11/11/2024
না বুজে মুখস্ত করার কুফল (আমরা উদার ও মানবিক হব কখন ?)
————————————————————————————
আপনার প্রশ্ন— “এতো ধর্ম-কর্ম করেও বাঙালি মুসলমান এমন অসভ্য কেন?” একটি উদাহরণ দিই। বাংলাদেশে কোটি কোটি মানুষ নামাজ পড়ে, এবং নামাজটা শুরু করে আল্লাহু আকবার, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, সূরা ফাতিহা, এগুলো দিয়ে। আল্লাহু আকবার কী? আল্লাহ মহান। কিন্তু যিনি আল্লাহ মহান বলে তাহরিমা বাঁধছেন, তিনি কি আল্লাহর মতো মহান হতে চাইছেন? চাইছেন না। কেবল মুখস্ত বাক্য জপে সওয়াব কামাতে চাইছেন। তার বিশ্বাস, মহান হওয়ার দায় শুধু আল্লাহর একার, মানুষের মহান হওয়ার দায় নেই।
তারপর আসি বিসমিল্লায়। নামাজটি আল্লাহর নামে শুরু করা হচ্ছে, যিনি পরম করুণাময় ও অত্যন্ত দয়ালু। কিন্তু এ বাক্য থেকে নামাজী লোকটি কি কিছু শিখছে? এখানে আল্লাহর দুটি গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে, করুণাময় ও দয়ালু, বাঙালি মুসলমান কি দয়ালু হতে চাইছে? তার মাঝে কি করুণার ছিটেফোঁটা আছে? সেদিন দেখলাম, একটি ছাগলকে, পেটে বাচ্চা আছে, প্রেগন্যান্ট, দুটি কলা খেয়ে ফেলেছে বলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। শিয়াল কুকুর, যাই দেখেন, তাকেই পেটাতে যান। অপছন্দের লোকদের প্রতি জিঘাংসা অনুভব করেন। নিজ ধর্মের লোক ছাড়া সকলকেই শত্রু ভাবেন। হিন্দু, ইহুদী, নাস্তিক, তাদেরকে গালাগালি করেন। সুতরাং, আপনি তো বিসমিল্লা থেকে কিছু শিখছেন না। দয়া, করুণা, কামপেশন, এসব আপনার ভেতর নেই। ইউ আর আ ক্রুয়েল এনিম্যাল।
নামাজে পাঁচবেলা আল্লাহ দয়ালু, আল্লাহ দয়ালু জপছেন। কিন্তু নিজে দয়ালু হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন না। শুধু আল্লাহ দয়ালু হলে পৃথিবীর কী লাভ? মানুষকে তো দয়ালু হতে হবে, না কি? পৃথিবীতে তো আল্লাহ বাস করেন না, মানুষ বাস করে। আপনি যদি আল্লায় বিশ্বাস করেন, তাহলে তো এটা বোঝার কথা যে মানুষ আল্লাহর বায়োলোজিক্যাল ম্যানিফেস্টেশন। আপনি দয়ালু হলেই আল্লাহ দয়ালু। আপনি নিষ্ঠুর হলে আল্লাহও নিষ্ঠুর।
তারপর ফাতিহার দিকে তাকাই। এর প্রথম আয়াত কী? আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। তো এখানে কী বলা হলো? সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি মহাবিশ্বের রব বা প্রভু। আমি তাফসির ইবনে কাসিরে দেখলাম, এ আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা উচ্চারণের মূল কারণ— মানুষকে আল্লাহ যা যা দিয়েছেন, তার জন্য কৃতজ্ঞতা বা ঋণ স্বীকার করা। অর্থাৎ কারও দ্বারা আপনি উপকৃত হলে, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শিক্ষা এখানে রয়েছে। কিন্তু শিক্ষাটা কি নামাজীরা নিচ্ছে? বাঙালি মুসলমান কি সহজে কারও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চায়? তারা অনেক ওষুধ, ভ্যাক্সিন, ও প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যার পেছনে ইহুদী, খ্রিস্টান, হিন্দু, ও নাস্তিক বিজ্ঞানীদের অবদান রয়েছে। সে-ঋণ কি তারা স্বীকার করে? করে না। উল্টো গালাগালি করে। তাহলে আলহামদুলিল্লাহ পড়ে লাভটা কী হলো? মুখস্ত প্রশংসায় কি আল্লাহর কিছু যায় আসে? প্রশংসা, এপ্রিশিয়েশন, এসব তো বেশি দরকার মানুষের। এক বাঙালি আরেক বাঙালিকে বলে নিমক-হারাম। কেন বলে? কারণ তাদের ভেতর কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। উপকারীর অপকার করতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার।
আরেকটি বিষয় হলো, আল্লাহ কী? আকোর্ডিং টু ইসলামিক বিলিফ, আল্লাহ এমন এক সত্ত্বা, যিনি জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, মহান, ক্ষমাশীল, ন্যায়বিচারক। এখন যদি আমি প্রশ্ন করি, আপনি রাতদিন আল্লাহর প্রশংসা করছেন, আল্লাহু আকবার বলে আল্লাহর মহত্ত্ব ঘোষণা করছেন, আল্লাহ আল্লাহ করে আল্লাহর কান ঝালাপালা করে দিচ্ছেন, কিন্তু আল্লাহর মতো হতে চাইছেন না কেন? আল্লাহ জ্ঞানী, আর আপনি মূর্খ, আল্লাহ ন্যায়বিচারক, আর আপনি ভণ্ড, এতে কি আল্লাহর কোনো লাভ হলো? আল্লাহর একটি গুণও কি ধারণ করার চেষ্টা করছেন? যেসব গুণাবলীর জন্য আল্লাহর প্রশংসা করেন, আল্লাহর নামে সবকিছু শুরু করেন, সেসব গুণাবলী তো মানুষের ভেতরও আছে। মানুষের মাঝে যারা জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, ন্যায়বিচারক, তাদের প্রশংসা কি কখনো করেছেন? তাদের খোঁজখবর রাখছেন? যে-সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস করেন, সেখানে অনেকেই আছেন জ্ঞানী মানুষ, কিন্তু আপনি মুখফুটে তা স্বীকার করছেন না। উল্টো তাদেরকে কীভাবে টেনে খাদে নামানো যায়, মিথ্যে নিন্দা ও কুৎসা প্রচার করা যায়, সে-ব্যবস্থা করছেন। আপনার চোখে কেবল বিশেষ ঘরানার লোকজন জ্ঞানী। আমরা কি বাঙালি নামাজীদের কোনোদিন দেখেছি, নিউটন বা গ্যালিলিওর প্রশংসা করতে? তাদের মুখে বার্ট্রান্ড রাসেল বা ডারউইনের প্রশংসা কোনোদিন শুনতে পাবো? পাবো না। তার মানে কী দাঁড়ালো? সে শুধু মুখস্ত আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন পড়ছে, কিন্তু এর শিক্ষাটুকু নিচ্ছে না।
তার পরের আয়াতটা দেখুন, আর-রাহমানির রাহিম। এখানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমের বক্তব্যই পুনরায় এসেছে। আল্লাহ দয়ালু ও করুণাময়। নামাজীদের ধারণা, দয়ালু আর করুণাময় হওয়ার চাকরিটা শুধু আল্লাহই করবেন, মানুষ নয়। দয়া-মায়া খুব বিস্তৃত ও শক্তিশালী ব্যাপার। শুধু মানুষের প্রতি দয়া নয়, গাছের প্রতি, পাখির প্রতি, গরুর প্রতি, সবকিছুর প্রতিই দয়া থাকা জরুরী। অথচ বাঙালি নামাজীদের অধিকাংশই নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত। মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর অধিকারে সে বিশ্বাস করে না।
তারপর মালিকিয়াও মিদ্দিন। এখানে কী বলা হলো? আল্লাহকে বিচার দিনের মালিক ঘোষণা করা হলো। অর্থাৎ আপনার যাবতীয় কাজকর্মের হিসাব আল্লাহর কাছে একদিন দিতে হবে, এটি স্বীকার করছেন। কিন্তু যে-লোক এ আয়াত পড়ছে, সে কি এমনটা ভাবছে? ভাবছে না। সে দিনরাত মিথ্যে কথা বলছে, ঘৃণা, হিংসা, ক্রোধ, এসবের বশে অন্যের ক্ষতির চেষ্টা করছে, ফেসবুকে ফেইক আইডি খুলে ইসলাম প্রচার করছে, বাস্তবে লুঙ্গিপরা ছেলে, কিন্তু ফেসবুকে প্রোফাইল পিকচার দিয়ে রেখেছে বুরকা পরা সুমাইয়ার, কাজে ফাঁকি দিচ্ছে, ঘুষ খাচ্ছে, লোক ঠকাচ্ছে, শো-অফ করছে, মালিকিয়াউমিদ্দিনের কথা তার মনে পড়ছে না, তাহলে লাভটা কী হলো? সে মুখে বলছে মালিকিয়াও মিদ্দিন, আল্লাহ বিচার দিনের মালিক, কিন্তু কাজকর্মে ঘোষণা দিচ্ছে মিসকিনিয়াও মিদ্দিন। আল্লাহ বিচার দিনের ফকির।
তারপর ঈয়াকা না’বুদু ওয়া ঈয়াকা নাস্তায়ীন। আমরা তোমারই উপাসনা করি, এবং তোমার কাছেই সাহায্য চাই। এই তো? বাঙালি ভাবে, উপাসনা করা মানে শুধু ভক্তি বা পূজা করা। আসলে তা নয়। গাইডেন্স বা পরামর্শ চাওয়াও উপাসনা। আপনি জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ কারও কাছে পরামর্শ চাইছেন, তার দিক-নির্দেশনা মেনে চলছেন, এটি একপ্রকার উপাসনা। এর মানে কী দাঁড়ালো? আপনি নামাজে জ্ঞানী ও ক্ষমতাবান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছেন, কিন্তু বাস্তবে মূর্খ ও ক্ষমতাহীনের কাছে সাহায্য চাইছেন। ক্ষমতা বলতে আমি রাজনীতিক ক্ষমতা বুঝাচ্ছি না। রোগ সারানোর ক্ষমতা আছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের, কিন্তু আপনি যাচ্ছেন ক্ষমতাহীন কবিরাজ ও ঝাঁড়ফুঁকওয়ালা হুজুরের কাছে। আপনি সংকটে জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞজনের সাহায্য চাইবেন, পরামার্শ খুঁজবেন, তাদের সান্নিধ্যে থাকবেন, এটিই তো এ আয়াতের শিক্ষা, নাকি? ঈয়াকা নাস্তায়ীন। অথচ নামাজীরা দেখুন, তারা রাতদিন বাচাল ও নির্বোধ লোকদের মাথায় নিয়ে নাচছে। শীতকালে মিথ্যেবাদী কথাশিল্পীদের ভাড়া করে আনছে। ওয়াজের নামে শুনছে নানা মিথ্যে কথা। কোনো জ্ঞানী লোকের পরামর্শ শুনছে না। ফেসবুক-হুজুরদের কাছে প্রশ্ন পাঠাচ্ছে, মাওলানা সাব, এটা করা কি জায়েজ? এই হলো অবস্থা। এখন আমি যদি বলি, আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করতে চান, কিন্তু সেটা জ্ঞানী লোকের মাধ্যমে, তাহলে? আসলে এরা শুধু সেজদাটুকুই দেয়। কিন্তু কেন দেয়, কাকে দেয়, এটা জানে না। ধর্মব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ে এরা শতকের পর শতক মূর্খ হয়ে আছে।
তারপরের আয়াতটি দেখুন, ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম, এবং কী যেন, হ্যাঁ, সিরাতাল্লাজিনা আন আমতা আলাইহিম। আমাকে সরল পথে পরিচালিত করো, যে-পথে তুমি তোমার আশির্বাদপুষ্টদের, বা প্রিয় মানুষদের পরিচালিত করেছো। এখন বাস্তবতটা দেখুন, নামাজে সে আল্লাহর কাছে সোজা পথে চলার ইচ্ছা প্রকাশ করছে, কিন্তু নামাজের পর যতো বাঁকা পথ আছে, যতো চিপাগলি আছে, সেগুলো দিয়ে চলাফেরা করছে। কোনো কাজই সোজা পথে করছে না। মন সরল করে দায়িত্ব পালন করছে না। সরকারি অফিসকে বানিয়ে ফেলেছে দোকান। সেবাগ্রহীতাকে মনে করছে প্রফিটেবল কাস্টমার। ঘুষ দিচ্ছে, ঘুষ খাচ্ছে। মানুষকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করছে। তো নামাজে ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম পড়ে কী লাভ হলো? নামাজের কোনো শিক্ষাই তো হৃদয়ে ধারণ করা হচ্ছে না।
—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ