
01/02/2025
বাঙালি না বাংলাদেশি: পরিচয়ের সন্ধানে
আমাদের দেশে একদল বলে, "আমরা বাঙালি", অন্যদল বলে, "আমরা বাংলাদেশি"। দলাদলির মাঝে নতুন প্রজন্মের একটাই প্রশ্ন, "আমরা আসলে কে?"
এই প্রশ্নের কোনো একক উত্তর নেই। বরং আমরা দুটোই—আমরা বাঙালি, আমরাই বাংলাদেশি। অনেকে মনে করেন, "বাঙালি" শব্দটি একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শব্দ। কিন্তু ভাষার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এটি নিছক সাংস্কৃতিক পরিচয়, কোনো ধর্মের নয়।
ভাষার বিবর্তন ও পরিচয়ের বিকাশ:
বাংলা ভাষার উৎপত্তি পূর্ব ইন্দো-ইউরোপীয় বা পূর্ব ইন্দো-আর্য ভাষা গোষ্ঠী থেকে। বাংলা, ওড়িয়া, অহমিয়া, ভোজপুরি ও হালবি ভাষা একসঙ্গে বিকশিত হয়েছে। প্রাচীনতম বাংলা গ্রন্থ "চর্যাপদ"-এ বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ পাওয়া যায়, যা ভাষার ক্রমবিকাশের প্রমাণ।
বাংলা ভাষায় সংস্কৃত, প্রাকৃত, আরবি-ফারসি (আফা), এবং ইউরোপীয় শব্দের প্রভাব লক্ষণীয়।যেমন:
সংস্কৃত > প্রাকৃত > তদ্ভব শব্দ: মৎস্য → মচ্ছ → মাছ।
ফারসি শব্দের প্রভাব: ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পর ফারসি ৬০০ বছরের বেশি সময় বাংলার রাষ্ট্রভাষা ছিল। ফলে বাংলা ভাষায় প্রচুর ফারসি ও আরবি শব্দ যুক্ত হয়, যা আজও বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে।
কিছু মানুষ মনে করে, বাংলা ভাষা থেকে ফারসি-আরবি শব্দ বাদ দিলে এটি খাঁটি থাকবে। কিন্তু বাস্তবে, যদি এসব শব্দ বাদ দেওয়া হয়, তাহলে ভাষা অনেক দুর্বল হয়ে পড়বে। যেমন:
"পড়াশোনার শুরুতে কলম, খাতা, বই, কাগজ, দোয়াত প্রয়োজন।"
এখানে "কলম", "নাম", "ফি", "আইন", "কিতাব" সবই ফারসি শব্দ, যা বাংলা ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
বাঙালি পরিচয়ের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা:
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, নূহ (আঃ)-এর পুত্রদের মধ্যে হামের বংশধর ভারতীয় উপমহাদেশে বসতি স্থাপন করে। তাঁর একজন বংশধর বঙ্গ নামের ব্যক্তি ছিলেন, যাঁর নামানুসারে "বঙ্গ" অঞ্চলের উৎপত্তি হয়।
মুসলিম শাসকরা "বঙ্গ" শব্দের সঙ্গে ফারসি প্রত্যয় "আল" যুক্ত করে "বাঙাল" বা "বাঙ্গালাহ্" নামকরণ করেন। ফারসি ভাষায় "আল" বলতে নদীর ওপর বাঁধ বা দুটি আলাদা জমির মাঝের সীমনাকে বোঝায়।
সুতরাং, "বাঙালি" শব্দটি কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নয়, বরং জাতিসত্তার পরিচায়ক। বাঙালি বনাম বাংলাদেশি বিভেদ নয়, ঐক্য
যাঁরা বলেন, "আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি?" তাঁদের বোঝা উচিত—এই দুই পরিচয় একে অপরের পরিপূরক, পরস্পরবিরোধী নয়। আমাদের ভাষা ও ইতিহাসই আমাদের আসল পরিচয়।
তাই দলাদলি বাদ দিয়ে আসুন, শহীদদের রক্তে রাঙানো বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি! বাংলাদেশকে ভালোবাসি!
—আশরাফুল মুহাম্মদ