12/10/2024
একটি টুকরিতে করে নিয়ে ম্যানহোলে ফেলে দিতে চেয়েছিল মহাবীর শহীদ নাফিস কে! অথচ তখনও বেঁচে ছিল নাফিস।
রিকশার পাদানিতে আড়াআড়িভাবে ঝুলে আছে নাফিসের দেহ। এক পাশে শূন্যে ঝুলছে দেশের পতাকা মোড়ানো মাথা অন্যপাশে ঝুলছে গুলিবিদ্ধ নিথর পা দুটো। একজন রিকশা ড্রাইভার প্যাডেল চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নাফিসকে। এই দৃশ্য যতবার মনে পড়ে ততবার চোখে ভিজে যায়।
নাফিস তখনো জীবিত ছিল। টুকরিতে করে নিয়ে গুলিবিদ্ধ আহত নাফিসকে ম্যানহোলে ফেলে দিতে চেয়েছিল পুলিশ, তারপর পোড়াতেও ট্রাই করে। শেষ পর্যন্ত পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নাফিসকে বাঁচানোর চেষ্টা করে রিকশাচালক এই ভাইটি।
নাফিস সবেমাত্র বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাশ করেছে। বয়স মাত্র ১৭। এ বয়সে এতবড় স্যাক্রিফাইস করে ফেলল সে।
৪ আগষ্ট সকালে নাফিস শাহবাগ হয়ে ফার্মগেটে মুভমেন্টে যোগ দেয়। দুপুর দেড়টার দিকে সর্বশেষ তার মাকে কল দিয়ে জানায় সে নিরাপদে আছে। মা তাকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে বলে। এরপর সময় গড়াতে থাকে, নাফিসের আর কোনো সন্ধান পাচ্ছিল না তার মা। মোবাইলেও কোনভাবে কানেক্টে করতে পারছিল না। সন্ধ্যা নাগাদ তার বাবা বের হয় ছেলের খোঁজে। শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, হাসপাতাল টু হাসপাতাল খোঁজাখুজি করে কোথাও ছেলের সন্ধান না পেয়ে রাত বারোটায় ফিরে যান বাসায়। এরমধ্যে নাফিসের সেই হৃদয়বিদারক ছবি ফেসবুক ভাইরাল হয়ে যায়। বোন সেই ছবি দেখায় বাবাকে। সেখান থেকে তারা শনাক্ত করতে পারে নাফিসকে। পরবর্তীতে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে খোজাখুঁজি করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত নাফিসের বাবা মানবজমিন পত্রিকার অফিসে ছুটে যান সেই ছবিটির ফটোগ্রাফারের কাছে৷ মানবজমিনের অফিসে থাকা অবস্থায় তার শালা (মানে নাফিসের মামা) কল দিয়ে জানায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মর্গে পাওয়া গেছে নাফিসের লাশ।
আসলে নাফিসের সাথে সেদিন কী ঘটেছিল তার বর্ণনা দিই এই রিকশাওয়ালা ভাইয়ের জবানিতে। উনার নাম মো. নূর মোহাম্মদ। উনিই নাফিসকে পুলিশের কাছ থেকে উদ্ধার করে বাঁচাতে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সেদিন তিনি ২৭-এ যাত্রী নামিয়ে দিয়ে সংসদের সামনের দিয়ে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছিলেন, বিজয় সরণীর দিকের রোডে সংসদের কোণায় দেখেন মারামারি, তিনি তখন রং সাইড দিয়ে পাশ কাটিয়ে ফার্মগেট চলে যান। এরমধ্যে একজন যাত্রী তুলেন মগবাজারের। ফার্মগেট পুলিশ বক্স পার হবেন তখন দেখছেন বৃষ্টির মত গোলাগুলি চলছে। বিজ্ঞান কলেজের সামনে পুলিশ গতিরোধ করে উনাকে, টানেন সামনে নিতে। উনি তখন বলেন, ঐদিকে গোলাগুলি হইতেছে যামু ক্যান। পুলিশ ধমক দিয়ে বলে, তোরে আইতে কইছি আয়। এই বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। তিনি তখন, দোয়াদরুদ পড়তে থাকেন। কপালে তার কী আছে আল্লাহ জানে।
সামনে নেওয়ার পর বলে, এইডা তোল রিকশায়। মো. নুর মোহাম্মদ (রিকশাচালক) বলেন, কী তোলমু?
তখন পাশে প্লাস্টিকের কিছু একটা আর একটা টুকরি দেখতে পান, বলেন এগুলো তোলমু?
তখন খেয়াল করেন নাই পাশে একটা গুলিবিদ্ধ দেহ কুণ্ডলি পাকিয়ে পরে আছে।
পুলিশ তাকে ধমক দিয়ে বলে, আরে বেটা লাশ পালাই রাখছি দেখছ না! এই যে, এইডা তোল। গালাগালি শুরু করে পুলিশ।
নূর মোহাম্মদ তখন নাফিসের পেছনের সাইড ধরে আলগি দেয়। পুলিশ তার দুই পা ধরে পিক্কা মেরে রিকশার পাদানিতে ফেলায়।
গাড়িতে ফেলানোর পর বলতেছে, আরও দুইটা গুলি কইরা দে। বাইচ্চ্যা যাইতে পারে। রিকশার ড্রাইভারকে দেখিয়ে গালাগালি করে বলে, ওই শালার পায়েও গুলি মার। রিকশা টান দিতে গেছে দেখে নাফিস পরে যাচ্ছে। তখন পাশের আরেকজন পুলিশ এসে বলে সোয়া তারে। (ড্রাইভারের ভাষায় এই পুলিশ কিছুটা মানবিক ছিল) রিকশা ড্রাইভার দেখতেছে হাতটা চেইনে আটকে যাচ্ছে, তাই হাতটা টেনে রডের সাথে ঝুলিয়ে রাখে। রিকশার ড্রাইভার আল রাজিতে নিতে চেষ্টা করে। তখনও নাফিসকে বাঁচানো যেত হয়ত। বাট পুলিশ গালাগালি করে বলে, বেটা এইডা সোহরাওয়ার্দী বা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ফালা। পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করেও আল রাজির দিকে টানে রিকশা ড্রাইভার। তখন কেউ ধরতে আসে নাই। ছাত্রলীগ-যুবলীগের বাঁধার মুখে সেখান থেকে ফিরে আবার চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে সেনাবাহিনী দেখে এগিয়ে আসে। বলে তাকে ইমার্জেন্সিতে নিতে হবে। দুই তিনজন তাকে ধরাধরি করে একটা অটোতে তুলে৷ তাকে সোহরাওয়ার্দী নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণে আমাদের নাফিসে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। শহীদের তালিকায় তার নামও যোগ হয়ে যায়।
রিকশার ড্রাইভারের ভাষ্যমতে, পুলিশ প্রথমে ট্রাই করছিল তাকে টুকরিতে করে ম্যানহোলে ফেলে দিতে, বাট কোথাও আশপাশে ম্যানহোলের ঢাকনা খুঁজে দেখতে পায় নাই। পরে বলতেছে, তাকে পুইড়া ফেল। তখন রিকশা ড্রাইভার পাশেই দাঁড়ানো। রিকশার যখন তুলছিল তখন মানবজমিনের যে সাংবাদিক ছবি তুলছিল তাকেও গালাগালি করে বলতে থাকে, ক্যামরা বন্ধ কর। তোর ক্যামরা ম্যামরাসহ তোরে পুড়া দিয়ে লামু।
আমাদের স্মৃতি থেকে নাফিসরা কোনদিন সরবে না, এই পুলিশ বাহিনীও যতদিন থাকবে আমরা তাদেরকে ততদিন ঘৃ-ণার চোখের দেখব। এরা আমাদের ভাই, বন্ধু, সহপাঠীদের নির্মমভাবে হ-ত্যা করেছে, কিভাবে আমরা তাদের ক্ষমা করব।
©ফরিদউদ্দীন রনি