20/12/2024
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা সেবা ভয়াবহ ব্যয়বহুল।
কেমন ব্যয়বহুল একটু উদাহরণ দেই। নরমাল ফিজিক্যাল চেক আপ (ফ্যামিলি মেডিসিন বা ইন্টারনাল মেডিসিন ক্লিনিক) ভিজিট বাংলাদেশী টাকায় ১০-৩০ হাজার টাকা। কোন কারণে ইমার্জেন্সী রুমে নিতে হলে বিল আসবে দেড়-আড়াই লক্ষ টাকা। হাসপাতালে থাকা লাগলে বিল ৫ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা আসতে পারে। নরমাল ডেলিভারির খরচ পড়ে ১০-১৫ লক্ষ টাকা, সিজারিয়ান হলে বিল ৩০ লক্ষ টাকায় ঠেকতে পারে। এপেন্ডিক্স রিমুভাল সার্জারির মত বেসিক সার্জারির বিল ৩০ লক্ষ টাকার উপর চলে আসে!
তো এত ব্যয়বহুল চিকিৎসার ব্যয় মানুষ বহন করে কীভাবে?
হেলথ ইন্সুরেন্সের মাধ্যমে।
মানুষজন ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোতে প্রতিমাসে একটা এমাউন্টের টাকা জমা দেয়, যাকে বলে "প্রিমিয়াম"। যখন কারো চিকিৎসা বিল দেওয়া লাগে, তখন সে ইনস্যুরেন্স ক্লেইম করতে পারে। তাও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো যে পুরো ব্যয় বহন করে তাও না। শুরুতে ক্লায়েন্টকে ব্যয়ের একটা অংশ নিজেরই বহন করতে হয়। তারপর ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি টোটাল খরচের একটা অংশ দেয়।
এখন, এই ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবেচেয়ে বড় হলো UnitedHealth Group. প্রায় সাড়ে চার কোটির বেশি মানুষ এই কোম্পানি থেকে হেলথ ইন্স্যুরেন্স নেয়। তাদের টোটাল রেভিনিউ হলো ৩৭১ বিলিয়ন ডলারের উপরে আর গতবছর তাদের ইনকাম ছিলো প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারের বেশি!
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এরা এত টাকা ইনকাম করে কীভাবে! এই ইউনাইটেড হেলথকেয়ার ক্লায়েন্টদের ক্লেইম রিজেক্ট করার জন্য কুখ্যাত। তাদের ক্লেইম রিজেক্ট করার হার ৩২% যা ইন্ড্রাস্ট্রি এভারেজের প্রায় ডাবল! মানে, মাসের পর মাস মানুষ এই কোম্পানিতে প্রিমিয়াম হিসেবে টাকা দিয়ে যায়, আর যখন তাদের জীবন-মরণ অবস্থায় চিকিৎসার দরকার হয়, তখন নানা রকম ছুতো দেখিয়ে এই কোম্পানি তাদের ইন্স্যুরেন্সের টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়! তাদের এই অস্বাভাবিক লাভের পাহাড় মূলত লক্ষ লক্ষ মানুষের কান্না-মৃত্যুর উপর দিয়ে হয়!
শুধু তাই না, কে টাকা পাবে আর কে পাবে না, সেটা তারা একটা AI দিয়ে নির্ধারণ করে। সেই AI এর সিদ্ধান্ত বিভিন্ন পরীক্ষায় ৯০% ভুল প্রমাণিত হবার পরও তারা সেটা ইউজ করা থামায় নাই। এমন বহু ঘটনা আছে যেখানে তারা মারাত্মক অসুস্থ রোগীর চিকিৎসার মাঝপথে টাকা দেওয়া অফ করে দিয়েছে, রোগী মারা গেছে। তাদের নামে এত এত কন্ট্রভার্সি আর মামলা, যে, সেটার লিস্ট পড়তে গেলেও যে কেউ হাঁপিয়ে যাবে।
সম্প্রতি এই ইউনাইটেড হেলথ এর CEO ব্রায়ান থম্পসনকে নিউ ইয়র্কে এক হোটেলের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে ঠান্ডা মাথায় গু/লি করে হ*ত্যা করা হয়েছে। ঐ হোটেলে সেই সময় কোম্পানির ইনভেস্টরদের মিটিং হচ্ছিলো। গু/লির খোসায় তিনটা শব্দ লেখা ছিলো "Deny" "Delay" আর "Depose" শব্দগুলো, যে পদ্ধতিতে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলো মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের চিকিৎসার টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
এই হ*কাণ্ডের পর একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। একদিকে রাজনীতিবিদ, অন্যান্য কোম্পানির CEO রা গভীর শোক প্রকাশ করছে আর নিন্দাপ্রকাশ করছে, আর উল্টোদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষ যতভাবে পারা যায় এই ঘটনা নিয়ে হাস্যরস করছে, মিম বানাচ্ছে, মজা নিচ্ছে। ব্রায়ানের মৃত্যু রিলেটেড প্রতিটা খবরের নিচে “I’m sorry, prior authorization is required for thoughts and prayers,” “Does he have a history of shootings? Denied coverage,” এই ধরণের কমেন্ট করছে, তালির ইমোজি দিচ্ছে, হাসির রিয়েক্ট দিচ্ছে। মিম পেইজগুলোতো মাথা খারাপ অবস্থা, এই ঘটনা নিয়ে বিদেশী মিম পেইজ, 9gag এর মত সাইটগুলো মিমের বন্যা ভাসায় দিচ্ছে। কোথাও ঐ CEO এর জন্য এক ফোঁটা সমবেদনা নাই।
মানুষের এই রিয়েকশন অবশ্য অভাবনীয় না। প্রতি বছর আমেরিকায় গড়ে ৬৮০০০ মানুষ কেবল মাত্র ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর নানা নিয়ম নীতির অজুহাতে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় বিনা চিকিৎসায় মারা যায় আর এই ব্রায়ান থম্পসনের মত CEO রা ১০-১৫ মিলিয়ন ডলার বোনাস পায় পুরস্কার হিসেবে!
এদিকে এই ঘটনায় দায়ী সন্দেহে যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, Luigi Mangione, সে রাতারাতি ইন্টারনেট সেনশনে পরিণত হয়েছে। তার নামে অসংখ্য আইডি খোলা হচ্ছে, মানুষ তাকে প্রশংসায় ভাসায় দিচ্ছে, তাকে হিরো বানানো হচ্ছে।
কিছুদিন আগের নির্বাচনের পর থেকে বিভক্ত হয়ে পড়া আমেরিকার মানুষজনের দলমত নির্বেশেষ কোন বিষয়ে এমন একাত্মতা দেখানোর নিদর্শন অচিন্তনীয় ছিলো। কিন্তু এই একটা মৃত্যু পুরো আমেরিকার মানুষজনকে একত্রিত করেছে, সমাজের হাতেগোণা কিছু এলিট আর অতি সুশীল বাদে কেউ সেই সিইও এর জন্য সমবেদনা জানাচ্ছে না উলটো দুর্নীতিতে জর্জরিত যুক্তরাষ্ট্রের হেলথকেয়ার সিস্টেম নিয়ে প্রশ্ন উঠাচ্ছে নতুন করে।
আর সবেচেয়ে বড় যে ম্যাসেজটা গেছে, মানুষের চোখের পানি আর রক্ত চুষে সম্পদের পাহাড় গড়া কোম্পানির সিইওদের কাছে। তারা হঠাৎ অনুভব করছে, অঢেল সম্পদের বিলাসী জীবনের আড়ালে আর নিরাপদ নয়, তাদের কারণে আপন মানুষ হারানো, নিঃস্ব হওয়া ভিক্টিমরা আর নীরব থাকবে না। তাদের রাতের শান্তির ঘুম হারাম।
প্রায় ২ বছর ৩মাস হয়েছে মার্কিন মুলুকে এসেছি। সম্পদের সীমাবদ্ধতা, রোগীর অনুপাতে চিকিৎসক ও নার্সদের অপ্রতুলতা এবং সাধারণ মানুষদের নিয়ম ভাংগার প্রবণতা সত্ত্বেও আমাদের দেশের আপামর জনসাধারণ যত সহজে চিকিৎসাসেবা পেয়ে (সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতকেই বিবেচনা করে) সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে, তা রীতিমতো অকল্পনীয় এবং গল্পের মতো মনে হয়।
(সংগৃহীত)