03/01/2023
কাজের শেষে অভ্যেস মতো মোবাইলটা হাতে নিয়েই হোয়াটসঅ্যাপটা খুললো অদিতি। এক এক সবুজ বিন্দুতে আঙুল ছুঁয়ে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো সে---। বেশির ভাগই ওই গুডনাইট, গুডমর্নিং এর জমে থাকা ম্যাসেজ। সৌজন্যতা রক্ষার্থে ঘনিষ্ঠ দু'চার জনকে রিপ্লাইও দিতে হয়! আবেগে নয়, বেগে পড়ে এই ম্যাসেজ চালাচালি...! ধ্যুত্, ভালো লাগে না। দুটো শব্দ লেখারও যেন কারো সময় নেই! হঠাৎ একটা আননোন নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এলো সবুজ নিশান নিয়ে। কৌতূহলবশতঃ খুলে দেখতেই... ভেসে উঠলো পঁচিশ বছর আগের এক পরিচিত মুখ! এতোদিন সেরকমভাবে মনে পড়েনি তার কথা। স্বামী, সন্তান, সংসারে এমনভাবে একাত্ম হয়ে পড়েছিল যে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ পায়নি মোটে।
"হাই, চিনতে পারছিস?"
"পারছি, কোথায় পেলি আমার নাম্বার??"
"পেয়েছি, যেখান থেকে হোক! চিনতে পেরেছিস্, এই যথেষ্ট!!"
" হ্যাঁ, মোটা শরীরে বয়সের ছাপ। তবে একেবারে চিনতে না পারার মতোও পাল্টাসনি!! তা হঠাৎ কি মনে করে??"
"না, এমনি! তোর কথা খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কেমন আছিস। কটা ছেলেমেয়ে। সংসার কেমন করছিস্....এইসব আর কি!!"
"ওহ্ঃ, এইকথা?? পরস্ত্রীর জীবনে উঁকি ঝুঁকি দেওয়াটা কি ঠিক?"
"বেঠিকের কি আছে? আমি তো কেড়ে নিতে যাচ্ছিনা! আর তুই সব কিছু মন থেকে মুছে দিতে পারলেও , আমি পারিনি। আজও আমার প্রথম আর শেষ প্রেম তুই....!!"
সশব্দে হেসে ওঠে অদিতি। এসব শুনে সে বেশ মজা পাচ্ছে..! "তাই নাকি? শুনে তো ছিলাম, নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে তুই বহাল তবিয়তেই আছিস! এক ছেলেও আছে তোর!"
"ওহ্, তুই অন্যের মুখেই ঝাল খেলি? একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি... কি পরিস্থিতিতে কেন আমি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলাম??"
কথা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে দেখে অদিতি বললো,"বাদ দে না পুরানো কথা। আজ আমরা যে যার জীবনে সুখী আছি। এতোটা সময় পেরিয়ে জীবনের অপরাহ্নে এসব কথা শোভা পায়না। সেটা উচিৎও নয়। তার চাইতে বন্ধু হয়ে জুড়ে থাকি...!"
" তোর অসুবিধা না থাকলে আমাকে কল করবি? কত না বলা কথা যে জমে আছে!"
"আচ্ছা, করবো!"
রাহুল অদিতির স্কুলজীবনের বন্ধু। দুজনের পারিবারিক অমিলের কারণে, আর কিছুটা ভুল বোঝাবুঝিতে.... একপ্রকার রাগ করেই দুজন দুজনকে ছেড়ে আলাদা পথ বেছে নিয়েছিল। বেশ কিছুদিন তার রেশ থাকলেও.... হঠাৎ রাহুলের বিয়ের খবরে অদিতির মন পুরোপুরি ঘুরে যায়। ভাবে, ও যদি সুখী থাকতে পারে নতুন সাথি নিয়ে...., আমি কেন পারিনা!! কেন আমি অতীতকে ভুলে যাবো না! পরে অদিতির বিয়ে হয়ে যেতে সব স্মৃতি বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়...!
আজ এতো বছর পর!! কেমন যেন অবাক লাগে তার। যেহেতু, সেই আবেগ আর বয়স আজ নেই,... এসব কথাকে ততটা পাত্তা না দিয়ে ভাবলো , বন্ধুত্ব রাখতে দোষ কি? রাহুল তার জীবনের চাপান উতোরের সব কাহিনী শোনালো... ! জানালো তার জীবন সংগ্রামের বৃত্তান্ত!! অদিতির খারাপ লাগে সব শুনে। ভাবে, সম্পূর্ণ না জেনে ওকে বোধহয় এতোটা দোষ দিয়ে ঠিক করেনি সে।
যে মেয়েটিকে রাহুল বিয়ে করেছে, সে নাকি গরীব ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে। পণের টাকা জোগাড় না হওয়ায় বিয়ে ভেঙে যায় তার...। আত্মহননের পথ বেছে নিতে যায় মেয়েটি...! রাহুল ওই মেয়েটিকে বিয়ে করে নতুন জীবন দান করে তাকে...! মহৎ কাজ করেছে রাহুল...! দোষ তো তাদের দুজনেরই ছিল...! অদিতিও তো এগিয়ে গিয়ে ভুল বোঝাবুঝিটা মিটিয়ে ফেলতে পারতো! ইগোর লড়াইয়ে দুজনেই সমান। কম যায় না কেউ। যাইহোক, সব ভুলে নির্মল বন্ধুত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নিলো সে।
মাঝে মাঝের চ্যাট, ফোন এখন রোজে পরিনত হয়েছে। অদিতির জীবনের ছোটছোট সব ঘটনা, অনুভূতি জেনেছে রাহুল পরম আগ্ৰহে.....! কিছুই আর গোপন নেই। এর ফাঁকে রাহুল সমানে অদিতিকে বিশ্বাস দেওয়াতে চেষ্টা করেছে যে, তাদের পুরানো প্রেম আজো বেঁচে। সময়ের ধূলায় ঢেকে ছিল কেবল। আর তাতে কোনো দোষও নেই। এটুকু কারচুপি চলতেই পারে..! তারা সমস্ত কর্তব্য চুকিয়ে একটু যদি মনের খোরাক খোঁজে, ক্ষতি কি?? অদিতির প্রতিটি মুহূর্তের খবর রাহুলের নখদর্পণে....! একটু অনলাইন আসতে দেরি হলে রেগে যায় সে। হাজারো মিষ্টি কথার ফুলঝুরি...! আজ এই বয়সেও একান্তে পেতে চায় অদিতিকে...! অদিতির গায়ের গন্ধের মাদকতা আজও তার চেতনায়। ভাবলে, পাগল করে তাকে--! যে কোনভাবে একবার অন্ততঃ মিলতে চায় সে। শারিরীক দূরত্ব তা হতে দেয় না।
শেষে এমন হলো, অদিতিকে নানা মুহূর্তের নানান ফটোর ফরমায়েশ করতে থাকে। না পাঠালে রাগারাগি করে, ম্যাসেজ করা বন্ধ করে দেয়। হাজার অনুরোধেও সে কোন খারাপ ফটো পাঠায় না। বন্ধুর রসিকতা ভেবে গুরুত্ব দেয়নি তেমন। শেষে বিরক্ত হয়ে অদিতি স্পষ্ট জানায়, না তো সে কোন অনুচিত ফটো পাঠাবে, না খারাপ ভাষার উত্তর দেবে...! তখন সেটা মেনে নিলেও ধীরে ধীরে রাহুলের ব্যবহার বদলে যেতে থাকলো...! একদিন, দুদিন , পাঁচদিন , দশদিন হতে হতে ব্যবধান বাড়তেই থাকলো। তারপর দুম করে আবার ম্যাসেজ করে পুরানো আমেজে, আবার ডুব দেয়..। অদিতি অসহিষ্ণু হয়ে রেগে গিয়ে দুচার কথা শুনিয়ে দেয় তাকে। সরাসরি জানতে চায়, রাহুল কি চায়? উত্তরে বলে, "ওরকম ভদ্রভাষায় কথাবার্তা বলা আমার পোষায় না। আমি তাই ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছি। এতদিনের কথা না ধরে তুই তোর নিজের মতো থাক। ওরকম বন্ধুত্বে আমার দরকার নেই...!" ব্যস্, একদম চুপ্। কোন যোগাযোগ বা ম্যাসেজ নেই। রাহুলের হঠাৎ এসে অদিতিকে এভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গায়েব হয়ে যাওয়াটা... কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। বারবার ভাবছে, রসিকতা করছে না তো! অদিতি তো একজন প্রকৃত বন্ধু চেয়েছিল, যার কাছে অকপটে মনের সব কথা সে বলতে পারে, একসাথে হাসতে পারে, নিজেদের চাওয়া পাওয়ার আলোচনা করতে পারে...! বিশ্বাস করেছিল চোখ মুদে!! স--ব মিথ্যে? নাটক? ছলনা---?? কোন পুরানো প্রেমিক না হোক, বন্ধুও কি পারে এমনটা করতে!! লজ্জা, অপমান, ঘেন্নায় নিজের গালেই চড় কষাতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। বারবার দুচোখ জলে ভরে যাচ্ছে...! এটাতে কার ভুল?? কাউকে বন্ধু ভেবে ভরসা করাটা? নাকি পুরানো প্রেমকে প্রশ্রয় দেওয়াটা? এতদিন পর উপযাচক হয়ে এসে তাকে দুঃখ দেবার কি খুব দরকার ছিল?? জানে না, সে কিচ্ছু জানে না।।