20/12/2024
ইসলামের দাওয়াতে এসে সংঘর্ষ-মৃত্যু, কী হচ্ছে তাবলিগে
হোমঅন্যান্য
ইসলামের দাওয়াতে এসে সংঘর্ষ-মৃত্যু, কী হচ্ছে তাবলিগে
সালমান তারেক শাকিল
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:০০
গাজীপুরের টঙ্গী ইজতেমা মাঠে ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা ঠেকাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে মাওলানা জুবায়ের অনুসারীদের বিক্ষোভ, বুধবারের ছবি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গিয়ে তাবলিগ জামাতে যুক্ত ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার এগারসিন্দু গ্রামের আমিনুল ইসলাম বাচ্চু। ইসলামের দাওয়াতের কাজে ইজতেমার মাঠে আসা ৭০ বছরের এই বৃদ্ধের প্রাণ গেছে প্রতিপক্ষের হামলায়। ঘুমন্ত অবস্থায় বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) ভোরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ঘটনাস্থলেই নিহত হন দুই পুত্র সন্তানের পিতা আমিনুল ইসলাম।
সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরের পর বিগত ছয়-সাত বছর ধরে তিনি যুক্ত হন তাবলিগ জামাতে। যেদিন ভোরে নিহত হন তার আগের দিন রাতেই কিশোরগঞ্জ মারকাজ মসজিদ থেকে ইজতেমার কাজে টঙ্গীতে আসেন। অসিয়ত মতো ৭০ বছর বয়স্ক আমিনুল ইসলাম এই মসজিদ প্রাঙ্গণেই চিরশায়িত হয়েছেন ।
তাবলিগে এসে প্রতিপক্ষের হামলায় তার মৃত্যুর কারণে পুরো এলাকায় শোক ছড়িয়ে পড়েছে। খামা গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউপি মেম্বার মো. খুরশিদ উদ্দিন বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘পুরো এলাকার মানুষের মন খারাপ। বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর ইবাদতে গেছিলেন আমিনুল। এখন আসলেন মৃত লাশ হয়ে। প্রশাসন থেকে বলেছে মামলা হয়েছে, আসামিদের গ্রেফতার করবে।’
খুরশিদ উদ্দিন মেম্বার জানান, আমিনুল ইসলামের জানাজা তার অসিয়ত মতো কিশোরগঞ্জ জেলার মারকাজ মসজিদে হয়েছে এবং সেখানকার গোরস্থানে তাকে দাফন হরা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমিনুল ইসলাম এটা অসিয়ত করে গিয়েছিলেন। তার পরিবারের অবস্থা বেশি সচ্ছল না। তার দুই ছেলে। মৃত্যুকালে স্ত্রী ও সন্তানসহ আত্মীয়স্বজন রেখে গেছেন।’
মৃতের সংখ্যা কত?
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) ভোররাতে টঙ্গীতে ইজতেমার মাঠে বাংলাদেশ তবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত তিন জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যদিও বুধবার সচিবালয়ে তাবলিগের সমস্যাকেন্দ্রিক এক বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, ‘ইজতেমা মাঠে চার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।’
জামাতসহ একাধিক দল বিবৃতিতে চার জন নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। তবে পরিচয় মিলেছে তিন জনের। বৃহস্পতিবার দুপুর একটায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত নিহত অপরজনের সম্পর্কে কোনও তথ্য জানা যায়নি।
বুধবার ভোররাতের সংঘর্ষে নিহত বগুড়ার বেলাল হোসেন (৬৫), তাজুল ইসলামও (৭০) আমিনুল ইসলাম বাচ্চুর মতো এসেছিলেন ইজতেমার মাঠে দ্বীনের দাওয়াত কাজে।
সাদপন্থি তাবলিগ গ্রুপের বিশেষ মিডিয়া সমন্বয়ক তৌহিদুর রহমান সোহেল জানান, বেলাল হোসেন তাদের ‘সাথী’ ছিলেন।
বৃহস্পতিবার সকালে সাদপন্থি গ্রুপের একজন বাংলা ট্রিবিউনের কাছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে দাবি করেন, তাদের অনুসারীদের অন্তত তিন জন ঢাকা মেডিক্যালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থা গুরুতর।
গতকাল বুধবার সংঘর্ষের পর দুঃখ প্রকাশ করে ইজতেমা মাঠ ত্যাগ করেন সাদপন্থিরা। ঘটনার পর গাজীপুরের টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। উত্তরার অংশে ১৪৪ ধারা জারি করেছে ডিএমপি।
বুধবার ১৮ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদে সড়ক দখল করে বিক্ষোভ করেন জুবায়েরপন্থিরা
‘ট্র্যাপে পা’ দিয়েছেন সাদপন্থিরা
বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি হিসেবে ইজতেমা মাঠে ‘জোড় ইজতেমা’ হয়ে থাকে। এবার ২৯ নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ‘জোড় ইজতেমা’ ছিল জুবায়েরপন্থিদের। এরপর সাদপন্থিরাও ‘জোড় ইজতেমা’ করতে চায় ময়দানে।
সাদপন্থি একজন সক্রিয় তাবলিগ জামাত কর্মী জানান, বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ইজতেমা মাঠকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা চলছিল। মূল ময়দানে জুবায়েরপন্থিরা অবস্থান নিলে সাদপন্থিরা অবস্থান নেয় আহসানিয়া মিশন এলাকা থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত। আমরা সেখানে অবস্থান নিই।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সাদপন্থিদের মিডিয়া টিমের একজন প্রভাবশালী সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা মূলত জুবায়েরপন্থিদের ট্র্যাপে পা দিয়েছি। ওরা আমাদের উসকানি দিয়েছে। তাই সংঘর্ষ বেঁধেছে। বুধবার রাত তিনটার দিকে কামারপাড়ার দিকে যখন আমরা, তখন ওদের দুই-তিনশত লোক আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে আমাদের সাথী ভাইদের উদ্দেশে ঢিল নিক্ষেপ করছিল। এরপর লাঠির মাথায় চাকু বেঁধে আমাদের সাথী ভাইদের ওপর আক্রমণ করা হয়।’
তাবলিগের সাদপন্থি একজন সাথী বলেন, ‘আমরা ডিসেম্বরের শুরু থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জানিয়েছি যে জুবায়েরপন্থিরা জোড় করছে, তাদের শেষ হলে আমরা জোড় আয়োজন করবো। কিন্তু তারা মাঠ ছাড়েনি।’
বুধবার রাতে জুবায়েরপন্থি হাবিবুল্লাহ রায়হান এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিসসহ কয়েকজন সমন্বয়ক বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত আড়াইটায় কাকরাইল মসজিদে যান। সেখানে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, সে বিষয়েও আলোচনা করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে সাদপন্থি কাকরাইল মসজিদের ইমাম মুফতি আজিমুদ্দীন বলেন, ‘মূলত প্রশাসন ময়দানের নিয়ন্ত্রণ না নেওয়ার কারণে বুধবারের সংঘর্ষ হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, জোড় আয়োজন নিয়ে বিদ্যমান উত্তেজনার মধ্যে ১৫ ডিসেম্বর টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দান -সংলগ্ন টঙ্গী স্টেশন রোড-কামারগাঁও রাস্তায় এক প্রতিবাদ সমাবেশে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘প্রয়োজনে তুরাগ নদীকে আমাদের রক্তে লাল করে দেবো, তবু ইজতেমা ময়দান ছাড়বো না।’
বুধবার সংঘর্ষের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের উপস্থিতিতে মামুনুল হক বলেন, ‘তাবলিগ জামাতের সাদপন্থিদের ইজতেমার আর কোনও সুযোগ নেই।’ ‘সাদপন্থিদের সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে তাদের নিষিদ্ধের দাবি’ জানান মামুনুল।
২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল সংঘর্ষের দিন, ছবি: বাংলা ট্রিবিউন
ইজতেমা মাঠে সাদপন্থিদের নিষেধাজ্ঞার দাবি
সরকার নির্ধারিত আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত সময়ে বিশ্ব ইজতেমা করার ঘোষণা দিয়েছে তাবলিগ জামাতের জুবায়েরপন্থিরা। সাদপন্থিরা ইজতেমা করতে চাইলে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তারা।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনে জুবায়েরপন্থিদের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবউল্লাহ রায়হান এ কথা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে এসময় তিনি জানান, গতকালের (বুধবার) সংঘর্ষে তাদের তিন জন সাথী মারা গেছেন। এ ঘটনায় হত্যা মামলা করা হবে।
হাবিবউল্লাহ রায়হান আরও বলেন, ‘মাওলানা সাদের অনুসারীরা প্রশাসনের আদেশ অমান্য করেছে। সাদপন্থিরা যদি ইজতেমা মাঠ দখলের চেষ্টা করে তাহলে সাধারণ মুসল্লিরা প্রতিহত করবে। এই বিভক্তি ইজতেমার সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে কোনও প্রভাব ফেলবে না।’
‘মাওলানা সাদ তার মতবাদ থেকে ফিরে এসে ক্ষমা চাইলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব’ বলেও মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, বুধবার সচিবালয়ে বৈঠক শেষে জুবায়েরপন্থি মাওলানা মামুনুল হক সাদপন্থিদের ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি সাদপন্থিদের সন্ত্রাসী হিসেবে দাবি করেন।
‘তাবলিগে রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ চায়’ সাদপন্থিরা
সাড়ে ৩ মাস ধরে প্রশাসনের কাছে গেলেও কোনও সাড়া না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন তাবলিগের সাদপন্থি অনুসারীরা। তাদের অভিযোগ, সাড়ে তিন মাস ধরে প্রশাসনের নানা স্তরে গিয়ে, যোগাযোগ করেও কোনও সাড়া পাননি তারা। এ কারণে ইজতেমা মাঠে বুধবার হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে মনে করেন সাদপন্থিরা।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) বিকালে রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বরে একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন কাকরাইল মসজিদের ইমাম মুফতি আজিমুদ্দীন।
সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন সাদ অনুসারীরা। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদ কান্ধলভির অংশগ্রহণ নিশ্চিত, কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থিদের স্বাভাবিক কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনার সুযোগ, টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে সাদপন্থিদের ইজতেমার আগে ময়দান বুঝিয়ে দেওয়া।
৫ নভেম্বর হেফাজত সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মহাসমাবেশ, সেখানেই সাদপন্থিদের কাকরাইল ও ইজতেমা মাঠে প্রতিহতের ঘোষণা দেওয়া হয়
‘দ্বন্দ্বের সূত্রপাত অর্থে’
তাবলিগের উভয়পক্ষের সঙ্গে আলাপকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে বিদ্যমান বিরোধ খুব সহসা কাটছে না। ইতোমধ্যে তিন জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে ইজতেমা মাঠে পরস্পরের হাতে খুন হন তাবলিগের দুই সাথী। ওই সময় থেকে ভাগ হয়ে যায় তাবলিগ। জুবায়েরপন্থি ও দিল্লির নিজামুদ্দিনের সাদপন্থি হিসেবে দুভাগে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অংশীদারত্বের বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বিরা। ২০১৫ সালে তাবলিগের দিল্লির নিজামুদ্দিন বিশ্ব মারকাজের আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভির বিরোধিতা করেন পাকিস্তান ও ভারতের কয়েকজন মুরুব্বি।
তাবলিগের সাথীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বাংলাদেশে ঐক্যবদ্ধ তাবলিগ-জামাত পরিচালনা কমিটির সুরা সদস্য ছিলেন ১১ জন। ফায়সাল বা আমির হিসেবে সাত জন দায়িত্ব পালন করতেন। আর্থিক লেনদেন ও তাবলিগের অর্থ ভাগকে কেন্দ্র করে মূলত বিরোধ শুরু হয় ২০১৪ সালের দিকে।
‘তাবলিগ জামাত বাংলাদেশ’র মজলিসে শুরা সদস্য এবং ফায়সাল (আমির) বর্তমানে সাদপন্থিদের শীর্ষনেতা সৈয়দ ওয়াসিফ ইসলামের বিরুদ্ধে ‘আর্থিক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহারের’ অভিযোগ তুলেছিলেন তাবলিগের প্রবীণ দায়িত্বশীল মুরুব্বি অধ্যাপক মুশফিক আহমেদ ও তার অনুসারীরা। পাশাপাশি মাওলানা জুবায়েরপন্থিদের প্রতিও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ওয়াসিফ অনুসারীদের।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক মুশফিক আহমেদের মৃত্যুর পর কোণঠাসা হয়ে পড়েন তার অনুসারীরা। সেই বিরোধ প্রায় চার বছর ধরে চলে। ওয়াসিফ-বিরোধীদের অংশের নেতৃত্বে চলে আসেন মাওলানা জুবায়ের।
এরপর বিরোধ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর। ওই বছর পাকিস্তানে তাবলিগ-জামাতের একটি আয়োজনে মাওলানা জুবায়েরের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে বিরোধে জড়ান সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম। ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর জুবায়ের ও ওয়াসিফপন্থিদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ রূপ নেয় ভাঙচুরে।
২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ১ ডিসেম্বর টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়। সংঘর্ষে দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হন।
তাবলিগের উভয়পক্ষের সশস্ত্র বিরোধিতা এখানেই থেমে থাকেনি। ছড়িয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে রাজধানীর ভাটারায় একটি মাদ্রাসার দখল নিয়ে তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ দুই গ্রুপের অন্তত ৯ জন আহত হয়।
এ বছর সূত্রপাত যেখান থেকে…
চলতি বছর তাবলিগে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। হেফাজত সংশ্লিষ্ট একটি দলের মহাসচিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার আমাদের কাছে খবর ছিল সাদ সাহেবকে ইজতেমায় আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তার অনুসারীরা। এটা আমরা টের পাওয়ার পরই সব ইসলামি দল মিলে সিদ্ধান্ত নিই প্রতিহত করার। ওই চেষ্টার অংশ হিসেবে ৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছিল ‘উলামা মাশায়েখ বাংলাদেশ’। ‘দাওয়াত ও তাবলীগ, মাদারেসে কওমিয়া এবং দ্বীনের হেফজতের লক্ষ্যে’ এ সমাবেশ হয়েছিল।’
ওই সমাবেশে আলেমরা ৯টি দাবি দেন। এর মধ্যে একটি ছিল—‘কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার ময়দানের যাবতীয় কার্যক্রম উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে শুরারি নেজামে পরিচালিত হবে। এই স্থানগুলোতে সাদপন্থিদের কোনও কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না।’
একাধিক আলেম বলেন, ওই সময় থেকেই বিষয়টি অস্থিরতার দিকে যাবে, এমনটি আশঙ্কা ছিল অনেক আলেমের। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ নভেম্বর সিনিয়র কয়েকজন আলেম সংঘর্ষের আশঙ্কা জানিয়ে বিবৃতি দেন। সেই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে হেফাজত সমর্থিত দুটি ভুঁইফোড় রাজনৈতিক দল দেশে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ সংঘাত তৈরি করে এই সরকারের চলমান সব অর্জনকে ম্লান করে দিতে চায়।’
এই মুখোমুখি অবস্থার মধ্যেই ১২ ডিসেম্বর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবসহ জুবায়েরপন্থি আলেমদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করা হয়। যদিও সাদপন্থিরা মামলা করেনি বলে দাবি করেছেন। ওই মামলার প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সমাবেশ করে মাওলানা জুবায়ের অনুসারী মুসল্লিরা।
আলেমরা কী বলছেন?
হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা মনে করেন, তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে চক্রান্তের অংশ হিসেবেই কয়েক বছর ধরে এই কার্যক্রমের বিরোধিতা চলে আসছে। বিশেষ করে মাওলানা সাদের দেওবন্দি আলেমদের উদ্দেশে দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই বিরোধিতার সূত্রপাত।
তবে কোনও কোনও আলেম মনে করছেন, তাবলিগের একটি পক্ষে চলমান সরকারসমর্থিত হেফাজতভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে, অপরপক্ষে বাইরের একটি দেশের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে। এ কারণেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও সাদপন্থিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে—এমন দাবি করেছেন তাবলিগের কোনও কোনও সদস্য।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে তাবলিগের মাওলানা জুবায়ের ও সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সাদপন্থিদের দায়িত্বশীলদের অনেকেই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোথাও কোথাও জুবায়েরপন্থিদের দ্বারা প্রতিহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
হোমঅন্যান্য
ইসলামের দাওয়াতে এসে সংঘর্ষ-মৃত্যু, কী হচ্ছে তাবলিগে
সালমান তারেক শাকিল
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:০০
গাজীপুরের টঙ্গী ইজতেমা মাঠে ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের পাঁচ দিনের জোড় ইজতেমা ঠেকাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে মাওলানা জুবায়ের অনুসারীদের বিক্ষোভ, বুধবারের ছবি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গিয়ে তাবলিগ জামাতে যুক্ত ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার এগারসিন্দু গ্রামের আমিনুল ইসলাম বাচ্চু। ইসলামের দাওয়াতের কাজে ইজতেমার মাঠে আসা ৭০ বছরের এই বৃদ্ধের প্রাণ গেছে প্রতিপক্ষের হামলায়। ঘুমন্ত অবস্থায় বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) ভোরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে ঘটনাস্থলেই নিহত হন দুই পুত্র সন্তানের পিতা আমিনুল ইসলাম।
সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরের পর বিগত ছয়-সাত বছর ধরে তিনি যুক্ত হন তাবলিগ জামাতে। যেদিন ভোরে নিহত হন তার আগের দিন রাতেই কিশোরগঞ্জ মারকাজ মসজিদ থেকে ইজতেমার কাজে টঙ্গীতে আসেন। অসিয়ত মতো ৭০ বছর বয়স্ক আমিনুল ইসলাম এই মসজিদ প্রাঙ্গণেই চিরশায়িত হয়েছেন ।
তাবলিগে এসে প্রতিপক্ষের হামলায় তার মৃত্যুর কারণে পুরো এলাকায় শোক ছড়িয়ে পড়েছে। খামা গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউপি মেম্বার মো. খুরশিদ উদ্দিন বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘পুরো এলাকার মানুষের মন খারাপ। বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর ইবাদতে গেছিলেন আমিনুল। এখন আসলেন মৃত লাশ হয়ে। প্রশাসন থেকে বলেছে মামলা হয়েছে, আসামিদের গ্রেফতার করবে।’
খুরশিদ উদ্দিন মেম্বার জানান, আমিনুল ইসলামের জানাজা তার অসিয়ত মতো কিশোরগঞ্জ জেলার মারকাজ মসজিদে হয়েছে এবং সেখানকার গোরস্থানে তাকে দাফন হরা হয়।
তিনি বলেন, ‘আমিনুল ইসলাম এটা অসিয়ত করে গিয়েছিলেন। তার পরিবারের অবস্থা বেশি সচ্ছল না। তার দুই ছেলে। মৃত্যুকালে স্ত্রী ও সন্তানসহ আত্মীয়স্বজন রেখে গেছেন।’
মৃতের সংখ্যা কত?
বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) ভোররাতে টঙ্গীতে ইজতেমার মাঠে বাংলাদেশ তবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত তিন জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যদিও বুধবার সচিবালয়ে তাবলিগের সমস্যাকেন্দ্রিক এক বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, ‘ইজতেমা মাঠে চার জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।’
জামাতসহ একাধিক দল বিবৃতিতে চার জন নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। তবে পরিচয় মিলেছে তিন জনের। বৃহস্পতিবার দুপুর একটায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত নিহত অপরজনের সম্পর্কে কোনও তথ্য জানা যায়নি।
বুধবার ভোররাতের সংঘর্ষে নিহত বগুড়ার বেলাল হোসেন (৬৫), তাজুল ইসলামও (৭০) আমিনুল ইসলাম বাচ্চুর মতো এসেছিলেন ইজতেমার মাঠে দ্বীনের দাওয়াত কাজে।
সাদপন্থি তাবলিগ গ্রুপের বিশেষ মিডিয়া সমন্বয়ক তৌহিদুর রহমান সোহেল জানান, বেলাল হোসেন তাদের ‘সাথী’ ছিলেন।
বৃহস্পতিবার সকালে সাদপন্থি গ্রুপের একজন বাংলা ট্রিবিউনের কাছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে দাবি করেন, তাদের অনুসারীদের অন্তত তিন জন ঢাকা মেডিক্যালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থা গুরুতর।
গতকাল বুধবার সংঘর্ষের পর দুঃখ প্রকাশ করে ইজতেমা মাঠ ত্যাগ করেন সাদপন্থিরা। ঘটনার পর গাজীপুরের টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ। উত্তরার অংশে ১৪৪ ধারা জারি করেছে ডিএমপি।
বুধবার ১৮ ডিসেম্বর হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবাদে সড়ক দখল করে বিক্ষোভ করেন জুবায়েরপন্থিরা
‘ট্র্যাপে পা’ দিয়েছেন সাদপন্থিরা
বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি হিসেবে ইজতেমা মাঠে ‘জোড় ইজতেমা’ হয়ে থাকে। এবার ২৯ নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ‘জোড় ইজতেমা’ ছিল জুবায়েরপন্থিদের। এরপর সাদপন্থিরাও ‘জোড় ইজতেমা’ করতে চায় ময়দানে।
সাদপন্থি একজন সক্রিয় তাবলিগ জামাত কর্মী জানান, বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ইজতেমা মাঠকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা চলছিল। মূল ময়দানে জুবায়েরপন্থিরা অবস্থান নিলে সাদপন্থিরা অবস্থান নেয় আহসানিয়া মিশন এলাকা থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত। আমরা সেখানে অবস্থান নিই।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সাদপন্থিদের মিডিয়া টিমের একজন প্রভাবশালী সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা মূলত জুবায়েরপন্থিদের ট্র্যাপে পা দিয়েছি। ওরা আমাদের উসকানি দিয়েছে। তাই সংঘর্ষ বেঁধেছে। বুধবার রাত তিনটার দিকে কামারপাড়ার দিকে যখন আমরা, তখন ওদের দুই-তিনশত লোক আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে আমাদের সাথী ভাইদের উদ্দেশে ঢিল নিক্ষেপ করছিল। এরপর লাঠির মাথায় চাকু বেঁধে আমাদের সাথী ভাইদের ওপর আক্রমণ করা হয়।’
তাবলিগের সাদপন্থি একজন সাথী বলেন, ‘আমরা ডিসেম্বরের শুরু থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জানিয়েছি যে জুবায়েরপন্থিরা জোড় করছে, তাদের শেষ হলে আমরা জোড় আয়োজন করবো। কিন্তু তারা মাঠ ছাড়েনি।’
বুধবার রাতে জুবায়েরপন্থি হাবিবুল্লাহ রায়হান এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিসসহ কয়েকজন সমন্বয়ক বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত আড়াইটায় কাকরাইল মসজিদে যান। সেখানে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, সে বিষয়েও আলোচনা করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে সাদপন্থি কাকরাইল মসজিদের ইমাম মুফতি আজিমুদ্দীন বলেন, ‘মূলত প্রশাসন ময়দানের নিয়ন্ত্রণ না নেওয়ার কারণে বুধবারের সংঘর্ষ হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, জোড় আয়োজন নিয়ে বিদ্যমান উত্তেজনার মধ্যে ১৫ ডিসেম্বর টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দান -সংলগ্ন টঙ্গী স্টেশন রোড-কামারগাঁও রাস্তায় এক প্রতিবাদ সমাবেশে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘প্রয়োজনে তুরাগ নদীকে আমাদের রক্তে লাল করে দেবো, তবু ইজতেমা ময়দান ছাড়বো না।’
বুধবার সংঘর্ষের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের উপস্থিতিতে মামুনুল হক বলেন, ‘তাবলিগ জামাতের সাদপন্থিদের ইজতেমার আর কোনও সুযোগ নেই।’ ‘সাদপন্থিদের সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে তাদের নিষিদ্ধের দাবি’ জানান মামুনুল।
২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল সংঘর্ষের দিন, ছবি: বাংলা ট্রিবিউন
ইজতেমা মাঠে সাদপন্থিদের নিষেধাজ্ঞার দাবি
সরকার নির্ধারিত আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত সময়ে বিশ্ব ইজতেমা করার ঘোষণা দিয়েছে তাবলিগ জামাতের জুবায়েরপন্থিরা। সাদপন্থিরা ইজতেমা করতে চাইলে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তারা।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টে এক সংবাদ সম্মেলনে জুবায়েরপন্থিদের মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবউল্লাহ রায়হান এ কথা জানান।
সংবাদ সম্মেলনে এসময় তিনি জানান, গতকালের (বুধবার) সংঘর্ষে তাদের তিন জন সাথী মারা গেছেন। এ ঘটনায় হত্যা মামলা করা হবে।
হাবিবউল্লাহ রায়হান আরও বলেন, ‘মাওলানা সাদের অনুসারীরা প্রশাসনের আদেশ অমান্য করেছে। সাদপন্থিরা যদি ইজতেমা মাঠ দখলের চেষ্টা করে তাহলে সাধারণ মুসল্লিরা প্রতিহত করবে। এই বিভক্তি ইজতেমার সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে কোনও প্রভাব ফেলবে না।’
‘মাওলানা সাদ তার মতবাদ থেকে ফিরে এসে ক্ষমা চাইলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব’ বলেও মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, বুধবার সচিবালয়ে বৈঠক শেষে জুবায়েরপন্থি মাওলানা মামুনুল হক সাদপন্থিদের ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি সাদপন্থিদের সন্ত্রাসী হিসেবে দাবি করেন।
‘তাবলিগে রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ বন্ধ চায়’ সাদপন্থিরা
সাড়ে ৩ মাস ধরে প্রশাসনের কাছে গেলেও কোনও সাড়া না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন তাবলিগের সাদপন্থি অনুসারীরা। তাদের অভিযোগ, সাড়ে তিন মাস ধরে প্রশাসনের নানা স্তরে গিয়ে, যোগাযোগ করেও কোনও সাড়া পাননি তারা। এ কারণে ইজতেমা মাঠে বুধবার হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে মনে করেন সাদপন্থিরা।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) বিকালে রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বরে একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ তুলে ধরেন কাকরাইল মসজিদের ইমাম মুফতি আজিমুদ্দীন।
সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন সাদ অনুসারীরা। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সাদ কান্ধলভির অংশগ্রহণ নিশ্চিত, কাকরাইল মসজিদে সাদপন্থিদের স্বাভাবিক কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনার সুযোগ, টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে সাদপন্থিদের ইজতেমার আগে ময়দান বুঝিয়ে দেওয়া।
৫ নভেম্বর হেফাজত সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মহাসমাবেশ, সেখানেই সাদপন্থিদের কাকরাইল ও ইজতেমা মাঠে প্রতিহতের ঘোষণা দেওয়া হয়
‘দ্বন্দ্বের সূত্রপাত অর্থে’
তাবলিগের উভয়পক্ষের সঙ্গে আলাপকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে বিদ্যমান বিরোধ খুব সহসা কাটছে না। ইতোমধ্যে তিন জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে ইজতেমা মাঠে পরস্পরের হাতে খুন হন তাবলিগের দুই সাথী। ওই সময় থেকে ভাগ হয়ে যায় তাবলিগ। জুবায়েরপন্থি ও দিল্লির নিজামুদ্দিনের সাদপন্থি হিসেবে দুভাগে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অংশীদারত্বের বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তাবলিগের শীর্ষ মুরুব্বিরা। ২০১৫ সালে তাবলিগের দিল্লির নিজামুদ্দিন বিশ্ব মারকাজের আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভির বিরোধিতা করেন পাকিস্তান ও ভারতের কয়েকজন মুরুব্বি।
তাবলিগের সাথীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বাংলাদেশে ঐক্যবদ্ধ তাবলিগ-জামাত পরিচালনা কমিটির সুরা সদস্য ছিলেন ১১ জন। ফায়সাল বা আমির হিসেবে সাত জন দায়িত্ব পালন করতেন। আর্থিক লেনদেন ও তাবলিগের অর্থ ভাগকে কেন্দ্র করে মূলত বিরোধ শুরু হয় ২০১৪ সালের দিকে।
‘তাবলিগ জামাত বাংলাদেশ’র মজলিসে শুরা সদস্য এবং ফায়সাল (আমির) বর্তমানে সাদপন্থিদের শীর্ষনেতা সৈয়দ ওয়াসিফ ইসলামের বিরুদ্ধে ‘আর্থিক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহারের’ অভিযোগ তুলেছিলেন তাবলিগের প্রবীণ দায়িত্বশীল মুরুব্বি অধ্যাপক মুশফিক আহমেদ ও তার অনুসারীরা। পাশাপাশি মাওলানা জুবায়েরপন্থিদের প্রতিও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে ওয়াসিফ অনুসারীদের।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে অধ্যাপক মুশফিক আহমেদের মৃত্যুর পর কোণঠাসা হয়ে পড়েন তার অনুসারীরা। সেই বিরোধ প্রায় চার বছর ধরে চলে। ওয়াসিফ-বিরোধীদের অংশের নেতৃত্বে চলে আসেন মাওলানা জুবায়ের।
এরপর বিরোধ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর। ওই বছর পাকিস্তানে তাবলিগ-জামাতের একটি আয়োজনে মাওলানা জুবায়েরের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে বিরোধে জড়ান সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম। ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর জুবায়ের ও ওয়াসিফপন্থিদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ রূপ নেয় ভাঙচুরে।
২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ১ ডিসেম্বর টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়। সংঘর্ষে দুজন নিহত ও শতাধিক আহত হন।
তাবলিগের উভয়পক্ষের সশস্ত্র বিরোধিতা এখানেই থেমে থাকেনি। ছড়িয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে রাজধানীর ভাটারায় একটি মাদ্রাসার দখল নিয়ে তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ দুই গ্রুপের অন্তত ৯ জন আহত হয়।
এ বছর সূত্রপাত যেখান থেকে…
চলতি বছর তাবলিগে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। হেফাজত সংশ্লিষ্ট একটি দলের মহাসচিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার আমাদের কাছে খবর ছিল সাদ সাহেবকে ইজতেমায় আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তার অনুসারীরা। এটা আমরা টের পাওয়ার পরই সব ইসলামি দল মিলে সিদ্ধান্ত নিই প্রতিহত করার। ওই চেষ্টার অংশ হিসেবে ৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছিল ‘উলামা মাশায়েখ বাংলাদেশ’। ‘দাওয়াত ও তাবলীগ, মাদারেসে কওমিয়া এবং দ্বীনের হেফজতের লক্ষ্যে’ এ সমাবেশ হয়েছিল।’
ওই সমাবেশে আলেমরা ৯টি দাবি দেন। এর মধ্যে একটি ছিল—‘কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার ময়দানের যাবতীয় কার্যক্রম উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে শুরারি নেজামে পরিচালিত হবে। এই স্থানগুলোতে সাদপন্থিদের কোনও কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না।’
একাধিক আলেম বলেন, ওই সময় থেকেই বিষয়টি অস্থিরতার দিকে যাবে, এমনটি আশঙ্কা ছিল অনেক আলেমের। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২ নভেম্বর সিনিয়র কয়েকজন আলেম সংঘর্ষের আশঙ্কা জানিয়ে বিবৃতি দেন। সেই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে হেফাজত সমর্থিত দুটি ভুঁইফোড় রাজনৈতিক দল দেশে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ সংঘাত তৈরি করে এই সরকারের চলমান সব অর্জনকে ম্লান করে দিতে চায়।’
এই মুখোমুখি অবস্থার মধ্যেই ১২ ডিসেম্বর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিবসহ জুবায়েরপন্থি আলেমদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করা হয়। যদিও সাদপন্থিরা মামলা করেনি বলে দাবি করেছেন। ওই মামলার প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমে প্রতিবাদ সমাবেশ করে মাওলানা জুবায়ের অনুসারী মুসল্লিরা।
আলেমরা কী বলছেন?
হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা মনে করেন, তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে চক্রান্তের অংশ হিসেবেই কয়েক বছর ধরে এই কার্যক্রমের বিরোধিতা চলে আসছে। বিশেষ করে মাওলানা সাদের দেওবন্দি আলেমদের উদ্দেশে দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই বিরোধিতার সূত্রপাত।
তবে কোনও কোনও আলেম মনে করছেন, তাবলিগের একটি পক্ষে চলমান সরকারসমর্থিত হেফাজতভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো রয়েছে, অপরপক্ষে বাইরের একটি দেশের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠছে। এ কারণেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও সাদপন্থিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে—এমন দাবি করেছেন তাবলিগের কোনও কোনও সদস্য।
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে তাবলিগের মাওলানা জুবায়ের ও সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সাদপন্থিদের দায়িত্বশীলদের অনেকেই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কোথাও কোথাও জুবায়েরপন্থিদের দ্বারা প্রতিহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
গত ৬ নভেম্বর সাদপন্থি আলেমদের সংবাদ সম্মেলন (ফাইল ফটো)
ইসলামি ঘরানার জনপ্রিয় লেখক সালাহউদ্দিন জাহাঙ্গীর তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘জুবায়েরপন্থি তাবলিগের মুরুব্বিদের একটা বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল তাবলিগকে তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদের হাতে তুলে দেওয়া। ‘ওয়াজাহাতি সম্মেলন’ নামে ২০১৮ সালে তাবলিগকে যখন রাজনীতিকরণ করা হলো, তখনই মনে হয়েছিল যে তাবলিগ হজরতজি মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি (রহ.) শুরু করেছিলেন, সেই তাবলিগকে কলুষিত করার মারণাস্ত্র তুলে দেওয়া হলো রাজনৈতিক নেতাদের হাতে।’’
‘অনেকে প্রশ্ন তুলবেন, আমি সাদপন্থিদের ব্যাপারে কিছু বলছি না কেন? সাদপন্থিদের ব্যাপারে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। তাদের ভ্রষ্টতা, অপরিণামদর্শিতা, ঔদ্ধত্য এবং তাবলিগের নামে পেশিশক্তির ব্যবহার কোনোভাবেই তাবলিগের স্পিরিটকে ধারণ করে না।’
লেখক সালাহউদ্দিন তাবলিগ ভাঙনের পেছনে আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে দায়ী করেন।
তাবলিগের চলমান ঘটনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বিশ্ব মুসলিমের দ্বিতীয় বৃহত্তর মিলনমেলা বিশ্ব ইজতেমাকে ধ্বংস করার চক্রান্ত চলছে। এর অংশ হিসেবে ইজতেমা মাঠে এই সংঘর্ষ। সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। এই হত্যাকাণ্ডের অবিলম্বে বিচার দাবি করছি।’
বুধবারের মরণঘাতী সংঘর্ষের আগে গত ১২ ডিসেম্বর টঙ্গীতে জুবায়ের ও সাদ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে সাদ গ্রুপের ৫ মুরুব্বি আহত হন। বুধবারের আক্রমণের বিষয়ে ওই ঘটনার প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন জুবায়েরপন্থি একাধিক আলেম।
বিরোধ মেটাতে পরিপত্র
২০১৭ সালের বছরের শেষের দিকে তাবলিগের দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের (মূল কেন্দ্র) মাওলানা সা’দ কান্ধলভির বাংলাদেশে আসা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বের জেরে ওই বছরের ১৪ নভেম্বর রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে হাতাহাতিসহ ভাঙচুর হয়।
তাবলিগের একাধিক সাথী জানান, বিশ্বজুড়ে তাবলিগ জামাতের মারকাজ দিল্লির নিজামুদ্দিন। যা ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’ নামে পরিচিত। ওই মারকাজের শীর্ষ মুরুব্বি মাওলানা সা’দ কান্ধলভির বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। মাওলানা সা’দ আলেমদের অর্থের বিনিময়ে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার বিরোধিতা করেন। ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল পকেটে রেখে নামাজ হয় না বলেও মন্তব্য করেন।
মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, ‘এসব ঘটনায় দারুল উলুম দেওবন্দের পক্ষ থেকে সা’দ কান্ধলভির বক্তব্যের প্রতিবাদ করা হয়। দারুল উলুম দেওবন্দের তৎকালীন আলেমসহ শীর্ষ আলেমরা বিবৃতি দেন তার বিরোধিতা করে।’
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও তাবলিগের দ্বন্দ্ব সমাধানে উদ