18/01/2022
প্রেমে পড়া, প্রেম করা এগুলো খুব স্বাভাবিক। কাউকে প্রেম করতে দেখে চোখ কপালে তোলাটাই বরং অস্বাভাবিক।
টিভি চালু করে দুই ঘন্টায় দশটি চ্যানেল চেঞ্জ করুন, দেখুন টিভির প্রোগ্রাম/বিজ্ঞাপনগুলো কী বার্তা দিতে চায়? নাটক-সিনেমা এমনিতেই প্রেমের বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে, বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনগুলোতেও প্রেমের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, নারীসঙ্গ/পুরুষসঙ্গ লাভের জন্য মোটিভেট করা হয়। বডিস্প্রে, টুথপেস্ট, সাবানের বিজ্ঞাপনগুলোতে ঐসব পণ্য ব্যবহারের মূল মটিভ দেখানো হয় মেয়ে/নারীর কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করা।
আপনি সাহিত্যে যান, ৫ টি গল্পের বই, ৫ টি কবিতার বই, ৫ টি উপন্যাস পড়ে দেখুন সেখানে কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে। প্রেম, প্রণয়, পরিণতি, ট্র্যাজেডি এসব নিয়েই মূলত সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ থেকে হুমায়ূন, র্যান্ডমলি যেকোনো একজন লেখকের বই হাতে নিয়ে একটি গল্প-উপন্যাস পড়ে দেখুন সেগুলোতে আপনাকে প্রেম করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
আপনি যাদের সাথে ঘুরাফেরা করেন, আড্ডা দেন, তাদের বেশিরভাগই নিশ্চয়ই প্রেম করে? স্কুল- কলেজ- ভার্সিটি পড়ুয়া একজনের যদি ১০ জন বন্ধু/বান্ধবী থাকে, তাহলে তাদের অন্তত ৫ জন প্রেম করছে।
ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করতেই দেখবেন বন্ধু তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে রেস্টুরেন্টে খাবার পিক আপলোড দিয়েছে, হাত ধরাধরি ছবি আপলোড দিয়েছে, গার্লফ্রেন্ডকে ট্যাগ করে একটি কবিতার লাইন লিখেছে ইত্যাদি।
যেই ছেলেটা বা মেয়েটার চোখের সামনে এতোগুলো প্রেমের বিজ্ঞাপন ভাসছে, তার মনে একবারও প্রেম করার ইচ্ছা জাগবে না এই ধারণাটি ভুল। অবশ্যই তারও প্রেম করতে ইচ্ছে হয়, তারও কারো হাত ধরে হাঁটতে ইচ্ছে হয়, নিঃসঙ্গ রাতে কারো সাথে ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে হয়।
পারিপার্শ্বিক এমন প্রভাবে তার এমন ইচ্ছাপোষণ কিংবা প্রেম করাটাকে ‘অস্বাভাবিক’ চিহ্নিত করার মানে হলো সমস্যাকে এড়িয়ে গিয়ে সর্বরোগের ঔষধ প্যারাসিটামল/ নাপা সাজেস্ট করতে থাকা!
প্রেমের সম্পর্ক ২০ বছর আগে সমাজে যতোটা ট্যাবু ছিলো, এখন ততোটা তো নেই-ই; বরং প্রেম করাটা এখন অনেক পরিবারই সহজে মেনে নেয়। যেসব পরিবার তার ছেলে/ মেয়েকে কলেজ- ভার্সিটিতে পড়তে পাঠায়, তারা অনেকটা ধরেই নেয় যে সে প্রেম করবে (শারীরিক সম্পর্ক না করলেই হয়)। অন্যদিকে কলেজ-ভার্সিটিতে ছেলে/ মেয়েকে পড়তে দিয়েও যেসব বাবা-মা মনে করে তার খোকা/খুকি ‘নিষ্পাপ’ হয়ে গ্র্যাজুয়েট হবে, তাহলে সমস্যাটি খোকা/খুকির না; বরং মা-বাবারই।
মিডিয়া (নাটক-সিনেমা, সাহিত্য) যেভাবে প্রেমের বিজ্ঞাপন প্রতি মুহূর্তে করে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে নিজের সন্তান প্রেমে জড়াবে না এমন কনফিডেন্সকে ওভার- কনফিডেন্স বলাই শ্রেয়। এই ওভার- কনফিডেন্সের মূল কারণ হলো সন্তানের প্রতি মা-বাবার অন্ধবিশ্বাস।
আমাদের মা-বাবার জেনারেশনের (অর্থাৎ, আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগের) কথা যদি বলতে হয়, তাহলে দেখা যায় উনাদের ক্লাসে ‘কাপল’ ছিলো সর্বসাকূল্যে ১-২ টি। পুরো স্কুলে যে ৮-১০ টি কাপল ছিলো, তাদেরকে সবাই চিনতো। টিফিনের আড্ডায়, কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে ঐসব কাপলদের দুঃসাহস নিয়ে কথা উঠতো- ‘বাপরে বাপ, কী সাহস!’
এখন? ১০০ জন শিক্ষার্থীর একটি ক্লাসের মধ্যেই ৮-১০টি কাপল পাওয়া যায়, ক্লাসের বাইরে প্রেম করছে এমন সংখ্যা ৩০-৪০ জন হয়। হঠাৎ করেই এই পরিবর্তন আসলো কিভাবে? দুটো বিষয় এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রাখছে।
১. মিডিয়ার প্রেমের প্রচার, প্রেমকে নরম্যালাইজ করা, বাধাকে জয় করার দুঃসাহসিক মোটিভেশন দেওয়া।
২. সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছেলে-মেয়ের সহজে এক্সেস পাবার সুযোগ।
একটি কম্বাইন ক্লাসে ৫-৭ জন থাকে খুব এক্সট্রোভার্ট, ছেলেমেয়ের সাথে খুব সাবলিলভাবে তারা কথা বলতে পারে, কোনো দ্বিধা হয় না। কিন্তু ক্লাসের বড়ো একটি অংশ থাকে ইন্ট্রোভার্ট; তারা বিপরীত লিঙ্গের সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কোনো নোটস আদান প্রদান করতে হলে, কোনো তথ্য জানাতে হলে তারা ক্লাসের ঐ এক্সট্রোভার্ট বন্ধুদের সাহায্য নেয়। এই দৃশ্যটি ১৫-২০ বছর আগের।
ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ সহজলভ্য হওয়ায় ক্লাসের প্রায় সবাই সবার সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বন্ধু’ হয়ে থাকে। তারমধ্যেও দেখা যায় ১০০ জনের ক্লাসে ৮-১০ জন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিপরীত লিঙ্গকে ‘বন্ধু’ বানায় না। ক্লাসের বাকিরা তাদেরকে ‘গোঁড়া’ বলে।
যে ছেলেটা সামনাসামনি কোনো মেয়ের দিকে তাকাতে সাহস পেতো না, পা কাপতো (কথা বলা তো অনেক দূরের কথা), সেই ছেলেটাও কিন্তু ফেসবুকে তার ক্লাসমেটকে ভয়ে-ভয়ে একদিন ‘Hi’ পাঠায়। অনলাইনের বদৌলতে যে ছেলেটা জীবনের প্রথমবার একটি মেয়ের সাথে কথা বললো, তার সেই ফিলিংসটি সে খুব যত্নের সাথে লালন করে। চ্যাট করতে শুরু করে- "কেমন আছো? খেয়েছো? আজ ক্লাসে আসোনি কেনো?"
ম্যাসেঞ্জারের শব্দ শুনলে তার বুক ধড়ফড় করে উঠে, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটি ক্লাসে ঐ মেয়েটিকে/মেয়েদেরকে হাই-হ্যালো বলতে একসময় অভ্যস্ত হয়ে যায়। অনলাইনে চ্যাটের ফলে তার মনের ভয় অনেকটা কেটে যায়, ভয়ের জায়গায় জন্ম নেয় সুপ্ত ভালোবাসা। এক পর্যায়ে ২-৩ দিন কোনো কারণে কথা না হলে সে মনে করে তার অস্তিত্ব জুড়েই শূন্যতা। সে ‘মিস’ করা শুরু করে। অতঃপর অনলাইনে বা অফলাইন প্রপোজ, ঐদিক থেকে বেশিরভাগ সম্ভাবনা থাকে একসেপ্ট হবার।
কম্বাইন স্কুল-কলেজে পড়ার ফলে অনলাইনে- অফলাইনে দেখা হবার সুযোগ যেমন বেশি থাকে, প্রেমে পড়ার সম্ভাবনাও তেমনি বেশি থাকে। কিন্তু অনলাইন প্লাটফর্ম এতোটা সহজলভ্য হবার ফলে যারা বয়েস স্কুল/গার্লস স্কুলেও পড়ে তারাও সমানে সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও প্রেমে পড়া, প্রেমে জড়ানোর ক্ষেত্রে স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থীদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। হতে পারে সেই হার স্কুল-কলেজের মতো মহামারী আকার ধারণ করেনি, কিন্তু তাদের প্রেমে পড়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি।
১২-১৫ বছর মাদ্রাসার সুশৃঙ্খল পরিবেশে থেকে, দৃষ্টির হেফাজত করেও ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে যে হারে মাদ্রাসা থেকে আগত শিক্ষার্থীরা প্রেমে জড়িয়ে পড়ে, সেটা চোখে না দেখলে কাউকে বিশ্বাস করানোটা কঠিন।
প্রেম সম্পর্কে আমার-আপনার মন্তব্য হলো এক শব্দে- ‘হারাম’। মজার ব্যাপার হলো, প্রেম করাটা যে হারাম, সেটা স্কুল- কলেজ পড়ুয়ারা যেমন জানে, মাদ্রাসা পড়ুয়া প্রেমিক/প্রেমিকাটিও জানে। তবুও তারা সেটায় লিপ্ত কেনো?
কারণ, কর্মের হারাম সহজে ছাড়া যায়, আবেগের হারাম সহজে ছাড়া যায় না। যেমন ধরুন- সুদ খাওয়া হারাম, কিন্তু যে সুদ খাচ্ছে তার সুযোগ আছে সুদ ছেড়ে হালাল উপায় অবলম্বন করার। সে খুব সহজেই, একদিনের মধ্যেই হারাম থেকে হালালে শিফট করতে পারবে। সুদের মতো হারামের সাথে তার লাভ- ক্ষতির সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু আবেগের সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে প্রেম- ভালোবাসা পুরোটাই আবেগ। সেক্ষেত্রে জানা সত্ত্বেও এই হারামে লিপ্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক, এটা থেকে বের হওয়াটাও অনেক জটিল; কারো কারো কাছে অসম্ভব বটে।
আপনি যখন শুনতে পারলেন আপনার মেয়ে বা আপনার ছোটো বোন প্রেম করছে, তখন আপনি কী করবেন?
আবেগীয় সম্পর্কের উপর আমরা তখন ছড়ি ঘুরানো শুরু করি। আমরা মনে করি বকাঝকা করে, ধমক- হুমকি দিয়ে তার ঐ ফিলিংসটি নিঃশেষ করে দেবো। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে দু-চারটি চড়-থাপ্পড় মারলে ঠিক হয়ে যাবে।
প্রেমের সম্পর্ক জানার পর আমাদের এমন রিঅ্যাকশন সিনেমার ঐ ‘ভিলেন’ বাপ-ভাইয়ের মতো; যে কোনোভাবেই নায়িকাকে নায়কের সাথে মিশতে দেবে না, আটকে রাখবে। সিনেমার সাথে বাপ- ভাইয়ের আচরণের মিল দেখে মেয়ে/বোনটি তখন নিজেকে সিনেমার নায়িকার জায়গায় দাঁড় করিয়ে একটা উপায় খুঁজে। নায়িকার মতোই মনে মনে বলে- যারা আমার অনুভূতিই বুঝে না, তাদেরকে বাপ- ভাই ডেকে কী লাভ? তারা আমার কী হয়?
মিডিয়ার মাধ্যমে প্রেমের যে বিজ্ঞাপন হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যা সহজলভ্য হয়েছে, সেটার বিরুদ্ধে আপনি একা, একদিনে বা এক বছরে লড়াই করতে পারবেন না। প্রেমাক্রান্ত ছেলে/মেয়ে, ভাই/বোনের সাথে কিভাবে রিঅ্যাকশন করবেন, প্রেমে না পড়ার জন্য তাকে কিভাবে গাইড করতে হবে সেগুলো সময় থাকতে ঠিক করে নিন।
নতুবা, যেই মুহূর্তে আপনি আরেকজনের মেয়ের পালিয়ে যাওয়ার রসালো ঘটনাটি বলে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছেন, মেয়ের বাপ-মার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখে হাসছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে আপনার ঘরের ছেলে/মেয়েটি যে ব্যাগ গুছাচ্ছে না, সেটার গ্যারান্টি আপনি দিতে পারবেন না।
➖➖➖➖➖➖➖➖➖
❝প্রেমের বিজ্ঞাপনের প্রভাব❞
✍🏼আরিফুল ইসলাম