24/08/2023
একটি বাংলা ভূতের গল্পঃ- ” বস্তা বন্দী লাশ”
সবে সন্ধ্যা হয়েছে। গতিশীল এই পৃথিবীর জনমানবের মধ্যে সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততার আবরণ উন্মোচনের পর নিজের সুখের নীরে ফেরার একটা ক্লান্ত অলীক প্রতিযোগিতায় মেতেছে শহরের সব মানুষ।
এরকমই এক কর্ম ব্যস্ত শহর থেকে ফিরছিল ভুবন ওরফে ভুবন স্যানাল। শহরের এক প্রতিষ্ঠানে তিনি ম্যানেজার পদে কর্মরত। তবে অন্যদিনের চেয়ে আজ গরমটা অনেক মাথা চাড়া দিচ্ছে। আবার এদিকে অফিস থেকে ফেরার সময় জলের বোতলে জল ভরতেও ভুলে গেছেন তিনি।
মহানন্দা নদীর ব্রিজের উপর দিয়ে আসার সময়, নদীর স্নিগ্ধ জলের দিকে তাকিয়ে তার মন গেল, কিছুটা সময় এই নদীর পাড়েই কাটাবেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে তবেই তিনি বাড়ি ফিরবেন। বাইকটাকে ঘুড়িয়ে তিনি নামতে থাকলেন নদীর পাড় ধরে। এরপর এক জায়গায় বাইক টা রেখে দিয়ে ব্রিজের পাশেই যে বড় সিঁড়ি টা রয়েছে সেখানে বসে পরলেন, আর নদীর জলের দিকে এক মনে তাকিয়ে রইলেন।
নদীর স্নিগ্ধ জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কি মনে করে তিনি নদীর জলে নেমে হাত মুখ ধুইতে লাগলেন। মুখ ধোঁয়ার সময় তার নজর গেল, নদীর ব্রিজের নীচে। সেখানে কিছু একটা অবশ্যই রয়েছে, যেটা বারবার নদীর জলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নামছে এবং উঠছে।
ভুবন বাবু অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ভালো ভাবে সেই ভাসমান তরঙ্গায়িত বস্তুটিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। একটি লম্বা কাপড় গতিশীল জলে ছেড়ে দিয়ে তার একটি অংশ যদি জলের নীচে বেধে দেওয়া যায় যেভাবে কাপড়টি স্রোতের সঙ্গে দোল খাবে সেইভাবে সেই বস্তুটি দোল খাচ্ছিল। যদিও ভুবন ভাবে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে এটি কোন কাপড় নয় বরং ভারী কিছু।
অনুসন্ধিৎসু মনের ভুবন বাবুর মধ্যে এক অজানা অ্যাডভেঞ্চার নাড়া দিয়ে উঠল। ধীরে ধীরে জল বেয়ে তিনি সেই বস্তুটির কাছে যেতে লাগলেন। তিনি দেখলেন যে, প্রায় ৬ ফুট এর মতো লম্বা একটি কাপড়ের বস্তাতে কিছু ভরা রয়েছে আর সেটি ব্রিজের নীচের বাড়তি লোহার মধ্যে লেগে গেছে।
ভুবন বাবু অবাক হলেন কেননা, তার মনে হল বস্তাটি বেশ ভারী কিন্তু সেটি কিভাবে জলের মধ্যে ভাসছে! ভুবন বাবুর মনে চলতে থাকে নানান প্রশ্ন। এটাতে কি থাকতে পারে? উম্মম এটার ভিতরে হয়ত কোন বড় লোকের ধন রত্ন রয়েছে, যেগুলো হয়ত ইনকাম ট্যাক্স থেকে ধরা পড়ার ভয়ে জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। উম্মম না না এই বস্তাতে দামী কাপড়ও থাকতে পারে, মাল ট্রেন থেকে যদি নদীতে পরে ভেসে এসেছে।
ধুর এত ভাবনার কি আছে! বস্তাটিকে টেনে তুলে খুলে দেখলেই তো হয়। ভুবন বাবু চারিদিকে দেখলেন সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত তার দিকে কারোর নজর নেই। তিনি ধীরে ধীরে ব্রিজের নীচের লোহার রডে লেগে থাকা সেই বস্তাটিকে ছাড়িয়ে নিলেন। বস্তার উপর হাত দিয়ে তার মনে হল, কিছুটা নরম আবার কিছুটা শক্ত। অর্থাৎ এতে দামী কাপড় এবং রত্ন উভয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উফফফ দারুণ ভারী বস্তাটি। কোন ভাবে টেনে হিঁচড়ে তিনি বস্তাটিকে টেনে তুললেন পাড়ে। ছুটে গিয়ে অফিসের ব্যাগ থেকে ফল কাঁটার চাকুটি নিয়ে এসে সাবধানে বস্তার মুখ কাটতে লাগলেন চোখ বুজে।
একসময় তার মনে হল, কাটা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন এবং তাকালেন সেই বস্তাটির দিকে। এক ভয় মিশ্রিত আর্তনাদ করে ভুবন বাবু ছিটকে পরলেন নদীর পাড়ের বালিতে। বস্তাটি তিনি ছেড়ে দেওয়াতে বস্তাটি দাঁড়িয়ে না থেকে পরে গেল এবং গড়াতে গড়াতে নদীর জলের দিকে যেতে লাগল। ভুবন বাবু দেখলেন, বস্তার খোলা মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এসেছে এক অর্ধ কাটা মানুষের দেহ।
পড়ুনঃ- শুনশান রাস্তায় আমি ও নিলি
সেই মানুষের দেহটি কোমর পর্যন্ত কাটা, বস্তাটি যখন গড়িয়ে যাচ্ছিল, মানুষের দেহের উপরের অংশটি অর্থাৎ কোমর থেকে উপরের অংশটি বেড়িয়ে গেছে বস্তা থেকে এবং সেটি শুকনো বালির উপর দিয়ে অদ্ভুত ভাবে গড়াতে গড়াতে নদীর জলে গিয়ে পড়ল। সেই অর্ধ কাটা দেহটি সাদা হয়ে গেছে, এবং অদ্ভুত ব্যাপার হল, ওতে এক ফোঁটা রক্তের দাগ বা চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
এদিকে আলো-আধারি নেমে গেছে আতঙ্কিত ভুবন বাবু পড়িমরি করে ছুটে চললেন তার বাইকের দিকে। তাড়াতাড়ি বাইক স্টার্ট দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে পড়লেন। এখান থেকে তার বাড়ি যেতে আরও প্রায় ১ ঘণ্টা লেগে যাবে, আবার মাঝপথে একটি জঙ্গল ও পরবে। এইসব ভাবতেই তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।
যত দ্রুত সম্ভব তিনি ভীরের মধ্যে বাইক ছুটিয়ে চলতে লাগলেন। জনমানবের ভিড় ছেড়ে তিনি বেশ শুনশান একটা এলাকায় এসে গেছেন। তার কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। প্রতিদিনের চেনা রাস্তাটাও অচেনা মনে হচ্ছে, আর বারবার শুধু চোখে ভেসে আসছে আলো-আধারিতে সেই অর্ধ কাটা মানুষের দেহটির বালির মধ্য দিয়ে নদীতে গড়িয়ে যাওয়ার ভয়ংকর দৃশ্য।
তার মনে হতে লাগল তার হাত ভারী হয়ে যাচ্ছে। যেন নিয়ন্ত্রনে নেই তার হাত। আর বাইকটাও অদ্ভুত ভাবে ভারী মনে হচ্ছে। যেন পিছনে কেউ বসে আছে। এই অন্ধকারে মাথা ঘুড়িয়ে বাইকের পিছনে তাকিয়ে দেখার মত সাহস তার নেই। যত দ্রুত সম্ভব তিনি বাইক ছুটিয়ে চললেন।
পশ্চিম আকাশের দিকে তার চোখ গেল। মেঘটা কেমন যেন কালচে সিঁদুরে বর্ণ ধারন করেছে। অর্থাৎ আর মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে। বলতে না বলতেই বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা তার মুখ স্পর্শ করল। এদিকে তিনি সেই শুনশান জঙ্গলে এসে গেছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যত জোড়েই বৃষ্টি আসুক না কেন তিনি থামবেন না কিছুতেই।
কিন্তু বৃষ্টির প্রকোপ এমন বেড়ে গেল যে, বৃষ্টির কনা তার হাতে মুখে সজোরে আঘাত করতে লাগল। তার পক্ষে আর বাইক চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে হঠাৎ করেই একটা বড় পাইন গাছের নীচে এসে তার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। ইসসস বিপদ যখন দুয়ারে কড়া নাড়ে তখন ভগবানও কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমান বুঝি
তিনি একমনে ঈশ্বর কে ডেকে চলেছেন। বাইক থেকে নেমে সেই প্রবল বৃষ্টির মাঝে তিনি আশ্রয় নিলেন পাইন গাছটির নীচে। তার মনে হতে লাগল তার পিছনে যেন কেউ দাঁড়িয়ে। ইচ্ছে থাকলেও পিছনে ঘুরে দেখার মতো সাহস তার নেই।
তার বারবার মনে হতে লাগল, কেউ তাকে দেখছে। হঠাৎ তার মনে হল কেউ যেন তার কাঁধে হাত রাখছে। অনেকটা হিম শীতল সেই হাত। ভুবন বাবুর ইচ্ছে ছিল সেখান থেকে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই তার পা সেখান থেকে নড়াতে পারছেন না।
চোখ বন্ধ করে রইলেন তিনি। প্রায় পাঁচ মিনিট পর তার মনে হল, বৃষ্টি থেমে গেছে। তিনি চোখ খুললেন। আর দেখলেন-
এই অন্ধকার রাতেও তার সামনে হাওয়াতে দুলছে সেই নদীর পাড়ের বালির মধ্যে ভেসে যাওয়া অর্ধ কাটা মানুষের দেহটা। ভুবন বাবুর মনে হতে লাগল, তার মাথা ঝিমঝিম করছে। তিনি দেখলেন সেই অর্ধ কাটা দেহটা তার চারদিকে ঘুরছে। হঠাৎ তার মনে হল, কেউ যেন ধীরে ধীরে তার দুই কাঁধে হাত দিচ্ছে আর সেই হাত গলার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ভুবন বাবুর অবস্থা তখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ভয়ে চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছে না তার। তার মনে হতে লাগল, কেউ যেন তার ব্রেনের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে আর দুই হাতে তার মাথা সজোরে চিপছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না তিনি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন সেখানেই।
<
পরের দিনে একটি সুন্দর সকাল ভিড় জমেছে জঙ্গলের মাঝের সেই পাইন গাছের নীচে। উদ্ধার করা হয়েছে ভুবন বাবুর দেহ। উহু জীবিত নয় মৃত।
পুলিশি তদন্তে জানা যায় যে, মহানন্দা নদীর সেই ব্রিজ থেকে একটু দূরে জেলে দের জালে, এক অর্ধ কাটা মানুষের দেহ উদ্ধার হয়েছে। পরে জানা যায়, প্রায় একমাস আগে কে বা কারা সেই মানুষটিকে খুন করে শরীরের মাঝ বরাবর কেটে কাপড়ের বস্তায় পুড়ে ভাসিয়ে দিয়েছে নদীর জলে।
আর সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার হল, এতদিন পরেও সেই দেহে কোন পচন ধরে নি এবং এতটুকুও গন্ধ নেই ওতে। শুধু দেহটা সাদা হয়ে গেছে।
এই বস্তা বন্দী অর্ধ কাটা দেহ ভুবন বাবুর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, আর তিনি বারবার সেই কথাই ভাবছিলেন। যার কারণে তার মন বারংবার নানান অবয়ব সৃষ্টি করে চলে ছিল সেদিন। আর পাইন গাছের নীচে দাঁড়িয়েও তার মনে চলছিল সেই অর্ধ কাটা দেহটির গড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য। যার কারণে তার মন সেই অর্ধ কাটা দেহটির রেপ্লিকা তৈরি করে তার সামনে পেশ করেছে এবং আতঙ্কে মৃত্যু হয়েছে তার।
Writer of, Lips don’t lie