19/04/2021
২০০২ বিশ্বকাপের কথা মনে আছে? কে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বলুন তো। যারা ফুটবল নিয়ে অল্প পরিমাণ খবরও রাখেন তারা জানেন যে চ্যাম্পিয়ন ছিল ব্রাজিল আর রানার্স আপ হয়েছিল জার্মানি। কিন্তু সেই ওয়ার্ল্ডকাপের থার্ড আর ফোর্থ প্লেসে কোন কোন দেশ ছিল - এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই অনেকে মাথা চুলকাতে শুরু করবেন। তাই এখনি বলি, থার্ড প্লেসে ছিল তুরস্ক আর ফোর্থ প্লেসে ছিল সাউথ কোরিয়া। রোনালদো লিমার গোল্ডেন বুট আর অলিভার কানের গোল্ডেন বল পাওয়ার পাশাপাশি বেস্ট ইয়াং প্লেয়ার নির্বাচিত হয়েছিলেন ল্যান্ডন ডনোভান, ইউএসএ থেকে।
ফুটবল কেন সবার খেলা? বুঝতে হলে এইযে থার্ড আর ফোর্থ প্লেসের দল দুটির দিকে তাকান। ওয়ার্ল্ড ফুটবলের জায়ান্টদের সামনে তুরস্ক আর সাউথ কোরিয়ার অবস্থান কোথায়? খুব সম্ভবত প্রত্নতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয় এটা। কিন্তু ওয়ার্ল্ডকাপে আর্জেন্টিনা, ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডদের পেছনে ফেলে এরাই কিন্তু সেমিফাইনাল খেলেছিলো। এরকম আনপ্রেডিক্টেবল সব ঘটনা, কম রিসোর্স নিয়েও জায়ান্টদের স্তম্ভিত করে দেয়ার জন্য যে প্যাশন আর পরিশ্রম লাগে সেটা জেনারেট করতে পারার জন্যই ফুটবল সবার খেলা। স্পেনের স্বর্ণসুতোর জার্সি, ব্রাজিলের পাঁচ তারা যুক্ত জার্সি পরেও ফুটবল যেমন, জার্সি না পেয়ে পলিথিন দিয়ে মেসির জার্সি বানানো কিংবা পিঠের উপর 'Ronaldo 9' লিখে নেয়া বাচ্চাটার কাছেও ফুটবল সমান অর্থ বহন করে। দ্য জয় অব পিপল, দ্য মোস্ট বিউটিফুল গেম।
ক্লাব ফুটবলে এই মোস্ট বিউটিফুল গেমের থিমটা অনেক আগেই অর্থের কাছে আটকা পড়ে গেছিলো। এইযে আজ যেটা হল সেটা হবারই ছিল, অন্তত আর্সেন ওয়েঙ্গার একদম পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন৷ বিগ সাইনিং, বিগ ওয়েজ স্ট্রাকচার, স্পন্সরশিপ, মিডিয়া রাইটস, ডেবথ & পেমেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি এসে ফুটবলকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সাধারণ মানুষদের নাগাল থেকে। ফুটবল মানেই বার্সা রিয়াল ইউনাইটেড লিভারপুল না। ফোর্থ ডিভিশনের একটা ক্লাবেরও প্যাশন আছে, স্বপ্ন আছে, ফ্যানবেজ আছে। আছে কিছু একটা করে দেখানোর অদম্য ইচ্ছে। অথচ আমরা এসব বারবারই ডিনাই করে গেছি। আমরা পিএসজি, ম্যানচেস্টার সিটিকে পোক করেছি তেলের ক্লাব বলে, কারণ তারা ফুটবল বহির্ভূত বিজনেসের লিকুইড মানি নিয়ে মার্কেট অস্থিতিশীল করে তোলে। অথচ যারা এর বাইরে থেকে একটা স্ট্রাকচার দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে তাদেরও অন্যান্য ক্লাব ট্রান্সফার সিজনে ছিড়েখুঁড়ে খেয়েছে। খুবই রিসেন্ট ঘটনা, রনিয়েরির লেইচেস্টার সিটি কিংবা মোনাকো। তারা কোনরকম লিকুইড মানি ছাড়াই দল গড়ে দেখালো, এরপর পিজ্জার স্লাইসের মত করে বড় দলগুলো তাদের একাদশের প্লেয়ার কিনে নিয়ে আবার তাদেরকে নিজেদের অবস্থান দেখিয়ে দিল। এই দিক থেকে পিএসজি আর ম্যানচেস্টার সিটি কিন্তু সফল, তারা লিকুইড মানি এনে বলতে গেলে উয়েফার ফেয়ার প্লে কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জায়ান্ট টিম হয়ে দেখিয়েছে। মোনাকো কিংবা লেইচেস্টারের মত করলে তারা কি জীবনেও কোমড় সোজা করে দাঁড়াতে পারতো? মোটেই না। এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করুন যে সিটি আর পিএসজির বর্তমান স্কোয়াডটা নরউইচ সিটি আর হাল সিটি গড়ে তুলেছে, বছরের পর বছর এফোর্টের মাধ্যমে। তারপর কী হত? পরের সিজনেই বড় ক্লাবগুলো তাদের সব প্লেয়ার সাইন করিয়ে নিত। ইয়েস, ইট'স দ্যাট ইজি। কিন্তু যেহেতু তারা বাইরের লিকুইড মানি এখানে এনেছে, যেভাবেই হোক না কেন, জায়ান্ট ক্লাবের তকমা গায়ে ঠিকই লাগিয়ে নিয়েছে। কে কী বললো তাতে আর কীই বা আসে যায়?
উয়েফা কখনোই ফেয়ার প্লে রুল নিয়ে কোনো কাজ করে নি। যেখানে ফুটবলটা বিজনেস, সেখানে টাকা কোত্থেকে এলো সেটা দেখার তাদের প্রয়োজন নেই। দায়সারা কিছু নিয়ম ছিল বটে, কিন্তু সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মত অনেক পথ খোলা ছিল আর এর কোনোটাই এই আইনের এরর নয়, সবগুলোই ইচ্ছে করে করা৷ তা না হলে দিনের পর দিন রুল ভায়োলেটেড হওয়ার পরেও উয়েফা কেন স্ট্রিক্ট হয়নি? সেই গ্যারেথ বেল থেকে ১০০ মিলিয়নের পথচলা শুরু, এরপর সেটা এসে ঠেকলো ২২২ মিলিয়নে। ২২২ মিলিয়ন ইউরো একজন প্লেয়ারের দাম, ভাবা যায়? এটা কি ইনফ্লেশন নাকি জোরজবরদস্তি? ছোট একটা ক্লাব যেখানে স্টার্টিং ইলেভেন অ্যাফোর্ড করতে হিমশিম খায় সেখানে জায়ান্ট ক্লাবগুলোর প্রতিটা পজিশনের জন্য তিন চার জন করে ওয়ার্ল্ডক্লাস প্লেয়ার রেডি থাকে। তার উপর মাথা ঘোরানো ওয়েজ স্ট্রাকচার, কিন্তু সমস্যা কী? বিলিয়ন ডলার খরচ করে স্কোয়াড বানালেও প্লেয়ারদের চেহারার দাম পে করার জন্যই হাজার হাজার স্পন্সর একপায়ে খাড়া। অথচ ওই একই সময়ে লিগের আরেক ক্লাব স্পন্সর পাচ্ছে না, কারণ তাদের ওইরকম প্লেয়ার নেই। তারা প্লেয়ার তৈরি করে, জায়ান্ট ক্লাবগুলো এসে সেই প্লেয়ারকে রাজকীয় লাইফস্টাইল অফার করে বসে, সেই প্লেয়ার চলে যায়। ছোট ক্লাবের আর বড় ক্লাব হওয়া হয় না, ট্রফি উদযাপন করতে কী অনুভূতি হয় সেটা জানা হয় না। তারা শুধু দিনের পর দিন দেখে যায়।
জায়ান্ট ক্লাবগুলোর অদম্য ক্ষুধা আর এই সিস্টেমের বলি হওয়া থেকে বাঁচতে ক্লাবগুলোর অয়েল মানির কাছে নিজেদের সঁপে দেয়া, এই দুটো জিনিসই ধীরে ধীরে সবার খেলা ফুটবলকে গিলে ফেলেছে। প্লেয়ারদের দাম হয়েছে আকাশ সমান, এখন বড় ক্লাবগুলোরও হিমশিম খেতে হয় তাদের অ্যাফোর্ড করতে। গ্যালাক্টিকো গড়া মাদ্রিদ, এক বিলিয়ন ইউরো রেভেন্যু ঘরে তোলা বার্সা হালান্ডের মত হঠাৎ করে হাইপ পেয়ে যাওয়া প্লেয়ারের দাম শুনে পিছিয়ে আসে। প্লেয়ারের এজেন্টরা যে মার্কেটে সর্বেসর্বা, মিনো রাইওলার কমিশন যেখানে লোয়ার ডিভিশনের কয়েক ক্লাবের বাজেটের সমান, সেখানে এই দিন দেখা অবশ্যম্ভাবীই ছিল। টাকার কুমির জায়ান্ট ক্লাবগুলো এবার নিজেদের সিস্টেমেই ফেঁসে গেছে, ভারসাম্যহীন মার্কেটে দেনার অঙ্ক দিন কে দিন বড় হয়েছে। তাই হাজার অন্যায়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকা উয়েফার পিঠে ছুরি মেরে এখন তৈরি হল ইউরোপিয়ান সুপার লিগ। ফুটবল হুট করেই হয়ে গেল ধনীদের খেলা, যেখানে ছোট ক্লাবগুলো অনেকটা বোঝাস্বরূপ। জায়ান্ট ক্লাবগুলো প্রচুর ম্যাচ খেলবে, রেভেন্যুর হিসেব হবে বিলিয়নে। থাকবে স্পন্সর, মিডিয়া, মার্সেনডাইজ ব্যবসা - বড় ক্লাবগুলো ছোট ক্লাবদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে যে তারাই সেরা। বোঝানো হবে যে ব্রাহ্মণদের পবিত্রতার ধারেকাছে কোন শূদ্রের স্থান নেই। মাদ্রিদের রাজকীয়তার সাদা জার্সি যেটায় রক্ত কিংবা কাদা লাগলেও লজ্জার কোন স্থান ছিল না, কাতালুনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের পরশ লেগে থাকা বার্সার লাল নীল ব্লাউগ্রানা কিংবা শ্রমিকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গড়ে ওঠা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড - সব লেগ্যাসি, অনিন্দ্য সুন্দর প্রতিদ্বন্দীতা, পেয়েও না পাওয়ার ক্ষোভ, সব এসে অর্থের কাছে বিলীন হয়ে গেল। মোস্ট বিউটিফুল গেম থেকে কীভাবে যেন মোস্ট প্রোফিটেবল গেম হয়ে গেল সর্বসাধারণের খেলাটি। আর এজন্যই ইন্টারন্যাশনাল ফুটবলের আবেগকে ক্লাব ফুটবলের পক্ষে কখনোই ছোঁয়া সম্ভব হবে না।
ইউএসএল সত্যিই বাস্তবায়ন করা হবে কিনা জানিনা, কিন্তু যদি হয় তো সুন্দর ফুটবলের এইখানেই সমাপ্তি। ঘুম বাদ দিয়ে রাত দুটোয় গোলের উল্লাসে ফেটে পড়া সেই মুহূর্তগুলো হাতে গোণা অল্প কিছু দলের অর্থের কামড়াকামড়িতে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। ট্রফি জিততে আর কিউপিআরের সাথে লেইট গোল দিতে হবে না, ইউসিএলে অলিম্পিয়াকোসের মত দল তাদের ডিফেন্সের শক্তির জানান দেবে না। দুর্ধর্ষ সব দলের খেলা হবে, কিন্তু খেলায় প্রাণ থাকবে না। ইফ ইট হ্যাপেন্স, ফুটবল রিয়েলি ইজ ডেড ফ্রম নাউ।
রেস্ট ইন পিস, ওল্ড ফ্রেন্ড। ইট রিয়েলি ওয়াজ ফান টু বি উইদ ইউ ফর সাচ এ লং লং টাইম!
©Ananyo Seerat ভাই