26/08/2023
তলপেটে প্রচন্ড প্রাকৃতিক চাপ নিয়ে বউসেজে থাকা দুনিয়ার কঠিনতম শাস্তির মধ্যে একটা। এমন যন্ত্রণা না বলা যায়, না সহা। প্রমার এই মুহূর্তে ব্লাডার ফেটে যাবার জোগাড় হয়েছে। থেকে থেকে নিজের ওপর রাগ উঠছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে কেন যে জেদের বশে খাওয়া ছেড়ে এত পানি গিলতে গেল! এখন পেটটা টই টুম্বুর বোম! যেকোন সময় ফেটে যাবে।
এদিকে প্রমাকে চারিদিকে ঘিরে ধরে রেখেছে একঝাক মানুষ যেন সে চিড়িয়াখানায় নতুন আসা কোন আফ্রিকান শিম্পাঞ্জি ।দর্শনার্থীরা মূলত নতুন শিম্পাঞ্জির আত্মিয় স্বজন। একদংগল গেয়ো জংলী জংলী টাইপ মেয়ে- মহিলা, না কথাবার্তার ছিরি আচরণের; কিন্তু এদের সাথেই নাকি প্রমাকে বাকি জীবন মিলে থাকতে হবে।
নিয়ম হলো কেউ যখন কথ বলে বাকিরা শোনে। এইখানে সেইসব নেই, এরা সবাই একসাথে কথা বলছে,কেউ কাউকে শুনছে না। অনেকটা "কাউ কাউ" মতো শব্দ হচ্ছে। মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছেনা। তলপেটের চাপের সাথে প্রমার মাথা ধরে যাচ্ছে। শাড়ি পরানোর সময় পার্লারের মহিলা কোমরে এত্ত টাইট গিট লাগিয়েছে, প্রমার মনে হচ্ছে নিম্নাংশ থেকে শরীর দুই টুকরো না হয়ে যায়।
এখন জীবনে প্রথমবারের জন্য বাথরুমে না যাবার জন্য তার চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে।প্রমা একজনকে জিজ্ঞেস করেছিল বাথরুমটা কোথায়, কিন্তু কেউ যেন পাত্তাই দেয় না।এরা নিজের মত বক বক করেই যাচ্ছে।
প্রমাও নিজের মনের সাথে বলছে, " ছাগলী একটা, তোরে বলেছিল কে এরেঞ্জ ম্যারেজ করতে? ওই গাধা নোমানটার সাথে পালাতি,এই যন্ত্রণা তো ভোগ করতে হতো না। "এখন এত্তগুলা মানুষের মধ্যে কেলেঙ্কারি না হয়ে যায়। এই জংলী গুলা যায়ও না ঘরের থেকে। প্রমা করে তো করে কী....।
-"আজ বেচারির বাসর, সক্কলের এত কথা কইতে মুখ চুল্কায় ক্যান? আচ্ছা তোমরা এখন যাও তো বউটা একটু ফ্রেশ হউক। ব্যাচারি তো মনে হয় বাথরুমেও যাইবার পারে নাই! "
নতুন কন্ঠ শুনে কৃতজ্ঞ চোখ তুলে তাকালো প্রমা, তিনি তার স্বামীর কেমন ভাবি হন। গোলগাল এই মহিলা রুসমতের সময় সবচে চপড় চপড় করেছে৷ ম বেশীর ভাগই নন ভেজ জোকস, কান গরম করা কথা বার্তা। সবাই হেসে গড়িয়ে পড়েছে৷নতুন স্বামীর পাশে প্রমার মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছিলো। আচ্ছা বিয়ে করা কি শরীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? বিয়ের পর এইসব জঘন্য মস্করা কেন শুনতে হবে?তখন মহিলার উপর প্রমার এত্ত রাগ লেগেছিল, এখন কেমন কৃতজ্ঞ লাগলো।
তবে তার কথায় তেমন কেউ উঠতে চাইলো না, শুধু একটু নড়েচড়ে উঠলো। এদিক তলপেটে চাপে প্রমার মাথা ঘুরছে। মন করছে কাতর আকুতি, " ও আল্লাহ ইজ্জত বাঁচাও।বিয়ের বেনারসিতে নতুন জামাইয়ের সামনে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে নইলে...!"
"কী কইলাম! কানে যায় না? সার্কাস চলতেসে? উঠ সব কয়টা!"
ভাবির কড়া ধমকে সবে মেয়েদের ভিড়টা নড়া শুরু করলো। মেয়েরা সবাই একে একে বের হলে, ভাবি সাহেবা ভেটকি মেরে হাসলো প্রমার দিকে।
"এই যে ম্যাডাম, সাহেব আসতেসে এইবার রেডি হয়ে যাও। শিখে টিখে আসছো তো না শেখানো লাগবে কিছু? শিখায় দিব?"
প্রমার কান আবার ঝা ঝা করা শুরু করলো। বিয়ে করে তার এই কী শাস্তি হলো? কেন বিয়ে করতে গেল?
******
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে আছে প্রমা , একঘন্টা ধরে মাথার চুল থেকে গুনে গুনে সত্তরটা কাটা বের করেছে। ভারী জবরজং শাড়ি, কয়েক কেজি ময়দা গোলার মতো মেকাপ, আইল্যাস, আইশ্যডো, সব নকল জিনিস হতে এখন সে মুক্ত। যাক এখন আয়নায় নিজেকে চেনা যায়।
মেকাপ হতে মুক্ত তবে এই ঝামেলাদায়ক গয়নার গ্যাঞ্জাম হতে নয়। এই ভারী জাবরা গয়নাগুলো কেনার আগে দেখতে কি সুন্দর লাগছিল ; পরার পর থেকে এইগুলির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে হয়ে গেছে। ক্যামেরায় হাসিমুখে পোজ দিতে ভালো লাগছিল এখন চেষ্টা করেও মুড ভালো হচ্ছে না। নিজের ঘর বাড়ি আরামদায়ক বিছানা সব মিস করছে। একটা নীল কাগজে সাইন করে গোটা জীবনের পট পরিবর্তন হয়ে গেলো, এর মানে হয়?
এখন মনে হচ্ছে প্রমা আসলে বিয়ে করায় নয় বউ সেজে ফোটোসেশনের আগ্রহেই বিয়েতে রাজি হয়েছিল।তার বেশ লাগছিল, বিয়ের শপিং, গয়না গাটি, তাকে ঘিরে সব আয়োজন..। কিন্তু এখন সব শেষ। এখন ওই লোকটার স্বামীগিরি ফলানো শুরু। ভাবতেও অসহ্য লাগছে..!
ঢং ঢং করে ঘড়িতে এলার্ম দিল, রাত বারোটা। ভদ্রলোক এখনও আসেনি ঘরে। তবে যেকোন সময় এসে পড়বেন। ঘরে প্রমা একা। এক সপ্তাহের প্রস্তুতির বিয়েতে প্রমা না মানুষটাকে চিনেছে নাই তার সম্ভাব্য আবাসকে সাজাতে পেরেছে।একগাদা ক্যামিস্ট্রির ভারি ভারি বইয়ের ভরা বুকসেল্ফ আর পুরনো আসবাবে সাজানো ঘরটাও তাকে দেখছে ভ্রুকুটি করে। ষাট সত্তুর বছর পুরনো বিছানায় উঠতে গেলেও ছোটখাট সিড়ি প্রয়োজন।বলা যায় পুরোঘরটাও এর মালিকের মতো গোমড়ামুখো। প্রমা বিরক্তিতে কানে সোনার ঝুমকাগুলো ছুড়ে দিল ড্রেসিং টেবিলের উপর।
ঘরে ঢুকে কী বলবে লোকটা? চরম রকম মুডি,অহংকারী একটা লোক; যাকে দেখার শুরুতেই প্রমার অসহ্য লেগছে। তার সাথেই কিভাবে কিভাবে বিয়ে হয়ে গেল। অথচ শুরু থেকেই তাকে বলে দিয়েছিল- "না! "
ঘটনা শুনে আত্মিয়-স্বজন আকাশ থেকে পড়লো। প্রমার এক ভাবি তো বলেই বসলো "এতো ব্রিলিয়ান্ট, দেখতে ভালো, একটা মাত্র ছেলে, ঢাকায় নিজেদের বাড়ি ,বোনরা বিয়ে করে আলাদা ,আর সবচে বড় কথা শাশুড়ি নাই তার মানে ক্যাচালও নাই। নিজের মতো চড়ে খাবি,এমন ছেলে ছাড়তে আছে? আমি হইলে তো জীবনে ছাড়তাম না "
প্রমা বলল, "তাহলে ঝুলে যাও তোমার জামাই আর শাশুড়ি এমনিতেও তোমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ! "
ভাবির মুখটা পুরাই বিগড়ে গেল! তিনি মহা উৎসাহে ঢোল পিটিয়ে বলা শুরু করলো, "খোঁজ নাও আগে, প্রমাটার পছন্দ আছে বুঝলা, নাহলে এই ছেলে মানা করে?"
সত্যি বলতে প্রমার জীবনে প্রথমবার প্রেম না করার জন্য আপসোস হতে লাগলো৷ বান্ধবীর বি এতে তিনবার ডাব্বা খাওয়া বেকার ভাইটা ছাড়া প্রমাকে কেন যেন পছন্দও কেউ করে নাই। অথচ প্রমা দেখতে খারাপ না মোটেও, লম্বা চুল,দীঘল টানা চোখ মিষ্টি গোলগাল মুখ গায়ের রঙও মাজা, গাইতেও জানে। তবু কেন যেনওই ফেলটুস নোমান ছাড়া কারোর কোন ইন্টারেস্ট ছিলো না। মনে মনে বাধ্য হয়েই প্রমা চিন্তাটা একটু ট্রাই দিয়ে দেখছিল। কিন্তু ছাগলটারে ভালোই লাগাইতে পারেনাই।
নোমানকে ছাগল বলার অনেক কারণ আছে,আপাতত ছোট একটা উদাহরণ দেয়া যাক, গত বকরি ঈদে কাটা বকরির উপর সেলফি নিয়ে ফেসবুকে আপলোড দিয়েছে ক্যাপশন হলো, "আওয়ার বকরি! গিভিং বিশ মন মাংস ফিলিং প্রাউড! "
নোমানের উদ্ভট উলটা পালটা ভুল ইংলিশের ম্যাসেজের জ্বালায় প্রমা এমনিতেই অতিষ্ঠ ছিল, তার সাথে জুড়েছে এই অহংকারী প্রফেসারের সম্বন্ধ।
টিচার গোত্র এমনিতেও তার সহ্য হয়না।তার উপর তাকে দেখতে আসার দিন প্রথম কথাটাই ভদ্রলোক শুরু করেছেন ভুল ধরে। প্রমা ঘরে ঢুকলো তিনি বলে উঠলেন "শেকসপিয়ার বানান ভুল "
-জি? প্রমা অবাক।
পড়ার ঘরে বসানো হয়েছে তাকে,বুক র্যাকে থাকা বই ঘেঁটে কি সুন্দর প্রমার ডাইরীর পাতা উলটে যাচ্ছেন। এতটুকু ম্যানার নেই যে কারো ডাইরী চট করে খুলতে নেই।
-"এখানে হ্যামলেটের ডায়লগ লেখা, শেকসপিয়ার বানান ভুল! হ্যান্ড রাইটিং ভালো তবে মাঝেমধ্যে কিছু স্পেলিং মিস্টেক আছে "
প্রভা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, "ওটা আমার চৌদ্দ পনেরো বছরের ডাইরী"
হাসনাত নামের ভদ্রলোক হাসলেন - ওহ তাই, ইন্টারেস্টিং তো! হ্যান্ডরাইটিংটা বেশ "
প্রমা অবাক হয়ে খেয়াল করলো লোকটা আরও আগ্রহ নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছে।
প্রমা ঠান্ডা গলায় বলল, "যত ইন্টারেস্টিংই হোক কারো অনুমতি না নিয়ে তার পারসোনাল ডাইরী পড়া একটা অভদ্রতা! "
ডাইরি রেখে হাসনাত হেসে ফেলল তবে বিব্রত হলো না।অনেক খুটিনাটি প্রশ্ন করলো তাকে, প্রমার মনে হচ্ছিল ভাইবা দিচ্ছে।
"হোম ইকোমিক্স,এটা পড়ে কী হয়? ভালো গৃহিণী হওয়ার ট্রেনিং? ইন্টারেস্টিং! "
"এই কবিতাগুলো তোমার লেখা? বেশ ইন্টারেস্টিং! বুঝিনি কিছুই, তবে তোমার বাংলাহাতের লেখাটাও ভালো ,.."
"রিয়েলি ইন্টারেস্টিং "
লোকটা যতবার ইন্টারেস্টিং বলছিল তত বেশি তার প্রতি প্রমা ইন্টারেস্ট হারাচ্ছিল। ভদ্রলোক বেশ সুপুরুষ তবুও... । খালাতো বোন মিতুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মিতুর ডিপার্টমেন্টেরই প্রফেসর ইনি। ঠিক প্রফেসর না,আসলে ক্যামিস্ট্রির লেকচারার ।
" আর বলিস না প্রমা, কি যে অহংকারী! প্রচন্ড এরোগেন্ট! মেয়েদের সাথে যা বিহেভটা করে, বলার না রে...."
- কেন খারাপ চরিত্র! লুইচ্চা? তোর আব্বা মানে আমার খালু একটা লুইচ্চার প্রপোজাল আনসে আমার জন্য!
- না না লুইচ্চা না, ওই ঝামেলা নাই তবে খুব রুড, মানে চরম রুড!ম্যানার নাই ভদ্রতা বলতে জানেনা। তুই কথা বলেই বুঝবি।
সেদিনও একটা মেয়ের এসাইনমেন্ট জমা দিতে কি ভুল করলো যে ইনসাল্ট সবার সামনে বলার না! আবার পি এইচ ডি স্কলারশিপ পেয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়... এইজন্য মাটিতেই পা পড়েনা বুঝলি?"
প্রথম সাক্ষাতেই প্রমা বুঝে গিয়েছিল! লোকটার আসলেই সমস্যা আছে।
- তোমার কিছু জানবার নেই আমার বিষয়ে? শুধু আমিই কথা বলে গেলাম।
প্রমা উঠে দাঁড়িয়ে ছিল- আপনার এত এত প্রসংশা শুনে যা জানার তা সব মুখস্থ হয়ে গেছে। আমার ইন্টারভিউ হয়ে গেলে আমি যাই?আর হ্যাঁ, আমি চট করে কাউকে তুমি বলার অনুমতি দেই না!"
হাসনাত বড় বড় চোখ করে চেয়েছিলো।
-স্যরি ইফ আই অফেন্ডেড ইউ
প্রমা দেখল যুবকটার হাসিটাও দারুণ সুন্দর। কিন্তু সে অভদ্র চরম অভদ্র।গোটা সাক্ষাৎকারে তার কথার সাথে মিশি মিশে ছিল তাচ্ছিল্য
"এত কবিতা লেখ কেন? কি হয় কবিতায়? আমার মাথায় ঢোকে না
আমার মনে হয় কবি টাইপ লোকজন হাল্কা স্বভাবের হয়! সবজিনিস নিয়ে মর্ম বেদনার কবিতা লেখে ফেলে। পেট খারাপ হলে সেটা নিয়েও লেখে ফেলে বেদনা বিধুর কবিতা।খুব হাস্যকর লাগে! "
প্রমার গায়ে লেগেছিল এই কথাটা।এইজন্যই মেজাজ করে চলে এসেছিল সোজা দাদী নাজমা বেগমের ঘরে। বুড়ি আগে থেকে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন, তিনি প্রশ্ন করার আগেই প্রমা গলা চড়িয়ে উত্তর দিলো ,--
" না আ আ আ"
*******
এত দারুণ ছেলে! কত কত গরীব ছাত্রকে সাহায্য করে , কে এল স্কলার এমন মেধাবী, এই সেই...। হাসনাতের গুনগান প্রমার কানের কাছে ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজতেই থাকলো এক সপ্তাহ। তবে প্রমা ধরে নিয়েছিল তার রুক্ষ আচরণ দেখে হাসনাতও তার মতোই বলবে-" না " এবং ঘটনা ওইখানে শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু শেষ হলো না।শুরুতে ,ছেলেপক্ষ সরাসরি না বলল না, বলল সময় নেবে।প্রমা ভাবলো যাক, এই যাত্রা বেঁচে গেছে ।
এর বেশ কিছুদিন পর নিজের কলেজ ক্যাম্পাসের সামনে এক বিকালে প্রমা কয়েকটা পথশিশুকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছিল। রাস্তায় খেলা বাচ্চাদের সাথে তার আলাদা একটা পৃথিবী আছে। সুন্দর কিছু সময় কাটছিল। এর মাঝেই হঠাৎ দেখে ওপার থেকে হেঁটে আসছেন রসায়নবীদ। দেখামাত্র প্রমা দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে ফেলল,কিন্তু বিধি বাম! তিনি বড় বড় চোখ করে চেয়ে আছেন এদিকেই,
- "ভালো আছো প্রমা? ওহ সরি ভালো আছেন মিস প্রমা? "
প্রমা পাত্তা দেয়নি হাসি দিয়ে পাশ কেটে চলে এসেছে। সে বিকালে লেকচারার সাহেবের দৃষ্টি যেন কেমন কেমন ছিল, প্রমার ভাল্লাগে নাই।
তার দুইদিন পর হাসনাতের বাবা ফোন করলেন,তার ছেলের প্রমাকে দারুণ পছন্দ। কারো আপত্তি না থাকলে সামনের সপ্তাহে পাকা কথা করে ফেলেন।
প্রমার আব্বা মেয়ের পক্ষে একবাক্যে রাজি । এদিকে বাড়িত্র শুরু হলো প্রমার চিল্লাফাল্লা! তার যুক্তির বিপরিতে পালটা পরিবারের যুক্তি দাঁড়িয়ে গেল।
"অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে, বেশি দেরি করলে গ্লামার নষ্ট হবে। আব্বারো এই বছর হজ্বে যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে৷ তার ইচ্ছার মান রাখবি না?পরের আমানত কতদিন ঘরে থাকবি"
-আমি তো মানা করি নাই।কিন্তু ওই হাসনাতের আমানতই হইতে হবে ক্যান? খাইস্টা একটা লোক।
সবাই বিচিত্র চোখে তাকে দেখেছে , বুঝিয়েছে অনেক তবে লাভ হয়নি
প্রমা আরও বলল, "তোমারা একটাতেই আটকাইসো কেন আরেকটু দেখো "
বড় ভাবি বলল - আর কাকে দেখব যখন হাতের কাছে এমন হীরের টুকরো ছেলে! সেধে আসা ভাত পায়ে ঠেলে এভাবে? তোমার যে অসুখ তাতে সালমান খান আসলেও খুঁতখুঁত করবা..
- এহ! সালমান খানের অনেক বয়স!তার অফার আসলে আমি এমনেও রাজি হইতাম না...
সবাই হাল প্রায় ছেড়ে দিল। কিন্তু এই কেসে ফাইনাল ছক্কাটা হাঁকলেন সত্তুর বছরের নাজমা বেগম। শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি ষোলতম বার পটলক্ষেতে পটল বেছে তুলতে গিয়েও ফেরত এলেন...। তবে পটল বাছাই করতে করতে চি চি করে বলতে লাগলেন, " শফু তোর ছুডু মাইয়াডার কিছু হইলো নারে, বড় খায়েশ আসিলো পেত্নীটারে বউ সাজানি দেখনের! "
প্রমা বিড়বিড় করে বললো, "বুড়ি শোন, কবরে এক ঠ্যাং রেখে সব খায়েশ পুরণ করতে নাই, কিছু খায়েশ বাঁচিয়ে রাখো , বেহেস্তের হুরগুলা পুরণ করে দিবে!
- ও শফু, তোর মাইয়াডার লেহাজ আর হইলো নারে, দেখ আমারে কী কয়....।
ব্যাস! সেই দিন রাতেই বাড়িতে বসলো আদালত।
মা বললেন -তোর ঘটনা আমরা জানিনা তা মনে করিস? ওই তিনবারের বি এ তে ডাব্বা খাওয়া নোমান!
প্রমা হতভম্ব হয়ে বলল- আমি কবে নোমানের কথা বললাম?
- বলো নাই বলে আমরা বুঝিনা? ওই ছাগলটার জন্য এত ভালো ছেলে পছন্দ হইতেসে না তোর। ওই নোমানই তোর মাথাটা খেয়ে রাখসে।তেমন কিছু হলে জুতিয়ে লম্বা করে দেব ।
-ওহ আল্লাহ! নোমানের সাথে আমার কিছু নাই, আমি এমন কী করব যে তোমরা বিশ্বাস করবে ?
- হাসনাতকে বিয়ে!
************
সোয়া বারোটা বাজে। এখনও ভদ্রলোকের খবর নাই। এই লোক ঘরের বাইরে করছে কী? তার জন্য কোশ্চেন পেপার রেডি করছে? বাসররাতে ভাইবা, রিটেন হবে তার। গত একসপ্তাহে একবার ফোনে খবর নিতে যার মন চায়নি, তিনি এখন এসে সর্দারী ফলাবেন। প্রমা মুখ গোঁজ করে হাঁটছে ঘরময়। কিন্তু এই বিয়ে না করে আর করতোই বা কী, ওই নোমানটাই বাধ্য করলো।
ছাগলটা হুট করে একদিন ফোন করে ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলে, "আমি জানি কষ্ট হচ্ছে তোমার, আর কটাদিন অপেক্ষা কর, একটু ঠেকিয়ে রাখ। আমি একটু গুছিয়ে নেই তারপর, আমরা বেরিয়ে যাব অজানার দিকে...তারপর... "
- এই, তারপর মানে কী? তারপর মানে কী?তোমার কি মনে হয় আমি তোমার জন্য দেওয়ানা হয়ে এইগুলি করছি...? আমি কোনদিন বলসি যে তুমি আমার পছন্দ? বাপের পয়সায় চলা, ডাব্বা খাওয়া! সেদিনও দেখেছি দুই টাকার জন্য রিকশাওয়ালাকে চড় দিয়েছ। ছোটলোক! বিষ খেয়ে মরে যাব, তবু তোমার সাথে যাব না! "
প্রমা ফোন রেখে দিয়েছিল।কিন্তু কীভাবে যেন বন্ধুমহলে ঘটনা সয়লাব হয়ে সবাই তাকেই বোঝাতে এসেছে যে নোমান কত ভালো।
এই পরিস্থিতিতে তার অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি । একদিকে ছাগল নোমান, অন্যদিকে গাড়ল হাসনাত! কিছুতেই অন্য অপশন মিললো না। হাসনাতকে পছন্দ না করলেও প্রমা জানতো যে নোমানকে সে ভালোবাসে না। কিছুতেই না। আবেগ স্বপ্ন একপাশে রেখে মানুষকে বস্তুগত চিন্তা করতে হয়।মানুষের নিজ যোগ্যতায় বড় কোন অর্জন তুচ্ছ করার জিনিস নয়। মেধা, শিক্ষা, সোশাল ডিগনিটি, স্ট্যাটাস, আপাত ভদ্র আচরণ বিচারে হাসনাত অনেক এগিয়ে। বড়দের সামনে প্রমার প্যানপ্যান ধোপে টিকলো না।অবশেষে রণ-ক্লান্ত সৈনিকের নিমরাজিতে হাসনাতের সাথেই দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল ।
কিন্তু এখন হতাশ লাগছে। মিতুর কথাগুলো মনে পড়ছে। সে হাসনাতের ছাত্রী হয়ে নিশ্চয়ই ভুল বলেনি।ঘরের দেয়ালে ঝোলানো ছবিতে কালো কনভোকেশন গাউন পরা গম্ভীর যুবকটার সুন্দর মুখে অহংকারের প্রলেপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে প্রমা। বউ হয়ে সারাজীবন এনার মুড সামলাও এখন! কাজির সামনে কবুল বলতে তারস্বরে কেঁদেছিল প্রমা, কান্না শুধু পরিবার থেকে আলাদা হয়েই শুধু নয় ক্ষোভে, রাগে, জেদে....। তার জন্য আর কি কেউ মিলল না যে তাকে হৃদয় থেকে ভালোবাসে?
সেই কান্না থামেনি গাড়িতে বসেও।যদিও হাসনাত সান্ত্বনা দিতে আলতো করে একটা হাত ধরেছিল তার। প্রমা ঝাটকা দিয়ে হাত সরিয়ে ফেলেছিল। এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয় নাই। লোকটা খালিঘরে একা পেয়ে সেটার শোধ তোলার চেষ্টা না করে...।
প্রমা চিন্তা ঘোরাতে ঘরের দিকে চোখ ফেরালো৷ আলমারির পাশে বুক সেলফ, অনেকগুলো বই । ক্যামিস্ট্রি বাদেও কিছু বেখাপ্পা সাহিত্যের বই আছে। আনিসুল হকের বই দেখলো কয়েকটা। তার খুব পছন্দের রোমান্টিক উপন্যাসগুলো । গত বইমেলায় মিতু কিনেছিলো এর কয়েকটা, পড়তে চাইলে মিতু পড়তে দেয়নি তাকে। বলেছিল তুই কিনে পড় ,এগুলো গিফটের। "
প্রমার মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল মিতুর ওপর। যদিও এখনো মেজাজ খারাপ, মিতু আজ প্রমার বিয়েতেও আসেনি । অথচ প্রমার সর্বনাশের মুলহোতা মিতুরই বাবা, যিনি বিয়ের ঘটক। হাসনাত ওনার জুনিয়র কলিগ।বাবা বিয়ে ঠিক করেছে কিন্তু মেয়ে ফোন করে কানপড়া দিতে ভোলেনি--
"চরম অহংকারী, খুবই রূড, শোভানিস্ট একটা লোক...৷ "
মিতুর তথ্য মতে এমন ধরনের প্রেমের বই লেকচারার সাহেবের পড়ার কথা না। কী মনে করে প্রমা টেনে বের করলো বইগুলো,
"আপনার স্বপ্ন গুলো সত্যি হোক আমিও যেন তার অংশ হতে পারি।
--সাবরিনা আক্তার! "
সাবরিনা আক্তার মিতুরই ভালো নাম। হাতের লেখাটাও তার।বই হাতে প্রমা তবকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরও কিছু নতুন বই বের হলো মিতুরই দেয়া। সব বইতেই আবেগ দিয়ে লেখা দুটা লাইন।
বিয়ের কয়েক দিন আগে মিতুর বলা কথাগুলো কানে বাজছে এখনও," নোমান ভাই আসলেই ভালোবাসেরে তোকে,
মানুষটা বোকা তবে বোকারা স্বামী হিসেবে কিন্তু ভালো হয় । ভেবে দেখ, হাসনাত স্যার ঠিক যায় না তোর সাথে ,বেশি কোয়ালিফাইড বলেই তোকে ডমিনেট করবে খালি...।এটা একধরনের মানসিক অত্যাচার কিন্তু, তোর সারাজীবনের ব্যাপার প্রমা.. "
প্রমা দ্বিধা নিয়ে বলেছিল -হতে পারে, কিন্তু আব্বা খোঁজ করে কোন ভুল কিছু পায়নি। শুনলাম মানুষটা পরোপকারী খুব .."
" ও তো লোক দেখাতে "
" বুঝলাম কিন্তু তাকে আব্বা আম্মার খুবই পছন্দ। তাদের কষ্ট দিতে মন চাচ্ছে নারে..। দেখা যাক যা আছে কপালে। বড়োদের দোয়া থাকলে ... "
- নোমানের আসল ভালোবাসা হারালি।ওই রূডটার সাথে সুখী হবি না জীবনে; আমি বলে রাখলাম"
মিতুর হঠাৎ আক্রোশ ভরা অভিশাপের কারণ হিসেবে তখন প্রমার মনে হয়েছিল, সে নোমানের কাছে ঘুষ খেয়ে এসেছে। বইগুলো দেখে এখন কেমন কেমন উলটা হিসাব লাগে কেন?
হঠাৎ দরজায় লক ঘোরানোর শব্দ। প্রমা কি করবে, দৌড়ে বিছানায় গিয়ে নতুন বউয়ের মতোন গুটি সুটি হয়ে বসবে ? না এমনি থাকবে? সিদ্ধান্ত নিতে নিতে তিনি এসে গেলেন ঘরে..।
********-
"তোমার আমাকে পছন্দ হয়নি কেন? "
হাসনাত বেশ শান্তস্বরে জানতে চাইলো। বিছানার দুইপাশে মুখোমুখি বসে আছে দুজন। প্রমা ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে৷ স্বামীর কথায় প্রমা বেশ ভড়কে গেছে,তবে ব্যাপারটা হাসনাতকে দেখাতে চাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ আগে হাসনাতের দেয়া ডাউস সাইজের আংটিটার দিকে চোখ পড়ল। এর যা সাইজ তার বুড়ো আঙুলেও ঢিলে হবে।এটা পরানোর সময় কি হাসনাত বুঝে নিয়েছে স্ত্রীর মনোভাব?
হাসনাতের স্বগতোক্তি - যারা তোমায় পছন্দ করে, তাদের অপছন্দ করাই কি নিয়ম তোমার?
প্রমা ঘুরে তাকালো, হাসনাত হাসছে মিটমিট করে। আচ্ছা, তো গোয়েন্দাগিরি করে তার ব্যাপারে আধ্যপান্ত সব জেনেই এসেছেন মহাশয়।
- আমার আপনাকে অহংকারী মনে হয়! আমার মনে হয় আপনি ডমিনেট করতে পছন্দ করেন।
হাসনাত চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ - এমন ধারণার কারণটা জানতে পারি?
- আপনি নিজের ক্যাম্পাসের নিজের সাবজেক্টের কোন মেধাবী মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে বেছে নিতে পারতেন কিন্তু আপনার নিজের সমকক্ষ উচ্চশিক্ষিত মেয়ে ভয় লাগে, তাদের ডমিনেট করা যাবে না, এই জন্য বেছে বেছে আপনার হিসাবে একটু কমমেধাবী হোম ইকোনমিক্সের ছাত্রী স্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেছেন, যাতে আপনার ইগো ঠিক থাকে। কিন্তু এটা ভুলে গেছেন যে কাউকে মন থেকে পেতে চাইলে তার পছন্দ, ভালোলাগা, শিক্ষাগত যোগ্যতাকেও সম্মান করতে হয়। হোম ইকোনোমিক্স মোটেও কোন ফালতু সাবজেক্ট নয় ,আর নাই কবিতা কোন খারাপ জিনিস!কবিতা সবাই লিখতে জানে না "
প্রমা নিজেকে সামলে নিল, ফর্সা মুখ গোলাপি করে হড়বড় করে অনেক কথা বলে ফেলেছে।বাসররাতে পুরা রণাঙ্গনীর মুর্তি তার।
হাসনাত সাবধানে মুগ্ধতা চেপে বলল- আর কিছু ?.
- আরও আছে... আপনার রেজাল্ট নিয়ে সব সময় চ্যালেঞ্জ দেন, আপনি ঢাকা ভার্সিটির কালি নারায়ণস্কলার! আপনার রেকর্ড চার বছরে কেউ ভাঙতে পারেনি....৷
- হ্যাঁ সেটা সত্যি। নিজের অর্জন নিয়ে বলা অন্যায়?
- অন্যায় না তবে তা দিয়ে অন্যকে ছোট করা অন্যায়!
- আমি তো নিজের কথা বলে স্টুডেন্টদের উৎসাহ দেই, আমার তো খুবই ভালো লাগবে যদি আমারই স্টুডেন্ট সেই রেকর্ড ভেঙে ফেলে৷ কিন্তু সেটাতে কেউ ছোট ফিল করলে আমি কি করব? আর আমার স্টুডেন্টরা যত যোগ্যই হোক না কেন, তাদের মাঝে নিজের স্ত্রীর জায়গা দিতে আমার রুচিতে বেঁধেছে! তাদের আমি অন্যচোখে দেখি। অনেকটা নিজের সন্তান বা ছোটবোনের মতো, যাদেরকে ভালোবাসা যায় কিন্তু প্রেম হয়না....। আর আমার কাজ তাদের পড়ানো তাদের মধ্যে সঙ্গীনি খোঁজ করা নয়। এটা যার যার নিজের পারসেপশন, কিছু বলার নেই এই বিষয়ে।
প্রমা চুপ করে গেল। হাসনাত বেশ শান্ত গলায় কথা বলছে, সময় আর ধৈর্য নিয়ে। অহংকারী মানুষ নিজের সমালোচনা নিতে পারে না; তাদের ধৈর্য থাকেনা সেগুলো শোনার।সমালোচনা শুনলে তারা রেগে যায়।
প্রমা হঠাৎ প্রসংগ পালটে বুকসেল্ফ এর বাংলা বইগুলো দেখিয়ে বলল- ওই বই গুলো আপনার?
হাসনাত ঘুরে দেখে বলল- হ্যাঁ আমার, তবে কখনো খুলে দেখা হয়নি। বাংলা রোমান্টিক আমার ভাল্লাগে না, ন্যাকামি মনে হয়। বইমেলার সময় স্টুডেন্টরা শখ করে দেয়,তাই নিয়ে নেই,এটাও চয়েজের ব্যাপার, অহংকার নয় নিশ্চয়ই"
- অবশ্যই অহংকার! এক-দুটা গল্প পড়েই স্টেটমেন্ট তৈরি করে ফেলা। শুনুন, সব রোমান্টিক গল্প ন্যাকামি হয় না। আপনার মনে হয় আপনি যেটা পছন্দ করেন সেটাই বেস্ট বাকি সব ফালতু। যা আপনার আছে সেটাই সবচেয়ে ভালো, সবচে শ্রেষ্ঠ!
হাসনাত হাসতে হাসতে বলল- তাহলে তো এখন তুমিও আমার! অহংকারীর নিয়ম হিসেবে আমার দৃষ্টিতে তুমিই সবচে ভালো, সবচে শ্রেষ্ঠ। অহংকারটা তো আমি তোমায় নিয়েও করবো। আমি দারুণ অহংকারী মানুষ কিনা!
প্রমা চমকে থেমে গেছে। বাসররাতে কথার যুদ্ধে এই মুহূর্তে সে স্বামীর কাছে পরাস্ত। কথার মিষ্টি তীর সোজা গিয়ে লেগেছে বুকে। বিচিত্র সুখ মাখানো ব্যথা সেখানে। ক্ষত এমন যে রক্ত এসে জমছে ফর্সা গালে। হাসনাত তাকিয়ে আছে মুগ্ধ হয়ে। মিষ্টি মুখের কবি, জেদি, একরোখা, আজীবনের প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিয়ে এখন আসলেই অহংকার হচ্ছে তার। অহংকার নতুন এক জয়যাত্রার...।
(সমাপ্ত)
লেখক-- শারমিন আঞ্জুম
#ছোটোগল্প-- #জয়যাত্রা
পাঁচ বছর পুরনো লেখা অসংখ্য গ্রুপে পোস্ট করা।গল্পস্বল্প ওয়েবসাইটেও শেয়ার করা গল্প, তাই কপি পেস্ট করবেন না। গল্পটা ভালো লাগলে লাইক দিন পেইজে ফলো দিন এবং আমার আরও লেখা সম্পর্কে জানতে পেইজ পিনপোস্টে ক্লিক করুন লিংক-- --https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=725473442746674&id=100058520755905&mibextid=Nif5oz