16/01/2024
“আসমান এবং জমিন তাদের জন্য অশ্রুপাত করেনি এবং তাদেরকে দেওয়া হয়নি একটু অবসরও।” (১)
ফিরআউন বাহিনী যখন ডুবে মরলো, তখন তাদের জন্য আসমান আর জমিন একটুও কাঁদেনি—এটাই হচ্ছে এই আয়াতের প্রতিপাদ্য বিষয়। কিন্তু কেনই বা এখানে আসমান আর জমিনের কাঁদবার কথা বলা হলো? কারও মৃত্যুতে কি আসমান আর জমিন আসলেই কাঁদে?
তাফসীর ইবনু কাসীরে এসেছে, সাঈদ ইবনু যুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন—একবার একলোক ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার কাছে এসে জিগ্যেশ করলেন, ‘ওহে আল-আব্বাসের পিতা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কুরআনে বলেছেন—‘আসমান এবং জমিন তাদের জন্য অশ্রুপাত করেনি এবং তাদেরকে দেওয়া হয়নি একটু অবসরও।’ কিন্তু আসমান আর জমিন কি সত্যই কারও জন্য কাঁদে?’
জবাবে ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বললেন—‘হ্যাঁ, দুনিয়াতে এমন কেউ নেই যার জন্য আসমানে একটা দরোজা বরাদ্দ রাখা হয়নি। সেই দরোজাগুলো দিয়ে আসমান থেকে ব্যক্তির রিযক জমিনে আসে এবং ব্যক্তির আমল ওই দরোজা দিয়েই আসমানে উত্থিত হয়। যখন কোনো মুমিন ব্যক্তি মারা যায়, সাথে সাথে সেই দরোজাটা বন্ধ হয়ে যায়। সেই দরোজা তখন আফসোস করে আর মুমিন ব্যক্তির জন্য কান্না করে। এবং জমিনের যে জায়গায় ওই মুমিন ব্যক্তি সালাত আদায় করতো—সেই জায়গাটাও তার জন্য কান্না করে।
কিন্তু ফিরআউন এবং তার বাহিনীর এমন কোনো আমল ছিলো না। তাদের না কোনো ভালো আমল ছিলো, যা আসমানের দরোজা দিয়ে উত্থিত হতো, আর না জমিনের কোথাও তারা সিজদাহবনত হয়েছে কখনো, যার জন্য জমিন তাদের জন্য অশ্রু ঝরাবে।’ (২)
(২)
চলুন, একান্ত অবসরে বসে আমরা একটু কল্পনা করার চেষ্টা করি দৃশ্যটা। দুনিয়াতে আমি যে ভালো কাজগুলো করেছি, হোক তা কম কিংবা বেশি, আসমানের নির্দিষ্ট একটা দরোজা দিয়ে তা আল্লাহর কাছে পৌঁছায়। ওই নির্দিষ্ট দরোজাটা কেবল আমার একার—আর কারও না। শুধু তো আমল নয়, আমার জন্য যে রিযক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নির্ধারণ করেছেন, তা-ও আসমানের ওই দরোজা দিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে।
ওই দরোজাটা আমাকে চিনে, আমার নাম জানে। আমি যখন ভালো আমল করি, মানুষের বিপদে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাই, মানুষের সাথে ভালো আচরণ করি, আমি যখন অশ্লীলতাকে পরিহার করে চলি, যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নাযিলকৃত বিধানকে আমি নিজের জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিই—আসমানের সেই দরোজা তখন খুশি হয়ে যায়। হয়তো-বা ঠিক সেরকম, যেরকম আমাদের ভালো ফলাফলে, ভালো অর্জনে খুশি হয়ে পড়েন আমাদের বাবা-মা।
আমরা বিপথে গেলে, অসৎ সঙ্গ আর অনিয়মের বেড়াজালে আটকে গেলে আমাদের বাবা-মা’রা যেভাবে ব্যথিত হন, ঠিক সেভাবে আমরা যখন গুনাহ করি, মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়ি, যখন আল্লাহর বিধানকে ছেড়ে আমরা পা বাড়াই কু-প্রবৃত্তির বাতলানো পথে, তখন কি আসমানের সেই দরোজা ব্যথিত হয় না? দুঃখ পায় না? আমাদের ভালো কাজে, ভালো আমলে যদি সেটা আনন্দিত হয়, মন্দ কাজ আর মন্দ আমলে ব্যথিত হবে—সেটাই তো স্বাভাবিক।
ঘরের সেই কোণ আর মসজিদের সেই স্থান, যেই স্থানে দুনিয়াতে আমরা সালাত আদায় করতাম, আমাদের জায়নামায বিছানোর সেই চির পরিচিত জায়গাটাও মৃত্যুর দিন আমাদের জন্য কাঁদবে। সে কাঁদবে, কারণ—তার ওপর দাঁড়িয়ে, বসে এতোদিন একজন লোক মহামহিম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলাকে স্মরণ করতো, কিন্তু আজ থেকে সেই চিরাচরিত নিয়ম বন্ধ হয়ে গেছে।
জমিনের দুঃখ পাওয়ার, ব্যথিত হওয়ার কারণ এটাই যে—তার ওপর দাঁড়িয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এমন এক ব্যক্তির আজ জীবনাবসান ঘটেছে। আর কেউ হয়তো তার বুকে কপাল লাগিয়ে গুনগুন করে বলবে না—সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা।
ফিরআউন এবং তার বাহিনী জীবনে এমন কোনো নজির রেখে যেতে পারেনি। জমিনে কোনোদিন তারা কপাল ঠোকেনি। কোনোদিন কোথাও দাঁড়িয়ে কিংবা বসে উচ্চারণ করেনি আল্লাহর কোনো প্রশংসাবাক্য।
মুমিন ব্যক্তি যদি দুনিয়াতে কোনো আপনজন, কোনো বন্ধু-হিতাকাঙ্ক্ষী, কোনো সুহৃদ-শুভাকাঙ্ক্ষী রেখে না-ও যেতে পারে, তথাপি তার জন্য কাঁদবার দুটো জায়গা আছে—জমিনের সেই অংশ যে অংশে সে কপাল ঠুকে সিজদাহ করতো মহান রাব্বুল আলামীনকে, আর আসমানের সেই দরোজা যে দরোজা দিয়ে তার রিযক আসতো এবং উত্থিত হতো তার আমলগুলো। বিদায়বেলায় তার জন্য কেউ কাঁদুক কিংবা না-কাঁদুক, এই দুটো বস্তু তার জন্য কাঁদবে, মনে খারাপ করবে, ব্যথিত হবে।
কিন্তু কী দুর্ভাগ্য ফিরআউন এবং তার বাহিনীর! দুনিয়ায় তারা তো রেখে যেতে পারেনি কোনো প্রিয়জন-প্রিয় মানুষ, সুহৃদ-শুভাকাঙ্ক্ষী, তথাপি আসমান এবং জমিনেও রেখে যেতে পারলো না কোনো স্মৃতিচিহ্ন। তৈরি করে যেতে পারলো না তাদের বিদায়ে ব্যথিত হওয়ার কোনো উপলক্ষ।
আমাদের মৃত্যুতে, আমাদের শূন্যতায় ব্যথিত হবে জমিন আর আসমানের মতো জড়বস্তুও—সুবহানাল্লাহ! খুশি হওয়ার জন্য, আনন্দে আত্মহারা হওয়ার জন্য কতো আয়োজনই না করে রেখেছেন আমাদের রব! সত্যই কতো মহান তিনি!
মৃত্যুর মাধ্যমে যখন আমরা হারিয়ে যাবো দুনিয়া থেকে, যখন পাড়ি জমাবো অনন্ত আখিরাতের পানে, তখন আমাদের জন্য হাহাকার করবে জমিনের সেই অংশ, যে অংশে আমি কপাল ঠুকিয়ে আমার মালিককে সিজদাহ করতাম, অশ্রু ঝরাবে আসমানের সেই দরোজা, যা দিয়ে আমার আমলগুলো উত্থিত হতো আর নেমে আসতো আমার রিয্ক—এটুকু জানার পরে আমার কী করা উচিত? আমার কি উচিত নয় আজ থেকে জমিনে সিজদাহর পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া? আমলকে আরও বেশি বাড়িয়ে নেওয়া, যাতে করে আমার জন্য আসমানের সেই দরোজার ব্যথার মাত্রাটা আরও অনেক অনেক বৃদ্ধি পায়? যাতে আমার শূন্যতাটুকু তারা আরও অনেক বেশি করে অনুভব করে?
জীবনের বেলা শেষে যখন আমাদের পদচিহ্ন আর পড়বে না এই দুনিয়ার ধুলো-মাটিতে, সেই সময়ের জন্য আমরা কি কোনো উপলক্ষ তৈরি করে যাচ্ছি, যাতে আমাদের মৃত্যুর পরে জমিন আর আসমানের কোথাও আমাদের জন্য হাহাকার তৈরি হয়, নাকি আমাদের অবস্থা ফিরআউন আর তার বাহিনীর মতো যাদের মৃত্যুতে জমিন আর আসমানের কোথাও কোনো সাড়াশব্দ পড়েনি, যাদের জন্য কাঁদেনি আল্লাহর কোনো জমিন আর অশ্রুপাত করেনি কোনো আসমানি দরোজা?
রেফারেন্স:
(১) সূরা আদ-দুখান, আয়াত-২৯
(২) তাফসির ইবন কাসীর, ৭/২৫৪
(এই অংশটুকু আমার লিখিত ‘কুরআন থেকে নেওয়া জীবনের পাঠ’ বই থেকে নেওয়া।)