03/11/2023
ইতিহাস
ডা. রিয়াদ শরীফ
সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর তাজউদ্দীন আহমেদ ছিল বন্ধুর মতো,,বয়সে দুই তিন মাসের ছোট বড় হবে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী নানান সময়ে নানা ক্ষেত্রে তাঁদের মতভেদ ছিল কিন্তু তাঁদের বন্ধূর্তে কোনদিন ফাটল ধরেনি,,এখন তারা জেলার ১ নাম্বার সেলে বন্দী।।তারা ছাড়াও আরও ৬ জন বন্দী ছিল তাদের সঙ্গী।।
মাঝে মাঝে দুজন গল্প করেন কিন্তু বেশির ভাগ সময় নিরাসক্ত দৃষ্টিতে বন্ধ সেলের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন,,হয়তো ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবেন কিম্বা তাঁদের প্রিয় মুজিব ভাইয়ের কথা ভাবেন,,
সৈয়দ নজরুল তাজউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন
-- উপরের দিকে তাকিয়ে কি দেখ তাজউদ্দীন?
কিছু দেখি না নজরুল ভাই,, ভাবি!!
-- ভাব? কি ভাব এ সময়ে,,
এইতো কত কিছু,,
--আচ্ছা তাজউদ্দিন ,মুজিব ভাইয়ের প্রতি তোমার কোন রাগ হয়?
রাগ!! রাগ কেন হবে,,!!
-- এই যে তোমাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিল,,
নাহ,,আমি জানতাম , কিছুদিন পর উনি ঠিকই আমাকে কাছে নিয়ে নিতেন ,,রাগ থাকলে তো আমি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকতাম,,তবে আফসোস হয় নজরুল ভাই, খুব আফসোস হয়,,
-- কি নিয়ে আফসোস ,,,মুজিব ভাই তোমাকে ভুল বুঝেছে সেজন্য,,উনি তো এমনই,,কিছুদিন পর ঠিকই বলতো,,এই চলে আয়, আজ তোকে নিয়ে দুপুরে ভাত খাব ,বিশাল বড় বড় কৈ মাছ রান্না হয়েছে,, আই খাবি ,, কৈ মাছের ঝোল দিয়ে,,,
সেটা আমি জানি ,,কিন্তু আমার আফসোস , যুদ্ধের নয় মাসের গল্প টা আমি মুজিব ভাইকে বলতে পারিনি,,উনি বলেছিল ,আমি শুনবো তাজ,,সব কথা শুনবো, কিন্তু সে সময় আর এলো না ,,মুজিব ভাই আর নেই
তাজউদ্দীন খুব শক্ত মানুষ ছিলেন , তবু তার চোখের কোনে অশ্রু,,
সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেটা না দেখার ভান করলেন,,
অশ্রু মুছে তাজউদ্দীন বললেন ,,আপনার আফোসস হয় কোন কিছু নিয়ে নজরুল ভাই,,??
-- না তাজউদ্দীন ,,আমার বড় কোন কিছু নিয়ে আর আফসোস হয় না ,খালি মনে হয় , দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজরুল ইসলাম বলেন ,একটি বার যদি নাফিসার রান্না করা পাবদা মাছ দিয়ে ভাত খেতে পারতাম,,
দুজনেই আবার চুপ করে যায়,,হয়তো ঘুমিয়েও পড়েলেন
কিন্তু ভোর রাতে জেলের ভিতর বেঝে উঠলো পাগলা ঘণ্টা
ভযঙ্কর সে ঘণ্টা,,জেলার আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান দৌড়ে গেলেন মূল ফটকে,,ফটকে দাড়িয়ে আছে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে এক দল ঘাতক,,,সবাই পার মাতাল,, যা করার এরা করবেই,,দরকার হলে ফটক ভেঙে,,
-- গেট খুলেন,,রাষ্ট্রপতির অর্ডার,,
নুরুজ্জামান তবু নিজে রাষ্ট্রপতি মোশতাক কে ফোন দিলেন,,
-- স্যার,,আমি আইজি প্রিজননুরুজ্জামান বলছি,,
আমি জানি সব,,ওরা যা করতে চায় তা করতে দিন,
রাষ্ট্রপতির কথার পর দ্বিতীয় কথা চলে না , তবু হতভম্ব নুরুজ্জামান বললেন,, স্যার এসব কি বলছেন??
যা বলছি , বোঝেন না ,,নাকি কানে কম শোনেন,,এই বলে রাষ্ট্রপতি ফোন রেখে দিলেন,,,
এদিকে পাগলা ঘণ্টার আওয়াজে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ দুজনেরই ঘুম ভেঙে গেল,,
-- এ কিসের ঘণ্টা তাজউদ্দীন,,,আমাদের মৃত্যুর ঘণ্টা !!
হতে পারে,,হওয়া খুব সম্ভব,,বুঝলেন নজরুল ভাই,,,,,,,
কথা শেষ করতে পারলেন না এরই মধ্যে ঘাতক রা ঢুকে গেল,,ছয় জনকে সরিয়ে নিয়ে গেল তারা,,
দুজন দুজনের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো,,মনে পড়ছে সেই পুরনো দিনের কথাগুলো ,,সেই মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকারের কথা,,
-- আমাদের বোধহয় সময় শেষ তাজউদ্দীন,,
না,, আরও কিছু সময় বাকি আছে,,জেলার ভিতর তো আর মারবে না,,এটা তো স্বাধীন দেশ,, জেলের ভিতর তো পাকিস্তানিরাও মারে নি,,
-- হু কোথায় মারে সেটাই ভাবছি,,
একটু পর ঘাতক রা কেপটেন মুনসুর আলী আর কামরুজ্জামান কেও নিয়ে এলেন,,
আহারে কত দিন পর দেখলেন মুনসুর আলী আর কামরুজ্জামান কে,,নজরুল ইসলাম ভাবছেন , কামরুজ্জামান এত শুকিয়ে গেল কেন?
চার নেতা,,তারা কত একসঙ্গে কত মিটিং করেছেন , খাওয়া দাওয়া করেছেন,,আবার উনারা একসাথে,,বহু দিন পর,,
কিন্তু সেটা ছিল কয়েক মিনিট ,,এরই মধ্যে সবার চোখ বাধা হয়ে গেল,,এক লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল চার জন যেন লেফ রাইট করবে,,,লেফ!! রাইট!! লেফ!! রাইট!!
আর অল্প কিছু মুহূর্ত,,সৈয়দ নজরুল ইসলাম দু হাত সামনের দিকে নিলেন,,,যেন ছুটে আসা বুলেট গুলো হাত দিয়ে থামিয়ে দিবে,,কিন্তু বুলেট আসলে কত স্পিডে যায়,,
নাফিসা যখন তার স্বামীর লাশটা পান তিনি দেখেন বুকের মধ্যে ছোট ছোট ছিদ্র,কিন্তু পিঠের দিকে বিশাল বিশাল গর্ত,,আসলে কত জোড়ে যায় বুলেট,,,তিনি পরম মমতায় পিঠের গর্তগুলো তে হাত দিলেন,,যেন হাত দিলেই গর্ত গুলো পুরন হয়ে যাবে আবার মাংস রক্ত দিয়ে,,
এদিক দিয়ে সবচেয়ে দুর্ভাগা ছিলেন তাজউদ্দীন,, ,,বুলেট উনার পেটে লেগেছিল,,রক্ত ক্ষরণ হতেই থাকে,,কিন্তু মৃত্যু তো হয় না উনার ,,ঘণ্টা খানেক ছিলেন তিনি এ যন্ত্রনা সহ্য করে,,রক্তক্ষরণ হতেই থাকে হতেই থাকে,,কত রক্ত থাকে একটা মানুষের? পাঁচ লিটার ? ছয় লিটার?
উনি অনেকবার বললেন ,পানি!! পানি!!,,
কে দিবে পানি!!আহারে,,
সেই সময় কি ভাবছিলেন তাজউদ্দীন ,,তার প্রিয়তমা স্ত্রী জোহরা বা রিপি, মিমি , রিমি নাকি সোহেলের কথা,,,
কষ্ট থেকেও লোকটা অভিমান ছিল আরও বেশি,,নয়টা মাস এত কষ্ট করলেন , সে স্বাধীন দেশে জেলের ভিতর এভাবে তাকে মরতে হবে,,,তবে কি তিনি স্বাধীনতায় অনিচ্ছুক কোন জাতির জন্য এভাবে কষ্ট করেছিলেন,,,?
সেদিন ১ নাম্বার সেলে নরক নেমে এসেছিল,,কি রক্ত!! গরু জবাই দিলেও কি এত রক্ত হয়,,
পরদিন ভোরে কিন্তু ঠিকই সূর্য্য উঠেছিল,,পূর্ব গগনের ভোরের মিষ্টি আভা ছড়িয়ে পড়েছিল,,কিন্তু যারা ভোর এনেছিল তারা নেই,,তাতে আকাশ বা সূর্য্যএর অবশ্য কিছু যায় আসে না,,,,