
27/12/2024
একসময় মসলার লোভে ভারত ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল ইউরোপীয় শক্তি। নানা দুর্লভ মসলার খোঁজে যুদ্ধও বেঁধেছিল। ‘মসলার যুদ্ধ’ নিয়ে মসলার চেয়ে উপাদেয় একটি বইও লিখেছেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক সত্যেন সেন। গুণগত মানের মসলার বাণিজ্য আয়ত্ত করার জন্য উৎসুক অন্যান্য শক্তিশালী সাম্রাজ্য থেকে কঠিন সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ভারতে আসতো ব্যবসায়ীরা। কিন্তু চাহিদা যত বেশি ছিল, মসলা সংগ্রহ করা ছিল ততটাই কঠিন। ওই সময় মসলার মূল্য ছিল সোনার চেয়েও বেশি। কথিত রয়েছে, মধ্যযুগে এক পাউন্ড আদা ছিল একটি ভেড়ার সমান মূল্যবান। এক পাউন্ড জয়ত্রী ছিল তিনটি ভেড়া বা অর্ধেক গরুর সমান। অন্যদিকে এক বস্তা মরিচের দাম ছিল একজন মানুষের জীবনের দামে! মনসামঙ্গল কাব্যেও মসলার উপস্থিতি লক্ষণীয়ঃ ‘জিরা মরিচ মেথি আর ধন্যা শুলফা নিল কাল জীরা পঞ্চ লবণ সত্বরে লইল’ (মনসামঙ্গল, ক্ষেমানন্দ দাস)। চাঁদ সওদাগর সিংহল তথা শ্রীলঙ্কায় বাণিজ্য করতে গিয়ে যেসব দ্রব্যের বিকিকিনি করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জিরা, মরিচ, মেথি, ধনে, শুলফা, কালিজিরা, জয়ত্রী, জয়ফল, লবঙ্গ, কর্পূর। বোঝাই যায়, বাঙালিও এককালে মসলার ব্যাপারী ছিল!
এই যে মসলা। যার জন্য এত যুদ্ধ, রক্তক্ষয়। এত শ্রম স্বীকার। এটি কিন্তু মূলত কোনো খাবার নয়, খাবারের স্বাদবর্ধক মাত্র। এ ছাড়া কখন কখন এটি ভেষজ চিকিৎসার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, প্রাচীন মিসর, গ্রিস, রোমের খাবারেও মসলার উপস্থিতি ছিল। মসলা ছাড়া আলু-মাংসের ঝোল, কিংবা পাঁচফোড়ন ছাড়া ডাল ও সবজির কথা ভাবা যায় না। ডিমের সোনালি রঙের পোঁচের ওপর ব্ল্যাক পেপার ওরফে গোলমরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে না খেলে নাকি ডিমের স্বাদের আভিজাত্য বাড়ে না। মরিচ আর পেঁয়াজকুচির সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে বাঙালি আয়েশ করে ডিমের মামলেট মতান্তরে অমলেট খাচ্ছে যুগ যুগ ধরে! একেক পদের খাবারে মসলা ব্যবহারের তরিকা একেক রকম। একবিংশ শতকের এই প্রান্তে এসে আমরা যদি মসলাগুলোর তালিকা তৈরি করি, সে তালিকা অবশ্য খুব একটা বড় হবে না। স্থানীয় অনেক মসলা এককালে ব্যবহৃত হলেও এখন সেগুলোর ব্যবহার সংকুচিত হয়ে গেছে একেবারেই। মসলার সেই গুণগত মান ও স্বাদ কতটা অক্ষুন্ন আছে সেকথা আর নাইবা বললাম!