27/04/2021
জোছনা প্লাবিত রাতের ধবধবে শাদা আকাশ। কোথাও যেন ডাহুক ডাকছে। বুনো ফুলের গন্ধে বাতাস আশ্চর্যরকম ভারি। চাঁদের আলোতে নদী পাড়ের বালিগুলো রূপো চূর্ণের মতো ঝিকমিক ঝিকিমিক করছে। থেকে থেকে কানে আসছে কিছু পাতি শেয়ালের ডাক। এসবের বাইরে পুরো দুনিয়াজুড়ে যেন গা ছমছমে নীরবতা! কোথাও কোন সাড়াশব্দের বালাই নেই।
জোছনার জোয়ার ভেদ করে, গ্রামীণ মেঠো পথের ধুলো উড়িয়ে, বুনের ফুলের বুনো গন্ধকে পাশ কাটিয়ে দুজন মানুষ গন্তব্যে ফিরছে। দুজন বলা কি ঠিক? ওদের সাথে তো আরো একজন আছে। চাদরে মোড়ানো বরফ শীতল আস্ত একখানা শরীর— নড়চড়বিহীন। তাকেও কি গোনায় ধরা যায়? জীবনের সম্ভাব্য সকল পাঠ চুকিয়ে যে পাড়ি জমিয়েছে অন্য জগতে, এই জগতের বাসিন্দাদের তালিকায় তার নাম উঠানো উচিত হবে?
মাঝে মাঝে বলদগুলো চেঁচিয়ে উঠছে। গোঙানি উঠলেই তাদের পিটে বসে যাচ্ছে শাদু মিয়ার বেতের বাড়ি। এই জোছনা মুখরিত রাতে, অরণ্যের এই সরু পথ চিনে চলতে বলদগুলোর বিশেষ অসুবিধে হবার কথা নয়। তবু পথ চলতে আজ তাদের রাজ্যের অনীহা! কে জানে— চাদরে মুড়ানো ওই যে নিথর শরীর, তার ভারে হয়তো তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বারংবার। এ ভার বয়ে নিয়ে যাওয়া কি এতোই সোজা?
সত্যিই কি সোজা নয়? যদি নাই-বা হবে, শহিদুলের কোলের ওপর ওই নিথর শরীরখানা, ওভাবে নিশ্চিন্তে পড়ে আছে কিভাবে? যে পাথুরে শরীরের ভার বইতে বলদেরা অপারগ, তার ভার কতো সহজেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে শহিদুল! তার কোলে কেমন নিবিড় নিশ্চিন্তে পড়ে আছে ওই দেহখানা! শহিদুলেরও যেন কোন ক্লান্তি নেই। সে-ও নিরাবেগ, নিশ্চল, নিশ্চুপ।
কথা শুরু করে শাদু মিয়া। এই ঘন গহীন অরণ্যের মাঝে, যেখানে বন্য জন্তুরাও বেঘোর ঘুমে অচেতন, সেখানে কতোক্ষণ-ই বা আর চুপচাপ পথ চলা যায়? অন্তত শাদু মিয়ার মতোন মুখরা মানুষের পক্ষে এতোক্ষণ মুখ বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়।
-‘তা ভাইজান, পোলাডা মরলো কেমন কইরা?’
মরে গেছে? সম্বিৎ ফিরে পায় শহিদুল। সত্যিই মরে গেছে? তার ফুটফুটে আদরের সন্তান, যার মাত্র চার মাস হলো বয়স, সে কি মরে গেছে? তুলতুলে হাতখানা ধরে কতো আদরই না করতো শহিদুল! ভারি দেখতে হয়েছিলো ছেলেটা! সেদিন ডাক্তার বললো, ‘আপনার ছেলের বয়স কতো?’
-‘চার মাস’- অস্ফুটে জবাব দিয়েছিলো শহিদুল।
ডাক্তার যেন বিশ্বাস করলো না তার কথা। মুখ তুলে, চশমার চিকন কাঁচের ভিতর দিয়ে ভালো করে আরেকবার দেখলো বাচ্চাটাকে। এরপর বললো, ‘বাচ্চার ডেভলপমেন্ট তো খুব ভালো। দেখে মনে হচ্ছে একবছর বয়স’।
অমন আদুরে চেহারা ছিলো— যেকেউ কোলে না নিয়ে থাকতে পারতো না। তুলতুলে শরীর। সবটা ছাড়িয়ে, তার মুখের হাসিটা ছিলো ভূবন ভুলানো। চোখে চোখ রেখে, মুখখানা খানিক বাঁকিয়ে যখন সে হাসতো, শহিদুলের মনে হতো— জগতের সকল সরলতা, মুগ্ধতা আর বিস্ময় যেন তার চেহারায় এসে মাখামাখি করছে! তার নিটোল চাহনির দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা মানবজনম।
কিন্তু, একেবারে হঠাৎ করে, সেদিন প্রচন্ড জ্বর উঠলো তার। চোখমুখ ফুলে বিপন্ন অবস্থা! ডাক্তার জানালো তার আমাশয় হয়ে গেছে। সাধারণ আমাশয় নয়, রক্ত আমাশয়। কতো যত্ন-খেয়াল, কতো আদর আর আলিঙ্গনের কাড়াকাড়ি— তার মাঝেও ছেলেটার এমন একটা রোগ হয়ে গেলো?
তারপর... তারপর একদিন অকস্মাৎ, একেবারে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শরীরে খিঁচুনি এসে কাহিল করে দিলো তাকে। হাসপাতালে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, ততোক্ষণে সে আর বেঁচে নেই।
বেঁচে নেই! কতো সহজেই হয়ে গেলো বলা! অথচ, শহিদুলের কাছে সে ছিলো তারা ঝলমলে এক পৃথিবী। যেদিন তার জন্ম হয়, যে ভোরবেলায়, কতো কান্ডই না সেদিন করেছিলো শহিদুল! তার পাগলামোতে হাসপালাতের সকলে অতিষ্ট হয়ে যায়। কেউ কেউ বলেছিলো, ‘পাগল!’। হ্যাঁ, পাগলই তো। কতো বছর, ঠিক কতো বছর পরে শহিদুলের ঘর আলো করে এই রত্নখানি এসেছে, তা কি মানুগুলো জানে? আল্লাহর কাছে কতো করজোড় মিনতি, কতো আকুল প্রার্থনা, ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এই ফল— তা কি কেউ বুঝবে?
'জীবন যেখানে যেমন' বইয়ের একটা গল্পের শুরুর অংশবিশেষ এটা। এই গল্পটা লিখবার সময় বারংবার আমাকে থামতে হয়েছিলো। কতোবার যে চোখ আমার ঝাপসা হয়ে উঠেছিলো ইয়ত্তা নেই। যদিও এই গল্পটা অনেকের জীবনের বাস্তবতা, তবু আমি খুব করে চাইবো— এমন বাস্তবতা কারো জীবনে না আসুক...
বইটির মুল্যঃ 180Tk
বইটি অর্ডার করতে অাপনার নাম,ঠিকানা, মোবাইল নম্বর আমাদের ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে দিন।