14/05/2023
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট ও বিশ্ব মন্দায় আমাদের করণীয়।
করোনাভাইরাস মহামারি, খরা, তীব্র দাবদাহ এবং সর্বোপরি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই তেল ও গ্যাসের মূল্য অত্যাধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বালানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাদ্য, পরিবহন, পরিষেবা সবকিছুরই খরচ বেড়েছে। এক কথায় জীবনযাত্রার ব্যয় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেসব সামাল দিতে লোকজনকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। এর ফলে প্রায় সব দেশের সরকারের ওপরেই বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা গ্রহণ করছে জ্বালানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে ব্যয় সংকোচনের অভিনব সব কর্মসূচি।
যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সরকার জ্বালানি সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছে। জ্বালানি সংকট সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে ইউরোপে। ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে রাশিয়া নর্ড স্ট্রিম ওয়ান পাইপলাইন দিয়ে গ্যাসের সরবরাহ প্রথমে সীমিত এবং পরে পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে এই মহাদেশে জ্বালানির মূল্য হু হু করে বেড়ে যেতে শুরু করে।
ইতালি, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার গ্যাসের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। এর ফলে এসব দেশের সরকার জ্বালানির যাতে অপচয় না ঘটে তার ওপর অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
হিটার ও এসির ব্যবহার কমানো
এ বছরের শীত মৌসুমে গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমানোর এক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। একই সাথে ১ নভেম্বরের মধ্যে তাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত যাতে ৮০ শতাংশ পূর্ণ থাকে সেটাও নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
জার্মানি, ফ্রান্স ও স্পেনের সরকার জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়ে নতুন কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। এসব নির্দেশনায় সরকারি ভবনগুলোতে হিটিং সীমিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব আদেশে বলা হয়েছে সরকারি ভবনে শীত মৌসুমে তাপমাত্রা যাতে ১৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি না ওঠে।
যেসব ভবনে এয়ার কন্ডিশনার বা এসি ব্যবহার করা হয় সেসব ভবনের ভেতরে তাপমাত্রা কত হবেও সেটাও নির্ধারণ করে দিয়েছে ফ্রান্স ও স্পেনের সরকার। ফ্রান্সে এই তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ২৬ এবং স্পেনে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে বলা হয়। ফ্রান্সে যেসব দোকানপাটে এসি আছে সেগুলোর দরজা সবসময় বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই আদেশ ভঙ্গ করলে ৭৫০ ডলার জরিমানা করা হবে।
ফ্রান্সের সরকার মনে করে তারা যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে তার ফলে জ্বালানির ব্যবহার ১০ শতাংশ হ্রাস পাবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর জার্মানি যতটা নির্ভরশীল, প্রতিবেশি ফ্রান্স ততটা নির্ভরশীল নয়। ফ্রান্সে বিদ্যুতের ৪২ শতাংশ আসে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। তবে দেশটিতে এ বছর যে নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ ও খরা দেখা দিয়েছে, যার ফলে বেশ কয়েকটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রে চুল্লি ঠান্ডা রাখার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে এসব কেন্দ্রে বিদ্যুতের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা বলেছে, ইউরোপের দেশগুলোতে শুধুমাত্র হিটিং কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে রাখার মতো সাধারণ কিছু পদক্ষেপ নিলে অনেক জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব। এর পরিমাণ নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন দিয়ে শীতকালে সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসের সমান।
বাংলাদেশেও সরকারি ভবনে এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহার সীমিত করা এবং কর্মকর্তাদের স্যুট-টাই না পরে অফিসে আসারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বাতি নিভিয়ে রাখা
জার্মানি ঘোষণা করেছে যে, তারা রাতের বেলায় সরকারি ভবন ও স্মৃতিসৌধের মতো স্থাপনাগুলোতে আলো জ্বালাবে না। স্পেনের দোকানপাটেও রাত ১০টার মধ্যে বাতি নিভিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশেও জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে রাত ৮টার পর দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে, এর ফলে প্রতিদিন অন্তত দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব হচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টার পর বিদ্যুতের চাহিদা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বেড়ে যায়। এই পরিবর্তন মূলত হয় সন্ধ্যার পর বাতি জ্বালানোর কারণে। সন্ধ্যার পর বিদ্যুতের এই বাড়তি চাহিদা যে শুধু দোকানপাট চালু থাকার জন্য তৈরি হয় তা নয়, মানুষের ঘরবাড়ির বাতিও এর কারণ। তবে আমাদের হিসেবে, দোকানপাট বন্ধ থাকলে প্রায় অতিরিক্ত চাহিদার ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা সম্ভব।
এছাড়া জুলাই মাস থেকেই জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সীমিত করেছে বাংলাদেশের সরকার। ফলে বহু বছর পর বাংলাদেশে পুনরায় রেশনিং আকারে লোডশেডিং চালু করা হয়েছে।
কৃত্রিম বৃষ্টি নামানো
চীনের জ্বালানি সংকট ভিন্ন ধরনের। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চীনে রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ তেমন একটা বিঘ্নিত হয়নি, তবে দেশটি এ বছর ভয়াবহ রকমের তাপপ্রবাহ ও খরায় আক্রান্ত হয়। এর ফলে দেশটির নদী নালা শুকিয়ে গেছে যার প্রভাব পড়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ওপর।
উদাহরণ হিসেবে চীনের সিচুয়ান প্রদেশের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই শহরে যতো বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, তার ৮০ শতাংশই আসে জলবিদ্যুতের বাঁধ থেকে। কিন্তু নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে সেখানকার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিচুয়ান কর্তৃপক্ষ সব কলকারখানা ছয় দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়। একই সাথে বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর জন্য সিচুয়ান প্রদেশের সব অফিস এবং দোকানপাটকে বাতি না জ্বালানোর পাশাপাশি এসি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রতিবেশী চংকিং রাজ্যেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় চীনের কৃষি মন্ত্রণালয় কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি নামানোর এক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে। এই প্রক্রিয়ায় আকাশে মেঘের ভেতরে কিছু রাসায়নিক পদার্থ পাঠানো হয় যা বৃষ্টিপাত ঘটায়। তবে কবে এটা করা হবে এবং কোথায় করা হবে এসব বিষয়ে এখনো বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হয়নি।
কম কাজ করা
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে পাকিস্তানের সরকারি অফিসে কাজের সময় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। জুন মাসে তারা ঘোষণা করে যে, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এখন থেকে সপ্তাহে ছয় দিনের পরিবর্তে পাঁচ দিন কাজ করবেন। কিন্তু এর মাত্র কয়েক মাস আগে দেশটির নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তাদের কার্যকারিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই পাকিস্তানে এতো গরম পড়ে যে, একপর্যায়ে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে পৌঁছায়। এর ফলে দেশটির বিদ্যুৎ সরবরাহের জাতীয় গ্রিডে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়।
একই সময়ে সারা বিশ্বে জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। এর ফলে দেশটিতে এখন শুক্রবারে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বাড়ি থেকে কাজ করার এক পরিকল্পনাও বিবেচনা করা হচ্ছে।
জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশেও অফিসের সময়সূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন নিয়ম অনুসারে এখন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত অফিস সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকছে। ব্যাংক খোলা থাকবে সকাল ৯টা থেকে ৪টা পর্যন্ত।
স্কুল ছুটি
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মঘণ্টা কমানোর পাশাপাশি বাংলাদেশের সব স্কুল কলেজের সাপ্তাহিক ছুটিও এক দিন বাড়ানো হয়েছে। এতদিন এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু শুক্রবারে বন্ধ থাকত। কিন্তু এখন শনিবারেও বন্ধ রাখা হয়েছে। দেশের সব সরকারি স্কুল ও কলেজসহ অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও সপ্তাহে এক দিন ছুটির নিয়ম মেনে চলে। তবে কিছু কিছু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় সপ্তাহে দুই দিন ছুটি দিয়ে থাকে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করার কথা আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য এখন থেকেই তা কার্যকর করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলএনজির ওপর নির্ভরশীল।
জ্বালানির বিভিন্ন ধরনের মধ্যে এলএনজি অনেক বেশি ব্যয়বহুল। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে সম্প্রতি সরকার ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল বা কেরোসিনের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি করে।
পরমাণু বিদ্যুৎ
জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় কোনো কোনো দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় ফিরে গেছে। জার্মানিতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প পুনরায় চালু করা হয়েছে। অথচ জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকানোর লক্ষ্যে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন কমাতে উন্নত দেশগুলো কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার কথা ঘোষণা করেছিল। এ বছরের জুন মাসে ভারত থেকে সারা বিশ্বে যে পরিমাণ কয়লা রফতানি করা হয়েছে তা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এর আগে ভারত সরকার কয়লা রফতানি কমিয়ে আনার কথা বলেছিল।
এর বিকল্প চিন্তাভাবনাও আছে কোনো কোনো দেশের। তাদের একটি জাপান। প্রায় ১১ বছর বিরতির পর দেশটি নতুন নতুন পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার জের ধরে জাপানে এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। জাপানে কর্তৃপক্ষ এখন এসব কেন্দ্র পুনরায় চালু করার কথা বিবেচনা করছে।
সূর্যের আলো
বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করছেন বর্তমান এই সংকটের কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে ফ্রান্স বায়ু-শক্তি থেকে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর এক পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং চীনের মতো দেশ সৌরশক্তির ওপর জোর দিচ্ছে। তারা তাদের নাগরিকদের উৎসাহিত করছে বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল বসানোর জন্য। বাড়ির ছাদে উৎপাদিত এই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডের জন্য বিক্রি করার ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে এখন নীতিমালাও তৈরি করা হচ্ছে।
চলমান জ্বালানিসংকট বিবেচনায় বাংলাদেশকে এলএনজির মতো জীবাশ্ম জ্বালানিতে নয়, বরং আসন্ন বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য শক্তি ও দেশীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জোর পরামর্শ দিয়েছেন টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা।
অনেক বছর পরে আমরা টের পাচ্ছি জ্বালানিনিরাপত্তা না থাকলে কী হয়। দেশজুড়ে লোডশেডিং হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এতে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। একই সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়েও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে কখন আমরা একটু ভালো পরিস্থিতিতে যাব, তা অনিশ্চিত। আবার শীত এলে যদি পরিস্থিতির একটু উন্নতিও হয়, এরপর আমরা যে আবার জ্বালানি নিয়ে বিপদে পড়ব না, তা কিন্তু নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারছে না। বাংলাদেশ জ্বালানিতে ঐতিহাসিকভাবেই দেশীয় উৎসনির্ভর ছিল। দেশীয় জ্বালানিতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে আমাদের গ্যাসের মজুত কমে আসায় আমদানিনির্ভরতা বাড়তে থাকে।
দেশের চলতি গ্যাস মজুত যখন কমে আসছিল, তখন সুযোগ থাকলেও নতুন গ্যাস মজুতের অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতেই সরকার বিনিয়োগ করেছে। একই সঙ্গে উৎপাদনের দিক থেকে বিদ্যুতের একটি অতি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ধরে কাজ করেছে সরকার। উল্লেখ্য, আট জেলায় বর্তমানে ২০টি এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যেগুলোর স্থাপিত ক্যাপাসিটি ১৩,৯৫৫ মেগাওয়াট এবং মেয়াদকালীন ক্যাপাসিটি চার্জ নূন্যতম ৯,৭৭৩ মিলিয়ন ডলার।
এর ফলে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উপাদনের জন্য অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয় করতে গিয়ে জ্বালানি আমদানি করতে হয়েছে , এর মধ্যে এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎও রয়েছে। আর তখনই আমদানি নীতি একটি দেশের জন্য ভালো, যখন বৈদেশিক রিজার্ভ ভালো থাকে, ডলারের মূল্য এবং জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল থাকে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, করোনার পরে এই তিনটি বিষয়ই বেশ খারাপ পরিস্থিতিতে চলে গেছে। করোনা–পরবর্তী ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশ্বে জ্বালানির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনকারীরা এর দামও বাড়িয়েছে। এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় জ্বালানির একটি বড় উৎসও বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি ডলারের বাড়তি দামের জন্য বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশকে এলএনজি আমদানির জন্য বাড়তি চাপে পড়তে হয়েছে। জ্বালানি–সংকট দ্রুত শেষ করা গেলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে যে চাপ ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০২১ সাল পর্যন্ত বেসরকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে মোট ৭১,৫৬৭ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে। আর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সর্বশেষ প্রস্তাবনা অনুযায়ী ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানিকৃত এলএনজি জাতীয় গ্রিডে দৈনিক যুক্ত করলে বর্তমান অর্থবছরেই সরকারি ভর্তুকি দাঁড়াবে ২৫,০০০ কোটি টাকা।
দেশের বর্তমান জ্বালানিসংকটের জন্য কি বৈশ্বিক সংকটই দায়ী? নাকি আমাদেরই অনেকগুলো ভুল ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে ইজাজ হোসেন বলেন, ‘আসলে বৈশ্বিক সমস্যার আগেই আমাদের পিঠ দেয়ালে প্রায় লেগেই গিয়েছিল। আর এখন আমরা নিরুপায়, স্বাভাবিকভাবে সংকটগুলোকে সামাল দিতে পারছি না। আমাদের যে গ্যাস মজুত আছে, সেটা তো অনুসন্ধান করে বের করতে হবে। কিন্তু আমরা সেটা করিনি।’ তিনি জ্বালানি খাতের চলমান চাপের কারণ হিসেবে শতভাগ বিদ্যুতায়নের বিষয়টিও উল্লেখ করেন।
সম্প্রতি এলএনজির বিশ্ববাজারে ইউরোপ প্রবেশ করায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ দামের দিক থেকে বেশ প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে। ইতিমধ্যে বলা হচ্ছে স্পট মার্কেটে এলএনজি নেই এমনকি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ২০২৫ সালের আগে উৎপাদনকারীরা সরবরাহ দিতে পারবে না। অপরদিকে ইউরোপে শীতে গ্যাসের চাহিদা যখন বাড়বে, তখন বাংলাদেশ গ্যাসের প্রাপ্তি নিয়ে আরও ঝুঁকিতে পড়বে। এর ফলে আমরা যে হারে এলএনজি আমদানি করি সেটা সম্ভব হবে না, দামের দিক থেকেও ঝুঁকি থাকবে। সব মিলিয়ে আগামী ছয় মাস জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশের ঝুঁকি থাকছে। ২০১০ সালের বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনায় যে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি, সেটা উল্লেখ করেন তিনি।
পরে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যোগ করেন, ‘জ্বালানি খাতে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা টেকসই উন্নয়নবিষয়ক যেকোনো আন্তর্জাতিক সেমিনারের আগে নবায়নযোগ্য শক্তিতে তাঁদের পরিকল্পনা, লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। কারণ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নবায়নযোগ্য শক্তির বিভিন্ন অসত্য তথ্য তুলে ধরে এর কোনো সম্ভাবনা নেই বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাস্তবে এর কোনো প্রয়োগও করছেন না।’ তিনি মনে করিয়ে দেন যে নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা এখন ২০৩০–এ গিয়ে ঠেকেছে।
খুব উল্লেখযোগ্য না হলেও জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারকেরা এখন নবায়নযোগ্য শক্তির গুরুত্ব অনুধাবন করছেন। সে জন্য আমাদের সংশ্লিষ্ট নীতিতে সব ধরনের অসামঞ্জস্য এখনই দূর করতে হবে। পাশাপাশি জীবাশ্ম জ্বালানির বিনিয়োগ থেকে বেরিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগকে গুরুত্ব নিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে আগ্রহ দেখাতে হবে।’ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম চলতি সংকটকে একধরনের সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
অনুষ্ঠানের শেষে বর্তমান সংকট বিবেচনায় সরকারের টেকসই সমাধানের সম্ভাব্য উদ্যোগ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন বলেন, এ নিয়ে সংশয় কিছুটা থেকেই যায়। তবে ইতিমধ্যে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ও নবায়নযোগ্য শক্তির দিকেও নজর দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আমদানিকৃত জ্বালানির চেয়ে বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ তুলনামূলক কম।
জ্বালানি সংকট: আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বিশ্ব পরিস্থিতি
বিশ্বব্যাপী চলমান জ্বালানি সংকটে হু হু করে বাড়ছে তেল-গ্যাসের দাম, যার প্রভাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহে। তবে এই সংকটের এখানেই শেষ নয়। অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) প্রধান। সিডনিতে একটি বৈশ্বিক জ্বালানি সম্মেলনে অংশ নিয়ে আইইএ’র নির্বাহী পরিচালক ফাতিহ বিরল বলেছেন, গভীরতা ও জটিলতার দিক থেকে এত বড় জ্বালানি সংকট এর আগে দেখেনি বিশ্ব। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়তো এখনো আসেনি। এটি সারা বিশ্বকেই ভোগাচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে টালমাটাল বৈশ্বিক জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা। ওই সময় বিশ্বের বৃহত্তম তেল-গ্যাস রপ্তানিকারক ও নিত্যপণ্যের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী ছিল রাশিয়া। বিরল বলেন, মূল্যবৃদ্ধির ফলে গ্যাসের ট্যাংক ভরা, ঘরবাড়ি গরম রাখা ও শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহের খরচ সারা বিশ্বেই বাড়ছে, যা মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এর ফলে আফ্রিকা থেকে শ্রীলঙ্কায় প্রাণঘাতী বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে।
আইইএ প্রধান আরও বলেন, ১৯৭০-এর দশকের তেল সংকট যেমন জ্বালানি সক্ষমতা ও পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বাড়াতে প্ররোচিত করেছিল, তেমনি এবার হয়তো পরিশুদ্ধ জ্বালানিতে স্থানান্তরে আরও দ্রুত সরকারি নীতি গ্রহণ দেখতে পারে বিশ্ব। তিনি বলেন, ইউরোপে এবারের শীতকাল খুব, খুব কঠিন হবে। এটি একটি বড় উদ্বেগ, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।
একই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি মন্ত্রী জেনিফার গ্রানহোম বলেন, বৈশ্বিক জ্বালানি খাতের বিশৃঙ্খলায় জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। বিশ্বব্যাপী পরিশুদ্ধ জ্বালানির জন্য আমাদের পদক্ষেপ হতে পারে সর্বশ্রেষ্ঠ শান্তি পরিকল্পনা। আমরা শুদ্ধ জ্বালানি চাই এবং তা দরকার। তিনি বলেন, এক প্রভাবশালী জ্বালানি সরবরাহকারী- রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে পরিশুদ্ধ জ্বালানিতে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে দেশগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে। গ্রানহোম বলেন, চীন অনেক প্রযুক্তি ও সাপ্লাই চেইন নিয়ে কাজ করছে। আমরা যদি নিজস্ব সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি না করি তাহলে সেটি আমাদের দুর্বল করে দিতে পারে।
আইইএর তথ্যমতে, সৌরবিদ্যুতে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থার শতকরা ৮০ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে চীন। ২০২৫ সাল নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৯৫ শতাংশ। এছাড়া লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি খাতে বেশিরভাগ আধিপত্য চীনের, বায়ু টারবাইনের অন্যতম প্রধান উৎপাদক তারা এবং খুব শিগগির পরিশুদ্ধ হাইড্রোজেন প্রযুক্তি সক্ষমতা তৈরিতেও কাজ করছে দেশটি।
ইউনির্ভাসিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের অধ্যাপক মার্টিন গ্রিন মনে করেন, চীনের জিনজিয়াং অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ এবং উচ্চ-কার্বন শক্তি দিয়ে তৈরি পণ্য আমদানিতে ইউরোপের ট্যাক্সসহ বিভিন্ন বিষয় ভারতের মতো উৎপাদকদের জন্য সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনার সুযোগ করে দিয়েছে।
ফোরামে অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি মন্ত্রী ক্রিস বোয়েন বলেন, টেকসই পরিশুদ্ধ জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করে আমরা আমাদের অর্থনীতিকে পরবর্তী সংকটের ধাক্কা থেকে রক্ষা করতে পারি। তবে তার জন্য আমাদের হাতে নষ্ট করার মতো সময় নেই।
জ্বালানির এ সমস্যাটা মূলত পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যা। বিশ্বের সব অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য মাথাপিছু জ্বালানি ব্যবহার বা আদতে মাথাপিছু সম্পদ পর্যাপ্ত পরিমাণে বেশি থাকতে হয়। এর বিপরীত হলেই, সভ্যতা হয়ে ওঠে পতনোন্মুখ। ইতিহাসও তা-ই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি শেষের পথে, কিন্তু কোনো রাজনীতিবিদ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সত্যটুকু বলতে চান না। আসল ঘটনা হলো, আমরা ইতোমধ্যে তেল, কয়লা, ও প্রাকৃতিক গ্যাসের সমাপ্তির দিকে এগোচ্ছি। কারণ অবশ্য মজুত ফুরিয়ে যাওয়া নয়, বরং এগুলো মাটির নিচ থেকে উত্তোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ খরচ দিন দিন এমনভাবে বাড়ছে, যা এগুলি থেকে পাওয়া লাভের তুলনায় ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
অর্থাৎ, ফুরিয়ে আসছে কম খরচে উত্তোলনযোগ্য মজুত। অন্যদিকে সৌরশক্তি বা অন্য যেকোনো 'ক্লিন এনার্জি'র পক্ষেও তাদের বর্তমান উৎপাদন সক্ষমতায় জীবাশ্ম জ্বালানিগুলোর প্রতিস্থাপক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত নেই। রাজনীতিবিদেরা তাই সরাসরি বলতে পারবেন না যে বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনীতি ধ্বংসের পথে যাচ্ছে। বরং তারা সাধারণের সামনে নিজেদের কর্তৃত্ব নিয়ে একটি বিভ্রম তৈরি করে রাখেন।
বিশ্বের নাগরিকদের চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে মনোভাব ভীষণ নিচু। মিশিগান বিশ্বিবদ্যালয়ের বৈশ্বিক ভোক্তাদের ওপর করা এক জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০০৮-২০০৯ সালে বৈশ্বিক মন্দার সময়ের চেয়েও মানুষের এখনকার মনোভাব অনেক নিম্নস্তরে অবস্থান করছে। ৪৮ শতাংশ মানুষ তাদের জীবনমান কমে যাওয়ার পেছনে মূল্যস্ফীতিকে দায়ী করছেন।
ইউরোপের পরিস্থিতি করুণ। এ শীতে 'অন্ধকারে জমে যাওয়া'র আশঙ্কায় আছেন এখানকার অনেক নাগরিক। ডলার আর ইউরোর দাম কাছাকাছি হয়ে যাওয়ায় এখানে তেলের দাম ইউরোতে ২০০৮ ও ২০১২ সালের মতো হয়ে গেছে। রাশিয়া থেকেও প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ আগের চেয়ে কমে গেছে। আর্জেন্টিনা, ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, তুরস্ক, জাপান, ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অনেক দেশের মুদ্রার মান ডলারের সাপেক্ষে কমে গেছে। চীনের কন্ডোমিনিমাম বাসস্থান প্রকল্পও সংকটের মুখে পড়েছে। এই সংকট সরাসরি আঘাত করতে পারে দেশটির ব্যাংকিং শিল্পে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ও ইউরোজোনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এতসব সমস্যার মাঝেও সুদহারের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াচ্ছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে এভাবে ইন্টারেস্ট রেটও বাড়লে ভোক্তাকে খরচ আরও কমিয়ে দিতে হবে, যার ফলে তৈরি হবে মন্দা'র পরিস্থিতি।
এনার্জির অপর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমস্যা বিষয়ে কিছু বলবেন না রাজনীতিবিদেরা , রাজনীতিবিদেরা চান বারবার ক্ষমতায় আসতে। সেজন্য তাদের লক্ষ্য হয়, নাগরিকদের বোঝানো সবকিছু ঠিক আছে। জ্বালানির সমস্যা থাকলেও সেটাকে সাময়িক বলে চালিয়ে দিতে চান। ইউক্রেনের যুদ্ধ এ সুযোগটা করে দিয়েছে। যেকোনো নতুন সমস্যাকেই তারা আইন করে বা ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেন।
ব্যবসায়ীরাও চান, সমস্যা যেন ন্যূনতম হিসেবে প্রকাশ পায়। তারা চান, তাদের ব্যবসায় চালু রাখতে; মিডিয়া যেন অর্থনৈতিক সমস্যাকে বড় করে না দেখায়, সে ব্যবস্থা করতে।
সমস্যাটি পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গেও সম্পর্কিত
এনার্জির 'খরচে'র মাধ্যমে অর্থনীতি বড় হয়। খাবার হজম হয়ে দেহে শক্তি উৎপাদন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, বিদ্যুৎ ব্যবহার করে আলো জ্বালানো; সবই এই খরচ প্রক্রিয়ার অংশ। তাই এনার্জির ব্যবহার ও বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি একে-অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর এনার্জির ব্যবহার কমে গেলে সংকুচিত হবে বৈশ্বিক অর্থনীতিও।
পদার্থবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখতে গেলে, এই খরচ ব্যবস্থাটির একটি সীমিত আয়ু রয়েছে। তবে এ তথ্যটি এখনো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। একারণে অর্থনীতির একজন গবেষকের পক্ষে পদার্থবিজ্ঞান বোঝা বা এটি অর্থনীতিতে কীভাবে ব্যবহার করা যায়- তা জানা সম্ভব নয়।
অর্থনীতি যে একটি খরচ-কাঠামো, তা ১৯৯৬ সালের আগে কেউ বুঝতেও পারেননি। জ্ঞানের একাধিক বিভাগকে এভাবে একত্রিত করে কোনো সমস্যাকে বিশ্লেষণ করতে যথেষ্ট সময়েরও প্রয়োজন হয়।
অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই অনেকের মাঝে
ক) অর্থনীতির প্রমিত মডেলের ধারণা অনুযায়ী, এনার্জির সরবরাহ না বাড়লেও অর্থনীতির ক্রমাগত প্রবৃদ্ধি হতে পারে। কারণ, যখন অর্থনীতির মডেলে কেবল শ্রম আর পুঁজিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তখন এনার্জির সরবরাহের কোনো প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নেওয়া হয় না।
খ) মানুষ এটা বুঝতে পারে যে, আইন করে বাড়িভাড়া নির্দিষ্ট করে দিলে নতুন বাড়ি তৈরি বন্ধ হবে। কিন্তু, জীবাশ্ম জ্বালানির দাম কমিয়ে রাখার জন্য নেওয়া ব্যবস্থাগুলোর ক্ষেত্রে তারা একই সংযোগ খুঁজে পায় না।
জীবাশ্ম জ্বালানির দাম কমানোর চেষ্টা করা হলে আমাদের এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, এতে জ্বালানি উত্তোলনের খরচ বেড়ে যাবে। বর্তমানে দাম তুলনামূলক বেশি হলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেলকূপের মালিকেরা উত্তোলনের জন্য এখন আর অর্থ বিনিয়োগ করছেন না। কারণ এর জন্য তাদেরকে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। আর নতুন করে বিনিয়োগের যে খরচ, তা তেল বিক্রি থেকে উঠে আসবে না।
গ) বিশ্বে এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির ভূগর্ভস্থ মজুতের পরিমাণ কম নয়। কিন্তু সেগুলো উত্তোলন করার যে খরচ তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উত্তোলন খরচ বেড়ে গেলে জীবাশ্ম জ্বালানি ও এটি থেকে তৈরি পণ্যের দামও বাড়াতে হবে। কিন্তু দাম বাড়লে আবার চাহিদা কমে যাবে।
ঘ) 'চাহিদা' কীভাবে কাজ করে তা নিয়েও মানুষের মধ্যে পরিষ্কার ধারণা নেই। প্রায় গবেষক ও সাধারণ মানুষ মনে করেন, জ্বালানি পণ্যের চাহিদা সবসময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঁচুতে থাকবে।
বিশ্বে এখনো কয়েকশ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের মাঝে জীবনযাপন করেন। তারা যদি ন্যূনতম মৌলিক চাহিদাগুলোর বাইরে আর কিছু ক্রয় করতে না পারেন– অর্থাৎ তাদের দিক থেকে যদি চাহিদা কমে যায়– তাহলে পণ্যের দামও এত কমে যাবে যে, কেউ আর নতুন করে বিনিয়োগের আস্থা পাবে না।
যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে নাইট্রোজেন সার তৈরি করা হয়। সারের দাম বাড়লে, কৃষক সারের ব্যবহার কমিয়ে দেন। ফলে ফসলের পরিমাণও কমে যায়। এতে করে, পরোক্ষভাবে পুরো খাদ্যপণ্য খাতের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। আর এ আন্তঃসংযোগটি অর্থনীতিবিদেরা তাদের অর্থনীতির মডেলগুলোতে বিবেচনা করেন না।
ঙ) এক ধরনের এনার্জিকে অন্য ধরন দিয়ে সহজে প্রতিস্থাপন করা যায় না। 'এনার্জি রিটার্ন অন এনার্জি ইনভেস্টেড' এ জনপ্রিয় অনুমানটি সত্য নয়। যেমন প্রচলিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে বায়ুবিদ্যুৎ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যাবে না। কারণ বায়ুবিদ্যুৎ একটি অনিশ্চিত ব্যবস্থা।
শীতকালে যখন সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাবে না বা কম উৎপাদিত হবে, তখন সেই ঘাটতিটুকু জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে মেটানোর কথা অনেকে বলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হলো জীবাশ্ম জ্বালানিকে তখন সারাবছরব্যাপী চলমান থাকতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হবে- দক্ষ জনবল, পাইপলাইন, ও জ্বালানি স্টোরেজ। অর্থাৎ, তখন বিদ্যুতের জন্য একক ব্যবস্থার বদলে দুইটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি ও বৈশ্বিক রাজনীতিবিদেরা জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য বায়ু ও সৌরশক্তি ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি বেশি ব্যবহারের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমে গেলে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে চিন্তিত; দুপক্ষই প্রস্তাবটির অনুমোদন দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
ধনী ও শক্তিশালী পক্ষগুলো এ পরিবর্তনকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে, যদি তারা এটি থেকে লাভবান হতে পারে। পর্যাপ্ত জ্বালানি না থাকলে, পারিশ্রমিক ও সম্পদের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে যাবে। এছাড়া রাজনীতিবিদেরা মনে করেন, যদি তারা নাগরিকদের কম জ্বালানি খরচ করেও পরিচালনা করতে পারেন, তাহলে জনগণের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়ে যাবে।
এনার্জির ব্যবহার কমানোর একটি উপায় হলো- কোনো এলাকা বন্ধ করে দেওয়া, যেমনটা কোভিড-১৯ ছড়ানো বন্ধ করতে চীন করছে। এ ধরনের শাটডাউনকে যেমন রোগ না ছড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়, তেমনিভাবে এগুলো ব্যবহার করে বৈদ্যুতিক ব্ল্যাকআউট হওয়ার মতো সমস্যাও প্রতিরোধ করা যায়।
আমরা বাস করছি অস্বাভাবিক এক সময়ে, জ্বালানি সংকট বিষয়ে ধুলো দেওয়া হচ্ছে আমাদের চোখে
বিশ্বের সামরিক বাহিনীগুলোও ঠিকই জানে জ্বালানি পরিস্থিতির আসল রূপ। এর মানে হচ্ছে, বিশ্ব একে-অপরের সঙ্গে কে কত বেশি এনার্জি সংগ্রহ করতে পারে তা নিয়ে ভবিষ্যতে প্রতিযোগিতায় নামবে। এ ধরনের যুদ্ধসম পরিবেশে যদি তথ্যপ্রবাহও নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। বিভিন্ন দেশের সরকার আর প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই ঠিক করে দেবেন সাধারণ নাগরিকেরা কী ধরনের তথ্য, দর্শন, ও আদর্শ নিয়ে জানতে পারবে।
Collected.