11/01/2025
"৪০ মিনিট আগেও যে আমাকে বলছিল “টেনশন করো না, আমি ঠিক আছি,” সে এখন নেই—এটা কীভাবে বিশ্বাস করি, বলেন?"
পেশায় আমার হাসবেন্ড একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, উনি কাজ করতেন ইবনে সিনাতে। আমিও পেশায় একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। জুলাইয়ের আন্দোলন শুরুর পর থেকেই আমার স্বামী এই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। প্রতিদিন ডিউটি শেষে তিনি আন্দোলনে যোগ দিতেন।
১৮ জুলাই রাতে ১১টার সময় ডিউটি শেষ করে যখন তিনি বাসায় ফিরছিলেন, তখন মিরপুর ১০ নম্বর থেকে তাঁর উপর আক্রমণ করা হয়। তিনি আমাকে কিছু জানাননি কারণ জানালে আমি তাঁকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করতাম, কারণ আমাদের একটি ছোট বাচ্চা আছে,তাই তিনি প্রাথমিকভাবে ব্যাপারটা আমার কাছে হাইড করেন । তাঁর শরীরের নানা জায়গায় রাবার বুলেট লাগে। তিনি বাসায় আসার পর বিষয়টি লুকানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু আমি তা দেখে ফেলি এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দেই সেদিন।
তারপরের দিন সকালে তিনি ডিউটিতে যান। তাঁর ডিউটি ছিল সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। ২টায় কাজ শেষ করে তিনি মিরপুর ১০ নম্বরে আন্দোলনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখন থেকেই আমি তাঁর সঙ্গে বারবার ফোনে কথা বলছিলাম। শেষবার বিকেল ৪টার দিকে, আসরের আজানের সময়, তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়।
তখন তাঁর গলা একদম বসে গিয়েছিল। আন্দোলনের প্রথম সারিতে থেকে স্লোগান দেওয়ার কারণে আর অতিরিক্ত ঘামে গরমে তাঁর গলা বসে যায়। তিনি আমাকে শেষ কথোপকথনে বলেন, “টেনশন করো না, আমি ঠিক আছি। আজ তো সবাই আন্দোলন করছে—মহিলা থেকে শুরু করে বাচ্চা, বৃদ্ধ সবাই নেমেছে রাস্তায়। আমি কিভাবে ঘরে বসে থাকি? নিজের কাছে নিজে কী জবাব দেব?” এটাই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কথা।
সেদিন এই কথা বলার কিছু মুহূর্ত পরেই মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর থেকে তাঁর মাথায় গুলি লাগে সরাসরি। একটি গুলি তাঁর মাথা ভেদ করে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়, আর দ্বিতীয় গুলি তাঁর মাথাতেই আটকে যায়।
আমার কাছে সঙ্গে সঙ্গেই ফোন আসে, এবং আমি সেখানে চলে যাই। কিন্তু আমি তাঁকে সেখানে পাইনি। সেখানকার এক ভাই তাঁকে মিরপুর আল-হিলাল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়, মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়। কিন্তু তাঁর অবস্থার অবনতি দেখে তাঁকে ইবনে সিনা কল্যাণপুর ব্রাঞ্চে স্থানান্তর করা হয়।
পরে জানতে পারি, সেখানে যাওয়ার পর অনেক ভালো ভালো ডাক্তার তাঁর ট্রিটমেন্টে এগিয়ে এসেছিলেন। অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু তাঁর আর জ্ঞান ফিরে আসেনি। কোনোভাবেই তাঁর আর জ্ঞান ফিরে আসেনি।
তাঁর ইবনে সিনাতে থাকার খবর পেয়ে আমি সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু ছাত্রলীগ ইবনে সিনায় যাওয়ার এবং হাসপাতালের মুখে তৎপর ছিল। কোনোভাবেই যেতে দেবে না। আমি সেখানে তাদের হাত-পায়ে ধরে কাঁদছিলাম, কিন্তু তারা আমাকে ঢুকতে দেয়নি।
তার মধ্যে আমার কাছে আরেকটা কল আসে। বলা হয় আমার স্বামী নাকি সোহরাওয়ার্দীতে। আমি আবার ওখান থেকে সোহরাওয়ার্দীতে যাই। ২ তলা থেকে ৫/৬ তলা আমি পাগলের মতো কতবার ছোটাছুটি করেছি, আমার হিসাব নেই।
সেদিন আমি যতগুলো লাশ দেখেছি, জীবনে এত লাশ দেখিনি। আমি সব লাশ উল্টে উল্টে দেখছিলাম আমার স্বামী কিনা। সেখানেও আমি তাঁকে খুঁজে পাইনি।
পরে আবার কল করি ওই নম্বরে। তখন বলা হয় নিউরো সায়েন্স বিভাগে যেতে হবে আমাকে। পরে সেখানেও যাই। কিন্তু ওখানেও কোনো এন্ট্রি নেই, কোনো তথ্য নেই, কিছুই নেই।
সেদিন শুধু লাশ আর লাশ। এত রেকর্ড রাখাও কি সম্ভব, আমি জানি না। ডাক্তাররা শুধু রোগী পাচ্ছিল আর যেভাবে পারছিল চিকিৎসা দিচ্ছিল। আর যারা মারা যাচ্ছিল, সবাইকে আলাদা রুমে সরিয়ে দিচ্ছিল।
ওই দৃশ্য আমি এখনো ভুলতে পারি নাই।
শেষে আরেকটা কল আসে। বলা হয় তিনি ইবনে সিনাতেই আছেন, আইসিইউ-তে ৯ তলায় আছেন। শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে সেখানেই খুঁজে পাই। সেখানেই তাঁর সার্জারি চলছিল।
কিন্তু ইবনে সিনায় সেদিন ছাত্রলীগ ঢুকে পড়ে এবং অনেক সমস্যা করছিল। ট্রিটমেন্ট করতে দেবে না। ডাক্তাররাই পরে আমার হাসব্যন্ডকে আমার কাছে হ্যান্ডওভার করে বলেন, এখানে রাখা যাবে না। তাঁকে নিউরোসার্জারি ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যেতে হবে, কারণ তাঁর মাথায় বুলেট লেগেছে। এই সমস্যার ভালো চিকিৎসা সেখানেই হবে।
তাই আমি তাঁকে নিয়ে নিউরো সায়েন্সে যাই। কিন্তু সেখানেও তারা মানা করে দেয় যে ট্রিটমেন্ট করাবে না। কারণ ততোক্ষণে ওখানেও লীগ-এর হামলা শুরু হয়ে যায়।
পরে যখন রাত ১০টা বাজে, আর কোনো উপায় না পেয়ে আমি যেখানে চাকরি করি, সেখানে তাঁকে ভর্তি করাই ইমার্জেন্সিতে।
ফজর পর্যন্ত আমার স্বামী বেঁচে ছিল। সারারাত তাঁকে ব্লাড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর শরীর কোনো ব্লাড নিচ্ছিল না। নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে, কান দিয়ে সব রক্ত বের হয়ে যাচ্ছিল।
পুরো রাত তাঁর ব্লিডিং হয়েছে। আমি শুধু এই আশায় ছিলাম যে তাঁর একবার জ্ঞান আসবে। কিন্তু তাঁর জ্ঞান আসেনি। একবারও চোখ খোলেনি। একটুও রেসপন্স করেনি।
শেষে ফজরের আজানের সময় আমার স্বামী মারা যায়।
ঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে হয়তো আমার স্বামী বেঁচে থাকত। এই একটা কষ্ট আমি নিজেকে বুঝাতে পারি না। আমি হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটেছি, কিন্তু নিজের স্বামীকে চিকিৎসা দিতে পারিনি।
আমার তিন বছরের একটা বাচ্চা আছে। সে তো বুঝে না যে তার বাবা আর নেই। আমি আমার ছেলেকে কী বলবো বলেন? যে আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম, কিন্তু তারা চিকিৎসা দিতে পারেনি?
যে দেশের জন্য তাঁর বাবা জীবন দিতে রাজি ছিল, সেই দেশের হাসপাতালগুলোর সামনে গুণ্ডা বাহিনী দাঁড়িয়ে থাকে যাতে রক্ত ঝরানো মানুষ চিকিৎসা নিতে না পারে?
আমার ছেলে এখনো কাগজের প্লেন বানায়। ভাবে তার বাবা আসবে, তার সাথে খেলবে। আমি উত্তর দিতে পারি না।দেখি আর নিজের কান্না লুকাই।
আমার নিজেরই বিশ্বাস হয় না, যে মানুষটা সকালে আমার সাথে কথা বলে নাস্তা খেয়ে আমার সামনে দিয়ে বের হলো, যার সাথে আমার এতবার ফোনে কথা হলো, ৪০ মিনিট আগেও যে আমাকে বলছিল “টেনশন করো না, আমি ঠিক আছি,” সে এখিন নেই—এটা কীভাবে বিশ্বাস করি, বলেন?
তবে যাই হোক, দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে আমার স্বামী। সে এখন এই দেশের শুধু আমার একার না। এটা ভাবলেও গর্ব হয়।
সে আমাকে আজীবনের কষ্ট আর গর্ব একসাথে দিয়ে গেল।
আমি একজন শহীদের স্ত্রী। একজন শহীদের ছেলে বড় করছি। এটাই আমার সম্বল।
বর্ণনায় - নাঈমা এরিন নিতু আপু
"ওয়াইফ অফ শহীদ মুত্তাকিন বিল্লাহ"
ঘটনার স্থান - মিরপুর ১০ গোল চত্তর
তারিখ - ১৯ জুলাই
মূল লেখা -Choukidar