04/03/2024
মাথাই নষ্ট। কি বিরল প্রতিভা নিয়েই না মানুষ জন্মেছে! একজনকে দেখলাম মুখ দিয়ে সিগারেট টানছেন আর কান দিয়ে ধোঁয়া বের করে দিচ্ছেন। বেজায় ভীড় সেখানে। টাসকি খাওয়া আরেকটু বাকি ছিল। দেখি, পুকুরপাড় জুড়ে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা কি বোঝার জন্য আমিও দাঁড়ালাম। সে এক ভয়ানক ব্যাপার। ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি পুকুরে নেমে মুখ দিয়ে পানি ভরছেন, এরপর পানিতে ডুব দিচ্ছেন, তারপর নাঙ্গা পশ্চাদখানি উপরের দিকে দিয়ে পিচকারির মত সেই পানি বের করে দিচ্ছেন। মুহুর্মুহু করতালিতে পুকুরপাড় সরগরম হয়ে উঠেছে। মানুষের এই সমস্ত বিরল প্রতিভা দেখে আমার চোখ ছলছোলিয়ে উঠলো । আহারে, কি অমিত প্রতিভা দিয়েই না স্রষ্টা মানুষকে তৈরি করেছেন। বিশেষ করে বাঙ্গালীদের। রীতিমতে গর্বে বুকটা ভরে উঠলো ।
এরপর মনটা একটু খারাপও হয়ে গেল। ভাবলাম, আমি এক ভেরেন্ডা। এ জীবনে কিছুই পারলাম না। আফসোস!
আমার মত এইরকম আফসোস করা লোকের অভাব নাই। জীবনে কিছুই হলো না এই কথা ভাবতে ভাবতেই তাদের দিন কেটে যায়। নিপুন ভাষায় কঠিন কঠিন শব্দ চয়ন করে প্রথমত বাপ-মায়ের গুষ্টি উদ্ধার করেন, এরপর গুষ্টি উদ্ধার করেন উপরওয়ালার। আজ জমিদার বংশে না জন্মানোর কারণে, মন্ত্রীর বেটা না হওয়ার জন্য, শিল্পপতি দুলাভাই না থাকায় জীবনে কিছুই হলো না এই আফসোস অন্তত ৮০% লোক প্রতিনিয়তই করে যাচ্ছেন। আমিও তার ব্যতিক্রম না। একটা গাড়ি কিনতে পারলাম না, একটা বাড়ি নাই, ঐশ্বরিয়া রায়ের মতো একটা বউ নাই, এইসব নানান অভাব অনটনে আমার দিন কাটছে। তারপর আরো চিন্তা করি, আমেরিকায় জন্মাইনি জন্য আমার প্রতিভার কোন মূল্যায়ন হলো না। পকেটে কাড়ি কাড়ি টাকা নাই জন্য আমার মত বিদগ্ধ লোকের সমাজে সম্মান নাই, বউয়ের কাছে মর্যাদা নাই, মায়ের কাছে আদর নাই, সমাজে কদর নেই। আরো কত কি যে মাথায় ঘোরে, তার ইয়াত্তা নাই। খালি, নাই আর নাই।
একবারও ভাবি না, যা পেয়েছি তা ঢের বেশি। ইদানিং অবশ্য একটু একটু ভাবতে শুরু করেছি। বয়স অ্যারাউন্ড ফোর্টি কিনা। জগতের যত মহামনীষী, আদর্শ মানবেরা সকলেই এই বয়সে নিগুঢ় তত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন । নবীজির নবুওয়াত প্রাপ্তি কিংবা গৌতম বুদ্ধের বোধি জ্ঞান সবই প্রায় এই বয়সেই। আমার বেলায় ব্যতিক্রম হবে কেন? তাই বোধ হয় একটু আধটু আমারও টনক নড়ছে ।
আমার স্কুলের এক সময়ের তুখোড় ছাত্র আজ মুদিখানার দোকানদার। চরম সুরেলা কোকিলকন্ঠী বান্ধবী গান ছেড়ে এখন হেঁসেল পারে হাড়ি ঠেলে। বিদ্যুতের গতিতে দৌড়ে চলা স্কুলের চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেট এখন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলা বন্ধু এখন কাপড়ের দোকানদার। সর্বগুণে গুণান্বিত অলরাউন্ডার বন্ধু নেশাসক্ত।
আবার বিপরীত চিত্রও আছে। স্কুলে যে ছেলেটা উল্লেখযোগ্য কোন স্থানেই ছিল না সে এখন প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা। একটু সহজ সরল আর বোকা সোকা যে বন্ধুটাকে আমরা গর্ধব বলে ডাকতাম, সে নিজেকে বদলে ফেলেছে আপাদমস্ত । স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর থেকে তার যে সাফল, তা রীতিমতো তাক লাগিয়ে দেবার মত। স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেছে দেশের বাইরে। মাঝারি মানের ছাত্রী, যে বান্ধবীটাকে সবাই আমরা মিস ভুলন দেবী বলে ডাকতাম, সে এখন দস্তুর ডাক্তার। ম্যাথ যার মাথায় ঢুকতো না সে এখন রীতিমত পিএইচডি হোল্ডার। না, কেউ তাদের করুনা করেনি। শ্রম মেধা যোগ্যতা আর সময়ের সদ্ব্যবহার এই কয়েকটি গুণই তাদের নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। সুনাম ও দাপটের সাথে যার যার কর্ম ক্ষেত্রে তারা আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন।
তবে কি যারা ডাকসাইটে চাকরি করছেন, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তারা সফল আর অন্যরা বিফল? মোটেও না। যে বন্ধুটা আজ টাকার পাহাড় গড়েছে, শুনলাম তার নাকি বউ চলে গেছে। যে বান্ধবীটা আজ সমাজের চোখে অনেক প্রতিষ্ঠিত, তার স্বামী নাকি রীতিমতো পাড় মাতাল। যে বন্ধুটা সকাল বিকাল রোগী দেখতে দেখতে চুল পাকিয়ে ফেলছে, তার সন্তানটাই নাকি স্পেশাল চাইল্ড। টাকার পাহাড়ের শুয়ে যে বান্ধবী বিলাসবহুল জীবনযাপন করে, তার নাকি কোলন ক্যান্সার।
অন্যদিকে মুদির দোকানদার বন্ধুর ছেলেটা নাকি বুয়েটে চান্স পেয়েছে। হেঁসেল ঘরে যে রাধুনী বান্ধবী শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তার মেয়েটা নাকি উদীয়মান শিল্পী হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পেয়েছে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রি অ্যাথলেট বন্ধুর ছেলেটা নাকি অলিম্পিকের বাছাই পর্বে চান্স পেয়েছে। স্পেশাল চাইল্ড বাবুটার আঁকা ছবি নিয়ে নাকি ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিতে রীতিমতো হইচই।
কি অদ্ভুত পৃথিবীর নিয়ম তাই না? সে নিজেই একবার শীর্ষে নিয়ে যাচ্ছে আবার নিমিষেই খাড়িতে নামিয়ে দিচ্ছে। এটাই পৃথিবীর খেলা। সে চলে তার আপন ছন্দে, আপন গতিতে। আমরা শুধুমাত্র তার খেলার উপাচার। ভাঙ্গা আর গড়া, এটাই প্রকৃতির খেলা। এই খেলা নিখাদ। এখানে কোন কপটতা নাই, নাই কোন তোষণের সুযোগ। শূন্যকে পূর্ণ আর পূর্ণকে শূন্য করাই নিয়তি। আপাতদৃষ্টিতে যাকে সফল মনে হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে হয়তো শূন্যতা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আবার, যাকে দেখে দীনহীন মনে হচ্ছে, তার চোখ জুড়ে রয়েছে প্রশান্তির ঘুম।
কাজেই, কি হবে এত সাত পাঁচ ভেবে? জীবন একটাই। উপভোগ করা না করা যার যার ব্যক্তিগত বিষয়। ভালো থাকতে হবে, ভালো রাখতে হবে। এর বিকল্প নাই। জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে।
অহং এর মেকি মুখোশ খুলে ফেলে দিয়ে পথে নামুন।গলা ছেড়ে গান গান। শিশুর মতো উদ্দাম নৃত্যে মেতে উঠুন। অন্তর আত্মার কথা শুনুন। বিবেকের সাথে বেইমানি ছেড়ে দিন। দেখেন, জীবন কতটা সুন্দর। দ্বিচারিতা আর আত্মপ্রবঞ্চনার চেয়ে বড় অন্তর্দহন আর নাই। জীবনকে ধোঁকা দিলে, আত্মাকে কষ্ট দিলে, পথ হারাবেন । আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘরেরও সাধ্য নেই যে, সেই ঘোর অমানিশায় আপনাকে পথ দেখায়।
আত্মাকে মুক্তি দিন। সাফল্যের দাসত্ব থেকে বেরিয়ে সারল্যের দীঘিতে ডুব মারুন ।
Life is beautiful
From dust I came
Dust I be
লেখা: আশিষ বিন হাসান
পুলিশ সুপার