29/12/2024
শাহাদাত হোসেন খান ফয়সাল রাহিমাহুল্লাহ: একটি আলোকিত জীবন
কর্মজীবন
শাহাদাত হোসেন খান ফয়সাল রাহিমাহুল্লাহর কর্মজীবন শুরু হয় ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ অ্যান্ড লিগ্যাল এইড সেন্টারের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে। তিনি প্রথমে একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হিসেবে লেখা শুরু করলেও অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে একজন গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইসলামী আইন সম্পর্কেও তিনি গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
পরবর্তীতে তিনি ড. সাইফুল্লাহ মাদানী হাফিজাহুল্লাহর প্রতিষ্ঠানে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইনস্টিটিউট ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চে গবেষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি গবেষণা কার্যক্রমের পাশাপাশি ফিকহ একাডেমির কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেন। এছাড়াও তিনি ড. সাইফুল্লাহ মাদানীর বিভিন্ন প্রোগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন।
তিনি কিছুদিন ইনসাইড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে তারবিয়া প্রশিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিয়েছিলেন। পরে তিনি মাদ্রাসাতুন নূরে প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দেন। কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি সমকালীন প্রকাশনে প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন। পাশাপাশি তিনি খাদেমুল হারামাইন আশ-শারিফাইন অ্যারাবিক সেন্টারের চেয়ারম্যান এবং বাংলা হাদিস ডাটাবেজ অ্যাপের সাথেও যুক্ত ছিলেন।
মাঠে ময়দানে
শাহাদাত ফয়সাল রাহিমাহুল্লাহ বক্তৃতায় ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। তার ভাষা ছিল সহজবোধ্য, সৎ এবং সাহিত্যিক সৌন্দর্যে ভরপুর। বিভিন্ন মসজিদে খুতবা দেওয়ার জন্য তিনি ঢাকার বাইরেও সফর করতেন। তিনি বংশাল কেউলারা জামে মসজিদে দীর্ঘদিন সাপ্তাহিক তাফসির প্রোগ্রামের দায়িত্ব পালন করেন।
তার উদ্যোগে পরিচালিত “এক মিনিটের মাদ্রাসা” কার্যক্রমটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
লেখক হিসেবে অবদান
ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। ছাত্রাবস্থায় তিনি তার প্রিয় প্রতিষ্ঠানে দেওয়ালিকা চালু করেন এবং বিভিন্ন রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। তার লেখার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমাজের জন্য সহজবোধ্য এবং প্রাসঙ্গিক। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বাংলা সাহিত্যে একজন লেখক প্রয়োজন, যিনি সহজ ভাষায় ইসলামের পক্ষে লিখে সমাজকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবেন।
গ্রন্থসমূহ:
১. গুনাহ মাফের উপায়: এটি তার একমাত্র মৌলিক গ্রন্থ। প্রথম মুদ্রণে আড়াই হাজার কপি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।
২. হতে চাই আলোকিত জ্ঞানী: সাড়ে ১১ হাজার প্রশ্নোত্তরের সংকলন, যা অধিকাংশ কাজ এবং সম্পাদনা করেন ড. মুসলেহ উদ্দীন।
৩. শিশু-কিশোরদের ইসলামী সাধারণ জ্ঞান: যদিও এটি প্রকাশিত হয়নি, এর পান্ডুলিপি প্রায় সম্পূর্ণ ছিল।
৪. তাহকিক মিশকাতুল মাসাবিহ: চার খণ্ডের অনুবাদ এবং সম্পাদনা পরিষদের একজন সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
৫. আল-মাওসূ‘আতুল ফিকহিয়্যাহ: ইসলামী ফিকহের বৃহৎ বিশ্বকোষ, যার অনুবাদ কার্যক্রমে তিনি অংশ নেন।
এছাড়া তিনি জীবন মরীচিকা, জীবন পথে সফল হতে, এবং ইসলামে সমাজ, জামাত ও সংগঠন গ্রন্থের সম্পাদনা করেছেন।
ব্যক্তিগত প্রভাব
তার একান্ত স্নেহপদ ভাই রবিউল্লাহ হাফিজাহুল্লাহ বলেন,
"মন-মগজে মেধায় মুসলেহুদ্দীন হাফিজাহুল্লাহকেই ধারণ করতেন। আমি বলতাম, ভাই, আমি কোনদিন আপনার মত হতে পারবো? তিনি বলতেন, ‘আমার মত নয়, ড. মুসলেহুদ্দীন হতে হবে।’ আমরাও ড. মুসলেহুদ্দীন হতে চাই।"
শাহাদাত হোসেন খান ফয়সাল রাহিমাহুল্লাহর মৃত্যু
ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালের শুরুর দিকে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কাশির সঙ্গে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, যা তিনি সম্ভবত লুকিয়ে রেখেছিলেন। অবশেষে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, সোমবার, সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি কালেমায়ে শাহাদাতাইন উচ্চারণ করে মুচকি হাসি দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেত্রিশ বছর।
একটি শোকাবহ বিদায়
শাহাদাত হোসেন খান ফয়সাল রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামিক শিক্ষার প্রচার এবং মুসলিম সমাজে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের প্রসারে কাজ করেছেন। তার মৃত্যু মুসলিম সমাজের জন্য একটি গভীর শোকের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মৃত্যুর পর, অনেকেই তাঁর শিক্ষণীয় জীবন এবং সমাজে তার অবদানকে স্মরণ করেন। তিনি ছিলেন একজন অসামান্য আলেম, যার জীবন ছিল পরিপূর্ণ ইসলামি আদর্শ, সৎ কর্ম, শান্তি, সহানুভূতি এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত।
একটি অনুপ্রেরণাময় জীবন
শাহাদাত ফয়সাল রাহিমাহুল্লাহ তার সাহসী ও প্রজ্ঞাময় দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বহু মানুষকে প্রভাবিত করেছেন। তার বিদায় মুসলিম সমাজে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, তবে তার শিক্ষা এবং আদর্শ চিরকাল বেঁচে থাকবে।
ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। তার শিক্ষা, আদর্শ এবং অবদান চিরকাল মুসলিম সমাজে বেঁচে থাকবে।
---
সাজিদুর রহমান
২৯/১২/২৪