09/08/2021
বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি এবং আচার আচরণ নিয়ে আমরা বাংলাদেশের মানুষ হাসাহাসি করি। কিন্তু একটা কথা বলে নেওয়া ভালো সম্ভবত রেসিজম, বডিশেমিং, বুলিয়িং এসবে ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট দুনিয়ায় অবিসংবাদিত চ্যাম্পিয়ন। তার মাঝেও আমরা বাংলাদেশের মানুষ সেরার সেরা হওয়ার কথা! গায়ের রঙ, উচ্চতা, চিকন মোটা, শারীরিক কোন প্রতিবন্ধকতা এসব নিয়ে নিজেরের অজ্ঞাতে অবলীলায় এমন কথা অন্যদেরকে নিয়ে আমরা বলি যে এসব উন্নত দেশে ক্রিমিনাল অফেন্স! এরকম কথা ইউরোপ আমেরিকায় বললে সাথে সাথে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিবে।
তবে আজকে আমি কথা বলতে চাইছি প্রফেশন এবং শারীরিক অবস্থা দুইটা মিলিয়ে একধরনের রেসিস্ট আচরণ আমরা করি তা নিয়ে। বেশ জ্ঞানী গুনী স্মার্ট লোকজনও করি। প্রায় সময় এটাকে কেউ অন্যায় বলেই মনে করে না! ধরেন প্রায়শই আমরা নোংরা হয়ে থাকলে বলি " শালা মেথর"! এরকম গালি প্রচুর আমরা দেই যেমন "শালা নাপিত, কসাই, শালা কামলা, বা তোরে তো রিক্সাওয়ালার মত লাগছে"! মেয়েদের ক্ষেত্রে বলি " তোরে তো তোমারে কাজের মেয়ে, বুয়ার মত লাগছে!"
একটা উদাহরণ দেই। বাংলাদেশের নাটকের পরিচিত মুখ শবনম ফারিয়া Sabnam Faria । অভিনয় খারাপ করে না, এক্সপ্রেশন দিতে পারে কিছু অন্য অনেক রোবোটিক অভিনেত্রীদের তুলনায়। সবচেয়ে বড় কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছুটা হিউমার ছড়ানোর জন্য ভালোই লাগে আমার তারে! তো তার মত একজন মিডিয়ার লোকের স্ট্যাটাস দেখুনঃ
০৩ জুলাই ২০১৯ এ সে তার ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস দেয় যেটি ২০২১ এর জুলাইয়ে সে আবার শেয়ার দিয়েছেঃ //Boys think they look gangsta while smoking cigarette, t**e rikshawala lage re!//
সে যা বলেছে তার মিনিং হল এমন
"ছেলেরা মনে করে সিগারেট টানার সময় তাদের গ্যাংস্টার এর মত লাগে, তোকে রিক্সাওয়ালা লাগে রে"! সে বুঝাতে চেয়েছে যে যেসব ছেলেরা সিগারেট টানে তারা নিজেদের কুল ভাবে, গ্যাংস্টার এখানে পজিটিভ হিরোইক ইমেজ অর্থে ব্যবহৃত। কিন্তু আসলে তাদেরকে তখন রিক্সাওয়ালার মত লাগে।
প্রথমে পড়লে আপনার মনে হবে মেয়েটা তো পজিটিভ ম্যাসেজ দিতে চাইছে। ধূমপান বিরোধী একটা লেখা। নিরুৎসাহিত করার জন্য সে এটা বলেছে। এইটায় আমিও একমত। কিন্তু একটা অস্বাস্থ্যকর বিষয়ের বিপক্ষে বলতে গিয়ে সে যেই উপমা ব্যবহার করেছে সেটা চূড়ান্ত বর্ণবাদী।
"তোকে রিক্সাওয়ালার মত লাগে রে" এই অংশটুকুর মানে কি? রিক্সাওয়ালা মানেই দেখতে খারাপ? নাকি সেটা সমাজে অগ্রহণযোগ্য কোন চেহারা? একজন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের এএসপি, একজন লেখক এদের চেহারা কেমন? একজন মেথরের চেহারাই বা কেমন?
আল্লাহর দুনিয়ায় কি কোন পেশার জন্য চেহারা কেমন হবে এটা নির্ধারণ করা আছে? এক বাসার মালিক মহিলা দেখতে সুশ্রী নাও হতে পারে, সেই বাসায় সহায়তাকারী কাজের মেয়েটার সুন্দরী হতে পারে, নাকি পারে না? সৃষ্টি কর্তা কি কাউকে এমনভাবে বানিয়েছেন যে সে শুধু একটা বিশেষ পেশায়ই কাজ করতে পারবে? আমার নিজের চেহারা এভারেজ বলে মনে করি আমি। তো আমি আজকে রিক্সাওয়ালা হলে কার কি সমস্যা? আমার চেহারায় কি এই কথা লেখা আছে যে আমি রিক্সাওয়ালা হতে পারব না? আমাকে ইউএনও এডিসি, এডমিন ক্যাডারে জব করতে হবে?
আমার প্রফেশন আমার সক্ষমতার সাথে এবং আমার চয়েসের সাথে জরিত, আমার চেহারার সাথে না! কারও চেহারায় লেখা থাকে না সে কি কাজ করবে ভবিষ্যতে। শবনম ফারিয়ার ওয়ালে এই স্ট্যাটাসটা এখনো আছে, আমি নিশ্চিত তার মাথায় এইটুকু বুদ্ধি নাই যে এইটাকে সে একটা রেসিস্ট আচরণ মনে করবে!
কিছু কিছু পেশাকে অবমাননা করার সাথে আমাদের তথাকথিত ফালতু অহম জরিত আছে। কয়দিন আগে আমার ইউনিভার্সিটির ( রাজশাহী) বিজনেস ফ্যাকাল্টির একটা ছেলে নিউজে আসল। বিশেষত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজে এই নিয়ে ব্যাপক হইচই।
ছেলেটা লকডাউনে বেকার না বসে থেকে ভ্যান চালানো শুরু করেছে, পরিবারের আর্থিক অনটন দূর করতে। এই খবর প্রথমে একজনের স্ট্যাটাস থেকে ছড়াতে ছড়াতে বড়সড় নিউজ। এরপর আসলে হাজি মোহাম্মদ মোহসীনের দল। সবাই ছেলেটাকে সাহায্য করতে উঠেপড়ে লাগলেন। পরে জানা গেল ছেলেটা কারও কাছ থেকে সাহায্য নেবে না!
এখানে আমাদের ভার্সিটি পাশ লোকেদের ইগো ব্যাপক আহত হয়েছে। কেন ভার্সিটির একটা ছেলে অটো চালাবে, অন্য সব ভার্সিটি পাশ লোকেরা ব্যাপক লজ্জিত তাতে! আমি বলি কি সেই ছেলেটাই সত্যিকার শিক্ষা নিয়েছে রাবি থেকে। আমরা, তোমরা এবং আপনারা গণ্ডমূর্খ হয়েছি/হয়েছ/ হয়েছেন, নিয়েছেন কেবল ডিগ্রি! নিজের পরিবারের পাশে দাড়াতে ভ্যান চালানো লজ্জার কাজ, না?
এই যে লক্ষ লক্ষ গ্রাজুয়েট আমরা বানাই, পারে না শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে, ইংরেজিতে আমি বাড়ি যাই বলতে পারে না, সাইকোলজি থেকে সম্মান পাশ করে সাইকোলজি বানান পারে না, কিন্তু আছে শুধু পেটভরা অহংকার ( মাথায় কিছু নাই, খালি) কিন্তু এরা সব শার্ট প্যান্ট গ্লাস লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়, বাপের টাকায় বাইক কিনে উড়ে বেড়ায়! বাপের ক্ষেতে একটু হেল্প করতেও রাজি না!
অটো চালাবে না, রিক্সা চালাবে না, চাষবাসে অংশ নেবে না, ছোট খাট জব করবে না, ছোট ব্যবসাতেও রাজি না, গার্মেন্টস এ যাবে না, দলবেঁধে আড্ডা দেবে, ইভটিজিং করবে, মোবাইলে পর্ন দেখবে, আর বাবা মায়ের সাথে করবে দুর্ব্যবহার!
এসবের পেছনে আমাদের মত তথাকথিত লোকেরা দায়ী, এই যে রিক্সা চালাইতে, সেলুনে কাজ করলে, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি হইলে আমাদের জাত যায়! আমরাই এসব শিখিয়েছি। ফারিয়া একা না, পারিবারিক দিক থেকে আমরা যে যাই অর্জন করি আমরা সবাই একইরকম! সারা পৃথিবী এসব দিক থেকে কোথায় গেছে আর আমরা কোথায় আছি?
একটা দেশের উন্নয়ন খালি বিল্ডিং, টাকা, রাস্তা দিয়ে হয় না। মানুষের চিন্তা চেতনার উন্নয়ন সবচেয়ে জরুরি। এর অর্থনৈতিক ফলাফল ও সুদূরপ্রসারী। একটা দেশের যুবক শ্রেণীর সবাই সরকারি চাকুরীর পিছনে দৌড়ালে, না পেলে বেকার থাকলে কিভাবে দেশ এগোয়? দেশের ইকোনমি তো বাড়ছে কিন্তু আপনি যদি কোন কাজে যোগ না দেন, এই ইকোনমির হিস্যা তো আপনি পাচ্ছেন না, আপনার অংশগ্রহণ শূন্য হলে দেশের নাগরিক হিসেবেও তো আপনার দায় আছে, না???