30/09/2024
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ৩২টি রোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় এবং বিভিন্ন জাতের ধানে শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে ১০টি মুখ্য রোগ বাকি ২২টি গৌণ। এ রোগগুলো দ্বারা ধানের ফলন শতকরা ১০-১৫ ভাগ কম হয়। রোগগুলোর মধ্যে ভাইরাসজনিত ২টি, ব্যাকটেরিয়াজনিত ৩টি, ছত্রাকজনিত ২২টি, কৃমিজনিত ৫টি। নিম্নে ধানের ৯টি রোগের বিবরণ ও রোগ দমন ব্যবস্থাপনা বর্ণনা করা হলো-
১. রোগের নাম : বাদামি দাগ রোগ (Brown spot)
রোগের কারণ : বাইপোলারিস ওরাইজি (Bipolaris oryzae) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
এ রোগটি চারা অবস্থা থেকে যে কোনো বয়সের ধান গাছে হতে পারে। তবে চারার বয়স বেশি হলে রোগটির প্রকোপ বেশি দেখা যায়। মাটিতে পুষ্টি উপাদানের অভাব বা পানির অভাব হলে রোগের মাত্রা বেড়ে যায়।
রোগের লক্ষণ
পাতায় প্রথমে তিলের দানার মতো ছোট ছোট দাগ পড়ে। দাগগুলো বড় হয়ে মাঝখানে সাদা ও কিনারা বাদামি হয়ে যায়।
একাধিক দাগ মিলে বড় দাগ সৃষ্টি হয়ে পাতাটিকে মেরে ফেলতে পারে। ধানের পাতার চেয়ে রোগটি বীজে বেশি দেখা যায়। রোগ আক্রান্ত গাছে অপুষ্ট বীজ হয় ও বাদামি বর্ণ হয়।
রোগের প্রতিকার : সুস্থ বীজ বপন করতে হবে; বীজ গরম পানিতে (৫০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ৩০ মিনিট ভিজে রাখতে হবে) শোধন করতে হবে; Benda 50 WP (কার্বেন্ডাজিম ) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে; জৈব সার ব্যবহার করতে হবে; জমিতে সঠিক পরিমাণ নাইট্রোজেন ও পটাশ সার ব্যবহার করলে রোগ কমে যায়; সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা করতে হবে; জমিতে রোগ দেখা দিলে Benda 50 WP (কার্বেন্ডাজিম ) প্রতি লিটার পানিতে ১.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
২. রোগের নাম : ব্লাস্ট রোগ (Blast)। ধান গাছের ৩টি অংশে রোগটি আক্রমণ করে থাকে। গাছের আক্রান্ত অংশের ওপর ভিত্তি করে এ রোগ তিনটি নামে পরিচিত যেমন- ১. পাতা ব্লাস্ট, ২. গিট ব্লাস্ট এবং ৩. নেক/শীষ ব্লাস্ট।
রোগের কারণ
পাইরিকুলারিয়াগ্রিসিয়া (Pyricularia grisea) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
এ রোগটি আমন ও বোরো উভয় মৌসুমেই হতে পারে। ধানের চারা অবস্থা থেকে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় এ রোগটি হতে পারে। বীজ, বাতাস, কীটপতঙ্গ ও আবহাওয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। রাতে ঠাণ্ডা, দিনে গরম ও সকালে পাতলা শিশির জমা হলে এ রোগ দ্রুত ছড়ায়। হালকা মাটি বা বেলেমাটি যার পানি ধারণক্ষমতা কম সেখানে রোগ বেশি হতে দেখা যায়। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার এবং প্রয়োজনের তুলনায় কম পটাশ সার দিলে এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়। দীর্ঘদিন জমি শুকনা অবস্থায় থাকলেও এ রোগের আক্রমণ হতে পারে।
রোগের লক্ষণ
পাতা ব্লাস্ট
পাতায় প্রথমে ডিম্বাকৃতির ছোট ছোট ধূসর বা সাদা বর্ণের দাগ দেখা যায়। দাগগুলোর চারদিক গাঢ় বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এ দাগ ধীরে ধীরে বড় হয়ে চোখের আকৃতি ধারণ করে। অনেক দাগ একত্রে মিশে পুরো পাতাটাই মেরে ফেলতে পারে। এ রোগে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হলে জমিতে মাঝে মাঝে পুড়ে যাওয়ার মতো মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রে খোল ও পাতার সংযোগস্থলে কাল দাগের সৃষ্টি হয়। যা পরবর্তীতে পচে যায় এবং পাতা ভেঙে পড়ে ফলন বিনষ্ট হয়।।
গিঁট বা নোড ব্লাস্ট
ধান গাছের থোড় বের হওয়ার পর থেকে এ রোগ দেখা যায়। গিঁটে কালো রঙের দাগ সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে এ দাগ বেড়ে গিঁট পচে যায়, ফলে ধান গাছ গিঁট বরাবর ভেঙে পড়ে।
নেক বা শীষ ব্লাস্ট
এ রোগ হলে শীষের গোড়া অথবা শীষের শাখা প্রশাখার গোড়ায় কাল দাগ হয়ে পচে যায়। শীষ অথবা শীষের শাখা প্রশাখা ভেঙে পড়ে। ধান চিটা হয়।
রোগের প্রতিকার
রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার করতে হবে।
মাটিতে Arko Joibo (জৈব) সারসহ সুষম মাত্রায় সব ধরনের সার ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত জমির খড়কুটা পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং ছাই জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। সুস্থ গাছ হতে বীজ সংগ্রহ করতে হবে, দাগি বা অপুষ্ট বীজ বেছে ফেলে দিয়ে সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে। রোগের আক্রমণ হলে জমিতে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। জমিতে সব সময় পানি রাখতে হবে। রোগের শুরুতে হেক্টরপ্রতি ৪০ কেজি (বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। ট্রাইসাইক্লাজল (ট্রুপার ৭৫ ডব্লিউপি) বা টেবুকোনাজল + ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন (নাটিভো৭৫ ডব্লিউপি) প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৩. রোগের নাম : খোল পচা রোগ (Sheath rot) রোগের কারণ স্যারোক্লেডিয়াম ওরাইজি (Sarocladium oryzae) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার : এটা বীজবাহিত। রোগাক্রান্ত নাড়া ও বিকল্প পোষকে অবস্থান করে। মাজরা পোকা ও টুংরো রোগ আক্রান্ত গাছে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। গরম ও সেঁতসেঁতে আবহাওয়ায় এ রোগ বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টির ঝাপটায় এ রোগ ছড়ায়। খোলপচা রোগটি সব মৌসুমেই দেখা যায়। সাধারণত গাছের থোর অবস্থা এ রোগটির উপযোগী সময়।
রোগের লক্ষণ
রোগটি কোনো অবস্থাতেই পাতায় হয় না। খোলপচা রোগটি যে কোনো খোলে হতে পারে তবে শুধুমাত্র ডিগ পাতার খোল আক্রান্ত হলেই ক্ষতি হয়ে থাকে। ধানে থোড় আসার সময় এ রোগের আক্রমণ দেখা যায়। প্রথমে শেষ পাতার খোলের ওপর গোলাকার বা অনিয়মিত লম্বা দাগ হয়। দাগের কেন্দ্র ধূসর ও কিনারা বাদামি রঙ বা ধূসর বাদামি হয়। দাগগুলো একত্রে বড় হয়ে সম্পূর্ণ খোলেই ছড়াতে পারে। থোড়ের মুখ বা শীষ পচে যায় এবং গুঁড়া ছত্রাংশ খোলের ভেতর প্রচুর দেখা যায়। রোগের আক্রমণ বেশি হলে অনেক সময় শীষ আংশিক বের হয় বা মোটেই বের হতে পারে না এবং ধান কালো ও চিটে হয়ে যায়।
রোগের প্রতিকার
সুস্থ বীজ ব্যবহার করতে হবে। Benda 50 WP (কার্বেন্ডাজিম ) প্রতি কেজি বীজে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে শোধন করতে হবে। জমির আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। সুষম সার ব্যবহার ও ইউরিয়া সার কম প্রয়োগ করতে হবে। পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। খোল পচা দেখা দিলে জমির পানি শুকিয়ে কিছুদিন পর আবার সেচের পানি দিতে হবে। P Zole
250 EC (প্রোপিকোনাজল ২৫০ ইসি) ১ লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
৪. রোগের নাম : খোলপোড়া রোগ (Sheath blight) রোগের কারণ : রাইজোকটোনিয়া সোলানি (Rhizoctonia solani) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার
আউশ ও আমন মৌসুমে এ রোগটি বেশি হয়। মাটি ও পরিত্যক্ত খড়কুটায় ছত্রাক থাকে। বেশি তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় এ রোগের প্রকোপ বেশি হয়। অতিরিক্ত পরিমাণে ইউরিয়া সারের ব্যবহার করলে এবং ঘন ঘন বৃষ্টিপাত ও জমিতে পানি জমে থাকলে ও এ রোগের আক্রমণ বাড়ে।
রোগের লক্ষণ : পানির স্তর বরাবর খোলের ওপর পানি ভেজা সবুজ রঙের দাগ পড়ে। দাগগুলোর কেন্দ্র ধূসর এবং প্রান্তে বাদামি রঙ ধারণ করে। দাগগুলো একত্র হয়ে পাতার খোল ও পাতায় ছড়িয়ে পড়ে যা দেখতে গোখরা সাপের মতো মনে হয়। আক্রমণ বেশি হলে ক্ষেতের মাঝে মাঝে আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো দেখায়।
রোগের প্রতিকার : রোগ সহনশীল জাত ব্যবহার করতে হবে। সঠিক দূরত্বে চারা রোপণ (২০-২৫ সেমি দূরে) ও আক্রান্ত জমির খড়কুটা জমিতে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সুষম সারের ব্যবহার এবং অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহার পরিহার করা। রোগ দেখা দেয়ার পর বিঘাপ্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ এবং Hexan 5 EC ( হেক্সাকোনাজল ) প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।
৫. রোগের নাম : গোড়া পচা ও বাকানি রোগ (Foot rot and Bakanae) রোগের কারণ : ফিউজারিয়াম মোনিলিফরমি (Fusarium moniliforme) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে। এ ছত্রাক জিবেরিলিন নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ করে যা গাছের দ্রুত অঙ্গজ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। বাকানি আক্রমণের ফলে ফসলে শতকরা ৩০ ভাগ পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে।
রোগের বিস্তার : বীজ বাকানি রোগের অন্যতম বাহক। মাটি, পানি, বাতাসের মাধ্যমেও এ রোগের জীবাণু এক জমি হতে অন্য জমিতে ছড়ায়। মাটিতে আগে থেকেই এ রোগের জীবাণু থাকলে ধান গাছে এ রোগ হয়। অতিরিক্ত ইউরিয়া সারের প্রয়োগে এ রোগের আক্রমণ বাড়তে থাকে। উচ্চ তাপমাত্রায়ও (৩০-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এ রোগের আক্রমণ বেশি হয়।
রোগের লক্ষণ
বাকানি রোগ ধান গাছের চারা অবস্থা থেকে শুরু করে থোড় আসা পর্যন্ত যে কোনো সময়ে হতে পারে। তবে চারা অবস্থায় হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে থাকে। আক্রাস্ত ধানের চারা সাধারণ চারার চেয়ে দ্বিগুণ লম্বা হয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আক্রান্ত চারার পাতা হালকা সবুজ রঙের ও দুর্বল মনে হয়। আক্রান্ত কুশি চিকন ও লিকলিকে হয়ে যায়। কোনো কোনো সময় গাছের গোড়ার দিকে গিঁট হতে শিকড় বের হতে দেখা যায়। গাছের গোড়া পচে যায় এবং ধীরে ধীরে আক্রান্ত গাছ শুকিয়ে মরে যায়। চারা অবস্থায় বা রোপণের পরপরই এ রোগে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত গাছে কোনো ফলন হয় না। তবে গর্ভাবস্থায় এ রোগ হলে চিটা এবং অপুষ্ট ধান বেশি হয় এবং শীষ অনেক ছোট হয়।
রোগের প্রতিকার
রোগ সহনশীল ধানের জাত চাষ করতে হবে। সুস্থ বীজের ব্যবহার করতে হবে। খড়কুটা জমিতে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বীজতলা হতে চারা তোলার সময় রোগাক্রান্ত চারা বেছে ফেলে দিতে হবে। আক্রান্ত গাছটি ফুল আসার আগেই তুলে ফেলতে হবে। চারা রোপণের পর এ রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত গাছ তুলে পুড়িয়ে নষ্ট করে দিতে হবে। সুষম মাত্রায় ইউরিয়া সার ব্যবহার করেও এ রোগের প্রকোপ কমানো যেতে পারে। গোড়া পচা রোগ দেখা দেয়ার সাথে সাথে জমির পানি শুকিয়ে ফেলতে হবে। Benda 50 WP (কার্বেন্ডাজিম ) নামক ছত্রাকনাশক এক লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে শোধন করতে হবে।
৬. রোগের নাম : লক্ষীর গু (False S**t) রোগের কারণ : উস্টিলাজিনোইডিয়া ভাইরেন্স (Ustilaginoidea virens) নামক ছত্রাক দ্বারা হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার : ধানের দুধ অবস্থার পর থেকে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় এ রোগটি দেখা যায়। ধানের ফুল আসার সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত এবং জমিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সারের ব্যবহার করলে রোগের প্রকোপ বেশি হয়।
রোগের লক্ষণ : ধানের ছড়ার কিছু ধানে বড় গুটিকা দেখা যায়। গুটিকার ভেতরের অংশ হলদে-কমলা রঙ ও বহিরাবরণ সবুজ রঙের হয়। বহিরাবরণ পরবর্তীতে আস্তে আস্তে কালো হয়ে যায়। কচি গুটিকাগুলো ১ সেমি. এবং পরিপক্ব অবস্থায় আরও বড় আকারের হতে পারে। এক রকমের আঠা জাতীয় পদার্থ থাকার জন্য গুটিকা থেকে ক্ল্যামাইডোস্পোর জাতীয় অনুজীব সহজে বের হয় না। সাধারণত কোনো শীষে কয়েকটা ধানের বেশি আক্রমণ হতে দেখা যায় না।
রোগের প্রতিকার : সঠিক মাত্রায় ইউরিয়া সার ব্যবহার করতে হবে। জমির পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। আক্রান্ত গাছ বা শীষ তুলে ফেলা এ রোগ দমনের সবচেয়ে ভালো উপায়। তবে এটি সকাল বেলা আক্রান্ত শীষ পলিব্যাগে সাবধানে আবদ্ধ করে গাছ তুলতে হবে যাতে স্পোর ছড়াতে না পারে। জমিতে রোগ দেখা দিলে Benda 50 WP (কার্বেন্ডাজিম) ছত্রাকনাশক ১.৫ গ্রাম/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৭. রোগের নাম :
ব্যাকটেরিয়াজনিত পোড়া রোগ (Bacterial Blight)
রোগের কারণ : জ্যানথোমোনাস অরাইজি পিভি অরাইজি (Xanthomonas oryzae pv.oryzae) এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার : রোগটি আউশ, আমন ও বোরো এ তিন মৌসুমেই ব্যাপকভাবে দেখা যায়। উচ্চ তাপমাত্রা (২৬-৩০ ডিগ্রি সে.), ৭০% এর ওপরে আপেক্ষিক আর্দ্রতা, ঝড়ো-বৃষ্টি আবহাওয়া, রোগপ্রবণ জাত লাগানো, রোপণের সময় শিকড় অথবা গাছে ক্ষত সৃষ্টি, উচ্চ মাত্রায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ ইত্যাদির কারণে রোগের প্রকোপ বেশি হয়। পাতাপোড়া রোগ ধানের খড়, মাটি, পোকা, বাতাস ও সেচের পানির মাধ্যমে এক জমি থেকে অন্য জমিতে ছড়ায়।
রোগের লক্ষণ : প্রথমে পাতার অগ্রভাগ বা কিনারায় নীলাভ পানিচোষা দাগ দেখা যায়। দাগগুলো আস্তে আস্তে হালকা হলুদ রঙ ধারণ করে পাতার অগ্রভাগ থেকে নিচের দিকে বাড়তে থাকে। শেষের দিকে আংশিক বা সম্পূর্ণ পাতা ঝলসে যায় এবং ধূসর বা শুকনো খড়ের রঙ ধারণ করে। ফলে গাছটি প্রথমে নেতিয়ে পড়ে ও আস্তে আস্তে পুরো গাছটি মরে যায়। চারা ও কুশি অবস্থায় সাধারণত ক্রিসেক লক্ষণ প্রকাশ পায়। এ রোগের ফলে গাছটি প্রথমে নেতিয়ে পড়ে ও আস্তে আস্তে পুরো গাছটি মরে যায়। অনেক সময় এ রোগের লক্ষণের অগ্রভাগ দিয়ে ব্যাকটিরিয়ার কোষগুলো বেরিয়ে আসে এবং কোষগুলো একত্রে মিলিত হয়ে ভোরের দিকে হলদে পুঁতির দানার মতো গুটিকা সৃষ্টি করে এবং এগুলো শুকিয়ে শক্ত হয়ে পাতার গায়ে লেগে থাকে। পরবর্তীকালে পাতার গায়ে লেগে থাকা জলকণা গুটিকাগুলোকে গলিয়ে ফেলে, ফলে এ রোগের জীবাণু অনায়াসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত গাছের কা- ছিড়ে চাপ দিলে দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজের মতো তরল পদার্থ বের হয়। রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য বেশি (৮-১০ ডিগ্রি সে.) হলে কচি পাতায় ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের লক্ষণটি প্রকাশ পায়।
রোগের প্রতিকার
রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করতে হবে। রোগাক্রান্ত জমির ধান কাটার পর নাড়া ও খড় পুড়িয়ে ফেলতে হবে। চারা উঠানোর সময় যেন শিকড় কম ছিড়ে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার ও ইউরিয়া সার ৩/৪ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু রোগ দেখার পর ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। ক্রিসেক আক্রান্ত জমি শুকিয়ে ৫-১০ দিন পর আবার পানি দিতে হবে। রোগ দেখার পর বিঘাপ্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার ছিপছিপে পানিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে Arena Zinc ( চিলিটেড জিংক) স্প্রে করলে রোগের তীব্রতা কমে যায়।
৮. রোগের নাম : টুংরো (Tungro)। অনেক এলাকায় এ রোগকে লোনা ধরা, বসে যাওয়া, লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
রোগের কারণ : রাইস টুংরো ভাইরাস (Rice Tungro Virus) নামক এক ধরনের অতি সূক্ষ্ম জীবাণু দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে।
রোগের বিস্তার : এ রোগটি আউশ ও আমন মৌসুমে বেশি হয়। টুংরো আক্রান্ত চারা রোপণের মাধ্যমে রোগ ছড়ায়। সবুজ পাতাফড়িং (নেফোটেটিকস ভাইরেসেন্স), আশপাশে স্বেচ্ছায় গজানো রোগাক্রান্ত গাছ, বাওয়া ধান বা ঘাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। বাহক পোকা আক্রান্ত গাছ থেকে ২-৩ মিনিট কাল রস শোষণ করেই ভাইরাস সংগ্রহ করতে পারে এবং তা পরবর্তী ২-৩ মিনিটে সুস্থ গাছে রস শোষণ কালে সংক্রমণ করতে পারে। ফলে সুস্থ গাছটিতেও ২-৩ সপ্তাহের মধ্যেই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
রোগের লক্ষণ
টুংরো আক্রান্ত গাছের পাতায় প্রাথমিক অবস্থায় লম্বালম্বিভাবে শিরা বরাবর হালকা সবুজ ও হালকা হলদে রেখা দেখা দেয়। পরে আস্তে আস্তে সব পাতাটাই হলদে বা কমলা হলদে রঙ ধারণ করে। আক্রান্ত কচি পাতা হালকা রঙের হয় এবং মুচড়ে যায়। চারা/কুশি অবস্থায় আক্রান্ত হলে সুস্থ গাছের তুলনায় আক্রান্ত গাছ বেশি খাটো হয় কিন্তু বয়স্ক গাছে হলে ততোটা খাটো হয় না। আক্রান্ত গাছ দুর্বল হয়ে যায়, কুশি কম হয় এবং শিকড় দুর্বল হয়ে পড়ে। আক্রান্ত পাতাগুলো ভূমির দিকে নুয়ে পড়ে। রোগাক্রান্ত গাছ ধান পাকা পর্যন্ত বাঁচতে পারে তবে আক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে গাছগুলো শুকিয়ে মরার মত হয়ে যায়। হালকাভাবে আক্রান্ত গাছ বেঁচে থাকে, তবে তাতে কিছুটা দেরিতে ফুল আসে এবং ফলন অনেক কম হয়।
রোগের প্রতিকার : রোগ প্রতিরোধী জাতের চাষ করতে হবে। হাত জাল দিয়ে সবুজ পাতাফড়িং ধরে মেরে ফেলতে হবে। টুংরো আক্রান্ত জমির আশপাশে বীজতলা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ, বাওয়া ধান এবং আড়ালি ঘাস দমন করতে হবে। আলোকফাঁদ ব্যবহার করে সবুজ পাতাফড়িং মেরে ফেলতে হবে। জমিতে বাঁশের কঞ্চি পুঁতে পার্চিং করতে হবে। বাহক পোকা দমনের জন্য Agroimida 20 SL (ইমিডাক্লোরোপিড) ০.৫ মিলি/লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
৯. রোগের নাম : উফরা রোগ (ডাক পোড়া) (Ufra)। বিভিন্ন এলাকায় এ রোগ উর্বা, ডাকপোড়া, জ্বলে যাওয়া, পুড়ে যাওয়া, লোনা লাগা ইত্যাদি নামে পরিচিত। সাধারণত শতকরা ৪০-১০০ ভাগ ফলন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোগের কারণ : ডাইটিলেংকাস এ্যাংগাসটাস (Ditylenchus angustus) নামক এক ধরনের কৃমি দ্বারা এ রোগ হয়।
রোগের বিস্তার : সেচের পানি, ঘন ঘন বৃষ্টিপাত, মাটি, রোগাক্রান্ত চারা, নাড়া ও খড় দ্বারা এ রোগ ছড়িয়ে থাকে। শুরুতে এ রোগ জলি আমন ধানে হলেও বর্তমানে সব মৌসুমেই দেখা যায়। সেচের পানিতে ভেসে এরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে আক্রমণ করে। আক্রান্ত জমির পরিত্যক্ত নাড়া, খড়কুটা, শীষের অংশ বা ঝরে যাওয়া ধানে এবং মাটিতে কোন খাদ্য ছাড়াই এ কৃমি কু-লী পাকিয়ে ৬-৮ মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
রোগের লক্ষণ : কৃমি ধান গাছের কচি পাতা ও খোলের সংযোগস্থলে আক্রমণ করে। কৃমি গাছের রস শোষণ করায় প্রথমে পাতার গোড়ায় ছিটা-ফোটা সাদা দাগ দেখা দেয়। সাদা দাগ ক্রমে বাদামি রঙের হয় এবং পরে এ দাগ বেড়ে সম্পূর্ণ পাতাটাই শুকিয়ে ফেলে। অনেক সময় থোড় হতে ছড়া বের হতে পারে না বা বের হলেও অর্ধেক বা আংশিক বের হয়। ছড়া বের হতে না পারলে তা ভেতরে মোচড়ানো অবস্থায় থাকে। গাছ কিছুটা বেটে হয়। ধান খুব চিটা ও অপুষ্ট হয়। আক্রমণ থোড় গজানোর সময় হতে শুরু হলে সে ধানের কোনো ফলনই পাওয়া যায় না।
রোগের প্রতিকার : রোগাক্রান্ত ফসল কাটার পর নাড়া ও খড় জমিতেই পুড়িয়ে ফেলতে হবে; ঘাস জাতীয় আগাছা এবং মুড়ি ধান ধ্বংস করতে হবে; বছরের প্রথম বৃষ্টির পর জমি চাষ দিয়ে ১৫-২০ দিন শুকাতে হবে; পর পর ধান না করে পর্যায়ক্রমে অন্য ফসলের চাষ করতে হবে; আক্রান্ত জমিতে বা জমির পাশে বীজতলা করা থেকে বিরত থাকতে হবে; প্রথম অবস্থায় আক্রমণ দেখা দিলে ধানের আগার অংশ কেটে পুড়ে ফেলতে হবে; চারা লাগানোর ১২-২০ ঘণ্টা আগে বীজতলা থেকে চারা তুলে শিকড় ১.৫% কৃমিনাশক যেমন- Carboran ৫জি দ্রবণে ভিজিয়ে রেখে জমিতে রোপণ করতে হবে; জমিতে রোগ দেখা দিলে ২ ইঞ্চি পানি থাকা অবস্থায় Carboran ৫জি বিঘাপ্রতি ২.৫-৩.০ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
Source of Information :
বিজ্ঞানী ড. কে এম খালেকুজ্জামান*
*এসএসও (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব)