30/09/2024
আল্লাহ ﷻ বলেছেন, আমি জ্বিন ও মানবকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র এ কারণে যে, তারা আমারই ইবাদাত করবে।
(আয যারিয়াত, আয়াত ৫৬)
অর্থাৎ আমাদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত করা। এখানে আমরা মুসাফির হিসেবে এসেছি আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য। আমাদের আসল গন্তব্যস্থল হলো জান্নাত অথবা জাহান্নাম।
আল্লাহ ﷻ বলেন,আর এ দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং নিশ্চয় আখিরাতের নিবাসই হলো প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত।
(সূরা আল-আনকাবূত : আয়াত ৬৪)
দুনিয়া আমাদের জন্য কর্মক্ষেত্র। দুনিয়ায় আমরা আল্লাহ ﷻ ও তাঁর রাসূল ﷺ এর দেখানো পথে চলবো অথবা নফসের গোলামী করবো আর আল্লাহর এই আনুগত্য অথবা অবাধ্যতার ফলাফল স্বরূপ আমাদের জন্য নির্ধারন হবে জান্নাত অথবা জাহান্নাম।
এখন মানুষের জীবনচক্রকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি।
১. ইহকালীন অর্থাৎ দুনিয়ার জীবন যা ক্ষণস্থায়ী।
২. পরকালীন অর্থাৎ মৃত্যুর পরের জীবন তথা আখিরাত যা চিরস্থায়ী।
আখিরাতের এই জীবনকে আবার কয়েকটি স্তরে ভাগ করা যায়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে কবরের জীবন বা বারযাখ।বারযাখ অর্থ পর্দা, আবরণ, প্রতিবন্ধক। মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত সময়কে কবরের জীবন তথা বারযাখ বলা হয়।
কুরআনে আল্লাহ ﷻ বলেন, "আর তাদের সামনে বারযাখ থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।"
(সূরা আল - মুমিনুন : আয়াত ১০০)
মৃত্যুর সাথে সাথেই এই দুনিয়ার সাথে আমাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। শুরু হবে পরপারে যাত্রার প্রথম ধাপ। যে ব্যক্তির দুনিয়ায় ঈমান ও আমলের পাল্লা ভারী হবে আশা করা যায় তার বারযাখের সফরও সহজ হবে। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ায় থাকাকালীন তার নফস আর শয়তানের পূজা করে যাবে তার বারযাখের সফরও কঠিন থেকে কঠিনতর হবে।
রাসূল ﷺ থেকে বর্ণিত হয়েছে,
فَلَوْلاَ أَنْ لاَ تَدَافَنُوا لَدَعَوْتُ اللَّهَ أَنْ يُسْمِعَكُمْ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ الَّذِى أَسْمَعُ مِنْهُ»
‘‘এই উম্মতকে কবরের ফিতনায় ফেলা হবে। আমার যদি এ আশঙ্কা না হতো যে, কবরের আযাব শোনালে তোমরা মৃতদেরকে দাফন করা বর্জন করবে, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করতাম, তিনি যেন কবরের আযাব থেকে তোমাদেরকেও কিছু শুনান, যা আমি শুনতে পাই’’।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৭৩৯২)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সদস্যগণ বলেন, মৃত্যুর সময় দেহ হতে রূহ বের করা হয়। রূহ ধ্বংস হয় না। এর উপযুক্ত ঠিকানা ও স্থিতিস্থানের প্রয়োজন হয়। সব দেহকে কবরস্থ করার পর সাওয়াল-জওয়ারের জন্য উক্ত দেহে রূহ ফিরিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর দেহের সাথে রূহের এতটুকু সম্পর্ক অবশ্যই স্থায়ী হয়, যার দ্বারা শান্তি ও শাস্তি অনুভব করতে পারে। (শারহু ফিকহে আকবার : পৃষ্ঠা ১০১)
-খালামনি, আমি শুনেছি কবরে মানুষকে কিছু প্রশ্ন করা হবে।
- হ্যাঁ। কবরে দাফন কাফন সম্পন্ন হওয়ার পর শুরু হয়ে যাবে প্রশ্ন উত্তরের সিলসিলা। অপরিচিত বিকট চেহারা সম্পন্ন মুনকার-নাকির নামক দুইজন ফেরেশতা আমাদের তিনটি প্রশ্ন করে থাকবেন। মুনকার-নাকির অর্থ হলো অস্বীকারকারী এবং তিরস্কারকারী। তাদের অদ্ভুত চেহারা ও ভীতিকর অবয়বের কারণে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে।
যারা প্রশ্নের উত্তরগুলো যথাযথ দিতে পারবে, তারাই সফলকাম। আর যারা প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবে না , তারা ব্যর্থ।
মুনকার-নাকির কবরে এসে মৃতব্যক্তিকে ধারাবাহিকভাবে ৩টি প্রশ্ন করবে-
১ম প্রশ্ন:
مَنْ رَبُّكَ؟
মান রাব্বুকা? আপনার রব কে?
২য় প্রশ্ন:
مَنْ دِيْنُكَ؟
মান দ্বীনুকা? আপনার দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা কী?
৩য় প্রশ্ন:
مَنْ هَذَا الرَّجُل؟
মান হাজার রাজুল? এই ব্যক্তি কে?
যদি সে ব্যক্তি নেককার হয় তবে বলবে-
رَبِّى الله
আল্লাহ আমার রব।
دِيْنِىَ الْاِسْلَام
ইসলাম আমার দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা ।
نَبِيُّنَا مَحَمَّدُ رَّسُوْلُ الله
তিনি আমাদের নবী মুহাম্মাদ ﷺ
অতঃপর জিজ্ঞেস করা হয় তুমি কি করে জানতে পারলে?
তখন সে বলে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি এবং তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং সত্য বলে স্বীকার করেছি।
আর যদি সে মন্দ লোক হয় তবে কোন প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারবে না। সে বলবে আমি এ ব্যক্তিকে চিনি না। (নাউজুবিল্লাহ)
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
অতঃপর নেককার বান্দার উদ্দেশ্যে আকাশ থেকে একজন ঘোষক ঘোষণ করেন, আমার বান্দা যথাযথ বলেছে, সুতরাং তার জন্য জান্নাতের একটি বিছানা বিছিয়ে দাও এবং তাকে জান্নাতের পোশাক পড়িয়ে দাও। এছাড়া তার জন্য জান্নাতের দিকে একটা দরজা খুলে দাও। তিনি ﷺ বলেন, সুতরাং তার দিকে জান্নাতের স্নিগ্ধকর হাওয়া ও তার সুগন্ধি বইতে থাকে। তিনি ﷺ আরো বলেন, ঐ দরজা তার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত প্রশস্ত করা হয়।
আর বদকার বান্দার উদ্দেশ্যে আকাশের দিক থেকে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন, সে মিথ্যা বলছে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামের একটি বিছানা এনে বিছিয়ে দাও এবং তাকে জাহান্নামের পোশাক পরিয়ে দাও। আর তার জন্য জাহান্নামের দিকে দরজা খুলে দাও। অতঃপর তার দিকে জাহান্নামের উত্তপ্ত বাতাস আসতে থাকে। এছাড়া তার জন্য তার কবরকে সংকীর্ণ করে দেয়া হয়, ফলে তার একদিকের পাজর অপর দিকের পাজরের মধ্যে ঢুকে যায়। অতঃপর তার জন্য এক অন্ধ ও বধির ফিরিশতাকে নিযুক্ত করা হয়, যার সঙ্গে একটি লোহার হাতুড়ি থাকবে, যদি এ দ্বারা পাহাড়কে আঘাত করা হয় তাহলে তা ধুলায় পরিণত হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, তারপর সে তাকে হাতুড়ি দিয়ে স্বজোরে আঘাত করতে থাকে, এতে সে বিকট শব্দে চিৎকার করতে থাকে। যা মানুষ ও জীন ছাড়া পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সকল সৃষ্ট জীবই শুনতে পায়। আঘাতের ফলে সে মাটিতে মিশে যায়। তিনি বলেন, অতঃপর (শাস্তি অব্যাহত রাখার জন্য) পুনরায় তাতে রূহ ফেরত দেয়া হয়।
(সুনান আবু দাউদ - ৪৭৫৩)
- আচ্ছা খালামনি মারা যাওয়ার পর কি কবরে কোনো আমল করা যায় না?
- না মামনি। মৃত্যুর সাথেই মানুষের সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে এমন কিছু আমল রয়েছে যেগুলো মানুষের মৃত্যুর পরও চলমান থাকে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত , রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ‘মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩টি আমল বন্ধ হয় না। ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. এমন ইলম যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ও ৩. এমন নেক সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৩১০)
১.সদকায়ে জারিয়া: যেসব আমলের সওয়াব মৃত্যুর পরও অব্যাহত থাকবে, সেগুলোকে সদাকায়ে জারিয়া বলা হয়। যেমন: মসজিদ নির্মাণ, খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করা, হাসপাতাল নির্মাণ, গাছ রোপণ, নদী খনন, কুরআন বিতরণ, ইলম অর্জনে কাউকে সাহায্য করা, ইসলামী বই বিতরণ, আল্লাহর পথে দাওয়াত ইত্যাদি।
আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়ার ফজিলত প্রসঙ্গে রাসূল ﷺ বলেন, ‘তোমার মাধ্যমে একজনও যদি হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়, তবে তা হবে তোমার জন্য লালবর্ণের অতি মূল্যবান উট থেকেও উত্তম।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২৯৪২)
হাদিসে আরও বলা হয়েছে, ‘যে মানুষকে হেদায়েতের দিকে আহ্বান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সওয়াব তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের সওয়াব থেকে কোনো কমতি হবে না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৯৮০)
২.এমন ইলম যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হবে: এমন ইলম যা আপনি কাউকে শিক্ষা দিয়ে গেলেন বা বই আকারে লিখে গেলেন আর তা দ্বারা মানুষ উপকৃত হলো। এতে ওই ব্যক্তির করা আমল এর সওয়াব তার সাথে সাথে আপনার আমলনামায় যোগ হতে থাকবে। যতদিন এ ইলমের ধারা চলতে থাকবে ততদিন এর সওয়াবও চলমান থাকবে।
৩.নেক সন্তান: যদি কোন সন্তান তার বাবা-মার মৃত্যুর পরও তাদের জন্য নিয়মিত দোয়া করতে থাকে তাহলে এই দোয়ার বরকত, ফজিলত ও সওয়াব তাদের আমলনামায় যোগ হতে থাকে। কোনো সন্তান যদি হকের পথে থাকে এবং তার মৃত বাবা মায়ের জন্য দান-সাদাকা, রোজা, হজ, কুরবানী করে তবে ইন শা আল্লাহ্ এর সওয়াব পিতা-মাতা পেয়ে যাবেন ইন শা আল্লাহ্।
- আচ্ছা খালামনি আমি আম্মুকে দেখেছি প্রতি রাতে সূরা মূলক পড়তে। আম্মু বলেছে এই সূরা পড়লে কবরের আজাব মাফ হয়।
- হ্যাঁ। তোমার আম্মু একদম ঠিক বলেছে।
আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
‘কুরআনের তিরিশ আয়াত বিশিষ্ট একটি সূরা আছে , যা তার পাঠকারীর জন্য সুপারিশ করবে এবং শেষাবধি তাকে ক্ষমা না করিয়ে ছাড়বেনা,সেটা হচ্ছে ‘তাবা-রাকাল্লাযী বিয়্যাদিহিল মূলক’ (সূরা মূলক)। [আবূ দাউদ ১৪০০]
রাসূল ﷺ সূরা মুলক পাঠ না করে কখনও ঘুমাতেন না।
[তিরমিযী,২৮৯৭]
ইবনে মাসউদ রা. বলেন, এ সূরা ‘মানিআহ’-বাধা দানকারী; ব্যক্তি থেকে কবরের আযাব রুখে দেয়। যে ব্যক্তি রাতে এটি তিলাওয়াত করল সে অনেক ভালো ও বড় কাজ করল। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৮৩৯; শুআবুল ঈমান বায়হাকী, হাদীস ২২৭৯)
-খালামনি আমিও এখন থেকে প্রতি রাতে সূরা মূলক পড়তে চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ্।
- মা শা আল্লাহ্। ওয়ামা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহ্। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের সবাইকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করুন। বারযাখের সফর আমাদের জন্য সহজ করুন। পাশাপাশি রাসূল ﷺ এর শিখানো নিম্নোক্ত দোয়া আমল করার তৌফিক দান করুন।
اللّهُمّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ القَبْرِ، وَمِنْ عَذَابِ النّارِ، وَمِنْ فِتْنَةِ المَحْيَا وَالمَمَاتِ، وَمِنْ فِتْنَةِ المَسِيحِ الدّجّالِ.
হে আল্লাহ! আমি কবরের আযাব থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। জাহান্নামের শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আরো আশ্রয় প্রার্থনা করছি, জীবন-মৃত্যু ও দা*জ্জালের ফিতনা থেকে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৭৭)