20/12/2024
আনারকলি ❤️
মেহেরিন_আনজারা
পর্বসংখ্যা-(৭৪/৭৫)
পাখিগুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে গায়ের মধ্যে রক্তপানির ছিঁটেফোঁটা পড়েছে জোহানের। মহলে ঢুকে একেবারে গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে শিস বাজাতে বাজাতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। হঠাৎ দেখা হলো জোভানের সাথে। সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলো সে।
"বড় ভাইজানের ক্যামেরাটা দেখেছিস?"
"না।"
"মনে হয় কামরায়। যা তো নিয়ে আয়।"
"কী করবে তুমি?"
"ছবি তুলবো না?"
"তখন তো ভাইজানের কাছে দেখলাম।"
"নেই কামরায় রেখে আসছে মনে হয়।"
"জিজ্ঞেস করছো?"
"না। এতো কথা না বলে নিয়ে আয় যা।"
চটুল মেজাজে বললো জোভান।
"আচ্ছা।"
বিরক্তি নিয়ে চলে গেল জোভান। একটু আগে ক্যামেরার জন্য গিয়েছিলো দেখলো আশফাকের গলায় নেই। গোলাপবাহারের কারণে চেঁচামেচি করছে আশফাক। ঘটনাটার কিছুটা শুনেছিলো তাই ক্যামেরার কথা জিজ্ঞেস করতে নিয়েও করলো না। শিস বাজাতে বাজাতে আশফাকের কামরায় সামনে আসতেই দেখলো দরজা বন্ধ। ভাবলো আশফাক কামরায় তাই নক করলো।
"ভাইজান,তোমার ক্যামেরাটা দাও তো।"
অনেকক্ষণ ধরে দরজায় নক হওয়ায় বুক থেকে হাঁটু অব্ধি টাওয়াল পেঁচিয়ে হাম্মামখানা থেকে বেরিয়ে এলো অনামিকা। ভাবলো আশফাক এসেছে। এখনো সম্পূর্ণ পরিষ্কার হওয়া শেষ হয়নি তার। চুলের মধ্যে মাটি,কচুরিপানার শিকড় লেগে গিয়েছে এইসব পরিষ্কার করতে যথেষ্ট সময় লাগছে। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ রেখে হাম্মামখানার দরজা লক না করে চাপিয়ে রেখেছে যেহেতু এখন কেউ নেই কামরায় তাই আর ভয়ও হচ্ছিলো। তাই নক করার শব্দ কর্ণগোচর হয়।
"কী হলো খোলো।"
"খুলছি দাঁড়ান।"
"আরো খোলো না! এতক্ষণ লাগে!"
"এই তো খুলি।"
আশফাক ভেবে তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতেই চমকে গেল অনামিকা তদ্রূপ ভিতরে তাকাতেই চমকে উঠলো জোহানও। বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে আপাদমস্তক দৃষ্টি বুলাতেই ভড়কে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দিলো অনামিকা। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রইলো জোহান। ঠিক কী দেখলো বুঝতে পারলো না। সে যেটা দেখেছে এটা কি সত্যি? না ভুল নয় সত্যি! থম মে'রে কাঁপতে লাগলো অনামিকা। এবার কী হবে? কিছুই ভাবতে পারছে না সে। কাঁপতে কাঁপতে আকস্মিক জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো ফ্লোরে।
____
একজন দাসীর মুখ থেকে ঘটনাটির ইতিবৃত্তান্ত শুনতেই কৌশলে উঠে গেলেন বেগমবাহার। ঘটনাটি মেহমানদের কানে যেন না পৌঁছায় সেটাও অবগত করলেন; তবে মনঃক্ষুণ্ণ হলেন গোলাপবাহারের প্রতি। আংশিক শুনতেই উঠে এলেন জাহানারা জোয়ার্দারও। দেখলেন পুকুর ঘাটে পড়ে আছে গোলাপবাহার। অবস্থা তার প্রায় আধমরা। এগিয়ে গেলেন দু'জনই। দূর থেকে আসা সাগরের ঢেউয়ের সাথে বাতাসের শোঁশোঁ শব্দে গর্জন কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে যেন। বুনোফুলের মনমাতানো সৌরভও যেন ঝাঁঝালো মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। খুবই বিরক্ত লাগছে আশফাকের। হন্য হয়ে কয়েকজন ভৃত্যকে নিয়ে আংটিটা খুঁজতে লাগলো। এই আংটি না পেলে অনামিকা যে আজ জ্ঞান হারাবে সেটা সম্পর্কে অবগত সে। সেদিন কি পাগলামিটাই না করলো মেয়েটা সে আর নাই-বা বলি! বিরক্তি নিয়েও খুঁজতে লাগলো টর্চ লাইট দিয়ে।
"এইসব কী আশফাক?"
"যেমন কর্ম তেমন ফল।"
"তোমার বউয়ের জন্য এমনটা করেছো তাই না?"
"হ্যাঁ।"
"বউকে পুরুষের মতো করে ভালোবাসো সম্মান পাবে। কাপুরুষের মতো ভালোবাসলে বউ হাতে চুড়ি আর পড়নে শাড়ি পড়িয়ে দিবে। এই বউয়ের জন্য কত বড় জঘন্য কাজ করেছো ভেবেছো একবার?"
"মন্দ বলেননি ফুপি। আমি যদি ভুল না হই আপনিও ফুপার হাতে চুড়ি আর শাড়ি পরিয়ে রেখেছেন ভুল বললাম কি?"
অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন। পরোয়া করলো না আশফাক। গোলাপবাহারকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না আংটিটা। সম্ভবত পানির মধ্যে পড়ে গিয়েছে। কীভাবে বুঝ দিবে নাছোড়বান্দা মেয়েটাকে ভাবতেই মস্তিষ্কের মধ্যে কিলবিল করতে লাগলো যন্ত্রণার পোকারা।
___
মহল থেকে বেরিয়ে অন্ধকারের মধ্যে একাকী একটি বহু বছরের পুরোনো প্রকাণ্ড গাছের নিচে চোখ বুজে বসে রইলো জোহান। তিতিরপাখি আর কাচপোকাগুলো কেমন ডাকছে। থেকে থেকে হুতোমপেঁচার ডাকও শোনা যাচ্ছে। একটু দূরে দু একটা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ আর কিচিরমিচির ডাক শুনতে পেলো। ঝগড়া লেগেছে বোধহয় পাখি দম্পতিরা; হতেও তো পারে! দূর পাহাড়ের কোনো এক চূড়া হতে ভেসে আসছে বাঁশির আর্তনাদ মাখা সুর! জমিদার বাড়ির পাশের জঙ্গল থেকে শিয়ালের হুক্কাহুয়া শোনা যাচ্ছে। কেমন ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হলেও ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো দু'চোখ বুজে বসে রইলো জোহান। তার চোখের মণিতে ভেসে উঠলো হীরকচূর্ণ পাথরের ন্যায় বিন্দু বিন্দু জলসিক্ত অনামিকার আবেদনময়ী ওই দৃশ্যটি। মুখের সৌন্দর্য বাদ,জলসিক্ত বক্ষবিভাজন সহ নগ্ন হাঁটু জোড়ার দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতেই কেমন শরীরটা উষ্ণ হয়ে উঠলো। বেশি কিছু না এতো সুন্দর ধবল সবল ফর্সা হাঁটু কারো হয় তা জানা ছিলো না জোহানের। জীবনে এমন দৃশ্যে অনামিকাকে দেখবে কখনো কল্পনাও করেনি। মানে কী ছিলো এটা শুধু তার মস্তিষ্কে সার্কেলের ন্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে! এই বয়সে অনেক সুন্দরী রূপবতী নারী ভোগ করেছে সে কিন্তু তার চোখে এতো সুন্দরী আর এতো আকর্ষণীয় ফিগার অনামিকার ছাড়া আর কাউকে দেখেনি। ঠিক কেমন অনুভূতি হচ্ছে তার ভাষা বোঝানো অসম্ভব! দৃশ্যটি অক্ষিপটে ভেসে উঠতেই শিরদাঁড়া বেয়ে সর্পিল গতিতে হীম শীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। একটা ঘোরের মধ্যে আঁটকে গেল জোহান। তার মানে তার ভাই সবই জানতো! আর মেয়েটা সুন্দরী বলে ছলনার আশ্রয় নিয়েছে দু'জন! কিন্তু কেন জানি তার ভাইয়ের সাথে মানতে পারছে না মেয়েটাকে। এমন একটা আকর্ষণীয় ফিগারওয়ালা মেয়ে সে-ই ডিজার্ভ করে তার ওমন কাঠখোট্টা রসকষহীন ভাই না।
জোহানের দেরী দেখে ভীষণ রাগ হয় জোভানের। তেঁতে আছে জায়ানও। উৎসবমুখর এতো সুন্দর একটা মুহূর্তে গোলাপবাহারের কি এমন কাজ করাটা আদোও উচিত হয়েছে? ওই গোলাপবাহার তো তার মানসম্মান সব নষ্ট করে দিয়েছে ইভেন তাকে ছোটও করেছে ভাইয়ের সামনে। লজ্জায় নাক-মুখ সব কাটা গেল। রাগে-জিদে মাথা ফেটে যাচ্ছে,তবুও স্থির রাখলো নিজেকে।
"জোহান কইরে?"
"ওকে ক্যামেরা আনতে পাঠিয়েছি।"
"এতক্ষণ লাগে আনতে?"
"সেটাই তো!"
"ডেকে নিয়ে আয় যা।"
"যাচ্ছি।"
জোহানকে খুঁজতে লাগলো জোভান। দেখলো অন্ধকারের মধ্যে একটা গাছের নিচে ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো বসে রয়েছে। আচমকা একটা লাথি মা'র'তেই পড়ে গিয়ে হঠাৎ আক্রমণে ঘাবড়ে গেল জোহান।
"তোরে কী বললাম?"
প্রতিক্রিয়া করলো না জোহান।
"শালা কথা বলোস না কেন? তুই কি ধ্যানে বসেছিস?"
মৌন রইলো জোহান।
"একটাও কাজও ঠিকঠাক মতো পারে না। বলছি ক্যামেরাটা নিয়ে আয় শালা ধ্যান করতে বসেছে! শালারে পুঁতে ফেলতে ইচ্ছে করছে! ক্যামেরা কই?"
কিছুই বললো না জোহান। আরেকটা লাথি দিয়ে চলে গেল। আগুনের তাপে আর কাজের চাপে মেজাজ চটে আছে তার।
"কিরে জোহান কই?"
"ধ্যানে বসেছে।"
"কী?"
"গিয়ে দেখো পারলে,আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না।"
বিরক্ত হয় জায়ান।
"কোথায়?"
"ওইদিকে।"
এগিয়ে যেতে দেখলো সত্যি সত্যি চোখ বুজে বসে রয়েছে জোহান। তাজ্জব বনলো জায়ান। এমনটা পূর্বে কখনো হয়নি।
"জোহান,কী হয়েছে তোর?"
কিছু বললো না।
"এই! কী হয়েছে?এভাবে ধ্যানে বসলি কেন? খাবি না?"
লক্ষ্য করলো বিড়বিড় করছে জোহান। কানের কাছে মুখ নিতেই শুনতে পেলো,"মেয়েটা খুব সুন্দরী! ভীষণ সুন্দরী! ও ছলনা করছে আমাদের সাথে।"
"কোন মেয়ে?"
"আমার চোখে দেখা সে সেরা সুন্দরী আর তার আকর্ষণীয় ফিগার! ওফ!"
"এই জোহান কী হয়েছে তোর বলতো? কী বলিস এগুলো?"
"ফুলো ফুলো গালে লালিমা,ঠোঁট দুটো যেন রক্তের মতো টুকটুকে লাল! স্নো হোয়াইটের গল্প শুনেছো নিশ্চয়ই ঠিক তেমন!"
মাথায় একটা থাপ্পড় দিলো।
"কি সব আবোল-তাবোল বলা শুরু করেছিস? গাঞ্জা খেয়েছিস?"
"তার পরিপক্ব অভিব্যক্তি,ষোলো আনায় পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের মাদকতায় আমি পাগল হয়ে গেলাম। ওফ!"
"কী বললি?"
"আমি পাগল হয়ে গেলাম।"
"কেন?"
অনামিকার সেই জলসিক্ত দেহের আবেদনময়ী দৃশ্যটি কল্পনা করতে করতে অন্য একটা জগতে চলে গেল জোহান। ভীষণ অস্বাভাবিক দেখালো তাকে।
"কী হয়েছে বল?"
"পৃথিবীতে অনেক সুন্দরী নারী রয়েছে,অনেক সুন্দরী দেখেছি কিন্তু এই রকম স্নিগ্ধ,মায়াবী মুখশ্রী সুন্দরী নারী আর কোথাও দেখিনি!"
"মানে?"
"বহু সুন্দরী নারী অনেকেই আছে কিন্তু এই রকম সৌন্দর্য,এক্সপ্রেশন,চাহনী,তার হাসি,তার হরিণটানা চোখ,স্নিগ্ধ চেহারার মতো আর কেউ নেই। তার দুটি চোখ একদিকে আর সারা বাংলার সুন্দরী নারীরা একদিকে।"
কল্পনা করতে লাগলো জোহান। সে কল্পনায় দেখতে লাগলো অনামিকা হাসছে,কথা বলছে ইত্যাদি।
"এই কী বলছিস এইসব? পাগল হয়েছিস?"
ননস্টপ বলতে লাগলো জোহান। থামার নামগন্ধ নেই।
"সত্যি বলছি!"
"কীসের সত্যি?"
"সকল সুন্দরীকে এক করলে সে এগিয়ে থাকবে!"
"মানে?"
"তার চোখের দিকে তাকিয়ে হাজারো মহাকাব্য রচনা করা সম্ভব! আমাদের সাথে করা তার দক্ষ অভিনয় শৈলী,তার কথার বলার ধরণ,উচ্চারণ,তার অভিব্যক্তি,তার দৈহিক সৌন্দর্য,তার চাঁদপানা মুখশ্রী,গোলাপের মতো হাসি,তার হরিণটানা নয়নযুগল!ওফ! আমাকে বুঁদ করে ফেলেছে এক সেকেন্ডে! আমি আহত হলাম তার সৌন্দর্যের ধারালো তরবারিতে। এই মুগ্ধতা,এই রেশ কয়েক হাজার যুগ অব্ধি থাকবে। তাকে দেখার পর থেকে কিছুতেই আমার রেশ কাটছে না,কাটবেও না কখনও। আর এই রেশ থেকে আমি কখনো বেরুতেও চাই না,চাইবোও না। তোমরা বিরক্ত করো না আমাকে।"
"কী বললি?"
"এতো সুন্দরের অধিকারী শত জনমে একজনই হয়। অনেকেই আছে এমন কিন্তু তার রূপের কাছাকাছি কেউ নেই,কেউ যেতে পারবেও না।"
জোভান এসে দাঁড়ালো।
"কী বলে ও?"
"কোন সুন্দরী মেয়ে দেখেছে তার কথা বলছে।"
"লাথি দাও পাগলকে। হ্লার ধ্যান ভাঙ্গুক। সুন্দরী মেয়ে দেখলে এমন করা লাগে বুঝি!"
বেশ সময় পেরিয়ে গেলেও স্বাভাবিক হলো না জোহান। আবোল-তাবোল এইভাবেই বলতে লাগলো। পুষ্করিণী থেকে এক বালতি ঠাণ্ডা পানি এসে ঢেলে দিলো মাথায় তাতেও লাভ হলো না। সবাই ভাবলো জ্বীনে আছর করেছে তাকে। মহলে নিয়ে যাওয়া হলো,ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার ঘুমের মেডিসিন দিয়ে গেলেন। চিন্তিত হয়ে পড়লেন জোয়ার্দার সাহেব।
___
এমন একটা কাণ্ড ঘটলো যে কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না আশফাক। কীভাবে থাকবে?এতো সুন্দর উৎসবমুখর একটা মুহূর্তে একি হয়ে গেল! রকিকে বলে দিয়েছিলো মিনুদের দিকে খেয়াল রাখতে কখন না জানি তার সর্বনাশা ভাইয়েরা সর্বনাশ ঘটায় তাই। আর নিজে খেয়াল এবং চোখ রেখেছিলো অনামিকা আর তার ভাইদের উপর। সবটাই দক্ষহাতে সুন্দরভাবে হ্যান্ডেল করছিলো কিন্তু চোখের পলকে গোলাপবাহার যে সুযোগ বুঝে এমনটা করে বসবে ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। এদিকটা অমিতকে সামলাতে বলে মহলে ফিরে গেল। একা মহলে থাকতে ভয় পাবে অনামিকা। বার কয়েক নক করার পরেও যখন ডোর খুললো না চিন্তিত হয়ে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখলো ফ্লোরে পড়ে আছে অনামিকা। ঘাবড়ে গেল আশফাক। দ্রুত হাঁটু গেঁড়ে বসলো,শরীরে হাত রাখতেই বুঝতে পারলো হীম হয়ে আছে। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রেখেছে। চুলগুলো থেকে পানি নেয়নি ভেজা। ফ্লোর ভিজে আছে। বোধগম্য হলো না কিছুই। পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে বিছানায় শোয়ালো। চুলের পানি নিয়ে গায়ের উপর কম্বল মুড়ি দিলো। হাতে-পায়ে গরম তেল মালিশ করে উষ্ণ করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ পর পিটপিট করে তাকাতেই চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো আশফাকের চিন্তাগ্রস্ত মুখাবয়ব। হুহু করে কেঁদে উঠলো অনামিকা।
"ভৃঙ্গরানি কী হয়েছে তোমার?"
কিছু বললো না অনামিকা। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো।
"তুমি ওইভাবে কেন পড়ে রয়েছিলে বলো?"
কিছুই বললো না নীরব রইলো অনামিকা।
"রিংটার জন্য কান্না করছো? চিন্তা করো না কাল ঠিকই পেয়ে যাবো।"
"লাগবে না! লাগবে না ওই আংটি! কিচ্ছু লাগবে না!"
চেঁচিয়ে উঠায় ভড়কে গেল আশফাক।
"কী হয়েছে? উত্তেজিত হলে কেন?"
"ওই আংটি একটা অভিশাপ!"
মুখ চেপে ধরলো আশফাক।
"চুপ! এমন জঘন্য কথা আর কখনো বলো না। আংটির কোনো দোষ নেই! বরং কিছু কূটবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ আংটিটা লুফে নেওয়ার জন্য আমাদের পিছনে লেগেছে। লাগুক! কতো লাগতে পারে! শোনো,টিকে থাকার লড়াইয়ে এমন ফাঁক-ফোকর আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। কেউ আমাদেরকে খুঁজে দিবে না বা জায়গা দিবে না। নিজের জায়গা নিজেদেরকে করে নিতে হবে। ওরা আমাদের পিছনে লেগেছে অনিষ্ট করার জন্য কিন্তু আল্লাহ চাইলে কিছু করতে পারবে না। তুমি ভেবো না,সকালে আংটিটা খুঁজে বের করবো আমি।"
কোনো কথাই কানে প্রবেশ করছে না অনামিকার। অজস্র কান্না করতে লাগলো কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছে না জোহানের এই বিষয়টি। কীভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছে না। বললে নিশ্চয়ই আশফাক চিন্তা করবে কিংবা ঝামেলা বাঁধাবে কেন তাদের ডোরে নক করেছে ইত্যাদি। আর এতে ভাইয়ে ভাইয়ে মনকষাকষি তো হবেই আবারও রণক্ষেত্র বাঁধবে যা অনামিকা চায় না। কিন্তু কী করবে? মানুষটার জীবন বিপন্নের মুখে ঠেলে দিয়ে সে-কি সুখে থাকতে পারবে? না! একদম পারবে না! যত যাইহোক সে মানুষটার কাছে তার সতীত্ব বিসর্জন দিয়েছে,মানুষটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। মানুষটার খারাপ সে কখনো চায় না। পারবে না মানুষটার জীবন বিপন্নের মুখে ঠেলে দিতে। আচ্ছা,সে-কি ডিভোর্স নিয়ে চলে যাবে?এতে যদি মানুষটা ভালো থাকে তাহলে সেটাই করবে সে। কষ্ট হবে এই আরকি! হুহু করে কাঁদতে লাগলো। নানান চিন্তা-চেতনায় বিভোর হলো।
___
নির্জন নিশুতি রাত। মাঝরাতের দিকে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো অনামিকার। ঘুম মে'রে সারারাত জলপট্টি দিলো আশফাক। আজেবাজে দুনিয়ার সব কথা বলতে লাগলো অস্পষ্ট স্বরে। আশফাক ভাবলো রিংটির জন্য এমন করছে অনামিকা কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হঠাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিলো।
"ভৃঙ্গরানি একটা জিনিস দেখবে?"
নিভু নিভু চোখে তাকালো অনামিকা।
"কী?"
"যাবে একজায়গায়?"
"এখন! এতোরাতে!"
"হুম। আমার বিশ্বাস তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।"
আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইলো অনামিকা।
"চলো।"
গায়ে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর কমেছে। আশফাকের বিশ্বাস ওখানে গেলে অনামিকা সুস্থ হয়ে উঠবে। ধরে উঠালো। একটা টর্চ লাইট নিয়ে অনামিকার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে হঠাৎ একটা রুমে ঢুকলো।
"কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?"
"গেলেই দেখতে পাবে।"
সেই রুমের ভিতর দিয়ে পাতালে করা নিচতলায় নেমে গেল দু'জন। অবাক হয় অনামিকা এই বাড়িতে পাতালের নিচে থাকা আরেকটি তলা দেখে যেটা বাইরে থেকে বুঝা যায় না। তবে ভীষণ ভয় হচ্ছে! কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মানুষটা তাকে? আতঙ্কিত হলো অনামিকা তবে নীরব রইলো। দেখতে দেখতে একটা কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো। দেখলো মাকড়সায় পরিপূর্ণ কক্ষের আশপাশ। বুঝাই যাচ্ছে তেমন কেউ আসে না এদিকটায়। হুট করে অজানা উত্তেজনায় শরীর গরম হয়ে গেল অসুস্থতাও যেন লেজ তুলে পালিয়ে গেল। বেশ সুস্থ লাগছে নিজেকে। এটা কি সত্যি কোনো ম্যাজিক? চাবি খুলে ভিতরে ঢুকতেই চমকায় অনামিকা। ভিতরটায় বেশ কতগুলো কাসা,পিতলের সিন্দুক। কৌতুহলী হয় অনামিকা। একটা সিন্দুক খুলতেই চোখগুলো কেমন ঝলসে এলো। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে আবার তাকালো। দেখলো সোনা আর সোনার গয়নায় পরিপূর্ণ! সেখানে নানারকম দামী পাথরের গয়নাও দেখা গেল। দেখা গেল রূপা সহ হীরে,মণি-মুক্তো আর জহরতের গয়না। টর্চ লাইটের আলো পড়তেই কেমন চিকচিক করে ঝলমল করে উঠলো সূর্যরশ্মির মতো। চোখগুলো ধাঁধিয়ে এলো।
"এতো গয়না!"
মৃদু হাসলো আশফাক।
"কার এইসব?"
সবগুলো সিন্দুক খুলে দেখালো,অনামিকার মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। মানে এতো এতো গয়না!
"তোমার যেটা পছন্দ নাও।"
"লাগবে না চলুন।"
"ভয় পাচ্ছ?"
অনামিকার সুশ্রী গালে হাত রাখলো আশফাক। চোখ বুজে রইলো সে।
"চলুন ফিরি।"
আশফাক ভেবেছিলো অনামিকা খুশি হবে কিংবা উৎকণ্ঠা হয়ে ধরে দেখতে চাইবে অথবা নিবে আর তার আংটিটির মায়াও ছেড়ে দিবে কিন্তু তেমন কিছুই করলো না অনামিকা। বরং কেমন অস্থির দেখালো।
"তোমার পছন্দের একটা গয়না নাও।"
"লাগবে না! এইসব কিছু আমাকে খুশি করতে পারবে না।"
"কেন?"
"চাই না কিছু চলুন।"
মলিন হয় মন,বেরিয়ে এলো দু'জন। হঠাৎ কারো গুঙিয়ে উঠা কান্নার স্বর শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালো অনামিকা।
"কী হলো আসো!"
"কেউ কাঁদছে!"
চমকায় আশফাক। একটু স্থির হতেই সেও শুনতে পেলো।
"হ্যাঁ,তাই তো!"
উৎকণ্ঠা হয়ে কান্নার স্বর অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলো দু'জন। অজানা আতঙ্কে কাঁপতে লাগলো অনামিকা। বেশ কতগুলো পরিত্যক্ত কক্ষ চেক করেও তেমন কিছু পেলো না। তবে কিছু ছেঁড়াবেড়া,রক্তে মাখানো শাড়ি,জামাকাপড় দেখতে পেলো। আতঙ্কিত হয় অনামিকা। কী ভয়ানক জায়গায় এসে পড়েছে সে! ভয়ে বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। চারদিকে টর্চ মা'র'তে লাগলো আশফাক। এতো এতো কক্ষ পুরো বাড়িজুড়ে যে কোনটা রেখে কোনটা চেক করবে! একটা কক্ষের পাশ দিয়ে যেতেই কান্নার স্বর স্পষ্ট হতেই দেখলো তালা ঝুলানো। শিওর হলো যে এখানেই কেউ আছে সম্ভবত তার ভাইয়েরা আবারও কোনো নারীকে তুলে এনেছে। কী যে করবে ভেবে পায় না আশফাক। অনামিকার কাছেও বা লুকিয়ে কী লাভ সেও তো সেক্সুয়্যাল হ্যারেজমেন্টের স্বীকার হয়েছিলো তার ভাইদের। একটা পাথর এনে তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকতেই দেখলো অনেকগুলো প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। বেশিরভাগ উপজাতিয় সুন্দরী নারী। মেয়েগুলোর অবস্থা খুবই বিদঘুটে। হতে পারে তাদের নির্যাতন করেছে কিংবা রেপ। ভীষণ খারাপ লাগলো দু'জনের। ওদের দেখতেই কেঁপে উঠে কাঁদতে লাগলো মেয়েগুলো। ছোট্ট ছোট্ট বারো-তেরো বছর বয়সী বেশ কতগুলো মেয়েকেও দেখা গেল। আশফাক কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। সে জানে এটা তার ভাইদের কাজ। হঠাৎ কয়েকটা উপজাতি মেয়ে ছুটে এসে পায়ে পড়লো আশফাকের। হতভম্ব হলো সে। পা জড়িয়ে তাদের ভাষায় কিছু বলছে যেটা আশফাক বুঝতে পারলেও অনামিকা বুঝলো না। তাদের মাথায় হাত রেখে সেই ভাষায় কথা বলে আশ্বস্ত করলো মেয়েগুলোকে রক্ষা করবে। অতঃপর জমিদার বাড়ির জঙ্গলের শেষপ্রান্তে সমাপ্ত হওয়া সুরঙ্গপথ দিয়ে মেয়েগুলোকে বের করে দিলো। এরপর মহলের পথে পা বাড়াতেই মুখোমুখি হলো জমিদার বাড়ির পাহাদার করিম মিয়ার। এতো রাতে ওদের দু'জনকে দেখতেই চমকে উঠে ঘাবড়ে গেলেন। আশফাককে কেমন দেখালো চোখ-মুখ শক্ত। ভড়াকালো করিম মিয়া। আচমকা গলা চেপে ধরলো করিম মিয়ার।
"কতদিন ধরে চলছে এইসব?"
"কোনসব আব্বাজান?"
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো মধ্যবয়সী করিম মিয়া।
"কতদিন ধরে এবাড়িতে আবারও নারীদের তুলে আনা হচ্ছে?"
"আমি কিছু জানি না আব্বাজান।"
গলায় চাপ প্রয়োগ করতেই ককিয়ে উঠলো।
"বলো।"
"আমি কিছু জানি না।"
"কে জানে বলো?"
"আমি কিচ্ছু জানি না।"
"মে'রে পুঁতে ফেলি?"
"না আব্বাজান আপনার পায়ে পড়ি আমারে মাইরেন না।"
"সত্যিটা বলো।"
"আমারে এইসব বিষয়ে জানাইতে নিষেধ করছে।"
"কে?"
"আপনার ভাইরা।"
"জমিদার সাহেব জানে?"
"না।"
"আমাকে জানাওনি কেন?"
"আমারে বলছে কেউ যেন জানতে না পারে।"
"কতদিন থেকে এইসব চলছে?"
"আপনি শহরে যাওয়ার পর থেইকা।"
"মানে?"
"সত্য কইতাছি। জমিদার সাহেবের জন্য যত দাসী আনা হইতো এরপর কিছু দাসী আ'ত্ম'হ'ত্যা করতো,কেউ মা'রা যেত,কেউ পালিয়ে যেত আর যারা থাকতো তাদেরকে বিক্রি কইরা দিতো। এরপর জাহাজ দিয়া পাঁচার কইরা দিতো বিদেশে।"
চমকালো আশফাক। অবশ্য তারা যেখানে আছে সেখানে জাহাজে করে পাঁচার করে দেওয়াটাই সহজলভ্য। সে অবশ্য জলসাঘরের জন্য আনা দাসীদের খবর কখনো জানার আগ্রহ করতো না। তার মানে অনেক খারাপই হতো দাসীদের সাথে। অনামিকার সারা শরীর কেমন কাঁপছে! ছেড়ে দিলো করিম মিয়াকে।
"আজকের পর থেকে সব জানাবে আমাকে নয়তো পুঁতে ফেলবো তোমাকে।"
"জি আব্বাজান।"
মহলে ঢুকে গেল দু'জন। আর একটি কথাও বললো না অনামিকা। সে মুক্তি চায় এই সংসার থেকে। তার কপালে বোধহয় সুখ থেকেও নেই! এতো সুখের মধ্যেও শুধু দুঃখ আর বিপদ। কি লাভ এতো আভিজাত্যের মধ্যে থেকে যদি প্রিয় মানুষটার সঙ্গে শেষ অব্ধি না থাকতে পারে তাহলে? অনর্গল চোখের জল বিসর্জন দিতে লাগলো। পাশাপাশি শুয়ে রইলো দু'জন অথচ যোজন যোজন দূরত্ব তাদের মধ্যে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশফাক।
"তুমি তখন জানতে চাইলে এতো এতো সোনা কোথায় থেকে এলো। আসলেই এইসব আমাদের বলা যায় না; তবে আমাদের কাছেই আমানত রয়েছে।"
নীরব রইলো অনামিকা। প্রতিত্তোর না পেয়ে বলতে লাগলো আশফাক।
"যখন দেশে যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমাদের এই পুরো গ্রামে মুসলিমদের চাইতেও হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রিস্টান কিংবা যত ভিন্ন ধর্মের লোক ছিলো সবার উপর বেশি নির্যাতন হয়েছিলো। এরপর তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের অর্জিত এবং রক্ষিত যত সোনার গয়না ছিলো কেউ বিক্রি করে চলে গিয়েছে কেউ আমানত রেখে চলে গিয়েছে আমার নানার কাছে। যেহেতু তিনি এবং আমার দাদা দু'জনই জমিদার বংশের ছেলে কিংবা তৎকালীন জমিদার ছিলেন। উনারা আবার দু'জন ভাই ছিলেন। সে যাইহোক,এরপর নানাভাই এখানেই সব অর্থ প্রাচুর্য সংরক্ষণ করে রাখেন এবং এখানেই আশ্রয় নেন যুদ্ধকালীন সময়। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা ফেরত এসেছিলো তারা কেউ তাদের গয়না ফেরত নিয়েছে,কেউ বিক্রি করেছে তো কেউ এখনো নেয়নি। সেইভাবে আমরা এতো সোনা গয়নার মালিক আর ওই সোনাগুলো আমানতের। এখনো কেউ নিতে আসেনি। তাই ওগুলো ওইভাবে পড়ে আছে। আর ওই সোনার সিন্দুকগুলোর দায়িত্ব নানাভাই আমার হাতে দিয়েছিলেন। যদিও এই সোনার ভাণ্ডারের খবর আব্বাজান,আম্মাজান এবং আমি জানি আর আজ তুমি জানলে। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে আরো কেউও জানে। কারণ সিন্দুক খোলার পর আমি টের পেয়েছিলাম বেশকিছু গয়নার জায়গা খালি। হতে পারে আমার ভাইয়েরা ওখান থেকে সোনার গয়না সরিয়েছে যেটা আমার অজান্তেই। আমি শিওর এই কারণে ওরা ছাড়া এই জায়গায় আসার সাহস আর কারো নেই। হতে পারে গোপনে আব্বাজান থেকে চাবি নিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়েছে। কিন্তু কাজটা ওরা ঠিক করেনি। এগুলো আমানতের জিনিস খেয়ানত করাটা উচিত হয়নি।"
চমকে তাকায় অনামিকা।
"জাহান্নামে যাক! আপনি মাথা ঘামাবেন না। সব নিয়ে যাক। তবুও আপনি সুস্থ থাকুন।"
"কী বললে?"
"ঠিক বলেছি। ওই সোনার ভান্ডার হজম করে ওরা যদি ভালো থাকে তো থাকুক না।"
"এগুলো আমানতের।"
"থাকুক তাতে কী! নিজে বাঁচলে বাপের নাম।"
"স্বার্থপর হতে বলছো?"
"প্রয়োজনে হবেন! আপনার মা এবং আমার জন্য হবেন।"
বিস্ময় নিয়ে তাকায় আশফাক।
"কী হয়েছে তোমার বলো তো! কেমন আতঙ্কিত দেখাচ্ছে তোমাকে!"
"আপনি সত্ত্বার কসম করে বলুন সব জাহান্নামে যাক আপনি আপনার ভাইদের ব্যপারে নাক গলাবেন না বলুন।"
"অসম্ভব! ওরা অন্যায় করছে এটা আমি সুস্থ মস্তিষ্কের একজন মানুষ হয়ে কখনো মানতে পারি না।"
"আজ-কাল ভালোর দাম নেই! যত খারাপ হতে পারবেন দুনিয়া ততটাই আপনার পায়ে নত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করবে।"
"ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড!"
"চাই না বুঝতে! আপনি বুঝুন আমাকে! নাক গলাবেন না বলে দিচ্ছি।"
"ভৃঙ্গরানি আমার কথা শোনো!"
"বিধবা করতে মন চাইছে আমাকে?"
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো আশফাক।
"কীসের সাথে কী?"
"আপনার এইসব কৌতুহলী না জানি মরণকামড়ের দশা হয়।"
"কিচ্ছু হবে না।"
"অসুরের শক্তি সবসময়ই শক্তিশালী। ওরা তিনজন আপনি একজন। সেই সাথে আছে আপনার কাকাও পারবেন ওদের সাথে?"
"আমার কথা শোনো!"
"সত্যি বলতে কি জানেন,আপনাদের পুরুষদের ভালোবাসা না ঠিক ওই জোনাকপোকার মতো ক্ষণে জ্বলে ক্ষণে নিভে! আপনার ভালোবাসাও তদ্রূপ আমার জন্য তেমন।"
"ভুল বুঝেছো!"
"মুক্তি দিন আমাকে।"
কড়জোড় করলো অনামিকা। হতভম্ব নয়নে তাকালো আশফাক।
"আবারও পুরোনো ব্যামো উঠেছে।"
"করবো না আপনার সংসার।"
শোয়া থেকে উঠে গেল।
"কিছু পুরুষ মানুষ আছে যারা স্ত্রীর চোখের দিকে তাকালে পুরো পৃথিবী বুঝে যায়। আর কিছু পুরুষ আছে যারা স্ত্রীর সঙ্গে একশো বছর জীবন কাটানোর পরেও স্ত্রীকে বুঝতে পারে না। স্ত্রী কিসে খুশি হয় আর কিসে দুঃখ পায় এটাই কিছু কিছু মেয়ের দুঃখ!"
"আমি আবার কী করলাম?"
"মেয়েদের যদি স্বামী ভালো না হলে এই পৃথিবীই জাহান্নাম। এর থেকে বড় শাস্তি বা কষ্ট মৃত্যুর পর আর কি হতে পারে জানা নেই।"
চলে গেল বসার রুমে। সোফার উপর শুয়ে পড়লো। হতভম্ব হলো আশফাক। মেজাজ দেখালো কেন মেয়েটা? উঠে এসে গায়ে হাত রাখতেই ফেলে দিলো।
"ঠাণ্ডা তো! বিছানায় চলো।"
"যান আপনি।"
"কথা শুনবে না মেয়ে?"
"আপনি শুনেন আমার কথা?"
"রাগলে কেন?"
"কিচ্ছু না।"
শক্ত করে চেপে ধরে বিছানায় নিয়ে গেল।
___
সকালে ঘুম থেকে উঠলো অনামিকা। পরনের শাড়ি চেঞ্জ করা লাগবে। ড্রয়ার খুলে শাড়ি নিতে গিয়ে দেখলো বেশকিছু জামাকাপড় নেই। সারা আলমারি,আলনা সবকিছু খুঁজেও পেলো না। ব্যালকনিতে চেক করলো কিন্তু নেই। শাড়ি আছে কিন্তু শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা পেটিকোট,ব্লাউজ আর তার গোপন বস্ত্রগুলো নেই। চিন্তিত হয় অনামিকা। কোথায় থাকতে পারে কিংবা কে নিতে পারে ভাবনায় বিভোর হলো। আশফাক ঘুমাচ্ছে; এগিয়ে গিয়ে ঝাঁকি দিলো।
"শুনছেন!"
আশফাক তখনো গভীর ঘুমে। আবারও ঝাঁকি দিতেই ঘুম হালকা হয়ে এলো।
"শুনছেন!"
"হুঁ!"
"ব্যালকনি থেকে আমার কাপড়চোপড় আপনি এনে রেখেছেন কাল?"
"না। কী হয়েছে?"
অবশ্য অনামিকা কিংবা ভৃত্যদের দিকে তাকিয়ে থাকে না আশফাক। সবসময়ই আসরের আযান হওয়ার পূর্বেই সে অনামিকার কাপড়চোপড় কামরায় নিয়ে আসে।
"বেশ কতগুলো কাপড়চোপড় পাচ্ছি না।"
"আছে কোথাও খুঁজে দেখো।"
"ভালো করে দেখেছি।"
"অন্যগুলো পরো।"
উঠে যায় অনামিকা। একটা শাড়ি নিয়ে হাম্মামখানায় যেতে যেতে ভাঁজ খুলতেই চমকালো। দেখলো আঁচলের এক কোনায় কাটা। আতঙ্কিত হলো অনামিকা। তার এতো সুন্দর শাড়ি এমনটা করলো কে? বিয়ের একমাস প্লাস হয়েছে সবে। এরমধ্যে প্রায় দু-তিনবার এই শাড়িটা পড়েছে; তখন ঠিক ছিলো। কামরায় ঢুকে আশফাককে ডাকলো।
"এই শুনছেন!"
"হুঁ!"
"দেখুন আমার শাড়ির আঁচল কেটে দিয়েছে।"
"কি!"
চমকে উঠে আশফাক। ঘুম চলে গেল চোখ থেকে।
"এই দেখুন।"
দেখলো সত্যি আঁচল কেটে নিয়ে গেছে। হতভম্ব হলো আশফাক।
"এই কাজ কে করেছে?"
"জানি না।"
"এটা পরার আর দরকার নেই অন্য শাড়ি পরো।"
সায় দেয় অনামিকা। তার যথেষ্ট শাড়ি আছে,শ্বাশুড়ি মা আর আশফাক তাকে ব্যান্ডেলে ব্যান্ডেলে শাড়ি দিয়েছে কিন্তু এই শাড়িটাও খুব সুন্দর। যতই মেয়েদের থাকুক তবুও ছোট একটা আঠা চলে যাওয়া টিপ কিংবা এক কানের একটা দুল হারিয়ে গেলেও মেয়েরা ফেলতে পারে না মায়ার জন্য। যত্ন করে সেই টিপটাও রেখে দেয় আয়নার এক কোনে। সেখানে এতো সুন্দর একটা শাড়িকে নষ্ট করে দিলো কোন হৃদয়হীন পাপী! ব্যথিত হয় চিত্ত। কীভাবে মায়া কাটাবে এতো সুন্দর শাড়িটার? কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি বের করলো। মাত্র একদিন পরেছে। সুতির তাঁতের শাড়ি,এতো সুন্দর ফিনিশিং আর আরামদায়ক বলে মাত্র একদিন পরে যত্ন করে রেখে দিয়েছে। ভাঁজ খুলে হাতে নিতেই দেখলো এই শাড়িটার দুইকোণেও কাটা। চেঁচিয়ে উঠলো অনামিকা।
"এই শাড়িটাও কাটা দেখুন।"
ঘুমু ঘুমু চোখে তাকালো আশফাক। ভীষণ রাগ হয়। কার এতো বড় দুঃসাহস এমন কাজ করে!
"আম্মাজানকে ডাকো।"
পরনের শাড়ি বদলে হাত-মুখ ধুয়ে বেগমবাহারকে ডেকে আনলো অনামিকা। সব শুনতেই চমকান তিনি।
"আর কী কী নিয়েছে?"
"এগুলোই দেখতে পেলাম আম্মা।"
"নিশ্চয়ই কেউ কালযাদু করার জন্য এগুলো নিয়েছে।"
"মানে?"
"হ্যাঁ। ব্যবহৃত বস্তু কিংবা কাপড়-চোপড় দিয়ে একজন মানুষকে খুব সহজে যাদুগ্রস্ত করা যায়।"
"কী বলছেন আম্মা!"
"এটাই সত্যি। সুতরাং যদি এই বিষয়ে সতকর্তা এবং সচেতনতা অবলম্বন না করতে পারে তাহলে আক্রান্ত হওয়ার পর এই কষ্টের বাহন বাহককেই বহন করতে হয়। মাথার চুল,দাড়ি,নখ,পরিধানের কাপড়-চোপড়,ব্যবহৃত পিরিয়ডের প্যাডসহ ইত্যাদি বস্তুগুলো দিয়ে একজন যাদুকর তার টার্গেট খুব সহজে ফাইনাল করতে পারে। সুতরাং যাদুগ্রস্ত হওয়ার পূর্বেই সচেতন হওয়া একান্তই জরুরী। আমি শিওর যেকেউ তোমাদের কালোযাদু করার জন্য এইসব নিয়েছে। তোমাদের দাম্পত্য জীবনে কলহ-বিবাদ কিংবা বিচ্ছেদের জন্য। তার কারণ তোমাদের সুখ-শান্তি সহ্য করতে পারছে না সে বা তারা। আর যাদু অস্বীকার করার মতো কিছু নেই এটা সত্য। পবিত্র কোরআনেও যাদু সম্পর্কে উল্লেখিত আছে।"
"এখন কী হবে আম্মা?"
ভয়ে কাঁপতে লাগলো অনামিকা।
"বেশি বেশি চার কুল,আয়াতুল কুরশি,দোয়া-দরুদ পাঠ করবে আর শরীর বন্ধ রাখো। আর চিন্তা করো না,এই বিষয় নিয়ে ইউসুফের সঙ্গে কথা বলবো। ও এই বিষয়ে ভালো বুঝবে। তবে কাকপক্ষীটিকেও কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না এই ব্যপারে বুঝেছো?"
"জ্বী।"
চিন্তিত মুখে বেরিয়ে গেলেন তিনি। কে করতে পারে এই কাজ? মহলের পাঁচজনের উপর সন্দেহ সৃষ্টি হলো বেগমবাহারের। অন্যদিকে অনামিকার সন্দেহ সৃষ্টি হলো তাদের বাড়ির লোকজনদের উপর। এতোদিন এইসব কিছুই হয়নি,কিন্তু কাল তাদের বাড়ি থেকে আত্মীয়রা আসতেই আজ এমন হলো। আচ্ছা তার জেঠি কিংবা ফুপি এমনটা করেনি তো? করলেও হয়তো হিংসা থেকে করতে পারে! কিন্তু আরেকটা চিন্তার এবং লজ্জার বিষয় হলো,গত দু-দিন পূর্ব থেকে তার পিরিয়ড শুরু হয়েছিলো। তখন একটা প্যাড চেঞ্জ করে কাগজে মুড়িয়ে পলিব্যাগ পেঁচিয়ে কাপড়ের মধ্যে রেখেছিলো পরে সুযোগ বুঝে ফেলে দিবে ভেবে কিন্তু আর পেলো না। পরে ফেলতে গিয়ে দেখলো নেই। অনামিকা ভেবেছিলো আশফাক হয়তো ফেলে দিয়েছে। কারণ এর আগেরগুলোও সে গোপনে পুঁতে দিয়েছিলো। তাই লজ্জায় আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আচ্ছা,যাদু করার জন্য তার সেই প্যাডটি কেউ চুরি করে নিয়ে যায়নি তো!
______
চলবে~