24/09/2022
মাটি দিয়ে কেন প্রতিমা তৈরি হয়? সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কেন পূজা করে? অজ্ঞানীরা কেন প্রতিমা ভাঙ্গে?
সর্বংসহা অর্থাৎ কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া ছাড়া সব কিছুকে সহ্য করে মাটি। এই মাটির উপর কত কত অত্যাচার, অনিয়ম করে মানুষ। মাটি নির্লিপ্ত ভাবে সব কিছুকেই সহ্য করে। সন্তান মায়ের সাথে যেমনই আচরণ করুক না কেন? মা সন্তানকে স্নেহ প্রদান করতে কোন ধরণের কার্পণ্য করেনা, মাটিও তেমন। মাতৃ দুগ্ধ ছাড়া সন্তান বড় হতে পারেনা। প্রথম খাদ্যই মাতৃ দুগ্ধ। একই ভাবে মাটির অবদান ছাড়া মানব খাদ্য প্রাপ্ত করতে পারবে না। মা ও মাটি হলো প্রতিপালকের গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত। যুক্তিযুক্ত কারণে সনাতন ধর্মের অনুসারীরা মাটিকে বসুন্ধরা মা হিসাবে শ্রদ্ধাবনত হয়ে পূজা করে।
“মা দুর্গা” তিনি হলেন শক্তির প্রতীক। তিনি প্রকৃতি রূপে বিরাজিত থাকেন। তাঁর সাথে ইঁদুর থেকে সিংহ, আর্য অনার্য দেব দেবীরা থাকেন। দূর্বা ঘাঁস থেকে বট গাছের ব্যবহার হয় দুর্গা পূজায়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎসের জল ও মৃত্তিকার ব্যবহার ছাড়া দুর্গা পূজা হয়না। এক কথায় প্রকৃতি, মানব, জিবের সমন্বয়ে গঠিত ইকোসিস্টেমেরই পূজা এই দুর্গা পূজা।
এখন প্রশ্ন হলো পূজার প্রয়োজন হয় কেন? পূজা না করলে কী হয়?
শ্রদ্ধা না থাকলে মানব কোন বিষয়কেই মূল্যায়ন করে না। গুরুত্ব না বুঝে প্রয়োজনীয় সব কিছুকেই উজাড় করে ফেলে। যেমন ধরুন হিন্দুরা নদীকে দেবী বলে পূজা করে বলে নদীর জলকে নষ্ট করে না বা ময়লাযুক্ত করে না। কিন্তু দেখুন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নদী বুড়িগঙ্গা মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গা ছাড়াও অনেক শাখা নদী মৃত হয়েছে। অনেক নদী মৃত হওয়ার পথে রয়েছে। শ্রদ্ধা না থাকার কারণেই এই সমস্যা গুলি হচ্ছে। অথচ এই নদী না থাকলে মানব বসতির বিস্তার সম্ভব হতো না। জল ছাড়া জীবন সম্ভব নয়, মিঠা জলই আমাদের জীবনের প্রতীক। সুতরাং ইকো সিস্টেমকে অক্ষত রাখতে যে সব উপাত্ত গুরুত্বপূর্ণ সনাতন ধরমাবলম্বিরা সেই সব উপাত্তকে শ্রদ্ধার সাথে পূজা করে। গাছ, বাঁশ, প্রাণী পূজা হিন্দুরা করে বলে হিন্দুদের নানান ভাবে হেয় প্রতিপন্ন ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে দেখা যায়। অজ্ঞানতার কারণেই এমনটা করে ওরা। মানব প্রয়োজনকে বোধ না করে শ্রদ্ধাবান না হলে কোন কিছুকেই টিকেয়ে রাখে না।
ব্রহ্মাণ্ডের সব বস্তুতেই ব্রহ্ম অর্থাৎ ঈশ্বর বিরাজিত। ঈশ্বর নেই এমন কোন স্থান নেই। আমরা ছোট বেলা থেকে জেনেছি প্রানীর প্রাণ আছে জড় বস্তুর প্রাণ নেই। তথ্যটা সঠিক নয়। জড় বস্তুর মধ্যে চৈতন্য রয়েছে। চৈতন্যকে ইংরেজিতে Consciousness বলা হয়। অর্থাৎ সচেতনতা। জড় বস্তু নিজের আকৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সব সময় সক্রিয় থাকে। যদি কোন বস্তু নিজেকে সক্রিয় রাখতে না চায় তবে সেই বস্তু ব্রহ্মাণ্ড থেকে বিলীন হয়ে যাবে, অস্তিত্ব ধরে রাখতে হলে চৈতন্য থাকতেই হবে। এই চৈতন্য ব্রহ্মাণ্ডের শক্তির অংশ। সুতরাং এমন কোন বস্তু নেই যার মধ্যে চৈতন্য নেই। অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডের সব বস্তুই সক্রিয়। যেহেতু সব বস্তুতে ব্রহ্ম তথা ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান সেহেতু শ্রদ্ধা করতে দ্বিধা কোথায়? ঈশ্বরকেই শ্রদ্ধা করতে হবে সুতরাং তিনি সব স্থানেই বিরাজিত।
মানব, জীব, প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহ গঠিত হয় পাঁচটা মৌলিক উপাদান দিয়ে। উপাদান গুলি হলো ক্ষিতি (পৃথিবী বা মৃত্তিকা), অপ্ (জল), তেজঃ (আগুন), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ বা শূন্যস্থান)। এই উপাত্ত গুলিকে হিন্দুরা দেবতা বলে মান্যতা প্রদান করে এবং পূজাও করে। এই উপাত্ত গুলির শুদ্ধতা গুরুত্ব অপরিসীম।
সূর্য, চন্দ্র, বৃহস্পতি, নক্ষত্র, বসুন্ধরা, বায়ু, অগ্নি, জল, নদী, সমুদ্র, প্রকৃতিক, জ্ঞান-সঙ্গীত-সংস্কৃতি, চিকিৎসা, ধনসম্পদ সহ মানব, জীব ও প্রকৃতি সম্পর্কিত সব বিষয়কেই হিন্দুরা শ্রদ্ধা করে ও পূজা করে। এই উপাত্ত গুলি ছাড়া মানবের অস্তিত্বই থাকেনা। সুতরাং মানবের সার্থে মানব উপযোগী সব উপাত্তকেই মানবের শ্রদ্ধা করতে হবে। শ্রদ্ধা ও প্রয়োজন অনুভব করে ব্যবহারের নামই পূজা।
এখন প্রশ্ন; প্রতিমার প্রয়োজন হয় কেন? প্রতিমা ছাড়া কী শ্রদ্ধা করা যায় না?
যায়। অবশ্যই যায়। কিন্তু প্রতিমা সহ শ্রদ্ধায় অসুবিধা কোথায়? যাঁরা প্রতিমা ছাড়া শ্রদ্ধা করতে চান তাঁরাও সঠিক, যাঁরা প্রতিমা সহ করতে চান তারাও সঠিক। প্রধান উদ্দেশ্য প্রকৃতি বন্ধনা, সে আপনি অবয়ব দিয়ে করেন আর অবয়ব ছাড়া করেন অসুবিধা নেই।
স্বামী বিবেকানন্দকে প্রশ্ন করা হয়েছিল প্রতিমার প্রয়োজন কী? প্রতিমা তো প্রতীক। প্রতীক উপাসনার মাধ্যমে শ্রদ্ধা আসবে কী করে? যিনি প্রশ্ন করেছিলেন তাঁকে বলা হয়েছে আপনার পিতার ছবিটা দিন। তিনি দিলেন। এবার বললেন এই ছবিটাকে পায়ের নিচে রাখুন বা এতে থুথু ফেলুন। তিনি রেগে গেলেন। বললেন আপনি আমার পিতাকে অপমান করতে বলছেন কেন? স্বামীজী বলেছেন আপনার কথা অনুসারে এই ছবি তো আপনার পিতা নন, এটা তো প্রতীক বা একটা ছবি। তাহলে অসুবিধা কোথায় হচ্ছে? ঐ ব্যক্তি ঐ ছবিটাকে পায়ের নিচেও ফেলতে পারেননি, থুথুও ফেলতে পারেননি।
বাস্তবতা হলো প্রতীক শ্রদ্ধা, ভক্তিকে বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আবেশ ও অনুভূতিকে জাগ্রত করতে ভূমিকা রাখে। যেমন ধরুন তাজমহল খুবই সুন্দর শুনেছেন আর নিজে দেখেছেন এই দুয়ের তফাত বিস্তর। দেখে অনুভব করা আর না দেখে অনুভব করার ব্যবধান তাঁরাই কমাতে পারেন যারা নিজের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিকে জাগ্রত করতে পারেন। দীর্ঘ ও ধারাবাহিক আধ্যাত্মিক ও যোগ সাধনার মাধ্যমে পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জাগ্রত করা যায়। আয় রোজগার করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করার মানুষ গুলির পক্ষে পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জাগ্রত করা সম্ভব হয় না। এই কারণে তাঁদের জন্যে প্রতীক লাগে।
বট, অশ্বত্থ, নিম, দূর্বা ঘাস, আম, বেল, কদলী, ডমুর, বিভিন্ন জাতীয় ফুল ও ফল, বিভিন্ন উৎস যেমন ঝর্না, নদী, সমুদ্র, পুকুর, বৃষ্টি ও শিশির জল। বিভিন্ন উৎসবের মাটি। কর্পূর, ঘি, মধু, তেলের প্রদীপ প্রজ্বলন, ধুপ ও সংকেত হিসাবে বিভিন্ন বাদ্য যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে হিন্দুরা পূজা করে। উল্লেখিত সব উপাত্তই ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ। মানব, জীব ও উদ্ভিদের জীবনচক্র উপযোগী উপাত্ত। এইসবের ব্যবহারের মাধ্যমে পূজা করতে হবে, অর্থাৎ বিষয় গুলিকে সংরক্ষণ ও উপযোগী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কোন ভাবে অবহেলা, অযত্নে ধংস করা যাবে না। ধংস করলে নিজেদের ধংস নিশ্চিত হবে।
এই প্রতীক অর্থাৎ প্রতিমা নিজেকে বাঁচাতে পারবে না তো অন্যদের কী ভাবে সহায়তা করবে? এমন ধারণা থেকে অনেকেই প্রতিমা ভাঙ্গার কাজকে পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করেন বলে শুনেছি। মুস্কিল হলো উনারা প্রতিমা, প্রতীক ও প্রয়োজন কোন কিছুর মূল্য ও মূল্যায়ন সম্পর্কে অবগত নন।
প্রতীক কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝানো জন্যে রাষ্ট্র, জাতীয় পতাকা, সংবিধান, জাতীয় প্রতীক দিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে পারেন। জাতীয় পতাকা জাতিকে বাঁচাবে না, একটা কাপড়ের টুকরা ও রং দিয়ে তৈরি হয়। কাপড়ের টুকরা বা রং কাউকেই কোন ধরণের সহায়তা করতে পারবে না। কিন্তু এই জাতীয় পতাকাকে সামনে রেখে আমরা জাতিয়তাবোদ্ধে উদ্বুদ্ধ হতে পারছি এবং শক্তিশালী জাতি সত্ত্বা গঠন করতে পারছি। সুতরাং প্রতীক অনেক গুরুত্ব বহন করে এবং প্রয়োজনীয় প্রতিকের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হতে হয়।
এর পরও আপনার অবয়ব পছন্দ নয় তো আপনি তেমনই থাকুন কিন্তু যাঁদের পছন্দ তাঁদের বাধা দিবেন না বা বাধা দেয়ার অধিকার আপনার নেই। প্রতিমা ভেঙ্গে আপনি নিজের অযোগ্যতাকেই প্রমাণ করছেন।