16/10/2025
একবার এক রাজা ছিলেন, তাঁর রাজ্যে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ চাকরির জন্য আসত। একদিন সকালে দরবারে এক অচেনা লোক এসে মাথা নোয়াল —
“মহারাজ, আমি আপনার সেবায় যোগ দিতে চাই।”
রাজা মুচকি হেসে বললেন, “তোমার বিশেষ যোগ্যতা কী?”
লোকটি শান্ত গলায় বলল, “আমি মানুষের মুখ দেখে বুঝতে পারি, তার ভেতরে মানুষ লুকিয়ে আছে, না পশু।”
রাজা একটু থেমে তার দিকে তাকালেন। কৌতূহলী হয়ে তাঁকে রাজপ্রাসাদের সবচেয়ে প্রিয় ঘোড়ার আস্তাবলের দায়িত্ব দিলেন।
কিছুদিন পরে রাজা তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“আমার সবচেয়ে দামি ঘোড়াটিকে কেমন দেখছ?”
লোকটি উত্তর দিল, “মহারাজ, ঘোড়াটি বাহ্যিকভাবে খুব সুন্দর, কিন্তু এটি খাঁটি জাতের নয়।”
রাজার মুখে বিস্ময়!
তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের অভিজ্ঞ ঘোড়সওয়ারকে ডেকে পাঠালেন।
ঘোড়সওয়ার মাথা নোয়াল ও বলল, “ঘোড়াটি সত্যিই খাঁটি জাতের, তবে জন্মের পরপরই তার মা মারা যায়। ছোটবেলায় সে গরুর দুধ খেয়ে বড় হয়েছে।”
রাজা তখন চাকরটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কীভাবে এমনটা বুঝলে?”
লোকটি বিনম্রভাবে বলল, “মহারাজ, ঘোড়াটি যখন ঘাস খায়, তখন গরুর মতো মাথা নিচু করে খায়। কিন্তু খাঁটি জাতের ঘোড়া ঘাস মুখে নেওয়ার সময় মাথা উঁচু করে রাখে।”
রাজা তার প্রখর বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে প্রচুর পুরস্কার দিলেন — শস্য, ঘি, ছাগল, মুরগি সব পাঠিয়ে দিলেন তার ঘরে।
তারপর রাজা বললেন, “তুমি এখন রাণীর প্রাসাদে কাজ করো।”
কয়েকদিন পরে রাজা জানতে চাইলেন, “আমার রাণী সম্পর্কে তোমার মত কী?”
লোকটি শান্তভাবে বলল, “রাণী খুবই মার্জিত, তার আচরণও রাজকীয়, কিন্তু তিনি জন্মসূত্রে রাণী নন।”
রাজা আবার হতভম্ব হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার শাশুড়িকে ডাকলেন।
শাশুড়ি কিছুটা ভারী গলায় বললেন, “এটা সত্যি মহারাজ, আপনার জন্মের আগে আমরা আমাদের মেয়েকে হারিয়েছিলাম। তাই সম্পর্ক বাঁচাতে আমরা অন্যের এক কন্যাকে নিজের মেয়ে হিসেবে বড় করেছি।”
রাজা আবার চাকরটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এতটা কীভাবে বুঝলে?”
লোকটি বলল, “মহারাজ, আসল রাজকন্যারা তাদের ভৃত্যদের সঙ্গে শ্রদ্ধা ও সৌজন্যে কথা বলে। কিন্তু আপনার রাণী ভৃত্যদের সঙ্গে আচরণ করেন এমনভাবে, যেন ওরা কেবল তার আদেশ পালনের যন্ত্র।”
রাজা আবারও মুগ্ধ হলেন।
তিনি তাকে আরও প্রচুর পুরস্কার দিলেন— ভেড়া, ছাগল, শস্য, ঘি— এবং এবার তাকে নিজের দরবারে স্থায়ী চাকরিতে নিযুক্ত করলেন।
কয়েক মাস পর, রাজা একদিন মুচকি হেসে বললেন,
“তুমি তো সবাইকে চিনে ফেলছো, এবার বলো, আমার সম্পর্কে কী ভাবো?”
চাকরটি চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর বলল,
“মহারাজ, আপনি যদি প্রতিশ্রুতি দেন যে আমার প্রাণ নেবেন না, তবে আমি বলি।”
রাজা রাজকীয় গম্ভীরতায় বললেন, “প্রতিশ্রুতি দিলাম।”
লোকটি মাটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি রাজার সন্তান নন, আর আপনার আচরণেও রাজরক্তের ছাপ নেই।”
রাজার চোখ রাগে লাল হয়ে গেল, কিন্তু প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ল। তিনি সরাসরি নিজের মায়ের প্রাসাদে গেলেন।
রানীমা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“হ্যাঁ, এটা সত্যি। আমরা সন্তানহীন ছিলাম, তাই এক রাখালের শিশুকে দত্তক নিয়েছিলাম, সেটাই তুমি।”
রাজা চোখ মেলে তাকিয়ে রইলেন, যেন পৃথিবীটা এক মুহূর্তে বদলে গেল।
তিনি আবার লোকটিকে ডেকে বললেন,
“তুমি কীভাবে জানলে?”
লোকটি মৃদু হেসে বলল,
“মহারাজ, রাজারা যখন পুরস্কার দেন, তখন তারা হীরা, মুক্তা বা সোনাদানা দেন। কিন্তু আপনি যে পুরস্কার দেন— ঘি, ছাগল, ভেড়া, শস্য— সেটা রাখালের স্বভাব।”
তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
“মহারাজ, একজন মানুষের আসল পরিচয় তার মুখে নয়, তার আচরণে লুকিয়ে থাকে। পদ-মর্যাদা বা ধনসম্পদ যতই হোক না কেন, মানুষকে মানুষ করে তোলে তার ব্যবহার।”