মানুষটার উদ্দেশ্য খারাপ না। তাই দাঁড়াল, তবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল না।
আমিরের গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। শার্ট ভিজে যাওয়াতে বারান্দার দড়িতে রেখেছে, যাতে বাতাসে শুকিয়ে যায়। যেন রূপকথার জগতে হারিয়ে গেছে এমনভাবে আমির বলল, ‘অলন্দপুরে এমন রূপবতী আছে—জানা ছিল না।’
পদ্মজা লজ্জা পাওয়ার পাশাপাশি বিব্রতবোধ করল। বৃষ্টি প্রায় কমে এসেছে। তাই সে বলল, ‘আপনি এবার আসুন। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।’
‘যেতে তো ইচ্ছে করছে না।’
লোকটা বলে কী! এতক্ষণ বলল বৃষ্টি কমলেই চলে যাবে। এখন বলছে, যাবে না। পদ্মজা ঘুরে তাকাল। চোখের দৃষ্টিতে আকুতি ফুটিয়ে বলল, ‘দয়া করে চলে যান।’
আমির কিঞ্চিৎ হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। না চাইতেও আমির পদ্মজার নজরে পড়ে। শ্যামবর্ণের একজন পুরুষ, থুতনির মাঝে কাটা দাগ। সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো পদ্মজা। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘বৃষ্টি কমে গেছে। আম্মা-আব্বা চলে আসবে। চলে যান।’
আমির অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে। তার নিস্তব্ধতা পদ্মজাকে বিরক্ত করে তুলল। এত ঘাড়ত্যাড়া, দুই কথার মানুষ কীভাবে হয়? উঠানে পায়ের শব্দ! কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ। বারান্দা থেকে দুজন তাকাল। গ্রামের এতজনকে দেখে পদ্মজার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ল সে। রমিজ আলি চেঁচিয়ে ডাকল, ‘কইরে মোর্শেইদদা? আকাম কইরা এখন লুকায়া আছস ক্যান? বাইর হ। তোর আকাম ধইরা লইয়া আইছি।’
আমির বারান্দা পেরিয়ে বেরিয়ে আসে।
গম্ভীরমুখে বলল, ‘উনারা বাড়িতে নেই।’
উৎসুক জনতা আমিরকে দেখে অবাক হয়। কামরুল বললেন, ‘আরে আমির। শহর থেকে আইলা কবে?’
‘এই তো চার দিন হলো। আছেন কেমন?’
‘এই তো আছি। তা এইহানে কী করো?’
আমির উত্তর দেয়ার আগে রমিজ আলি প্রশ্ন করলেন, ‘বাড়িত কেউ নাই?’
আমির বেশ সহজ-সরল গলায় বলল, ‘আছে। পদ্মজা আছে।’
উপস্থিতি পাঁচ-ছয়জন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। সবার দৃষ্টি দেখে আমির বুঝল, সে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছে। তাহলে পদ্মজা এটারই ভয় পাচ্ছিল? আমির দড়ি থেকে শার্ট নিয়ে দ্রুত পরল। এরপর কৈফিয়ত দেয়ার স্বরে বলল, ‘আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। বাড়ি ফিরছিলাম। বৃষ্টি নামে তাই এই বাড়িতে উঠে পড়ি। বাড়িতে কেউ নাই জানলে…’
আমির কথা শেষ করতে পারল না। রমিজ আলি চেঁচিয়ে আশপাশে বাড়ির সব মানুষদের ডাকা শুরু করল। মাতব্বর তাকে কম অপদস্ত করেনি সমাজ থেকে কোণঠাসা করেছে। মোর্শেদ পথেঘাটে কটু কথা শুনিয়েছে। আজ সেই যন্ত্রণা কমানোর দিন। আমির ভড়কে গেল।
কামরুল আঙুল শাসিয়ে কঠিন স্বরে বললেন, ‘তোমার কাছে এইডা আশা করি নাই। তোমার আব্বারে ডাকাইতাছি। উনি যা করার করবেন।’
আমির বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আরে আজব! কী শুরু করেছেন আপনারা?’
ছইদ আমিরের কাছাকাছি বয়সের। ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে তাদের মধ্যে। ছইদ হুংকার ছেড়ে বলল, ‘চুপ থাক তুই! তোর বাপে মাতব্বর বইলা তোরে ডরাই আমরা? আকাম করবি আর ছাইড়া দিমু?’
রাগে-অপমানে আমিরের চোখ লাল বর্ণ ধারণ করে। রেগে গেলে চোখের রং পালটে যায় তার। কালো মুখশ্রীর সঙ্গে লাল চোখ ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ছইদ ভেতরে ভেতরে ভয় পেল। আমিরের হাতে কম মার সে খায়নি। তবে আজ সুযোগ পেয়েছে। পুরো গ্রামবাসী এক দলে। সে কিছুতেই ছাড়বে না। ঢোক গিলে বলল, ‘চোখ উলডাইয়া লাভ নাই। কুকামের উসুল না তুলে যাইতাছি না।’
আমির রাগে শক্ত হাতে থাপ্পড় বসাল ছইদের কানে। মুহূর্তে ছইদের মাথা ভনভন করে উঠে। ততক্ষণে রমিজের উসকানিতে মানুষ জমে গেছে। সবার হাতে হাতে টর্চ, হারিকেন। রাতের আঁধার নেমে এসেছে। আমির আবারও ছইদকে মারতে গেলে কয়জন এসে তাকে জাপটে ধরল। কামরুল একজন মহিলাকে আদেশের স্বরে বললেন, ‘শিউলির আম্মা, কয়জনরে লইয়া মাইয়াডারে বার কইরা আনো। লুকাইছে নটি। গ্রামডা নটিদের ভিড়ে ধ্বংস হইয়া যাইতাছে।’
পদ্মজা মাটিতে নতজানু হয়ে বসে কাঁপছে, তীব্র কাঁপুনি পা থেকে মাথার চুল অবধি। বাইরের প্রতিটি কথা তার কানে এসেছে। চারপাশ যেন ভনভন করছে।
শিউলির আম্মা পদ্মজার ঘরে আসে। দরজা খোলা ছিল। টর্চ ধরে দেখল পদ্মজা মাটিতে বসে কাঁপছে। পদ্মজাকে খুব পছন্দ করে সে। তাই পদ্মজার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘কেন এমন কাম করছস?’
পদ্মজা ঝাপসা চোখ মেলে তাকাল। শিউলির আম্মা পাশের বাড়ির। পদ্মজার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। পদ্মজা শিউলির মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, ‘ভাবি আমি কোনো খারাপ কাজ করিনি। সবাই ভুল বুঝছে।’
রীনা নামে একজন মহিলা পদ্মজাকে জোর করে টেনে দাঁড় করাল। হেমলতার অনেক বাহাদুরি এই মেয়ে নিয়ে, অনেক অহংকার। সেই অহংকার আজ ভালো করে ভাঙবে। সে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠেছে।
ঘৃণা ভরা কণ্ঠে পদ্মজাকে বলল, ‘ধরা পড়লে সবাই এমনডাই কয়। আয় তুই।’
পদ্মজা আকুতি করে বলল, ‘বিশ্বাস করুন আমি খারাপ কিছু করিনি আম্মা এসব শুনলে মরে যাবে। আপনারা এমন করবেন না।’
কারো কানে পৌঁছাল না পদ্মজার আর্তনাদ, আকুতি। সবাই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর মনের, সুন্দর পরিবারের সদস্যগুলোকে ধ্বংস করায় মেতে উঠল। পদ্মজাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে বাহিরে। কখনো ঘোমটা ছাড়া কোনো পুরুষের সামনে না যাওয়া মেয়েটার বুকের ওড়না পড়ে রইল ঘরে। তিন-চার জন মহিলা শক্ত করে পদ্মজার বাহু চেপে ধরে রাখে। সবাইকে উপেক্ষা করে পদ্মজা ঘৃণাভরা চোখে তাকাল আমিরের দিকে। আমির চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর, কিছুতেই পারছে না।
পূর্ণা বাড়িতে ঢুকে দেখে কোলাহল। সে ভয় পেয়ে গেল। জ্বরের তোড়ে কাঁপছে পূর্ণা। একটু এগিয়ে দেখল, পদ্মজার বিধ্বস্ত অবস্থা। মুহূর্তে তার জ্বর উবে গেল। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার আপাকে এভাবে ধরেছেন কেন? আপা…এই আপা? কাঁদছ কেন?’
পদ্মজা কেঁদে বলল, ‘পূর্ণা, আম্মা মরে যাবে এসব দেখলে। আমি কিছু করিনি পূর্ণা।’
পূর্ণা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু অনুভব করছে তার বুক পুড়ছে। পুরো শরীর ব্যথায় বিষিয়ে যাচ্ছে। সে রীনাকে বলল, ‘খালা আপনি আমার বোনকে এভাবে ধরেছেন কেন? ছাড়েন।’ ধমকে উঠল পূৰ্ণা।
রীনা কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘তোর বইনের গতরে রস বাইড়া গেছিল। এজন্য খালি বাড়িত ব্যাঠা ছেড়া ডাইকা আইনা রস কমাইছে।’
নোংরা কথাটি শুনে পূর্ণার গা রি রি করে উঠল! তেজ নিয়ে বলল,
‘খারাপ কথা বলবেন না। আমার আপা এমন না।
পাশ থেকে একজন মহিলা পূর্ণার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোর মা যেমন হের মাইডাও এমন অইছে। নিজেও এমন কিচ্ছা করল। মাইয়াও করল।’
পদ্মজা চমকে তাকাল।
মহিলা বলে যাচ্ছে, ‘বুঝলা তোমরা সবাই…মায় এক বেশ্যা, মাইয়ারে বানাইছে আরেক বেশ্যা।’
পদ্মজা আচমকা রেগে গেল খুব। আক্রোশে তার শরীর কাঁপতে থাকল। রীনা সহ দুজন মহিলাকে ঠেলে সরিয়ে রাগে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার মা নিয়ে কিছু বললে আমি খুন করব। মেরে ফেলব একদম। জিভ ছিঁড়ে ফেলব।’
পদ্মজার এহেন রূপে সবাই থতমত খেয়ে যায়। তার লম্বা চুলগুলো খোঁপা থেকে মুক্ত হয়ে পিঠময় ছড়িয়ে পড়েছে। চোখের মণি অন্যরকম হওয়াতে মনে হচ্ছে, কোনো প্রেতাত্মা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। গ্রামের কিছু মহিলা আবার বিশ্বাস করে, পদ্মজা কোনো পরির মেয়ে। তাই এত সুন্দর। এই মুহূর্তে তারা ভাবছে, পদ্মজার ভেতর কেউ ঢুকেছে। তাই সামনে এগোল না। রীনা একাই এগিয়ে এলো। পদ্মজার চুলের মুঠি ধরে বিশি গালিগালাজ করতে শুরু করল। কামরুলকে বলল, ‘কামরুল ভাই, এই বান্দিরে বাঁন্ধা লাগব।’
পূর্ণা-প্রেমা পদ্মজাকে ছাড়াতে গেলে ছইদসহ আরো তিন চারজন এগিয়ে আসে। অন্ধকারে ভিড়ের মাঝে বাজেভাবে নিগৃহীত হলো পদ্মজা-পূর্ণা- প্রেমা। কয়টা কালো হাত নিজেদের তৃপ্তি মিটিয়ে নিলো খুব সহজে। তিন বোনের কান্না, তাদের আর্তনাদ কারো হৃদয় ছুঁতে পারল না।
হেমলতার অনুপস্থিতিতে তার আদরের তিন কন্যার জীবন্ত কবর হচ্ছিল, বাধা দেয়ার কেউ ছিল না।
১৭
নৌকা ছাড়ার পূর্বে আকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা চোখে পড়ল। তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎই নেমে এলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। খোলা নৌকা হওয়াতে চোখের পলকে কাকভেজা হয়ে গেল যাত্রী পাঁচজন। ভিজলেন না হেমলতা, মোর্শেদ ছাতা ধরে রেখেছেন। বজ্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে হেমলতার আত্মা দুলে উঠছে, খচখচ করছে মনটা। তিনি জলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। জলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার সঙ্গেই বলের মতো একদলা পানি লাফিয়ে উঠছে। তারপর ছোট্ট ছাতার মতো আকৃতি নিয়ে চারপাশে প্রসারিত হয়ে হাওরে মিলিয়ে যাচ্ছে। দেখতে সুন্দর! কিন্তু সেই সৌন্দর্য মনে ধরছে না। অজানা আশঙ্কায় তিক্ত অনুভূতি হচ্ছে। মোর্শেদ গলা খাকারি দিয়ে হেমলতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বললেন, ‘কিছু খাইবা?’
হেমলতা নিরুত্তর। মোর্শেদ শুষ্ক হাসি হেসে বললেন, ‘আর কিছুক্ষণ। আইয়াই পড়ছি।’
হেমলতা কিছু বললেন না। নিরুত্তরে রইলেন। বৃষ্টির স্পর্শ নিয়ে আসা হাওরের হিমেল বাতাসের ছোঁয়া লাগছে চোখেমুখে। হাওরের ঘোর লাগা বৃষ্টি দেখতে দেখতে চোখে এসে ভর করে ঘুম। হেমলতা নিকাব খুলে চোখেমুখে পানি দিয়ে ঘুম কাটান। এরপর ক্লান্ত চোখ দুটি মেলে তাকান মোর্শেদের দিকে। মোর্শেদের হাতে হাত রেখে বললেন, ‘আমার এত খারাপ লাগছে কেন? বুক পোড়া কষ্ট হচ্ছে।’
মোর্শেদ হেমলতার কণ্ঠ শুনে সহসা উত্তর দিতে পারলেন না। চিত্ত ব্যথায় ভরে উঠল। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আইয়া পড়ছি তো। ওই যে বাজারের ঘাট দেহা যাইতাছে।’
হেমলতা মোর্শেদের হাত ছেড়ে দূরে তাকালেন। অলন্দপুরের বাজারটা ছোটো পিঁপড়ার মতো দেখাচ্ছে। নৌকাটা বার বার দুলছে। ঝড় বইছে চারিদিকে, মনেও তো বইছে। তিনি নিজেকে শান্ত করতে চোখ বুজে বার কয়েক প্রাণভরে নিশ্বাস নিলেন। ব্যথাতুর মন আর্তনাদ করে শুধু জানতে চাইছে, আমার মেয়েগুলো কেমন আছে? কী করছে?
রীনা চুল এত শক্ত করে ধরেছে যে পদ্মজার সারা শরীর ব্যথায় বিষিয়ে উঠছে, আকুতি করেও ছাড়া পাচ্ছে না। পূর্ণা-প্রেমা খামচে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। কিছুতেই তারা বোনকে ছাড়বে না।
আমির ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘কামরুল চাচা এটা ঠিক হচ্ছে না! মেয়েগুলোর অভিশাপে পুড়ে যাবেন।’
আমিরের কথায় ক্ষণকালের জন্য কামরুল হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। রমিজ আলী কামরুলের নরম, নিঃশব্দ, ভয়ার্ত মুখের দিকে চেয়ে ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হলেও তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ‘বেশ্যাদের শ
Dakhhingaon, Bashabo Main Road, Shabujbag
Dhaka
1214
Be the first to know and let us send you an email when Sarosh Prokasoni posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.
Send a message to Sarosh Prokasoni:
কোরআনে শ্রেষ্ঠ ৪টি মোটিভেশন #fypシ゚ #islam #islamic #islamicreels #fypシ゚viralシ #reelsfypシ #fb #trend #virals #newpost #videos
পর্দা শুধু মেয়েদের জন্য ? #fypシ゚ #islam #islamic #islamicpost #fypシ゚viralシ #reelsfypシ #trendingreels #fb #contentcreator #statusvideo #caption #saroshprokasoni #samuddrasachi
বোন দুটি কারণে নারীরা জাহান্নামে বেশি যাবে: #fb #fypシ゚ #fypシ゚viralシ #trendingreels #reelsfypシ #islam #islamic #contentcreator #samuddrasachi #saroshprokasoni
অসাধারণ দার্শনিক চিন্তার প্রতিফলন #fb #fypシ゚ #reelsfypシ #fypシ゚viralシ #trendingreels #contentcreator #samuddrasachi #saroshprokasoni
বোন ৮টি উপায়ে স্বামীকে খুশি করবেন #fypシ゚ #islam #islamic #fypシ゚viralシ #reelsfypシ #trendingreels #fb #contentcreator
৫ টি কোথায় সকল চাওয়া পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ্ #fb #fypシ゚ #islam #islamic #reelsfypシ #fypシ゚viralシ #videos #contentcreator
গুজব ছড়ানো বন্ধ করুন #mugdho #fb #reelsfypシ #fypシ゚viralシ #news #politics #fypシ゚ #challenge #contentcreator
উম্মে কুলসুম পপি ; আলোচিত ক্রিয়েটিভ এবং পরিমার্জিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর || The First Female Agri Influencer UMMA KULSUM POPI . পর্দার মধ্যে থেকেও যে ভালো কনটেন্ট তৈরী করা যায় তা উনিই শিখিয়েছেন বাংলাদেশের নারীদের, তাই আমরা অশ্লীলকে না বলি শালীনতাকে সাপোর্ট করি। #Ummakulsumpopi #agriculture #contentcreator