05/01/2024
একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির সাহিত্যপাঠ বইতে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিদ্রোহী কবিতাটির সংকলিত অংশ রয়েছে। বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের কথা এই কবিতায় উঠে এসেছে যা পড়তে গিয়ে শিক্ষার্থী ও পড়াতে গিয়ে সঠিক তথ্য না জানায় অনেক শিক্ষক গলদঘর্ম হন। এই চরিত্রগুলোকে ব্যাখ্যা করে কয়েকটা পর্বে লিখব ও ভিডিও বানাব ভেবেছি।
পর্ব-০১
"মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ"
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি থেকে তিনি নটরাজকে তুলে এনেছেন বিদ্রোহের ধ্বংসাত্মক এবং নব সৃষ্টির রূপ দেখানোর জন্য।
মহাদেব বিভিন্ন রূপে সমস্ত সৃষ্টিজুড়ে আছেন। তাঁর যেমন সদাশয় রূপ আছে আবার ভয়ংকর মূর্তিও আছে। সব দেব-দেবী, মানব আর অসুর সমভাবে তাঁর বন্দনা করেন তাই তার নাম মহাদেব। মহাদেব দেবতার সেরা, তাকে অপরিবর্তনশীল পরম ব্রক্ষ্ম বলে অভিহিত করা হয়। মহাদেব সর্বজ্ঞ যোগী। তিনি কৈলাস পর্বতে সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেন। মানব-দানব, দেবতা আর অসুর ছাড়াও তিনি সৃষ্টি জগতের সমস্ত পশু বা জীবগণের কর্মবন্ধন করেন তাই তার নাম পশুপতি। সৃষ্টির প্রারম্ভে তিনি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছেন বিলে তাকে স্বয়ম্ভু বলা হয়। তিনি অল্পতেই তুষ্ট হন, অল্পতেই রুষ্ট হন এজন্য তার আরেক না আশুতোষ। মহাদেবের ইঙ্গিতেই প্রলয়লীলা ঘটে থাকে তাই তার আরেকনাম নটরাজ।
মহাদেব নৃত্য ও সঙ্গীতের স্রষ্টা৷ তিনিই নৃত্যনাট্য ও নৃত্যকলার প্রবর্তক। শিবের নর্তক ও নিত্যনর্তক নামে দুটি নাম রয়েছে। নটরাজরূপে শিবের সাথে সম্পর্কিত দুটি নৃত্যের নাম হলো তাণ্ডব ও লাস্য। লাস্য নৃত্যকলাকে পার্বতীর নাচরূপে কল্পনা করা হয়৷ শান্ত মহাদেবের নারীসুলভ আবেগময় নৃত্য লাস্য যা মধুর ও সুচারূ নৃত্যকলা। অপরদিকে নটরাজরূপী পুরুষবেশী মহাদেবের নৃত্যকে তাণ্ডবনৃত্য বলে। এই নাচ ধ্বংসের পরিচয় বহন করে।
মহাদেবের এই দুই নৃত্যের সাথে ধ্বংস ও সৃষ্টি সম্পর্কযুক্ত। তাণ্ডব ও লাস্য নৃত্যের কারণেই পৃথিবীতে লয় হয়৷ লয়ের পরে পুনরায় সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবী রক্ষা পায়৷ নটরাজরূপে মহাদেব সনকসহ অন্যান্য ঋষিকে উদ্ধার করার জন্য তাণ্ডব নৃত্য করেন৷ নটরাজরূপে তিনি পায়ের তলে দলিত করেছেন মায়াসুর নামক দৈত্যকে৷ মায়াসুর হলো মোহ, অজ্ঞতা ও অন্ধকারের প্রতীক। নটরাজরূপী মহাদেব অনন্তকাল ধরে অজ্ঞতা, লোভ ও স্বার্থপরতার প্রতীক দানব মায়াসুরকে অর্থাৎ আমাদের মনের দানবকে পদদলিত করে সৃষ্টিকে মোহমুক্ত করেছেন।
কবি মহাপ্রলয়ের নটরাজ অর্থাৎ শিবকে উপমা হিসেবে ব্যবহার করেছেন একই সাথে ধ্বংস ও ধ্বংসের পরে নবসৃষ্টির প্রেরণার উৎস হিসেবে। আমাদের অজ্ঞতা-মূর্খতা, হানাহানি-সংঘাতকে ধ্বংস করে মনের ভেতর নবসৃষ্টির প্রদীপ প্রজ্বলন করতে চেয়েছেন।
"আমি অভিশাপ পৃথ্বীর"
কে এই পৃথ্বী ? কী ছিল তাঁর অভিশাপ?
অসুরদের হাতে পরাজিত হয়ে একবার দেবরাজ ইন্দ্র মর্ত্যে নেমে আসেন। তিনি মহারাজ অঙ্গের প্রাসাদে ছদ্মবেশে আশ্রয় নেন। মহারাজ অঙ্গ তাকে চিনতে পেরে যথেষ্ট আপ্যায়ন করেন। ইন্দ্র তাঁর আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বরদান করতে চান । মহারাজ অঙ্গ যথাসময়ে বর চেয়ে নেবেন বলে অঙ্গীকার করেন।
এরপর দেবতারা একজোট হয়ে অসুরদের পরাজিত করলে, একদিন ইন্দ্র মহারাজ অঙ্গকে তাঁর প্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান । সেখানে মৃত্যুরাজের কন্যা সুনীথার সাথে মহারাজ অঙ্গের পরিচয় হয় । তাঁদের মধ্যে প্রণয় গড়ে ওঠে । মহারাজ অঙ্গ দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে সুনীথাকে বর হিসেবে প্রার্থনা করেন।দেবরাজ ইন্দ্র যেহেতু বর প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাই তিনি মৃত্যুরাজকে মহারাজ অঙ্গের সাথে তাঁর কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন ।
নিজের প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও মৃত্যুরাজ তাঁর কন্যা সুনীথাকে পৃথিবীর একজন সাধারণ রাজার সাথে বিয়ে দেন । তাঁর কন্যাকে পৃথিবীর একজন রাজা বিয়ে করেছেন বিধায় মৃত্যুরাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন । নিজের কন্যা পতিহারা হবে এই চিন্তা করে তিনি কোনো অভিশাপও দিতে পারছিলেন না। কিন্তু তাঁর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল না। নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ করতে মৃত্যুরাজ মনে মনে ইচ্ছা প্রকাশ করেন, এই বংশের উত্তরাধিকার দ্বারাই দেবরাজ ইন্দ্র পরাজিত হবেন ।
সুনীথার গর্ভে এক পুত্রসন্তান জন্ম নেয় । মহারাজ অঙ্গ তার নাম রাখেন বেন । বাল্যকাল থেকেই সে ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। যুবরাজ হিসেবে অভিষেক হওয়ার পর তার অত্যাচারের মাত্রা আরও বেড়ে যায় । তার অত্যাচার সইতে না পেরে মহারাজ অঙ্গ রাজ্য ছেড়ে বনে চলে যান । রাজার অভাবে রাজ্যে অরাজকতা সৃষ্টি হয় । ঋষিগণ আর কোনো উপায় না দেখে বেনকেই অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও রাজপদে অভিষিক্ত করে দেন ।
রাজার বিশাল ঐশ্বর্য পেয়ে বেন উন্মত্ত ও বিবেকশূন্য হয়ে যায় । সে নিজেকে ভগবান বলে প্রচার করতে শুরু করে। তখন ঋষিগণ নানাভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন । কিন্তু সে না বুঝে উল্টো ঋষিদেরকেই তিরস্কার করে । ক্রোধান্বিত হয়ে ঋষিগণ অভিশাপ দেন । ঋষির অভিশাপে রাজা বেন মারা গেলে রাজ্যে লুটতরাজ শুরু হয়। তখন ঋষিগণ বেনের শরীর মন্থন করেন । প্রথমে জঙঘা (উরু) মন্থন করেন । তার জঙঘা থেকে একজন কৃষ্ণবর্ণ বেঁটে মানুষ সৃষ্টি হয় । ঋষিরা তাঁর নাম দেন পৃথ্বী। সুন্দর বস্ত্র আর আভূষণে অলংকৃত করে মহারাজ পৃথ্বীর রাজ্যাভিষেক হয়। ব্রাহ্মণগণ পৃথ্বীকে প্রজাদেরকে রক্ষার জন্য আহ্বান করলেন ৷
বেনের অত্যাচারে পৃথিবীর সমস্ত কার্যকলাপ থেমে গিয়েছিল । পৃথিবীতে যাগ-যজ্ঞাদি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে প্রজারা কষ্ট পাচ্ছিল। তারা মহারাজ পৃথ্বীর কাছে এসে নিজেদের দুঃখের কথা নিবেদন করেন। তখন পৃথ্বী ক্রোধান্বিত হয়ে পৃথিবীকে লক্ষ্য করে ধনুকে বাণ যোজনা করেন । পৃথিবী ভয় পেয়ে গাভী রূপ ধারণ করে পালাতে শুরু করে । কিন্তু কোথাও স্থান না পেয়ে পুনরায় পৃথ্বীর চরণে আশ্রয় নেয় । পৃথ্বী পৃথিবীর সংকেতে গাভীরূপধারিণী পৃথিবীর দোহন করলেন । এতে পুনরায় সমস্ত অন্ন ঔষধি প্রকট হয়ে গেল । পরম ধার্মিক রাজা পৃথ্বী একশত অশ্বমেধ যজ্ঞ করার সংকল্প করেন । নিরানব্বই যজ্ঞ পূর্ণ হওয়ার পর যখন শততম অশ্বমেধ যজ্ঞের আরম্ভ করলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র নিজের সিংহাসন হারিয়ে যাবে মনে করে যজ্ঞে বিঘ্ন সৃষ্টি করেন । ইন্দ্র গুপ্তরূপে তাঁর যজ্ঞের অশ্ব হরণ করে নিয়ে যান । অশ্ব নিয়ে পালানোর সময় অত্রিমুনি ইন্দ্রকে চিনে ফেলেন । ইন্দ্রের মস্তকে তখন ছিল জটাজুট আর গায়ে ছিল ছাইভস্ম । অত্রিমুনি ইন্দ্ৰকে চিনিয়ে দিলে পৃথ্বী তাঁর পিছনে ধাওয়া করেন । ইন্দ্র ভয় পেয়ে রাজ্য ত্যাগ করেন । অন্য উপায়ে তিনি বারবার যজ্ঞ বিনষ্ট করার চেষ্টা চালান । অতঃপর পৃথ্বী মন্ত্রবলে ইন্দ্রকে অগ্নিতে আহ্বান করলেন । যজ্ঞকুণ্ড থেকে ইন্দ্র প্রকট হলে পৃথ্বী তাঁকে আটক করেন । নিজের কর্মে লজ্জিত ইন্দ্র পৃথ্বীর চরণে পড়তে চাইছিলেন, কিন্তু পৃথ্বী ইন্দ্রকে নিজের হৃদয়ে স্থান দেন । মহারাজ অঙ্গের উত্তরাধিকারী রাজা পৃথ্বীর কাছে ইন্দ্র নত মস্তক ধারণ করেন । এভাবেই মৃত্যুরাজ কর্তৃক প্রদান করা অভিশাপ পূর্ণতা পায় ।
অত্যাচারীর অরাজকতা এবং মহামারীর অভিশাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দৃঢ় সংকল্পবোধের এক প্রজ্ঞাবানের চেতনাকে কবি তুলে এনেছেন 'বিদ্রোহী' কবিতায় ।
গ্রন্থনির্দেশিকা
১। হুদা, মুহাম্মদ নুরুল (২০১৫), নজরুলের শিল্পসিদ্ধি ও বিদ্রোহী, আজমাইন পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
২। জিন্নাহ, ইসলাম আশিফুল (২০১৬), বিদ্রোহী কবিতার ঐতিহাসিক মূল্যায়ন, চমনপ্রকাশ, ঢাকা।
৩। নীল, দেবব্রত (২০২২), বিদ্রোহী কবিতার পৌরাণিক আবেদন, সময় প্রকাশন, ঢাকা।