25/06/2021
|♦| নিবিড় পল্লী থেকে আসা বনেদী শহরবাসীর জীবনের গল্প। ♦|
নিবিড় সেই পল্লী জীবন, যেখানে ছিল না চলাচলের ভাল রাস্তাঘাট, পথে পথে বাঁশের সাঁকো আর ফেরি নৌকায় পারাপার হয়ে যেত হয়েছে উপজেলা, জেলা শহরে, সেও বহুদূরের পথ। দিনব্যাপী হাঁটা ছাড়া আর কোন বাহন বলতে নৌকাই ছিল যেখানে অবলম্বন, তবে সেটাও বর্ষাকালের জন্য। সে দিনটা ছিল ১৯৭৯ইং সালের ২৮শে আগষ্ট মঙ্গলবার সকাল ৯ টায় ঢাকায় আসার উদ্দেশ্য যাত্রা করেছিলেন আজকের এই শহরবাসী লোকটি। তিনি সেই দিন বাড়ী থেকে আসার সময় স্যান্ডেল হাতে লুঙ্গি পড়ে ক্ষেতের আইল ধরে সুদূর ১৫ কিলোমিটার পথ হেটে জেলা শহর নেত্রকোনায় পৌঁছান। দিন গড়িয়ে রাত হয়ে আসলে মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ময়মনসিংহগামী ট্রেনে চড়ে ময়মনসিংহ জংশন স্টেশনে পৌঁছান। তারপর অপেক্ষা বাহাদুরাবাদ ঘাট থেকে ছেড়ে আসা এইটডাউন লোকাল ট্রেনের জন্য। সেই এইটডাউন লোকাল ট্রেন রাত সাড়ে তিনটায় ময়মনসিংহ জংশন স্টেশন থেকে ছেড়ে ঢাকায় কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছায় তখন সময় সকাল সাড়ে আটটা। ঘুমকাতুরে ও সারাদিনের ক্লান্তি ও অবসাদে তিনি পৌঁছালেন উত্তর শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনীর ৬নং বিল্ডিং-এ। রেলওয়ে কলোনীর ৬নং বিল্ডিং-এ তখন সাবলেট হিসেবে তাঁর চাচাতো ভাই সপরিবারে থাকতেন।
১৯৭৮ইং সনের মে মাসের কোন এক তারিখে জীবনে প্রথমবার ঢাকায় এসেছিলেন বেড়াতে, সেই সময়ে ভাবী বলেছিলেন ডিগ্রী পরীক্ষার পর যেন ঢাকায় চলে আসেন। ছেলে-মেয়েদের গাইড করা তথা পড়াশোনায় সাহায্যে করার জন্য বড় ভাবী তাঁকে ঢাকায় আসতে বলেছিলেন। তাই তিনি কথা রাখলেন এবং আসলেনও কিন্তু, সমস্যা হ'লো রাতে শুতে হবে বারান্দায় সে যাই হউক, মশারী নেই, মশার কামড় খেতে হবে, আপত্তি দেয়ায় ভাবী অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা মশারী যোগার করলেন সেটাও ছিল কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। তবে ঘুমের ঘোরে মশার কামড় খেয়ে শরীরটা একদম জ্বালাপালা হয়ে গিয়েছিল। সেই ভাই-ভাবীর পরিবারে ৯মাস থাকার পর নিজ চেষ্টায় চলে যান সিদ্ধেশ্বরী মহল্লায়, কিন্তু শাহজাহানপুর মহল্লার মায়া ছাড়তে পারেননি, তাই পুনরায় চলে আসেন শাহজাহানপুরে। আর এই শাহাজাহানপুরের একটি স্মৃতি মনে পড়ে, রাতের খাবারের ব্যবস্থা হয়নি। সময় তখন বারোটা, হোটেলগুলোও বন্ধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাই শহীদবাগ মহল্লায় মেছে থাকা সরকারি জগন্নাথ কলেজের ছাত্রের নিকট দুই টাকা হাওলাত চেয়ে না পেয়ে সেই ছাত্রের রুমমেইটের নিকট থেকে দুই টাকা ও নিজের কাছ থাকা এক টাকা চার আনা, এই মোট তিন টাকা চার আনা দিয়ে শহীদবাগ হোটেল সে রাতের খাবার সম্পন্ন করলেন। তখন টাকা রোজগারের একটাই পথ সে হ'লো বাসায় বাসায় গিয়ে ছাত্র-ছাত্রী প্রাইভেট পড়ানো। আজকের এই বনেদী শহরবাসী লোকটির জন্ম ১৯৫৩ইং সনের মে মাসে, তখন ছিল পবিত্র রমজান মাস ফজরের নামাজের সময়টাই ছিল জন্মক্ষণ। তাঁর মা তাকে শোনাতেন তাঁর জন্ম রমজান মাসে হওয়ায় সারা রমজান মায়ের আর রোজা রাখা হয়নি। মা এখন কবরবাসী মা'র এই কথাটি প্রায়ই মনে পড়ে, তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যান, কারণ ১৯৫৮ইং সনের নভেম্বর মাসে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই তাঁদের চার ভাইবোনকে নিয়ে সংসারের দায়ভার পড়লো মায়ের কাঁধে৷ যদিও পিতার রেখে যাওয়া চাষের জমি ছিল ১৮বিঘা, কিন্তু বর্গা চাষীদের নিকট থেকে ফসল বুঝে নেয়া, সেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে৷ তাই মাকে সংসার চালাতে গিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, এই ভেবে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷ লেখাপড়া শুরু হয়েছিল নানা বাড়ীতে বাল্যশিক্ষা দিয়ে, পরবর্তীকালে বড় ভাইয়ের সাথে সুসং দূর্গাপুর এলাকায় সুনাম খ্যাতি সম্পন্ন 'মৌ' মাদ্রাসায়। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষকের কঠোর শাসনের কারণে সে যাত্রায় মাদ্রাসায় লেখাপড়া পাঠ চুকিয়ে বাড়ী এসে, পাশের গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ১৯৬৪ইং সনে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। তারপর থেকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি, কিন্তু ঐ সময়কার সমাজ সভ্যতায় দাদাজান ছিলেন গদীনিশিন পীর সাহেব এবং বাবা ছিলেন ময়মনসিংহ জজকোর্টের জুরি বোর্ডের মেম্বার এবং নিজ বাড়ীর প্রাঙ্গনে অবস্থিত সাড়ে তিনশত বছরের পুরানো এবং কয়েকটি গ্রামের একমাত্র মসজিদটির ঈমাম। বড় চাচা ছিলেন নেত্রকোনা আঞ্জুমান গভঃ হাই স্কুলের হেড মাওলানা এবং মেঝো চাচা ছিলেন দাদাজানের দেয়া খেলাফত প্রাপ্ত গদীনিশিন পীর সাহেব। দাদাজান যদিও বেঁচে নেই তবুও পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে মাদ্রাসা শিক্ষাই ছিল তাঁর প্রাথমিক গুরুত্ব।
১৯৬৭ইং সনে প্রাইমারী স্কলারশীপ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করায় মেধাবী হিসেবে জ্ঞাতি পাওয়ায় তাঁকে নিকটবর্তী কোন হাই স্কুলে ভর্তি না করে পাশের উপজেলার খ্যাতি সম্পন্ন সি.কে.পি ইনস্টিটিউশন বারহাট্টায় ভর্তি করা হয়। তাঁকে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি কালীন সময়ে অনিবার্য কারণে জন্ম ১৯৫৭ইং সন লিখতে হয়েছে। ১৯৭০ইং সনে ৮ম শ্রেণীতেও জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করারও সুযোগ হাত ছাড়া হয়নি। ১৯৭৩ইং সনে এস,এস,সি এবং নেত্রকোনা কলেজ থেকে ১৯৭৫ইং সনে এইচ,এস,সি ও ১৯৭৮ইং সনে স্নাতক পাশের পর ১৯৮১ইং সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত তৎকালীন সরকারী জগন্নাথ কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এম,এস,এস ডিগ্রী অর্জন করেন (তবে সেশন জোটের কারনে ১৯৮৩ ইং সালে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়)। ইত্যবসরে সরকারী চাকুরীর বয়স ২৭ বছর অতিক্রম করায় বিভিন্ন পত্রিকায় চাকুরী করা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৮৩ইং সনের ৩০ নভেম্বরে ঢাকায় শাহজাহানপুর নিবাসী জনৈক বাড়ীওয়ালার মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ বিয়ের ঘটক হিসেবে তখন দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন সময়ে কমলাপুর স্টেশনের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার মহোদয়।
তিনি ১৯৮৬ইং সনে ব্র্যাক-আরডিপিতে প্রোগ্রাম অর্গানাইজার পদে চাকুরীতে যোগদান করেন এবং ১৯৯০ইং সন থেকে ১৯৯৩ইং সনে পর্যন্ত অত্র ব্র্যাক-আরডিপির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন৷ পরবর্তীকালে এনজিও বিষয়ক কনসালটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এলএল.বি-তে ভর্তি হয়ে সফলতার সাথে এলএল.বি পাশ করেন। তিনি ৩ (তিন) সন্তানের জনক এক মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়ে ও ছেলেরা লেখাপড়ায় ভাল ফলাফল করেছে এবং মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেছে। দীর্ঘদিন তিনি শাহজাহানপুর ও খিলগাঁও মহল্লায় ভাড়া বাড়ীতে বসবাস করেছেন, বর্তমানে পূর্ব নন্দীপাড়ায় নিজস্ব বাড়ীতে বসবাস করছেন। তিনি নিজে এখন আর গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার সময় করতে পারেন না বা সময় হয় না। এদিকে ছেলে-মেয়েও দাদার বাড়ীতে যাওয়ার খুব একটা তাগিদ অনুভব করে না। তাই বলছি যে, এভাবেই দিনে দিনে সৃষ্টি হয়েছে আজকের এ তথা কথিত বনেদী শহরবাসীর সংখ্যা। নিবিড় পল্লী থেকে আসা বিশাল এ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলেছে ঘনবসতি এ প্রাণের শহর ঢাকায়। পিতা-মাতার ভিটে-মাটির জন্য তাঁদের আর মন পোড়ায় না, সে সাথে গ্রামীণ জনপদেও কেবলই বিরাজ করছে গভীর শূন্যতা এবং শূন্যতা।
© ♦-খন্দকার হাবিবুর রহমান♦