12/12/2019
বেশি দিন নয়, মাত্র পাঁচ বছর আগেও বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুণী বোদ্ধা চিন্তক বিশ্লেষক পড়ুয়া লিখিয়ে—সকলেরই মাসশেষের অপেক্ষা কাটতো যার আগ্রহে, সে ছিলো মাসিক রহমত। তাই তো এই পাঁচ বছরেও সর্বমহলের আক্ষেপ দেখা যায় সমানে- রহমতের জন্য।
১৯৯১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বিশেষ করে পত্রিকাপাঠকের সংখ্যাধিক্য ছিলো রহমত ঘিরে। রহমত একটি অপরাজেয় পত্রিকা। রহমত এখনও বেঁচে আছে কোটি মানুষের হৃদয়ে। এই ভালোবাসা এবং জনপ্রিয়তার মূলে যে প্রধান কেন্দ্র নির্দেশ করা যায়, তা হলো পালাবদলের হাত ধরে রহমতের প্রতি পত্রিকাটির প্রধান প্রতিপালক—সম্পাদকদের হৃদয়িক পরিচর্যা।
সম্পাদক তিনিই হতে পারেন, যিনি পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে সব্যসাচী হতে পারেন। যিনি জ্ঞানে, পাণ্ডিত্যে, বুদ্ধিতে, বিশ্লেষণে, উদ্যোগে, প্রতিরোধে, অর্জনে, বিসর্জনে, কৌশলে, সৌজন্যে, পাঠে, লেখায়, অভিজ্ঞতায়, উপলব্ধিতে একজন পরিপক্ব ও সর্ববৃন্তের পদচারী হতে পারেন। যিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেন। যিনি বর্তমানকে সামলে নিয়ে ভবিষ্যতের কথা বলতে পারেন। যিনি অগুনতি পাঠকের সামনে বর্তমানের ভাষায় ভবিষ্যতের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারেন। এজন্যই একজন সম্পাদক হয়ে থাকেন অন্তর-দৃষ্টিসম্পন্ন। একজন সম্পাদকের কলামগুলো হয়ে থাকে জীবন্ত, সর্বকালে সব প্রেক্ষাপটেই প্রাসঙ্গিক।
রহমতের সম্পাদকীয়গুলো তেমনই। এক-দেড় দশক আগের প্রদত্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রতিটি ধারাভাষ্যের ভেতরই এই ঝড়ঝঞ্ঝাপূর্ণ সময়ের তীব্র স্রোত, হৈ-হল্লা এবং তর্কপ্রতর্কের একটি স্থানিক ধারাপাত ফুটে আছে। যারা সম্পাদক এ যুগে এবং ভবিষ্যতে, যারা বিভিন্ন অঙ্কের ফল মিলাতে আগ্রহী এখন এবং আগামীতে, তাদের জন্য রহমতের সম্পাদকীয়গুলো কতটুকু গুরুত্ব বহন করে, তা পাঠ করলেই কেবল বুঝার সাধ্য হবে।
২০০০ সালের ডিসেম্বর থেকে রহমতের সম্পাদক ছিলেন প্রবল জীবনদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ মুহতারাম মনযূর আহমাদ।
মনযূর আহমাদ একজন প্রাজ্ঞ ও প্রথিতযশা সম্পাদক। জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি সম্পাদনার কলম দিয়ে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ঊনিশশ একানব্বই থেকে এক দশক সময় জাগো মুজাহিদ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, দুই হাজারের ডিসেম্বর থেকে দেড় দশক রহমত পত্রিকার সম্পাদক—উভয় মিলিয়ে ১৯৮৫ থেকে শুরু হয়ে চলমান প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের কর্মজীবনে পঁচিশটি বছরই কাটিয়েছেন এই ডেস্কে!
মনযূর আহমাদের জীবন শুরু হয়েছিল পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানী থানায়, নলবুনিয়ার বৌডুবী এলাকায়, ১৯৬৫ সালে। শৈশব-কৈশোরে পড়াশোনা করেছেন নিজ এলাকা বৌডুবীতে এবং পার্শ্ববর্তী বাদুরা মাদরাসায়। পরিণত পড়াশোনার জন্য গিয়েছেন গোপালগঞ্জের কাজুলিয়া মাদরাসায় এবং গওহরডাঙ্গা মাদরাসায়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় সমাপ্তি দিয়েছেন হাটহাজারী মাদরাসায়, ১৯৮৩-৮৪ শিক্ষাবর্ষে।
১৯৮৫ থেকেই শুরু হয় তার জীবন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ঢাকায় তার প্রথম আগমন ঢালকানগরের ছাপড়া মসজিদে। ভাগ্য পরীক্ষার প্রথমপর্বে এখানে তার হাত ধরেন অভিন্ন পথের সহযাত্রী মরহুম মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন। এখানে থেকে তিনি বাংলাদেশের ইসলামি আধুনিক রেনেসাঁর অগ্রদূত মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের একান্ত সান্নিধ্য অর্জন করেন এবং যুগের কিংবদন্তি অধ্যাপক আখতার ফারূকের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়ে কলমচর্চার সূচনা করেন। সেই কলম শানিত হয় অধ্যাপক আখতার ফারূকেরই সুদীর্ঘ সংস্পর্শে।
তার লেখালেখির প্রথম কীর্তি বিখ্যাত তাফসিরে ইবনে কাসিরের আংশিক অনুবাদ। এরপর চলতে থাকে তার কলম, অনবরত, আজ পর্যন্ত। তার ইদানীংকালের কীর্তি হল বিখ্যাত হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ রহমাতুল্লাহিল ওয়াসিয়াহ-এর অনুবাদ। এর মাঝে তিনি লিখেছেন অনেক—অনুবাদ, ইতিহাস, প্রবন্ধ। সেসবের কিছু প্রকাশিত, কিছু প্রকাশিতব্য। কিছু নামে, কিছু বেনামে।
তবে এসব কীর্তির চেয়ে তার বড়ো পরিচয়—তিনি একজন সফল সম্পাদক। অন্তরালোকসম্পন্ন সম্পাদক। শুধু পত্রিকারই নন, প্রতিষ্ঠিত অনেক তরুণ লেখকের জীবনেরও সম্পাদক তিনি। সেক্ষেত্রে তিনি একজন পিতৃসত্তাবান সম্পাদক হিসেবেই তাঁর পরিচয় উজ্জ্বল করেছেন। যার স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত সকল লেখক তাদের নৈকষ্য আড্ডায় খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে গর্বভরেই দিয়ে থাকেন।
মনযূর আহমাদকে সর্ববিচারে বলা যায় চেতনা ও শিল্পমগ্ন তারুণ্যের মুখপাত্র। জীবনের নানা ব্যস্ততার ফাঁকেও তিনি একজন মজলিশি মানুষ। তার মজলিশি স্বভাবে রয়েছে রসালাপ, রয়েছে তিক্ত তুখোড় বাস্তবতায় অনায়াস সমালোচনার শিল্প। জীবনের বেলাভূমিতে তিনি এখন বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে এক ধরনের অতিন্দ্রিয় সময় কাটাচ্ছেন—যা তার কাছে গেলে, একটু বসলে, খানিক আলাপ করলে বুঝা যায়।
আল্লাহ তাকে কবুল করুন। তার সকল কীর্তি ও প্রচেষ্টা কবুল করুন। জীবনকে তার জন্য সহজ করে দিন।
-আশরাফুল হক
শিক্ষক, লেখক।