27/01/2020
১৯৭১ সালে ঢাকা ছিল সেক্টর-২ এর অধীনে আর সেক্টর-২ এর দায়িত্বে ছিলেন 'কে- ফোর্স' প্রধান মেজর খালেদ মোশারফ। পাকিস্তানি বাহিনী শুরু থেকেই চেষ্টা করছিল বহির্বিশ্ব কোনোভাবেই যেন বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম টের না পায়। ঢাকা ছিল বাড়তি নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টিত। কিন্তু ১৯৭১ সালের জুন মাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর মূর্তিমান আতংক হয়ে ওঠে মেজর খালেদ মোশারফের প্রতিষ্টিত আরবান গেরিলা দল 'ক্র্যাক প্লাটুন'। 'হিট এন্ড' রান পদ্ধতিতে যারা শুরু করেছিলেন পাকিস্তানি জানোয়ারদের বিরুদ্ধে এক 'সাইকোলজিক্যাল ওয়ার।' সারা ঢাকা জুড়ে ছোট বড় ৮২টি আক্রমণ পরিচালনা করে 'ক্র্যাক প্লাটুন'
শুরুটা ছিল ৯ই জুন হোটেল ইন্টারকনন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করে। মেজর খালেদ তাদের বলেছিলেন ঢাকার আশেপাশে গুলি আর বোমা ফাটিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করতে। সেখানে এই গেরিলা সদস্যরা সরাসরি নিরপত্তার চাদরে ঢাকা ইন্টারকনন্টিনেন্টালে গ্রেনেড ছুড়ে বসে। এ খবর পেয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ তার সহোযগী ক্যাপ্টেন এটি এম হায়দারকে বিড়বিড় করে বলেছিলেন “দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল"!
ধারণা করা হয় ক্র্যাক প্লাটু্নের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন শহীদ আবু বকর (১৯৫৩- ১৯৭১)। ১১ই আগস্ট হোটল ইন্টারকনন্টিনেন্টাল কেপে ওঠে ক্র্যাক প্লাটুনের দ্বিতীয় দফা আক্রমণে। সেদিন দূর্ভেদ্য ইন্টারকনন্টিনেন্টালের একতলার বাথরুমে 'প্লাসটিক এক্সপ্লোসিভ' (পি,কে) ভর্তি ব্রিফকেইস হাতে যে ছেলেটি প্রবেশ করেছিল সেই হল শহীদ আবু বকর আর সাথে ছিলেন নিয়ন সাইনের মালিক আব্দুস সামাদ। বাইরে গাড়িতে স্টেন গান হাতে অপেক্ষা করছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গোলাম দস্তগীর গাজী। টাইম বোম বিস্ফোরণে সেদিন তছনছ হয়ে যায় হোটেলের পুরো একতলা।
জুন মাস থেকে শুরু করে পুরো আগস্ট মাস ঢাকার পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘোল খাইয়ে রাখে দুধর্ষ ক্র্যাক প্লাটুন। ২৯ই আগস্ট রাতে সারা ঢাকা রেইড দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পনেরো জন ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যকে আটকে করে তার মধ্যে ছিলেন শহীদ আবু বকর-ও। তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলে। সেখানে ইন্টারোগেশনের নামে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। পাকিস্তানি আর্মি বার বার তাদের কাছে জানতে চায় কোথায় তারা অস্ত্র রাখে? কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। কেউ আর বেচে ফেরেননি। কেবল মনু নামের একজন গেরিলা পালাতে সক্ষম হন। শহীদ বদিউল আলমকে (শহীদ রুমির সহোযোদ্ধা) তিনি মৃত্যুর আগে অকুতোভয়ী কণ্ঠে বলতে শুনেছেন-
“আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। You can go to hell.”
১৯৭১ সালে আমার নানী শ্বাশুড়ি তার ছয় মেয়ে আর দুই ছেলেকে নিয়ে ধানমন্ডি- ৩১ নম্বর রোডের বাড়িতে থাকতেন। আমার শ্বাশুড়ির বয়স তখন ২২ বছর, আমার শাশুড়ি আর স্বামীর কাছে শুনেছি যে তাদের ধানমন্ডি ৩১ নাম্বার সড়কের বাড়িতেও আনাগোনা ছিল গেরিলাদের। বাড়ির ডান দিকে কক্রিটের স্ল্যাবে ঢাকা একটা হাইজ মতন ছিল (বাড়ি তৈরির সময় ইট ভিজানোর জন্য), সেখানে কয়েকবার তারা অস্ত্র লুকিয়েছিলেন। বিপদের সম্ভাবনা আছে জেনেও আমার নানী শ্বাশুড়ি যতটা সম্ভব তাদের সাহায্য করতেন। এমনকি মাঝে দুই দিন পাকিস্তানি আর্মি ধানমন্ডির বাসায় এসেছিল আমার মামা শ্বশুড়কে খুজতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই ঘটনার স্মৃতি চারণ করতে গেলেই আমার শ্বাশুড়ি ভয়ে শিউরে উঠতেন। টর্চার সেলের অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শহীদ আবুবকরদের মধ্যে কেউ যদি বলে দিতেন তারা কোথায় কোথায় অস্ত্র রাখেন, তাহলে আমার শ্বশুর বাড়ির সবাইকে পাকিস্তানি বাহিনী নিশ্চিত মেরে ফেলত। অজস্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা সেই সব অকুতোভয় বীর যোদ্ধার প্রতি যারা তাদের প্রাণের বিনিময়ে আমাদের দিয়েছেন প্রিয়জনের সাথে বেচে থাকার একটি স্বাধীন দেশ।
লেখক মোহাম্মদ এজাজ হোসেনে তার 'একাত্তর ও আমার শৈশব' বইয়ে শহীদ আবু বকরের ধরা পরার ঘটনা তুলে এনেছেন আবু বকরের বোন ডেন্টাল সার্জন ডা. সেলিনা খাতুনের জবানীতে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায়, অনন্যা প্রকাশনী প্যাভিলিয়ন '৫', এ পাওয়া যাবে, 'একাত্তর ও আমার শৈশব' ।
- ফাতিমা খানম সিন্থিয়া
প্রডিউসার, নৈঋত ফিল্মস
Director: S M Al Emran
DOP: Walle Bangali
Producer: Fatima Khanam Cynthia
Animation: Raihan Uddin Khan
Edit: Moshfiqur Rahman