06/03/2021
বলিউডের আছে অমিতাভ বচ্চন আর আমাদের আছে আলমগীর। আমার কাছে সিনেমা হলে বাংলা সিনেমা দেখার সোনালি দিনগুলোতে আলমগির হলেন অসংখ্য ব্যবসাসফল ও দর্শক নন্দিত চলচ্চিত্রের অভিনেতা আলমগীর হলেন খুব প্রিয় একজন অভিনেতা বা প্রথম পছন্দের অভিনেতা।আলমগীরের অভিনয় ও সংলাপ বলার ধরন এতোটাই স্মার্ট যে কোন চরিত্রে আলমগিরের অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করতো। বলিউডের চলচ্চিত্রে যেমন বিগবি খ্যাত একজন অমিতাভ বচ্চন আছেন আমার কাছে আলমগীর হলেন বাংলা চলচ্চিত্রের অমিতাভ বচ্চন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের যে কজন জীবন্ত কিংবদন্তী আছেন তাঁদের মধ্যে আলমগীর নামটি শীর্ষ তালিকায় থাকা একটি নাম । বাংলা চলচ্চিত্রের এক অসাধারন অভিনেতা ও কোটি কোটি দর্শকের পছন্দের অভিনেতা হিসেবে আজো আলমগির আছেন ও থাকবেন চিরকাল।
১৯৫০ সালের ৩রা এপ্রিল আলমগীর জন্মগ্রহন করেন । তাঁর পিতার নাম দুদু মিয়া যিনি সেই সময়ের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন । ১৯৫৬ সালে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর সহযোগী প্রযোজক ছিলেন আলমগীরের পিতা দুদু মিয়া । সেই সুত্রেই সিনেমার সাথে ছোটবেলা থেকেই আলমগীরের পরিবারের জানাশোনা । ‘আমার জন্মভুমি’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে আলমগীর এর বাংলা চলচ্চিত্রে আগমন। এরপর ৭০ দশকের মাঝামাঝি থেকে ৯০ দশকের প্রথম পর্যন্ত একের পর এক ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায় । ভারতের হিন্দি চলচ্চিত্রে যেমন বিগম্যান খ্যাত অমিতাভ আছেন আমার কাছে বাংলা চলচ্চিত্রের অমিতাভ বচ্চন হলেন আলমগীর যিনি তাঁর সমসাময়িক অভিনেতাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে পর্দায় দাপুটের সাথে অভিনয় করে গেছেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের নায়করাজ রাজ্জাক তাঁর সমসাময়িক অভিনেতাদের মাঝে আলমগিরের সাথে সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্রে একসাথে কাজ করেছেন ।রাজ্জাকের সাথে আশার আলো,কাপুরুষ,কেউ কারো নয়, লাইলি মজনু,স্বামী স্ত্রী, ন্যায় বিচার, অন্ধ বিশ্বাস, সমর সহ আরও অনেক ছবিতে। শুধু রাজ্জাক নয়, নায়ক বুলবুল আহমেদ, জসিম, ওয়াসিম, সোহেল রানা, ইলিয়াস কাঞ্চন, জাফর ইকবাল সবার সাথেই আলমগিরের আছে অসংখ্য দর্শকননন্দিত চলচ্চিত্র। একই সাথে ৯০ দশকের রুবেল,মান্না, সালমান শাহ,ওমর সানিদের সাথেও আছে একাধিক দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্র। মাল্টিস্টার ধারার চলচ্চিত্রে প্রযোজক পরিচালকদের কাছে আলমগির ছিলেন অন্যতম পছন্দের অভিনেতা। আলমগীর শুধু চলচ্চিত্রে একজন অভিনেতা হিসেবেই থেমে থাকেননি তিনি একাধারে একজন প্রযোজক, পরিচালক ছিলেন। সেই সময় সকল প্রযোজক ,পরিচালক এর কাছে আলমগীর ছিলেন সবচেয়ে আস্থাশীল ও নির্ভরশীল একজন অভিনেতা ।
সামাজিক অ্যাকশন , পারিবারিক টানাপোড়ন, রোমান্টিক অ্যাকশন। ফোক ফ্যান্টাসি সহ সব ধারাতেই আলমগীর ছিলেন সফল । যার ফলে সব ধরনের চরিত্রে আলমগীর ছিলেন মানানসই। বাংলাদেশের সর্বাধিক (৬৭টি) ছবির পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝনটু পরিচালিত ৪০ টি ছবিতেই আলমগীর অভিনয় করেন।শুধু তাই নয় সোনালি যুগের বাংলা চলচ্চিত্রের মাস্টার মেকার এ জে মিন্টু, ক্লাসিক পরিচালক আমজাদ হোসেন,জহিরুল হক,কামাল আহমেদ, শিবলি সাদিক, মোতালেব হোসেন,দেওয়ান নজরুল, আলমগীর কুমকুম, শহিদুল ইসলাম খোকন, কাজী হায়াত, দিলিপ বিশ্বাস,আজিজুর রহমান, ইবনে মিজান , গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোস্তফা মেহমুদ,কাজি জহির, আজহারুল ইসলাম খান , দিলিপ সোম, মতিন রহমান ,আব্দুল্লাহ আল মামুন, কবির আনোয়ার, সাইফুল আজম কাশেমের মতো রথি মহারথীদের একাধিক চলচ্চিত্র ছাড়াও নুর হোসেন বলাই, মোহাম্মদ হান্নান, সোহানুর রহমান সোহান, মালেক আফসারি, মমতাজুর রহমান আকবর, ইস্পাহানি আরিফ জাহানের মতো ৯০ দশকের পরিচালকদের একাধিক চলচ্চিত্রেও কাজ করেন এই গুণী অভিনেতা। এতেই বুঝা যায় যে আলমগীরের উপর নির্মাতারা কি পরিমান আস্থা রাখতেন। কলেজ পড়ুয়া তরুন ছাত্র, পুলিশ অফিসার, মাস্তান, গ্রাম্য যুবক, সহজ সরল বোকা যুবক, ব্যর্থ প্রেমিক, রাজকুমার, বড় ভাই, পিতা সহ সব ধরনের চরিত্রে আলমগীর ছিলেন সফল। চলচ্চিত্রে আলমগীর এমনই আস্থাশীল ছিলেন যে কিছু পরিচালক শুধু আলমগীর ছাড়া তাদের ছবিতে অন্য কাউকে চিন্তা করতে পারতেন না। এছাড়া স্বাধীন পরবর্তী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এমন পরিচালক পাওয়া দুঃসাধ্য যার সাথে আলমগীর কাজ করেনি। ৭০ দশকের শেষ প্রান্তে দিলিপ বিশ্বাস পরিচালিত ‘জিঞ্জির’ ছবিতে প্রথম একই ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাক ও সোহেল রানা’র সাথে সমান তালে অভিনয় করে তিনি নিজের অভিনয়ের দক্ষতা দেখিয়ে সবার কাছে বেশ আলোচিত হয়েছিলেন ।
এরপর ৯০ দশকের শুরুতে নায়করাজ রাজ্জাক ও অভিনেত্রী শাবানার সাথে মতিন রহমানের ‘অন্ধ বিশ্বাস’ ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন । জুটি বেঁধে কাজ করেছেন শাবানা, ববিতা, কবরী, সুচরিতা, অলিভিয়া, রোজিনা, অঞ্জু ঘোষ, দিলারা, দিতি , চম্পা সহ অসংখ্য অভিনেত্রীর সাথে যারমধ্যে আলমগীর শাবানা জুটি বাংলা চলচ্চিত্রের এক অনন্য রেকর্ড স্থাপন করে ইতিহাস হয়ে আছে। শাবানার সাথে প্রায় দেড় শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলা চলচ্চিত্রের যে কোন জুটির সর্বাধিক চলচ্চিত্রের রেকর্ড আজো অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। মজার ব্যাপার হলো চিত্রনায়িকা চম্পার সাথে জুটি বেঁধে নিস্পাপ চলচ্চিত্রে যেমন সফল হয়েছিলেন ঠিক তেমনি কাজী হায়াতের ‘দেশপ্রেমিক’ চলচ্চিত্রে চম্পার বাবার চরিত্রেও অভিনয় করে সফল হয়েছিলেন এই অসাধারন অভিনেতা। আবার বুলবুল আহমেদের ‘আকর্ষণ’ চলচ্চিত্রে জাফর ইকবালের সাথে সহ নায়ক হিসেবে যেমন সফল হয়েছিলেন ঠিক তেমনি একই সময়ে দিলিপ বিশ্বাসের ‘অপেক্ষা’ চলচ্চিত্রে জাফর ইকবালের বাবার চরিত্রে অভিনয় করেও সফল হয়েছিলেন ।
৭০ দশকের শেষ প্রান্তে গীতিকার খোশনূর আলমগীর এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন। আলমগীর -খোশনূর দম্পতির দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান রয়েছে । আলমগীর খোশনূর দম্পতির কন্যা আঁখি আলমগীর (সঙ্গীত শিল্পী) ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। আলমগির আরও একাধিক ছবির গানে কণ্ঠও দিয়েছিলেন । ১৯৯৮/৯৯ সালে কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লাকে বিয়ে করে আলাদা সংসার গড়েন আলমগীর।
১৯৮৫ সালে ‘মা ও ছেলে’ ছবির জন্য আলমগীর প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন । এরপর অপেক্ষা , ক্ষতিপূরণ, অন্ধ বিশ্বাস , মরনের পরে, পিতা মাতা সন্তান, দেশপ্রেমিক ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন যা ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কোন অভিনেতার সর্বাধিকবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পাওয়ার বিরল ও একমাত্র ঘটনা। এছাড়া আলমগীর ১৯৮৯ – ৯২ সাল পর্যন্ত একটানা ৪ বার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার ( ক্ষতিপূরণ , মরনের পরে , পিতা মাতা সন্তান ও অন্ধ বিশ্বাস) জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে এক অনন্য রেকর্ড করেন যা এখনও কেউ ভাঙতে পারেনি । শুধু ১৯৯৩ সাল বাদ দিয়ে ১৯৯৪ সালে কাজী হায়াত এর ‘দেশপ্রেমিক’ ছবির জন্য আবারও শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন । সর্বাধিক ৭ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার সহ ২০১০ সালে ‘জীবন মরনের সাথী’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেতা হিসেবে পুরস্কার নিয়ে সর্বমোট ৮ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অভিনেতাদের মধ্য এখন পর্যন্ত আলমগীরই হলেন সর্বাধিক বার জাতীয় পুরস্কার পাওয়া অভিনেতা।
প্রায় ৩ শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করা আমার দেখা আলমগীর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো – আমার জন্মভুমি, দস্যুরানী, মণিহার, দেনা পাওনা, জিঞ্জির, মাটির মানুষ, মধুমিতা, বাসর ঘর, মনিহার,আগুনের আলো,লুটেরা,ঘরের বউ, ভালোবাসা,দিওয়ানা, মেহেরবানু, চণ্ডীদাস রজকীনি, কেউ কারো নয়, কাপুরুষ, আশার আলো,সৎপথে হলো দেখা, আঘাত, ভরসা, লাইলি মজনু, বড় বাড়ির মেয়ে, ঘরের বউ, ছক্কা পাঞ্জা, মধু মালতী, নির্দোষ, মানে না মানা, আওলাদ, আকর্ষণ, মান সম্মান,শ্রীমতী ৪২০,বিচ্ছেদ,শশিপুন্না, সোনার নাও পবনের বৈঠা, সাথী,আক্রোশ,মায়ের দোয়া, স্বামীর আদেশ, নানটু ঘোটক, ওস্তাদ সাগরেদ, সবুজ সাথী, প্রতিজ্ঞা, ভাত দে, মা ও ছেলে, হালচাল, অস্বীকার, অপেক্ষা, লাল বেনারসি, ছেলেকার,আওয়াজ ,বৌমা, মায়ের দোয়া , সমর, ঘরের সুখ, জেলের মেয়ে, লাখে একটা, ব্যথার দান, জেল হাজত, ভাই আমার ভাই, জলপরী, আইন আদালত, অবহেলা, স্ত্রীর স্বপ্ন, ন্যায় বিচার, অমরসঙ্গী,অপরাধী, নিস্পাপ, অশান্তি, স্বামী স্ত্রী, সত্য মিথ্যা, বিদায়, বিশ্বাসঘাতক, দোলনা, চেতনা, অমর, ন্যায় অন্যায়,বিসর্জন,বউ শাশুড়ি, ক্ষতিপুরন , রাঙ্গা ভাবী , গরীবের বউ, সান্ত্বনা, ননদ ভাবী, মরনের পরে, অচেনা, অর্জন, গরীবের বন্ধু , অন্ধ বিশ্বাস , ক্ষমা, অবুঝ সন্তান, বাংলার বধূ, পিতা মাতা সন্তান, শাসন, বুকের ধন, দেশপ্রেমিক, স্নেহ, দুর্জয় , রাক্ষস, নির্মম, নরপিশাচ, অজান্তে সংসারের সুখ দুঃখ, জজ ব্যারিস্টার, রাগ অনুরাগ, ঘাতক , বন্ধন, বুকের ধন, ঘর দুয়ার, বাংলার মা, নির্মম,সত্যবাদী,অগ্নিস্বাক্ষর,কন্যাদান, আসামি বধূ, ঘাতক , স্নেহের বাঁধন, বাপের টাকা, আমি সেই মেয়ে।
নিচে সিনেমা হলে দেখা আলমগীর অভিনীত সেরা তিনটি ( ব্যক্তিগত বিচার) সিনেমার বিস্তারিত দেয়া হলো।
১) ক্ষতিপূরণঃ এফডিসির চলচ্চিত্র মানেই যে ৭ টা ফাইট, ৫ টা গান, যাত্রার ঢং এ অ্যাকটিং, কানের পর্দার ফাটানো চিঃকার, আজগুবি গল্প নয় এই কথাটার আরেকটি প্রমাণ দিচ্ছি ,শুনুন । আমাদের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে গতানুগতিক ধরনের বাহিরে অসংখ্য দর্শকনন্দিত ছবি আছে যা অনেকেরই অজানা। ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ক্ষতিপূরণ’ ছবিটি তারই একটি প্রমাণ যে ছবিটি সাধারন সিনেমা দর্শক থেকে সমালোচক সবার প্রশংসা কুড়িয়েছিল এবং যে ছবিটা জাতীয় চলচ্চিত্রের একাধিক শাখায় পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন । সম্প্রতি সালমান খানের ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ ছবিটি দেখে যারা কাঁদেন তাঁদের বলবো দয়া করে আমাদের স্বল্প বাজেটে নির্মিত ‘ ক্ষতিপূরণ’ ছবিটি একবার দেখুন ।
১৯৮৯ সালের কোন এক বিকেলে সপরিবারে গিয়েছিলাম সিলেটের ‘মনিকা’ সিনেমা হলে যথারীতি মুক্তিপ্রাপ্ত নতুন ছবি ‘’ক্ষতিপূরণ’’ দেখতে । ছবিটির নায়ক ছিলেন আলমগীর ও নায়িকা রোজিনা । কিশোর বেলার সেই সময় আলমগীর আমার সবচেয়ে প্রিয় একজন নায়ক যার ছবি মানেই অসাধারন কিছু । সেদিন ছবিটি দেখার আগ পর্যন্ত ভাবতে পারিনি কি চমক অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য ও সিনেমা হল ভর্তি সকল দর্শকদের জন্য । যাই হোক , টেলিসামাদ ও আবুল খায়েরের অলিম্পিক ব্যাটারি ও গোল্ডলিফের বিজ্ঞাপন দুটো শেষে জাতীয় পতাকা প্রদর্শন শেষে ছবি শুরু হলো ।
ছবির গল্পটি সংক্ষেপে এমন – আলমগীর একজন চিত্রশিল্পী যার স্ত্রী ও সন্তান মারা গেছে। সন্তান মারা যাওয়ায় প্রিয়তমা স্ত্রী সন্তানের শোকে একদিন আত্মহত্যা করেন। স্ত্রী’র মৃত্যু নিয়ে আলমগীরকে পুলিশও সন্দেহ করে । বিশাল বাড়ীতে আলমগীর একাই থাকেন । শোকে দুখে আলমগির প্রতিরাতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ীতে ফেরে। একদিন মাতালবস্থায় বাড়ী ফেরার পথে রাস্তার ধারে একটি ৫/৬ বছরের বয়সী শিশুকন্যাকে কুড়িয়ে পায় । বাসায় নেয়ার পর আলমগীর জানতে পারে মেয়েটি বোবা । মেয়েটিকে নিজের মেয়ে ‘কবিতা’ নাম দিয়েই লালন পালন করতে শুরু করে কিন্তু এই মেয়েটিকে বাড়ী আনার পর থেকেই ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা । কারা যেন মেয়েটিকে ছল বলে কৌশলে আলমগিরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চায় মেয়েটিকে খুন করতে চায় । আলমগির নিজেও ভেবে পায়না কেন এই নিস্পাপ শিশুটির পেছনে এতো শত্রু । ঘটনাক্রমে একদিন মেয়েটির ছোট খালা রোজিনার সাথে আলমগিরের পরিচয় হয়। রোজিনা মেয়েটিকে গাড়ীতে একা বসে থাকতে দেখে মায়ায় পরে যায় এবং কবিতাকে নিয়ে শপিংমলে ঘুরে বেড়ায় যেভাবে রোজিনার সাথে আলমগিরের পরিচয়। রোজিনাও জানে না যে এই শিশুটি তাঁর মেঝো বোনের মেয়ে যাকে বিদেশ থেকে আসার পর রোজিনা ও তাঁর বড় বোন রোজী আফসারি খুঁজছে। শিশুটিকে নিতে ছদ্মবেশে দিলদার ও তাঁর স্ত্রী আলমগিরের বাড়ীতে হানা দেয় এবং নিজেদের শিশুটির মা বাবা দাবী করে । কিন্তু দিলদার যখন মেয়েটিকে বাবা বলে ডাকতে বলে তখনই আলমগিরের সন্দেহ হয়। অর্থাৎ খুনি চক্র দিলদারকে টাকার বিনিময়ে মেয়েটিকে অপহরণ করতে পাঠায়। একদিন খুনি চক্রের সাজানো নারী অপহরণ ঘটনায় সন্দেহে জেলে যায় আলমগির । মেয়েটির দায়িত্ব নেয় রোজিনা এবং আলমগির রোজিনাকে বলে যেন যে ভাবেই হোক কবিতার দিকে যেন খেয়াল রাখে । রোজিনা কবিতাকে নিজেদের বাড়ীতে নিয়ে আসার পর রোজী কবিতাকে চিনে ফেলে এবং রোজিনাকে জানায় এই সেই তাঁদের মেঝো বোন দিলারার মেয়ে। মেঝো বোনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় থানায় আগেই জিডি করে রেখেছিল রোজী ।রোজী কবিতাকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনা পুলিশকে জানায় এরপর বের হয়ে আসে অন্য রোমহর্ষক ঘটনা । কে বা কারা কবিতার মা ও বাবাকে মেরে নিজেদের বাড়ীর বাগানের পেছনে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছিল যাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ । পুলিশ সন্দেহ করে আলমগীরকে কিন্তু বোবা শিশুটির আচরণে বুঝিয়ে দেয় আলমগির খুনি নয় বরং আলমগিরের কাছে সে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ । আলমগিরও সেদিন প্রথম জানতে পারে কুড়িয়ে পাওয়া বোবা শিশুটিকে কেন বারবার একটি চক্র ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল আলমগিরের কাছ থেকে । আলমগির পুলিশের জেলে যাওয়ার পথে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় । কামারের ঘরে হাতকড়া খুলতে এসে দেখা পেয়ে যায় কামাররুপী দিলদার’কে যে একদিন কবিতার বাবা সেজে আলমগিরের বাড়ী থেকে কবিতাকে অপহরণ করতে গিয়েছিল। আলমগির দিলদারের কাছ থেকে জানতে পারে যে এক দাঁড়িওলা লোক তাঁকে টাকার বিনিময়ে এই কাজ করতে বাধ্য করেছিল। অভাবে পরে দিলদার সেদিন রাজী হয়েছিল। দিলদারের কাছ থেকে ধারনা পেয়ে আলমগির একজন লোকের একটি ছবি আঁকে যাকে সে একদিন রাস্তায় দেখেছিল এবং যে লোকটিকে দেখামাত্রই শিশু কবিতা ভয় পেয়ে গিয়েছিল । রাতের আঁধারে রোজিনার সাথে দেখা করতে এসে সব খুলে বলে কেন সে পালিয়েছে এবং সাদা একটি কাগজে একজন দাঁড়িওয়ালা লোকের ছবি এঁকে স্ক্রেচটি রোজিনার হাতে তুলে দিয়ে বলে ‘’তুমি কবিতাকে এই ছবিটা দেখিয়ে জানার চেষ্টা করবে কবিতা এই লোকটিকে চিনে কিনা? ‘’ আলমগিরের কথামতো রোজিনা হাতে আঁকা ছবিটি কবিতাকে দেখাতেই কবিতা ভয় পেয়ে যায় যাতে বুঝতে বাকী নেই কবিতা আলমগিরের হাতে আঁকা ছবির মানুষটিকে চিনে যাকে একদিন রাস্তায় দেখে আলমগিরের সাথে থাকা শিশু কবিতা আঁতকে উঠেছিল । ………
এরপর শুরু হয় কবিতার মা বাবাকে খুন করার রহস্য উদ্ঘাটন ও খুনিদের ধরার আলমগিরের অভিযান যে নিস্পাপ শিশুটির মা বাবা হারানোর ‘’ক্ষতিপূরণ’’ বুঝিয়ে দিতে চায় এবং অবশেষে খুনি ড্যানি সিডাক ও আহমেদ শরীফের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ছবিটি শেষ হয় এবং চাঞ্চল্যকর একটি খুনের রহস্য উদ্ঘাটন ও খুনিদের জীবন বাজী রেখে ধরিয়ে দেয়ার পুলিশের হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়া ফেরারি আসামী আলমগিরকে পুলিশ বিভাগ ক্ষমা করে দেয় । শিশু কবিতা আলমগির ও রোজিনার মাঝে তাঁর হারানো মা বাবাকে খুঁজে পায় । এভাবেই সেদিন রুদ্ধশ্বাস এক গল্পের সহজ সরল কিন্তু অসাধারন নির্মাণের ছবি ‘’ক্ষতিপূরণ’’ ছবিটি দেখে তৃপ্তি নিয়ে দর্শক সিনেমা হল থেকে বের হয়েছিল । যে ছবিটির টাইটেলের শুরুতে পরিচালক মালেক আফসারি ‘’একটি বিদেশী ছবির ছায়া অবলম্বনে’’ লিখে না দিলে কেউ সহজে বুঝতেই পারতো না ছবিটি বাংলাদেশের গল্প নয় কারণ বিদেশী ছবির গল্প হলেও পুরো ছবিটি ছিল বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবি । সেদিন কিশোর বয়সে ছবিটি দেখলেও আজো ছবিটির স্মৃতি বারবার চোখে ভাসে কারণ বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমার ব্যতিক্রমধর্মী ছবিটি দেখে।
২) দেশপ্রেমিকঃ কাজী হায়াত নামের বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে একজন অসাধারন পরিচালক আছেন যা আজকের ডিজিটাল চলচ্চিত্রের তথাকথিত মেধাবী গোষ্ঠীর অনেক ডিজিটাল নির্মাতারা স্বীকারই করতে চান না। এই সকল নব্য মেধাবীরা মনে করে যে উনারা আজ যা দেখাচ্ছেন সেটাই মূলত চলচ্চিত্র আর কাজী হায়াত ও তাঁর সমমনা যারা ছিলেন তাঁরা সব বস্তাপোঁচা ছবি দেখিয়েছেন আমাদের !!! যা তাঁদের চরম মূর্খতার প্রমাণ দেয় । আমাদের নতুনধারার চলচ্চিত্রে এমনও কিছু নির্বোধ আছে যারা বলে ‘’ তখন (৮০/৯০ দশক) বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে ‘’ So called মেধাবী‘’ ছিল যারা আসলে মেধাবী না ‘’ যা শুনে হাসবো না কাঁদবো ভেবে পাইনা। যারা মনে করেন বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র কিছু গতানুগতিক ফর্মুলার ছবি তাঁদেরকে বলবো ‘’দেশপ্রেমিক’’ ছবিটা পারলে একটু দেখেন ।
কাহিনী সংক্ষেপঃ আলমগির একজন চিত্রপরিচালক । সংসারে স্ত্রী (ডলি জহুর) ও এক শিশু কন্যা (চম্পা) নিয়েই সুখেই আছেন । স্ত্রী ডলি জহুর শিল্পপতি পিতার একমাত্র মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও বাবার অমতে খুব সাধারন আলমগীরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন । যিনি আলমগিরকে নিয়ে গর্ব করেন। শ্বশুর আরিফুল হকের কাছে আলমগির হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নির্বোধ ব্যক্তি । যিনি পরিচালক আলমগীর’কে পছন্দ করেন না। আলমগির ‘দেশপ্রেমিক’ নামের একটি নতুন ছবি নির্মাণ করছেন যা ছিল নষ্ট সমাজ ও নষ্ট রাজনীতির এক সাহসী চিত্রায়ন। কিন্তু ছবিটি মুক্তির আগেই সমালোচিত হয় সরকারের পক্ষ থেকে । আলমগীর’কে তথ্যমন্ত্রী বাসায় ডেকে নিয়ে ছবিটি মুক্তি না দিতে অনুরোধ জানায় এবং এর বদলে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেন । আলমগীর তথ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব সরাসরি ফিরিয়ে দেন এবং শুরু করেন ছবিটি মুক্তি দেয়ার প্রক্রিয়া । কিন্তু সরকারের নির্দেশে তাঁকে এফডিসির ল্যাবে ছবিটি প্রিন্ট করতে দেয়া হয় না। পদে পদে আলমগির বাধাগ্রস্থ হোন। কোন প্রযোজক ,পরিবেশক ছবিটির বাকি কাজ শেষ করতে অর্থ প্রদানে আগ্রহী হয় না। আলমগির বিদেশ থেকে ছবিটি প্রিন্ট করিয়ে আনার জন্য এফডিসির সম্পাদক আশিস কুমার লৌহের কাছ থেকে টাকা ধার নেন এবং স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে বাকি টাকা যোগাড় করেন । সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন দেখলেন কোন ভাবেই আলমগীরকে থামানো যাচ্ছে না তখনই রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং একটি স্বর্ণচোরাচালানের মামলায় জড়িয়ে দেয়। রিমান্ডের নামে চলে পুলিশের অমানুষিক নির্যাতন । স্ত্রী ও সন্তানের কথা চিন্তাকরে পুলিশের কথায় মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে রাজী হয় । স্বীকারোক্তি দেয়ায় আলমগীরের ২০ বছরের জেল হয় । আলমগির চলে যান অন্ধকার কারাগারে । স্ত্রী ডলি জহুর শিল্পপতি বাবার সহযোগিতায় একমাত্র মেয়েকে নিয়ে চলে যান দেশের বাহিরে।
২০ বছর বৃদ্ধ আলমগীর জেল থেকে বের হোন এবং ঠিকানাবিহীন ভাবে পথে পথে ঘুরেন । একদিন শ্বশুরবাড়ীতে যান স্ত্রী ও মেয়ের খোঁজে । শ্বশুর তাঁকে তাড়িয়ে দেন । আলমগিরের মেয়ে চম্পা বিদেশ থেকে ফিরে আসে এবং তাঁর বাবাকে খুঁজে বেড়ায় । চম্পার বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়ায় মান্না। মান্না ও চম্পা সারাদিন আলমগির’কে খুঁজে বেড়ায় । নানা ঘটনা ও নাটকীয়তায় ছবিটা এগিয়ে যায় এবং একসময় চম্পা তাঁর বাবা আলমগিরকে খুঁজে পায়। আলমগীরকে খুঁজে পেয়ে নানা আরিফুল হক’কে ছেড়ে আলাদা ভাবে বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে বসবাস করতে থাকে এবং আলমগীরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনার চেষ্টা করে। চম্পা আলমগীরের নির্মিত সেই ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিটা মুক্তির প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করে যা ছিল আলমগিরের স্বপ্ন । এরমধ্য আলমগির আক্রান্ত হোন মরনব্যাধি রোগ লিভার ক্যান্সারে। মৃত্যুপথযাত্রী আলমগিরের ছবি মুক্তি পায় এবং দর্শকদের মধ্যে সাড়াফেলে। দর্শকরা আলমগিরের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে সেই অন্যায়ের বিচার দাবী করে । চীনের বেইজিং তে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আলমগিরের ছবিটি পুরস্কার লাভ করে যা চম্পা আলমগিরের পক্ষ থেকে পুরস্কার গ্রহন করেন । আলমগির পুরস্কারটি হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এবং চিরবিদায়ের আগে সবার কাছে অনুরোধ করেন যে ‘’ কখনও শিল্পীর কণ্ঠকে স্তব্দ করতে যেও না। তাঁর উপর যে অন্যায়টা করা হয়েছে আর কোনদিন যেন শাসকগোষ্ঠীর এমন নির্যাতন কোন শিল্পীর জীবনে না ঘটে ।‘’ সবশেষে মেয়ে চম্পা , মান্না, আশিস কুমার লৌহ সহ সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে আলমগির সমবেত কণ্ঠে ‘’ ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’’ গানটি গাইতে গাইতে মৃত্যুবরণ করেন । ছবির শেষ দৃশ্যটি ছিল আমার দেখা সেরা ৫ টি শেষ দৃশ্যর একটি যা ছিল বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অন্যতম ক্লাসিক সমাপ্তি। একটি মূলধারার বাণিজ্যিক বিনোদনধর্মী ছবি অথচ মারপিট ছাড়াই কত চমৎকার সমাপ্তি ভাবা যায়?
ছবিটা আলমগীরের জীবনের সেরা অভিনয় সমৃদ্ধ একটি ছবি এতে কোন সন্দেহ নেই । চম্পা, মান্না, মিজু আহমেদ, আরিফুল হক প্রতিটা চরিত্র সাবলীল অভিনয় করেছেন । আলমগিরের পর চম্পা ছিলেন ছবিতে অনবদ্য । পুরো ছবিটা কাজী হায়াত খুব যত্ন করে বানিয়েছেন সেটা স্পষ্ট। ছবিতে কাজী হায়াত একটা নির্দিষ্ট গল্প ছক বেঁধে নির্মাণ করেছেন এবং কাহিনি,সংলাপ ও চিত্রনাট্য এই তিনটি মূল বিষয়ের উপর কাজী গুরুত্ব সহকারে কাজ করেছেন যার ফলে ছবিটি পর্দায় মনে হয়েছে কোন বাস্তব ঘটনা আড়ালে থেকে ক্যামেরাবন্দি করা হয়েছে । একবারও মনে হয়নি পর্দায় যা দেখছি তা কোন ছবির গল্প যা বাস্তবে মিথ্যা । প্রতিটা দৃশ্য বাস্তবতার সাথে মিল রেখে কাজী এগিয়েছেন । মূল বক্তব্যটা শিক্ষিত , অশিক্ষিত কোন শ্রেণীর দর্শকদের কাছেই দুর্বোধ্য ছিল না । সব শ্রেণীর মানুষগুলোর চেহারায় পর্দার আলমগিরের জন্য একটা হাহাকার স্পষ্ট দেখা গেছে। এখানেই পরিচালক সফল । ছবির যে বিষয়বস্তু সেটা আজ থেকে ২১ বছর আগেও যেমন ছিল এখন তাঁর চেয়েও বেশি /প্রকট । সালমান ,সানি, রুবেল,মান্না’র সেরা সময়ে সিনিয়র অভিনেতা আলমগির’কে কেন্দ্র করে ছবি বানানো এবং কোন খলনায়কের কুটলামি ও প্রতিশোধ নির্ভর ছবির ভিড়ে খলনায়ক ছাড়া সম্পূর্ণ একটি ব্যতিক্রমধর্মী গল্প নিয়ে সব শ্রেনির দর্শকদের মন জয় করার মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ কাজী হায়াত খুব দারুন ভাবেই সফল হয়েছিলেন। মান্নার ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিটা দেখে আজকের চলচ্চিত্রের তথাকথিত ১নং নায়ক ও তাঁর ভক্তদের সেখা উচিৎ কিভাবে ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকাবস্থায় একজন নায়ক নিজেকে পার্শ্ব চরিত্রে রেখে অভিনয় করে দর্শকদের প্রশংসা কুঁড়াতে পারে । ক্যারিয়ারে সস্তা জনপ্রিয় ছবি অনেক পাওয়া যাবে কিন্তু মনে দাগ কাটার মতো চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ বারবার আসেনা যা মান্না সেইসময় নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দিয়েছিলেন ।
আজাদ রহমানের সুর সঙ্গীতে ছবির গানগুলো ছিল মানানসই। কাজী হায়াত এর আগে তাঁর চলচ্চিত্রে বিদ্রোহী নজরুলকে বারবার এনেছিলেন আর দেশপ্রেমিক ছবিতে আনলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথকে ।দেশপ্রেমিক ছবিতে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কণ্ঠে একাধিক রবীন্দ্র সঙ্গীতে ছিল । বিশেষ করে ডলি জহুর যখন তাঁর শিশু কন্যাকে গান ‘‘’ মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে / তা তা থৈ থৈ , তা তা থৈ থৈ , তা তা থৈ থৈ ......’’ শেখাচ্ছিল এবং আলমগির যখন ছবি মুক্তি দেয়ার দেয়া জন্য হন্য হয়ে টাকা খুঁজছিলেন সেই সময়ে আবহে ‘’ সংকটেতে বিহবলতা নিজেরই অপমান’’ রবীন্দ্র সঙ্গীত দুটো ছবির দৃশ্যগুলো ছিল দারুন চিত্রায়ন । এই ছবিতে কাজী হায়াত ‘’ তুমি দেখেছো কভু ‘’ গানটিকেও নতুন করে নির্মাণ করেন যা ছবির গল্পের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য বজায় ছিল । এমন একটি বিষয়বস্তু চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য খুবই বিপদজনক একজন পরিচালকের জন্য ,অথচ কাজী হায়াত সেই কঠিন বিষয়টাকেই বাণিজ্যিক বিনোদনধর্মী ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়েছেন এবং তা সার্থকভাবে নির্মাণ করে সফলও হয়েছেন । এমন বিষয়বস্তু নিয়ে ছবি কোন বিকল্পধারার পরিচালকদেরও কোনদিন নির্মাণ করতে দেখিনি ,হয়তো দেখবোও না। এমন একটি বলিষ্ঠ বক্তব্যর সাহসী ছবি হয়তো আমাদের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে আর দেখা যাবে না ।
সত্যি কথা বলতে ‘’দেশপ্রেমিক’’ ছবিটা সম্পর্কে লিখে বর্ণনা করে বুঝানো সম্ভব নয় যে ছবিটি কত অসাধারন ছিল ।ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল আজ থেকে ২১ বছর আগে । আজ ২০২০ সাল অথচ আজ আমরা বাস্তবে একাধিক ঘটনা দেখছি ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিটার গল্পের চিত্র । রাষ্ট্রশক্তির মতামত উপেক্ষা করে বা বিরোধিতা করলে কিছু প্রকাশ করতে গেলে সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা সহ সাধারন মানুষের উপর কি রকম নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে যা এক কথায় জনগণের মৌলিক অধিকার বাকস্বাধীনতা’র হরনের বাস্তবচিত্র। সরকারের রোষানলে পড়ে আজ অনেক সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল বন্ধ রয়েছে । রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, শিল্পী, টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক সহ সাধারন অনেক মানুষকে আজ আমরা জেলে যেতে দেখেছি । অথচ আজ থেকে ২৬ বছর আগে বাংলা মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের গুণী পরিচালক কাজী হায়াত তাঁর ‘’দেশপ্রেমিক’’ ছবিটার মাধ্যমে বাকস্বাধীনতা হরনের নির্মম এক চিত্র সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দি করেছিলেন যা দেখে সেদিন অসংখ্য দর্শকের চোখে অস্রু এসেছিল । শুধু টাই নয় ছবিটা সব শ্রেণীর দর্শকসহ সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিল যার ফলে ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিটি ১৯৯৪ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে হুমায়ুন আহমেদ এর ‘আগুনের পরশমনি’’ এর সাথে ‘শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র’ পুরস্কারের শাখায় ভাগ বসিয়েছিল এবং একাধিক শাখায় পুরস্কার লাভ করেছিল যা হলো – যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ অভিনেতা (আলমগির), শ্রেষ্ঠ পরিচালক (কাজী হায়াত), শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার (কাজী হায়াত) ।
২৬ টি বছর আগে সিলেটের নন্দিতা সিনেমায় দেখেছিলাম এরপর আর দেখা হয়নি ছবিটি, কিন্তু এখনও বাংলা বাণিজ্যিক ছবির গল্প উঠলে আমি ‘’দেশপ্রেমিক’’ ছবিটাকে মনে করি । খুব ইচ্ছে করে এমন একটি ছবি আবার আমাদের চলচ্চিত্রে দেখতে কিন্তু এমন ছবি বানানোর সাহসী ,দূরদর্শী নির্মাতা,প্রযোজক আমাদের দেশে নেই । প্রযোজক শেখ মুজিবুর রহমান (হাসনাবাদ কথাচিত্র) এর অন্যতম সেরা ও সফল ছবি ‘দেশপ্রেমিক’ । পুরো ছবিতে কাজী হায়াত এমন কিছু বিষয়ের অবতারনা করেছেন যা আপনাকে ভাবাবেই।
সেদিনের ‘’দেশপ্রেমিক’’ ছবিটার গল্প যেন আজ অহরহ ঘটছে । শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পরে একজন মেধাবী মানুষের জীবন কি ভাবে তছনছ হয়ে যায় সেটা ‘’দেশপ্রেমিক’’ ছবিতে সাহসিকতার সাথে তুলে ধরতে পেরেছিলেন কাজী হায়াত । কাজী হায়াত ছবিটির মাঝে বারবার বলতে চেয়েছেন জনগণের বাকস্বাধীনতা হরন করা কোন সমাজ, রাষ্ট্র, ব্যক্তিজীবন কোন কিছুর জন্যই সুফল বয়ে আনে না। আমাদের রাষ্ট্রে যখন বাকস্বাধীনতা থাকে না তখন সমাজে নানাক্ষেত্রে অসংগতি দেখা দেয় যা নিয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারেনা। শাসকগোষ্ঠী থেকে যায় সকল জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভবপর হয়না । ‘দেশপ্রেমিক’ ছবিটার মতোই আজ শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পরে অনেক মেধাবী মানুষ অকালে হারিয়ে যাচ্ছেন যার প্রতিবাদ আমরা করতে শিখিনি । আমাদের এই ব্যর্থতার কারণে শাসকগোষ্ঠী যেন আজ আমাদের বুকে পাথর হয়ে বসে আছে । আজ ‘ডিজিটাল চলচ্চিত্র’ নামের যেসব চলচ্চিত্র তথাকথিত মেধাবীরা তৈরি করছে তাঁদের বলবো কাজী হায়াতের ‘’দেশপ্রেমিক’’ ছবিটার মতো জীবন ঘনিষ্ঠ সাহসী একটি বাণিজ্যিক ছবি আজ নির্মাণ করে দেখান তো ? জানি পারবেন না , কারণ ঐ তথাকথিত মেধাবীরা আসলে কি সেটা গত ১০ বছরে বারবার প্রমাণ হয়েছে যারা বাংলাদেশের মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির ইতিহাসটাই জানে না সঠিক ভাবে । ভালো ছবি বানাতে গেলে ‘বিকল্পধারা’ বা ‘অফট্র্যাক’ যাওয়া লাগে না এবং টেলিভিশনের নাট্যশিল্পীদের দিয়ে অভিনয় করানো লাগে না। ভালো ছবি বানানোর মেধা থাকলে সব শ্রেণীর দর্শকদের জন্য মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়েই মনে দাগ কাটার মতো বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ করা যায় ।
১৯৯৪ সালে দেশপ্রেমিক যে পুরস্কারগুলো পেয়েছিল -
সেরা চলচ্চিত্র - আগুনের পরশমণি ও দেশপ্রেমিক
সেরা পরিচালক - কাজী হায়াৎ (দেশপ্রেমিক)
সেরা অভিনেতা - আলমগীর (দেশপ্রেমিক)
সেরা চিত্রনাট্যকার - কাজী হায়াৎ (দেশপ্রেমিক)।
৩) পিতা মাতা সন্তানঃ বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের ৯০ দশকের নিয়মিত দর্শক যারা তাদের কাছে ‘পিতা মাতা সন্তান’ শুধু একটি সাধারন কোন ছবির নাম নয় বারবার চোখে জল আনা একটি জীবনঘনিষ্ঠ অসাধারন ছবির নাম যা আজো সুযোগ পেলে ঐ দর্শকরা দেখতে বসেন । ‘পিতা মাতা সন্তান’ কেমন ছবি সেটা দেখার আগে যদি আজকের কোন খুঁতখুঁতে বিজ্ঞ দর্শক জানতে চান তাহলে তাঁকে বলবো ১৯৯১ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের তালিকাটা দেখে নিতে পারেন যে ছবিটা শ্রেষ্ঠ পরিচালক ,অভিনেতা সহ একাধিক পুরস্কার পেয়েছিল যা সেই বছরের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ পায়নি । ১৯৯১ সালের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হয়েছিল চাষি নজরুল ইসলামের অমর সৃষ্টি ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ছবিটি কিন্তু উক্ত ছবির জন্য চাষি শ্রেষ্ঠ পরিচালক হতে পারেননি তার কারণ ছিল এ জে মিন্টুর ‘পিতা মাতা সন্তান’ ছবিটি । চাষির ছবিটা দারুন কোন সন্দেহ নাই কিন্তু ‘পিতা মাতা সন্তান’ ছবিটা যে শুধু একটি ছবি ছিল না , ছিল জীবনের কিছু কঠিন বাস্তবতা, মানুষের মানবিক ও আত্নিক সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে দর্শকদের কিছু নির্মম প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয়ার অসাধারন কিছু । শুধু ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ নয় , ৯১ সালের জাতীয় পুরস্কারের তালিকায় ছিল কাজি হায়াতের আগুনঝরা ‘দাঙ্গা’ চলচ্চিত্রটিও কিন্তু সেই আগুন ঝরা ছবিটিকেও মিন্টু পেছনে ফেলে দিয়ে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার ৩য় বারের জন্য অর্জন করেছিলেন । আর ছবিটির প্রান অভিনেতা আলমগিরও পেয়ে যান শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার অথচ সেইবছর আলমগিরের অভিনীত অচেনা, সান্ত্বনা, লাখে একটা, স্ত্রীর পাওনা’র মতো একাধিক সেরা ছবি ছিল ।
লেখাঃ Fazlay Alahi ভাই💜