23/01/2025
চাকমা:আদিবাসী নয়,বহিরাগত
আব্দুস সাত্তার
পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের মধ্যে চাকমা, মগ, মুরং, কুকি, খুমি, বনজোগী, পাঙ্খো, লুসাই, তংচঙ্গা, টিপ্পা (ত্রিপুরা) এবং সেন্দুজ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। টিপ্লারা হিন্দুধর্মাবলম্বী, মগ ও চাকমারা বৌদ্ধ এবং অপরাপর জাতির মধ্যে কেউ কেউ নিজেদেরকে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বলে স্বীকার করলেও ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক জীবনের রীতিনীতিতে তাদের বৈসাদৃশ্য লক্ষণীয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পূর্বে চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত ছিল। পাহাড়ী জাতিদের আলাদা বৈশিষ্ট্যের দাবীতে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ১লা আগস্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বতন্ত্র জেলার মর্যাদা লাভ করে। 1
চাকমারা কোথা থেকে এখানে এসেছে এবং এদের উৎপত্তিই-বা কোথায়, এ প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে। উপজাতিদের উদ্ভব ও বসতি বিস্তার সম্পর্কে সবকিছু জানা সম্ভব না হলেও এ সম্পর্কে আমাদের মন সব সময়েই কৌতূহলী ও উৎসুক।
চাকমা জাতি যে এককালে ব্রহ্মদেশে ছিল, সে সম্বন্ধে কর্নেল ফেইরী আলোকপাত করেছেন। 2 ব্রহ্মদেশের পুরাবৃত্ত 'চুইজং ক্য থং' এবং আরাকান কাহিনী 'দেঙ্গ্যাওয়াদি আরেদফুং' নামক গ্রন্থদ্বয়েও অনুরূপ উল্লেখ রয়েছে।
প্রেদঙ্গ্যাওয়াদি আরেদফুং' গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী ৪৮০ মগাব্দে (খ্রীষ্টীয় ১১১৮-১৯ সালে) চাকমাদের সর্বপ্রথম উল্লেখ পরিদৃষ্ট হয়। "এ সময়ে পেগো (আধুনিক পেগু) দেশে আলং চিছু নামে জনৈক রাজা ছিলেন। পশ্চিমের বাঙ্গালীদিগের সহিত মিলিত হইয়া চাকমাগণ তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধ উপস্থিত করে। পেগো রাজা স্বীয় প্রধানমন্ত্রী কোরেংগ্রীকে সেনাপতি পদে বরণ করিয়া যুদ্ধার্থ প্রেরণ করিলেন। তিনি যুদ্ধ স্থলে উপনীত হইলে একটি সারসপক্ষী একখানি মৃত প্রাণীর চর্ম মুখে লইয়া তাঁহার সম্মুখে পতিত হইল। তিনি তাহাকে ধরিয়া রাজার শিবিরে লইয়া গেলেন এবং বুঝাইয়া দিলেন যে, এই সারস-বাঙালী ও চর্মখানি-চাকমা, উভয়ের মিত্রতা ঘটিয়াছে। কিন্তু আমাদের এই যুদ্ধে নিশ্চয়ই বাঙালী ও চাকমাগণ এই সারসের ন্যায় বশ্যতা স্বীকার করিবে।
"রাজা মন্ত্রীর এহেন যুক্তিগর্ত আশ্বাসবাক্যে অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া তাঁহাকে একটি হস্তী উপহার প্রদান করেন। অনন্তর হঠাৎ চতুর্দিকে নানা অশুভ লক্ষণ দেখা দিল, পবিত্র 'মহামুনি' মূর্তি স্বেদসিক্ত হইলেন। ঘন ঘন অশনি নিপাত, অকাল বৃষ্টি-সমস্তাৎ হাহাকার পড়িয়া গেল। রাজা যুদ্ধে ক্ষান্ত হইয়া এই অমঙ্গল শান্তির নিমিত্ত পুরোহিতকে শতমুদ্রা প্রদান করিলেন।
"এই ঘটনার বহুকাল পরে আনালুম্বা নামক পেগুরাজার শাসন সময়ে পুনরায় বাঙালী ও চাকমাগণ মিলিয়া উত্থিত হয়। রাজা পঞ্চাশ হাজার সৈন্য লইয়া দাম্বাজিয়াকে সেনাপতি করিয়া পাঠাইলেন। দাম্বাজিয়া যাত্রা করিয়া সম্মুখে দেখিলেন একটি বক ও একটি কাক ঝগড়া করিতেছে, অবশেষে বক কাকের ডানা ভাঙ্গিয়া দিল। তিনি রাজার নিকট আসিয়া ইহা বিবৃত
করিলেন। মন্ত্রী বুঝাইয়া দিলেন, এই কাক বাঙালী এবং বক আমরা। ইহা দ্বারা সুস্পষ্ট দেখা যাইতেছে, এই যুদ্ধে আমাদের জয়লাভ নিশ্চিত।
"সেনাপতি অমিত-উৎসাহে যুদ্ধারম্ভ করিলেন। পাঁচদিন অবিরাম যুদ্ধের পর বাঙালী ও চাকমাগণ পলায়ন করে।"3
ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত রাজমালায়4-ও একই কথার প্রতিধ্বনি বর্তমান। এ সম্বন্ধে ১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে জুন তারিখে চট্টগ্রামের তদানীন্তন শাসনকর্তাকে লিখিত ব্রহ্মরাজের একটি চিঠির উদ্ধৃতি থেকেই আমাদের বক্তব্যের যথার্থতার কিছুটা প্রমাণ মিলবে 'পাঁচ'শ ষাটটি দেশ নিয়ে আমাদের সাম্রাজ্য গঠিত। আমরা পরস্পর এতদিন বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ ছিলাম এবং এক দেশের অধিবাসীরা অন্য দেশের অধিবাসীদের সাথে অবাধ মেলামেশা করতে পারতো।... ত্রুটি নামে এক ব্যক্তি আমাদের সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে গিয়ে আপনার সাম্রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। তাকে জোরপূর্বক আনার ইচ্ছে আমাদের ছিল না বলেই তাকে ফিরিয়ে দেবার অনুরোধ করে আমরা আপনাদের কাছে বিনয়সহকারে চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু আপনারা তাকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেন। আমাদের সাম্রাজ্যের পরিধি নেহাৎ কম নয় এবং ত্রুটি তার অবাধ্য আচরণে আমাদের রাজশক্তির অবমাননা ও শান্তিভঙ্গ করেছে।... ডোমকান, চাকমা, কিরুপা, লেইস মুরং এবং অন্যান্য জাতির লোকও আরাকান থেকে পালিয়ে গিয়েছে ও আপনাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে তারা সীমান্তবর্তী উভয় দেশের অধিবাসীদের উপর অত্যাচার ও লুটতরাজ করেছে। তাছাড়া, তারা নাফ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের একজন খ্রীস্টানকে হত্যা করে তার যথাসর্বস্ব হরণ করে নিয়ে গেছে। এই কথা শুনে আমি একদল সৈন্য নিয়ে সীমান্ত এলাকায় এসেছি তাদের ধরে নেবার জন্যে। যেহেতু, তারা আমাদের সাম্রাজ্যের অধিবাসী এবং আমাদের রাজশক্তির অবমাননা করে বর্তমানে ডাকাতিবৃত্তি গ্রহণ করেছে।... তাদেরকে আশ্রয় দেওয়া আপনাদের পক্ষে মোটেই সমীচীন নয় এবং মগরা যারা আরাকান থেকে পালিয়ে গিয়েছে, তাদেরকেও ফেরত পাঠাতে যথাবিহিত ব্যবস্থা করবেন। এতে আমাদের পরস্পরের বন্ধুত্বসূত্র আরও দৃঢ় হবে এবং দুই দেশের পথিক এবং ব্যবসায়ীরাও ডাকাতির হাত থেকে অব্যাহতি পাবে।... মোহাম্মদ ওয়াসিমের মারফত এই চিঠি পাঠাচ্ছি। চিঠি পেয়ে যথাবিহিত ব্যবস্থা করবেন এবং অনুগ্রহ করে চিঠিটার উত্তরও তাড়াতাড়ি দিবেন।....'
এ চিঠির উত্তরে কি বলা হয়েছিল তা অবশ্য আমাদের প্রতিপাদ্য নয়, তবে চিঠিটার ঐতিহাসিক মূল্য যে যথেষ্ট তাতে সন্দেহ নেই। এ থেকে চাকমারা কি করে ব্রহ্মদেশ থেকে চট্টগ্রামে আগমন করেছিল তার হদিস পাওয়া যায়।
শাসন ব্যবস্থার সুবিধার জন্য বেঙ্গল গভর্নমেন্ট ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দের পহেলা সেপ্টেম্বর ১ এই বিস্তৃত পার্বত্যভূমিকে তিনটি সার্কেল যথা: চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল ও মঙ সার্কেলে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক সার্কেলের জন্য একজন করে রাজা বা প্রধান নিযুক্ত করেন। চাকমা সার্কেলের (২৪২১ বর্গমাইল) রাজা রাঙ্গামাটিতে, বোমাং সার্কেলের (২০৬৪ বর্গমাইল) রাজা বান্দরবনে এবং মঙ সার্কেলের (৬৫৩ বর্গমাইল) রাজা রামগড় মহকুমার মানিকছড়িতে অবস্থান করেন। উল্লিখিত জাতিদের মধ্যে চাকমারা সংখ্যার দিক থেকে রাঙ্গামাটিতেই সর্বাধিক এবং অন্যান্য জায়গায়ও এদেরকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এসব উপজাতি যে এখানকার ভূমিজ সন্তান নয় তা আমাদের উপরোক্ত আলোচনা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। নৃতত্ত্ববিদদের মতে, উপমহাদেশের আদিম অধিবাসী মাত্রই বাইরে থেকে এখানে আগমন করেছে এবং ভাষাতত্ত্ববিদরাও বিভিন্ন আদিম জাতির ভাষা বিশ্লেষণ করে একই কথার সমর্থন জানিয়েছেন। 'সুদূর অতীতে অন্যান্য ভূখণ্ডের মতো এই উপমহাদেশের মাটিতেও হয়তো এক শ্রেণীর দ্বিপদ বৃক্ষচরপ্রাণী নিতান্ত জন্তুদশা থেকে কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে নরদশা লাভ করেছে। ' 6 নৃতত্ত্ববিদ ডক্টর জে. এইচ. হাটনও এখানকার আদি অধিবাসী সম্বন্ধে এই মত পোষণ করেন এবং তাঁর ধারণা ক্রমবিবর্তন ও বিভিন্ন সময়ের বংশানুক্রমিক রক্তের মিশ্রণে এই সব আদি মানব নিজেদের আদিম অবস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ৭
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের বেলায় এই যুক্তি আংশিক সত্য। এদের ধর্ম ভাষ্য আচার-ব্যবহার এবং সামাজিক জীবনের রীতিনীতি বিভিন্ন ধর্মের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, তাদের আদিম বৈশিষ্ট্য অনেক ক্ষেত্রে খুঁজে বের করা অসম্ভব।
চাকমারা মূলত কি ছিল কিংবা কোন্ জাতি থেকে এদের উৎপত্তি, সে বিষয়টি জানা নিতান্ত কষ্টসাধ্য হলেও অনুসন্ধানের অপেক্ষা রাখে। কোনও জাতির সঠিক পরিচয় নির্ণয়ে সে জাতির অতীত ইতিহাস অনেকটা সহায়ক। ইতিহাসের অভাবে সেসব মানবগোষ্ঠীর আকৃতি-প্রকৃতি, বেশ-ভূষা, আচার-ব্যবহার, ধর্ম-কর্ম, ভাব-ভাষা ইত্যাদির সাথে সম্যক পরিচয় কিংবা তাদের কালস্থায়ী পরিবেশের গূঢ় উপলব্ধি না থাকলে সেসব জাতি সম্বন্ধে কিছু বলা সম্ভব নয়।
স্যার রিজলীর মতে, ব্রহ্ম ভাষার 'সাক' বা 'সেক' জাতি থেকে চাকমাদের উৎপত্তি। ক্যাপ্টেন লুইন বলেন:
..the name Chakma is given to this tribe in general by the inhabitants of the Chittagong District, and the largest and dominant section of the tribe recognises this as its rightful appellation. It is also sometimes spelt Tsakma or Tsak, or as it is called in Burmese Thek', 8
এই মন্তব্যে চাকমা কথাটি যে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের নয় সম্ভবত এ কথাটিই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন।
আরাকানের প্রাচীন রাজধানী রামাবতী নগরের নিকটবর্তী অঞ্চলে এই সাক বা সেক জাতি এককালে খুব প্রবল ও প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তাদের সাহায্যে ব্রহ্মরাজ ন্যা সিং ন্যা থৈন ৩৫৬ মগাব্দে (৯৯৪ খ্রীষ্টাব্দ) সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। কর্নেল ফেইরী এর মতে, ৯ তখন সেই অঞ্চলে পশ্চিম দেশের বিভিন্ন লোক বাণিজ্য ব্যাপদেশে আগমন করে এবং পরিশেষে উপনিবেশ স্থাপন করে। তাদের উপাধি ছিল সাক বা সেক।
কেউ কেউ অনুমান করেন, তখন আরব-ইরান তুরস্ক থেকে বহু মুসলমান সমুদ্র-উপকূলবর্তী কেউ নব্যবসা-বাণিজ্য উদ্দেশ্যে আগমন করে এবং তাদের অনেকেই দেশে ফিরে না গিয়ে সে অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। অতএব বোঝা যাচ্ছে, এইসব সাক বা সেক শব্দ ইসলামী শায়খের অপভ্রংশ।
এখনও ব্রহ্মদেশের সমুদ্র-উপকূলবর্তী স্থানে এই সাক সম্প্রদায় দেখা যায়। ধর্মীয় রীতিনীতিতে তাদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাদের মিল না থাকলেও আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে চাকমারা সাকদেরই উত্তর পুরুষ।
মগদের মতে, চাকমারা মুঘলদের বংশধর। 10 কোন এক সময়ে মুঘলরা আরাকান রাজের হাতে পরাজয়বরণ করে; ফলে বহু মুঘল সৈন্য বন্দিদশায় আরাকানে অবস্থান করতে বাধ্য হয়। আরাকানরাজ তাদেরকে স্বদেশের মেয়েদের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হবার আদেশ জানিয়ে আরাকানেই অন্তরীণ করে রাখেন। এসব মুঘল সৈন্যের ঔরসে এবং আরাকানী নারীদের গর্ভে যে জাতির উদ্ভব হয়েছিল তারাই সাক বা সেক।
জে. পি. মিলস্-ও একই মত পোষণ করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, "চাকমাগণ মগনারী ও মুঘল সৈন্যদের সমন্বরজাত। সপ্তদশ শতাব্দীতে চাকমাদের অনেকেই মুঘল ধর্ম গ্রহণ করে তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং তখনকার চাকমা প্রধানগণও মুসলমানী নাম ধারণ করেন। অতঃপর সেখানে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ফলে তারা হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব প্রকট হয়ে দেখা দেয় এবং হিন্দু ধর্ম অন্তর্হিত হয়।"11 ক্যাপ্টেন হার্বার্ট লুইন-এর মন্তব্যেও এই উক্তির সমর্থন মিলে। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন চাকমারা মুঘলদের বংশধর না হলেও এককালে এরা মুসলমান ছিল। কালের বিবর্তনে হয়ত ধর্মীয় ধারা পরিবর্তিত হয়েছে। এই মন্তব্যের সমর্থনে শ্রী সতীশচন্দ্র ঘোষ প্রতিপন্ন করেছেন যে, '১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত জামুল খাঁ, সেরমুস্ত খাঁ, সের দৌলত খাঁ, জান বক্স খাঁ, জব্বার খাঁ, টব্বার খাঁ, ধরম বক্স খাঁ প্রভৃতি চাকমা ভূপতিবর্গ 'খাঁ' উপাধি পরিগ্রহ করিতেন। তদানুষঙ্গিক ইহাও উল্লিখিত হইতে পারে যে, এই সময়ে তাঁহাদের কুলবধূগণেরও 'বিবি' খেতাব প্রচলিত ছিল।
এখনও অশিক্ষিত সাধারণে 'সালাম' শব্দে অভিবাদন করে এবং আশ্চর্য বা খেদসূচক আবেগে 'খোদায়' নাম স্মরণ করিয়া থাকে। 12
কেউ কেউ অনুমান করেন তখন মুসলিম (মুঘল শাসন) শাসনের প্রাধান্য ছিল বলে চাকমা রাজারা তাঁদের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য মুসলমানী নাম, 'খাঁ' খেতাব 13 ইত্যাদি গ্রহণ করেছিলেন, ফলে তাঁদের চাল-চলনে মুসলমানী ভাব এবং কথা-বার্তায়ও অনেক আরবী-ফারসী শব্দ অনুপ্রবেশ করেছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, 'খাঁ' উপাধি গ্রহণের বেলায় এই মতবাদ কতকটা শিথিল বলে ধরা যেতে পারে; কেননা, মধ্যপ্রদেশের কোন কোন স্থানে হিন্দুরাজাদের মধ্যেও 'খাঁ' খেতাব পরিলক্ষিত হয় এবং বাংলাদেশেরও কোন কোন হিন্দু পরিবারের 'খাঁ' পদবী দেখা যায়। কিন্তু মুসলমানী নাম আচার-ব্যবহার এবং কথাবার্তায় ইসলামী ভাব গ্রহণ করে এভাবে নিজের সত্তাকে বিলিয়ে দেবার প্রমাণ একমাত্র চাকমা সমাজেই দেখা গেছে। অনুরূপ দৃষ্টান্ত দুনিয়ার আর কোন জাতির ইতিহাসে দেখা যায় না।
প্রসঙ্গত আরও উল্লেখযোগ্য যে, চাকমা রাজাদের মুদ্রার প্রতিকৃতি খাস ফারসী ভাষায় উৎকীর্ণ ছিল। মুদ্রাগুলোর মধ্যে একটিতে খোদিত আছে 'আল্লাহু রাব্বী'। ১৪ এমন কি চাকমা রাজাদের কামানগুলোও 'ফতেহ খাঁ' 'কালু খাঁ' নামে পরিচিত।
'শ্রী শ্রী জয়কালী জয়নারায়ণ জব্বর খাঁ ১১৬৩'
[রাজা জব্বর খাঁর আমলের ফারসীতে উৎকীর্ণ (১১৬৩ মগাব্দ) মুদ্রার প্রতিকৃতি।
'জান বখশ খাঁ জামেনদার'
[চাকমা রাজা জান বখশ খাঁ জমিদারের
আমলের ফারসীতে উৎকীর্ণ মুদ্রার
প্রতিকৃতি]
চাকমা রাজাদের মধ্যে শের দৌলত খাঁর (১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দ) উপাসনাপদ্ধতি ছিল খাঁটি ইসলামী ভাবধারাসম্ভূত এবং মারেফাতের শিক্ষাই ছিল তাঁর সাধনার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়। সেই সাধনার বলে তিনি এতদূর উন্নীত হয়েছিলেন বলে জানা যায় যে, নিজের নাড়ীভূড়ি পর্যন্ত বের করে পানিতে পরিষ্কার করে পুনরায় তা যথাস্থানে সংস্থাপন করতে পারতেন। গৃহের এক নিভৃত কক্ষে তিনি আরাধনায় রত থাকতেন। তাঁর উপাসনাকালে কেউ যাতে তাঁর গৃহে প্রবেশ না করে এমন নির্দেশও দেওয়া থাকতো। কিন্তু একদিন তাঁর স্ত্রী কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সেই সাধনাকক্ষের ছিদ্রপথে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পান যে, রাজা তাঁর নিজের অস্ত্র বের করে পরিষ্কার করছেন। এই দৃশ্য অবলোকন করে রাণী অবাক হয়ে চীৎকার দিয়ে ওঠেন, ফলে রাজার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। কথিত আছে, সবগুলো অস্ত্র তিনি যথাস্থানে সংস্থাপন করতে পারেননি, যার ফলে তিনি উন্মাদ হয়ে যান। এ সম্পর্কে এখনও চাকমা সমাজে একটি গান প্রচলিত আছে:
মুনি দরবেশ ধ্যান গরে
পাগলা রাজা আপন চিৎ-কব্জা খৈ-নাই স্যান গরে।
[সাধু-দরবেশ যেমন ধ্যান করে থাকে, সেই রকম পাগলা রাজা নিজের কলজে বের করে স্নান করাতেন।
এ ছাড়াও চাকমা রাজারা যে ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন তার আরও অনেক প্রমাণ উপস্থিত করা যায়।
চাকমা রাজমহিষী শ্রীমতী কালিন্দী রাণী প্রথম দিকে ইসলাম ধর্মের প্রতি অটল বিশ্বাসী ছিলেন এবং ইসলামের অনেক অনুশাসনও তিনি মেনে চলতেন। রাজানগরে বিরাট মসজিদ তাঁর
নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মসজিদ তদারক ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মুসল্লিদের ইমামত করার জন্য তিনি একজন মৌলানা নিযুক্ত করেন। কথিত আছে, রাণী সেই মৌলানার কাছ থেকে অনেক সময় ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সম্পর্কে জ্ঞান সংগ্রহ করতেন। চাকমা রাজপরিবারের মহিলাদের অবরোধ প্রথা প্রচলিত ছিল। ইসলাম ধর্মের প্রতি বিশেষ বিশ্বাসী থাকা সত্ত্বেও শ্রীমতী কালিন্দী রাণী পরবর্তীকালে ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তন করেন। তিনি প্রথমে হিন্দুধর্ম এবং পরিশেষে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।
এসব প্রমাণাদি থেকে অনুমিত হয় যে, চাকমারা হয়ত বা মুসলমান ছিল। মুঘল বংশধর না হলেও এরা যে ব্রহ্মদেশের সাক বা সেক জাতির (ইসলামী শায়েখ বা শেখ থেকে) অন্তর্ভুক্ত ছিল তা অনুমান করা যায়।
কিন্তু চাকমাদের নিজেদের মতে উপরোক্ত যুক্তিসমূহ সর্বৈব মিথ্যা। মুসলমানী নাম গ্রহণ এবং তাদের মধ্যে মুসলিম প্রভাবের কারণ সম্পর্কে তারা শুধু এই বলতে চায় যে, অতীতকালে কোন এক চাকমা রাজা জনৈক মুসলমান নবাব কন্যার প্রেমে পড়ে তাঁকে বিয়ে করেন। সেই নবাব-কন্যার প্রভাবে চাকমারাজ ইসলামী ভাবধারার সমর্থক হয়ে ওঠেন। যার ফলে পরবর্তীকালে তাঁদের নামকরণ উপাধি গ্রহণ আচার-ব্যবহার প্রভৃতিতেও ইসলামী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ১৫ এক সময় চাকমা সমাজে কোনও রমণীর মৃত্যু ঘটলে তাকে রীতিমত কাফনপরিবৃত করে উত্তরশিয়রে কবরস্থ করা হতো এরূপ ঘটনাও বিরল নয়।
কোনও জাতির আদিপরিচয় উদঘাটনে প্রাচীন সংস্কারের দান অপরিসীম। এ দিক দিয়ে বিচার করলে চাকমাদের এই যুক্তি অনেকটা শিথিল বলে মনে হয়। কিন্তু চাকমারা কোনক্রমেই মানতে রাজী নয় যে, তারা কোনোকালে মুসলমান ছিল। চাকমারাজ শ্রী ভুবনমোহন রায় (মৃত্যু ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দ) দেখাতে চেয়েছেন যে, চাকমারা আসলে শাক্যবংশসম্ভূত মহামুনি বুদ্ধের বংশধর। ১৬ পুরাকালে যে তাঁরা পৈতাধারী ক্ষত্রিয় ছিলেন-একথাও তিনি উল্লেখ করেছেন।
মগভাষায় 'শাক্য' অর্থ 'সাক' আর যারা রাজবংশসম্ভূত তাদেরকে বলা হয় 'সাকমাং' ('মাং' রাজা অর্থে)। এই 'সাকমাং' থেকে 'চাকমা'। এই বিশেষ কথাটির উপর চাকমারা সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। চাকমাদের এই নিজস্ব মতামত এবং মগদের এই ভাষাগত অর্থের পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁরা প্রমাণ করতে চান যে, তাঁরা শাক্যবংশসম্ভূত মহামুনি বুদ্ধের বংশধর।
চাকমা জাতির আদি উৎস সম্পর্কে চাকমা সমাজে দুটি পুরাকাহিনী প্রচলিত আছে-'রাধামোহন-ধনপতি' উপাখ্যান এবং 'চাটিগাঁ ছাড়া'। এই কাহিনী দু'টি মূলত এক এবং দ্বিতীয়টি প্রথমটির দ্বিতীয় অধ্যায় মাত্র। উক্ত কাহিনীতে রাজা সাধ্বিংগিরির উল্লেখ রয়েছে। রাজা সাধ্বিংগিরি চম্পকনগরের (মতান্তরে চম্পানগরে) বাস করতেন। এই চম্পক বা চম্পা থেকে না-কি চাকমা জাতির নামকরণ করা হয়েছে। সেকালে চম্পানগরে বিজয় গিরি ও হরিশ্চন্দ্র নামে আরও দুজন সামন্ত রাজা ছিলেন। তাঁরা সবাই চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয়। চাকমারা নিজেদেরকে এঁদেরই বংশধর বলে দাবী করে। ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত 'রাজমালা'য় অবশ্য উক্ত কাহিনী দু'টি সম্বন্ধে মতভেদ রয়েছে।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এই চম্পানগর বা চম্পকনগরের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থিত করা যায় কি-না। কেউ কেউ অনুমান করেন, চম্পানগর বিহারে অবস্থিত। আবার চীন-পর্যটক ফা-হিয়েনের (৪২৯ খ্রীষ্টাব্দ) বর্ণনায় পাওয়া যায় চম্পানগর ছিল তখনকার সময়ে ভাগলপুরের কর্ণপুর রাজ্যের রাজধানী। ক্যাপ্টেন থমাস হার্বার্ট লুইন বলেন, 'চম্পানগর মালাক্কার নিকটবর্তী একটি শহর।' এ থেকে কেউ কেউ অনুমান করে থাকেন যে, চাকমারা 'মালয়বংশজ'। অবশ্য এ সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে।
ত্রিপুরার ইতিবৃত্ত 'রাজমালায়'য় চম্পা বা চম্পকনগরের কোন সরাসরি উল্লেখ নেই। তবে চাকমা সমাজে প্রচলিত একটি গানে চম্পানগর নয়-নূরনগরের উল্লেখ আছে। গানটির রচনাকাল জানা যায়নি, তবে চাকমা রাজাদের কেউ হয়ত একবার নিজ দেশ ছেড়ে ব্রহ্মদেশে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার ফলে দেশে ফিরে আসার অভিলাষ জ্ঞাপন করে তাঁরা ছড়া কেটে গান করতেন (আনুমানিক ৭০০ মগাব্দ):
ডোমে বাজায় দোল্ দগর
ফিরে যাইয়ম্ নূরনগর
[বাদ্যকরেরা ঢোল-ডগরা বাজায়। আমাদের নূরনগর ফিরে যেতে ইচ্ছা হয়।
এই নূরনগর পার্বত্য ত্রিপুরায় অবস্থিত। চাকমারা আগে (বর্তমানেও আছে) পার্বত্য ত্রিপুরায় ছিল। ত্রিপুরা জেলায় অবস্থিত গোমতী নদীর উৎস সম্বন্ধে যে আখ্যান প্রচলিত রয়েছে চাকমা সমাজে এখনও তা পবিত্রজ্ঞান করা হয়। পার্বত্য ত্রিপুরার সাথে চাকমাদের যোগসূত্র প্রাচীনকাল থেকেই। বস্তুত, এই নূরনগরই আসলে চম্পানগর কি-না তাও অবশ্য গবেষণার বিষয়।
সুতরাং এ-সব কাহিনীর উপর ভিত্তি করে একটা জাতির আসল পরিচয় উদ্ঘাটন সম্ভব নয়। চাকমাদের ধর্মভাবের পরিবর্তন সম্পর্কে প্রসঙ্গত আরও একটি প্রমাণ উপস্থিত করা যায়। নিম্নে কয়েকজন চাকমা রাজার নাম এবং তাঁদের সিংহাসন লাভের সময়কাল উল্লেখ করা হলো:
জব্বার খান ১৬৮৬ খ্রীষ্টাব্দ বেল্লাল খান ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দ জালাল খান ১৭০৬ খ্রীষ্টাব্দ শেরমুস্ত খান ১৭৩১ খ্রীষ্টাব্দ শের দৌলত খান ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দ জান বখশ খান ১৭৮২ খ্রীষ্টাব্দ ধরম বখশ খান ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ ইত্যাদি।
শেষের নামটির 'ধরম' (সংস্কৃত) কথাটি সম্ভবত বাংলা 'ধর্ম' শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং 'বঙ্গ' কথাটি খাঁটি ফারসী ভাষার শব্দ।
'ফতেহ খাঁ ১১৩৩'-
'শুকদেব রায় ১২১০ হিঃ'
[চাকমা রাজা ফতেহ্ খাঁর আমলের (১১৩৩ হিজরী) ফারসীতে উৎকীর্ণ মুদ্রা।
চাকমা রাজা শুকদেব রায় (১২১০ হিজরী)-এর আমলের মুদ্রার প্রতিকৃতি।
জয়কালী সহায় ধরম বখশ খাঁ'
[রাজা ধরম বশ খাঁর আমলের মুদ্রার প্রতিকৃতি।
'সিংহ চিহ্নিত চাকমা মুদ্রা'
ধরম বখশের শ্রীশ্রী মতী কালিন্দী রাণী এই সময়েই হিন্দু ভাবাপন্ন হন। পূর্বে চাকমা রাজাদের মুদ্রায় আরবী ফারসী শব্দের প্রতিকৃতি 'আল্লাহ' 'খোদা' ইত্যাদি লেখা থাকতো; কিন্তু এই ধরম বশ খান তাঁর মুদ্রার মধ্যে 'জয়কালী সহায়' খুদিত করেন।
পরে শ্রীমতী কালিন্দী রাণী বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন এবং রাজানগরে বাংলা ১২৭৬ সালের ৮ই চৈত্র 'মহামুনি' সংস্থাপন করেন। মন্দিরগাত্রে সর্বসাধারণের জ্ঞাপনার্থে একটি প্রস্তরফলক স্থাপিত হয়। নিম্নে প্রস্তরফলকটির হুবহু উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
শ্রী শ্রী ভোক্ত
ফড়া
বিজ্ঞাপন
সর্বসাধারণের অবগতার্থে এ বিজ্ঞাপন প্রচার করিতেছি যে, অত্র চট্টগ্রামস্থ পার্বত্যাধিপতি আদৌ রাজা সেরমস্থ খাঁ তৎপর রাজা যুকদেব রায় অতঃপর রাজা সের দৌলত খাঁ পরে রাজা জানবক্স খাঁ অপরে রাজা টর্বর খাঁ অনন্তর রাজা জর্বর খাঁ আর্য্যপুত্র রাজা ধরম বক্স খাঁ তৎসহধর্মিনী আমি শ্রীমতি কালিন্দী রাণি আপোন অদৃষ্ট সাফল্যাভিলাসে তাহানদ্বিগের প্রতি কৃতজ্ঞতাষুচক নমস্কার প্রদান করিলাম যদিও পূর্ববর্তীর ধর্মার্থে বৌদ্ধ ধর্মের শ্রীবৃদ্ধিসাধন জন্য দ্বিগদ্বেসিয় অনেকানেক যুধিগণ কর্তৃক সান্ত্রানুসারে ১২৭৬ বাঙ্গলার ৮ই চৈত্র দিবস অত্র রাজানগর মোকামে
স্থলকুল রত্নাকর 'চিহ্ন' সংস্থাপন হইয়াছে তাহাংশে শ্রী শ্রী ছাইকা মুনি করে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ঠাকুর স্থলকুল রাইবেক উলোকিত পূণ্যক্ষেত্রের দক্ষিণাংশে শ্রী শ্রী ছাইকা মুনি স্থাপিত হইয়া তদুপলদো হই্যেক সনাখেরিতে মহাবিষুর যে সমারোহ হইয়া থাকে ঐ সমারোহেতে ক্রয়-বিক্রয় করণার্থে প্রভেন্সমস্ত দোকানি ব্যাপারি আগমন করে ও মঙ্গলময় মুনি দর্শনে যে জাত্রিক উপনিত হয়, সোহারার দ্বিগ হইতে কোন প্রকারের মহাযুল অর্থাৎ কর গ্রহণ করা জাইবেক না ইদানিক কি ভাহারাতে উলোকিত ব্যক্তিগণ হইতে ইহা লঙ্গন করিয়া কর গ্রহণ করি বা করাই কি করে বা করায় তব এই জন্মে ঐ জর্মে এবং জন্মে জর্মে মহাপতিকিপাত্র পরিগণিত হইবেন।
কিমাধিক মিতি.... কালিন্দী রাণী
শ্রীমতি কালিন্দী রাণীর হস্তলিপি
শ্রীমতী কালিন্দী রাণী যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন এই অনুশাসনলিপির প্রতিটি অক্ষর তিনি যথাযথ প্রতিপালন করে গিয়েছেন। শ্রীমতী কালিন্দা রাণীর সময়ই চাকমারা পুরোপুরি বৌদ্ধধর্মের শাসনে চলে যায়।
চাকমাদের 'খাদি উৎস নির্ণয় সম্পর্কে যে-সব যুক্তি ও প্রমাণাদির উল্লেখ করা হয়েছে তার সঙ্গে তার ধর্মীয় বিষয়াদিও জড়িত। পাহাড়ী জাতি মাত্রই অপেক্ষাকৃত সরল। এদের মনোভাবও বিশেষ কোমল। এ-কারণে তাদের ধর্মবিশ্বাসেও স্থৈর্য লক্ষ্য করা যায় না। বর্তমানে, অবশ্য মিশনারীদের প্রচেষ্টায় অনেক পাহাড়ী সম্প্রদায়ও খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছে; কাজেই প্রবহমান ধর্মনীতির উপর নির্ভর করে কোন জাতির উৎস নির্ণয় সবক্ষেত্রে সঠিক ও নিরাপদ নয়।
তথ্য সূত্র
১. Vide Bengal Govt. Act XXIII dt. 1.8.1860.
২. Colonel Phayre: The History of Burma, p. 39.
৩. দেঙ্গ্যাওয়াদি আরেদফং, পৃ ১৭-১৯।
৪. 'দেঙ্গ্যাওয়াদি আরেদফুং' এবং 'রাজমালা'র বর্ণনায় যথেষ্ট সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। শুধুমাত্র রাজা-বাদশাহদের নামের মধ্যে কিছু কিছু তফাৎ দেখা যায়। যথা: রাজমালা দেঙ্গ্যাওয়াদি আরেদফুং অরুণ যুগ (চাকমা-রাজা ৬৯৬ মগাব্দ) ইয়াংজ (৬৯৬ মগাব্দ) মইসাং রাজা পৃ ৯৮ মংদুই রাজা পৃ ১১২ মারিক্যা রাজা পৃ ৫৭ মরেকাজ রাজা পৃ ৫৫ জনু রাজা (৮৮০ মগাব্দ) পৃ ৩৯ চনুই রাজা (৮৮০ মগাব্দ) পৃ ৫৮ সাজেস্বী (৮৮১ মগাব্দ) পৃ ২৩ সাজাইয়ু
(৮৮১ মগাব্দ) পৃ ৫৯ ইত্যাদি। 2. Vide letter No. 1985/797 LR dt. 1. 9. 1881.
৬. সুবোধ ঘোষঃ ভারতের আদিবাসী (উদ্ধৃত), পৃ৪।
4. Census Report of Bengal 1931.
T.H. Lewin: The Hill Tracts of Chittagong and the Dwellers Therein, p. 62. 20 Colonel Phayre: Journal of Asiatic Society of Bengal, No. 145, 1844, pp 201-202.
১০. সতীশচন্দ্র ঘোষঃ চাকমা জাতি, পৃ ৫।
of India Mills: Notes on a Tour. in the Chittagong Hill Tracts in 1926. Census
1931.
১২. সতীশচন্দ্র ঘোষ: প্রাগুক্ত, পৃ ৬।
১৩০ভাইর দীনেশচন্দ্র সেনঃ 'বঙ্গভাষা ও সাহিত্য'। 'সেকালের উপাধিগুলি কিছু অদ্ভুত রকমের ছিল। "পুরন্দর খাঁ'
খাঁ' এ সব রাজদত্ত খেতাব।'
১৪. সতীশচন্দ্র ঘোষ: প্রাগুক্ত, পৃ ৬৯।
১৫. শ্রী মাধবচন্দ্র চাকমাধর্মী: শ্রী শ্রী রাজনামা, পৃ ভূমিকা c/o
১৬. ভবন মোহন রায়: চাকমা রাজাবংশের ইতিহাস, (১৯১৯) পৃ ৩৭।
#চাকমা #উপজাতি #আদিবাসী