19/09/2023
ছোট থেকেই শুনতেন বাঙালির দ্বারা আর যাই হোক, ব্যবসা সম্ভব না | কিন্তু বড়বাজারে ডিস্ট্রিবিউটরের কাজ করতে করতে তিনি স্বপ্ন দেখতেন বড় ব্যবসা করার | বলতেন একদিন সারাদেশে আমার প্রোডাক্টের নাম ছড়িয়ে পড়বে | সেই সময় দাঁড়িয়ে তাঁর এই কথায় কেউ বিশ্বাস করত না | লোকে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত | কিন্তু তিনি ছিলেন নিজের লক্ষ্যে অবিচল | আর আজ তাঁর কোম্পানি বিস্ক ফার্ম বেকারি ব্যবসায় দেশের চতুর্থ বৃহত্তম কোম্পানি | বর্তমানে কোম্পানির ব্যবসার টার্নওভার দুহাজার কোটির বেশী | এখন সারা দেশে এই ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া..💙🌿
🤎| #বিশ্বকর্মার_সন্ধানে |🤎
কে তিনি...?
তিনি কৃষ্ণদাস পাল | তবে শিল্পমহলে তিনি কে ডি পাল নামেই পরিচিত | জন্ম ১৯৪০ সালে বর্ধমান জেলার কামারকিতা গ্রামে। বাবার নাম পূর্ণ চন্দ্র পাল। পাঁচ ভাই, তিন বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় |
পূর্ণচন্দ্র পাল বিয়ের আংটি বিক্রি করে বর্ধমান থেকে কলকাতায় এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে। তাঁর সঙ্গে আসেন স্ত্রী ও ছেলেরাও। শহরে পৌঁছে গঙ্গায় ডুব দিয়ে প্রার্থনা করেন 'যাই করি তাতেই যেন সেরা হতে পারি'। অভাবের সংসার | পরিবারের সকলকে নিয়ে এসে তুললেন শ্যামপুকুরের এক কামরার ঘরে। শুরুতে কলকাতার এক বেসরকারী কোম্পানিতে অল্প মাইনের একটা চাকরী পেয়েছিলেন পূর্ণচন্দ্র | তারপর সেটা ছেড়ে বড়বাজারের একটা ছোট্ট ঘর থেকে শুরু হল পূর্ণচন্দ্রের ট্রেডিং ও ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ।
কৃষ্ণদাস ভর্তি হলেন কাছেই শ্যামবাজার এ. ভি স্কুলে। পড়াশুনার জায়গার অভাব তাই তিনি পড়াশুনা করতেন রান্নাঘরে। অল্প বয়স থেকে ব্যবসার কাজে বাবাকে সাহায্য করতেন কৃষ্ণদাস। প্রথমে সাইকেল ভ্যানে এ্যালপাইন দুধ পৌঁছে দিতেন বাড়ি বাড়ি। আরও বড় হলে; মোটর ভ্যানে বড় বড় দোকানে নানান ধরনের মাল পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এদিকে আবার সেল্স ট্যাক্স রেজিস্টার লেখার দায়িত্বও ছিল তাঁর উপর | বেশ মেধাবী ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র | তাই ছোট ভাই বোনেদের লেখাপড়ায় সাহায্য করার দায়িত্বও ছিল তাঁর কাঁধে। এ. ভি স্কুলের পর ইংরাজী অনার্স পড়তে ঢুকলেন সিটি কলেজে। বিএ করার পর এমএ ও তারপর আইন পড়া শুরু হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পূর্ণচন্দ্রের ব্যবসার অবস্থা ততদিনে বেশ পোক্ত হয়ে উঠেছে। শ্যামপুকুর স্ট্রীটেই দেড় কাঠা জমির উপর ছোট্ট একটা বাড়ি করেছেন। তবু বাবার উপর চাপ না বাড়িয়ে কৃষ্ণদাস চাকরী নিলেন হাওড়ার অক্ষয় শিক্ষায়তন স্কুলে। এরপর কিছুদিন হাইকোর্টে ওকালতিও করেন। ততদিনে পূর্ণচন্দ্রের ব্যবসা আরও বড় হয়েছে। তিনি ছেলেকে পুরোপুরি টেনে নিলেন ব্যবসার কাজে।
১৯৭৩ সালে পূর্ণচন্দ্র তাঁর সমস্ত ব্যবসা ছেলেদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। কৃষ্ণদাস পেয়েছিলেন ডিস্ট্রিবিউশন | কৃষ্ণদাস পেলেন ডিস্ট্রিবিউশন। তখন থেকেই যোগাযোগ এই বিশাল মার্কেটের সঙ্গে। নেসলে, ল্যাকমি আর ক্যালকাটা কেমিক্যালস— এই তিনটে কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা তো ছিলই। পরে কৃষ্ণদাস প্রায় একার চেষ্টাতেই সেই তালিকায় যুক্ত করলেন ব্রিটানিয়া, ডাবর, হরলিক্সের মতো কোম্পানিকে। ব্যবসা ও লাভের পরিমাণ এক ধাক্কায় বেড়ে গেল অনেকটা।
ক্যালকাটা কেমিক্যালসের ডিরেক্টর সমরেশ দাশগুপ্ত এই সময় মারা গেলে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সেই কোম্পানির শেয়ার কিনে নেন কৃষ্ণদাস। কিন্তু উল্টোদিকে এগিয়ে এল আরেক প্রতিপক্ষ, শ ওয়ালেস। এমন ঘটনায় অসন্তুষ্ট হলেন কে ডি। আর সেই লড়াই গড়াল আদালত পর্যন্ত। বিস্তর ঘটনাপ্রবাহের পর তাঁর শেয়ার বিক্রি করে দিলেন কে ডি। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পেলেন প্রায় ৭ কোটি টাকা। আর এই টাকা দিয়েই ২০০০ সালে শুরু হল ‘সাজ ফুড প্রোডাক্টস প্রাইভেট লিমিটেড’। তিন ছেলেমেয়ে শর্মিষ্ঠা, অর্পণ, আর জয়িতার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে রাখা হল এই নতুন কোম্পানীর নাম। এই কোম্পানির প্রধান প্রোডাক্ট হল ‘বিস্কফার্ম বিস্কুট’।
প্রথমে উলুবেড়িয়া, তারপর শিলিগুড়ি— কারখানা বেড়েই চলল। সেইসঙ্গে বেড়ে চলল বিস্কফার্মের নাম। আর আজ? ২০ বছর বয়সী এই কোম্পানি গোটা ভারতে বেকারি ব্যবসায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে আছে। আগে আছে ব্রিটানিয়া, পার্লে আর আইটিসি | সাড়ে তিন হাজার কর্মী যুক্ত বিস্কফার্মের সঙ্গে। এই ব্র্যান্ডের দ্য টপ, গুগলি, স্পাইসি, জাস্ট জিনজার, বুরবোঁ, চিজ ক্রিম– ইত্যাদি বিস্কুটগুলি সাধারণের কাছে বেশ জনপ্রিয় | দেশের বড় শহরগুলিতে বিস্কফার্ম ব্র্যান্ডের আউটলেট রয়েছে, ‘জাস্ট বেকড’ নামে। সেখানে বসে নানা রকম বিস্কুটের সঙ্গে চা-কফি তো খাওয়া যায়ই, সেই সঙ্গে পাওয়া যায় বিভিন্ন কুকিজ, কেক, পেস্ট্রি, স্যান্ডউইচ, প্যাটিস, মাফিন | বর্তমানে ৪০ টির বেশি জাস্ট বেকড চালু আছে | কোম্পানীর লক্ষ্য হল এটাকে ১০০ তে নিয়ে যাওয়া। ইতিমধ্যে দেশের অন্যান্য প্রান্তে বিস্কফার্মকে ছড়িয়ে দিতে নাগপুরে একটা কারখানা খোলা হয়েছে। পরের লক্ষ্য বেঙ্গালুরু। সেখানে কনকপুরায় ৮ একর জমি কেনা হয়েছে। শীঘ্রই কারখানা তৈরী শুরু হবে।
২০২০ সালে প্রয়াত হন কৃষ্ণদাস পাল | কেডি পালের ছেলে অর্পণ পাল এখন হাল ধরেছেন ব্যবসার। সারা দেশে নাম করলেও, বর্ধমানের মাটিকে কখনওই ভোলেননি কৃষ্ণদাস পাল। সাধারণ গ্রামের মানুষ নানা ভাবে পাশে পেয়েছে তাঁকে। লকডাউনের সময়েও গ্রামের মানুষের যাতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য করেছেন। গ্রামে ১১২টি পথবাতি লাগিয়ে দিয়েছেন। বিদ্যুতের বিলও উনি মেটাতেন। বাড়ি-বাড়ি পানীয় জলের সংযোগ করে দিয়েছেন। উনি চলে যাওয়ার পরে গ্রামের বাসিন্দারা যাতে সমস্যায় না পড়েন , সে জন্য একটি সংস্থাও তৈরি করে দিয়েছেন। গ্রামের ৯৫ শতাংশ রাস্তা কংক্রিট করে দেওয়া, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংস্কার, শ্মশানঘাট তৈরি, দাতব্য চিকিৎসা, কম্পিউটার শিক্ষা, সেবা প্রতিষ্ঠানের মতো একাধিক প্রকল্প গ্রামের মানুষের জন্য চালু করেছিলেন। আশেপাশের গ্রামেও প্রচুর প্রাচীন মন্দির সংস্কার করেন। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ একশোরও বেশি বাড়ি দাঁড়িয়ে থেকে সংস্কার করে দিয়েছিলেন | তাঁর সংস্থায় এলাকার প্রচুর বেকার যুবকদের কাজ দিয়েছেন। গ্রামের মানুষের বিপদে-আপদে দাঁড়িয়েছেন। অসুস্থদের নিয়ে গিয়ে তাঁর হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করেছেন।হাটগোবিন্দপুরে কলেজ তৈরির সময়ে তিনি খুব বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সব মিলিয়ে নিজের কাজে অনন্য হয়ে উঠেছিলেন কেডি। হয়ে উঠেছিলেন আস্ত এক প্রতিষ্ঠান।
তাঁর দেখানো পথে আরও এগিয়ে চলুক বিস্কফার্ম...💫🌻
♦️তথ্যসূত্রঃ দ্যা ওয়াল, আনন্দবাজার পত্রিকা, The News বাংলা