01/09/2024
"প্রকৃতিতে ডোয়ার্ফিজম ও জাইগান্টিজম নামে দুটি ঘটনা ঘটে। ঘটনাগুলো এখানে একটু ব্যাখ্যা করছি:
বড় প্রাণীরা, যেমন হাতি, বাঘ, সিংহ, এরা যখন কোনো ছোট ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস শুরু করে, তখন বংশপরম্পরায় এদের আকার ছোট হতে থাকে। তাদের শরীর, মগজ, সবই ধীরে ধীরে খর্বাকায় হয়। কারণ বড় শরীর ধারণের জন্য যে-পরিমাণ খাদ্য দরকার, তা ছোট দ্বীপ বা এলাকায় পাওয়া যায় না। ফলে টিকে থাকার তাগিদে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, প্রাণীগুলোর আকার খর্ব হয়ে আসে, যেন কম খাবারে বেশিদিন বাঁচা যায়। বড় অতিকায় প্রাণী তখন পরিণত হয় বেঁটে জন্তুতে।
অন্যদিকে ছোট প্রাণীরা, যেমন ইঁদুর, ছুঁচো, টিকটিকি, এগুলো ওই পরিবেশে বংশ পরম্পরায় বড় হতে থাকে। কারণ ছোট দ্বীপে বড় প্রাণীর খাবার কম থাকলেও, ছোট প্রাণীর খাবার থাকে অঢেল। প্রিডেটর বা শিকারী প্রাণীর ভয়ও সেখানে কম। ফলে ছোট প্রাণীগুলো নির্ভয়ে প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে পারে। এতে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, ছোট প্রাণী পরিণত হয় বড় প্রাণীতে।
উদাহরণ হিশেবে মাদাগাস্কার, সার্ডিনিয়া, ও মৌরিশাসের কথা বলা যায়। ওখানে ইঁদুর, টিকটিকি, কোমোডো, এসব প্রাণী দানবাকৃতির, কিন্তু হাতি, ছাগল, জলহস্তী, এগুলো খর্বাকৃতির।
এই যে কোনো এলাকায়, রসদের অভাবে বড় প্রাণীর ছোট হয়ে যাওয়া, এটি হলো ডোয়ার্ফিজম; আর রসদের প্রাচুর্যে, ছোট প্রাণীর বড় হয়ে যাওয়া, এটি হলো জাইগান্টিজম।
আমি ভেবে দেখেছি, ইভোলিউশোনারি বায়োলোজির এ চমৎকার ধারণাটি সংস্কৃতি, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, এগুলোতেও প্রয়োগ করা যায়। গভীর চোখে তাকালে দেখতে পাই, জাইগান্টিজম ও ডোয়ার্ফিজম, প্রাণিজগতের মতো সমাজেও প্রতিদিন ঘটে চলছে।
কোনো এলাকায় মহৎ সাহিত্য, মহৎ দর্শন, মহৎ শিল্পকলা, মহৎ বৈজ্ঞানিক চিন্তা, উঁচু রাজনীতিক ভাবনা, এগুলোর গ্রাহক যদি কমে যায়, বা এপ্রিশিয়েশন উধাও হয়ে যায়, তাহলে ওই এলাকায় প্রতিভাবান মহৎ মানুষের সংখ্যা, ধীরে ধীরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, কমতে থাকে। ফলে যা কিছু উঁচু ও মহৎ, তার আকার ও প্রভাব আস্তে আস্তে বেঁটে ও খর্বাকায় হতে শুরু করে। অর্থাৎ হাই-আর্ট ও হাই-কালচার পর্যবসিত হয় নিম্নমানের মেঠো-শিল্পকলা ও মেঠো-সংস্কৃতিতে। উঁচু সভ্যতা ক্ষয় হয়ে রূপ ধারণ করে বামন-সভ্যতার।
সংস্কৃতির রসদ ও খাদ্য মূলত সমাজের বাসিন্দারা। বাসিন্দাদের কর্মকাণ্ডেই সংস্কৃতি বেঁচে থাকে। তাদের রুচির ওপরই দর্শন, শিল্পকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, এগুলোর বিকাশ ও বিস্তার নির্ভর করে। উঁচু সাহিত্য, উঁচু দর্শন, উঁচু শিল্পকলার জন্য দায়ী মানুষের উঁচু রুচিবোধ। সমাজে মানুষের গড় রুচিবোধ নিচে নেমে গেলে, হাই-আর্ট ও হাই-থট এপ্রিশিয়েট করার মতো মগজ মানুষের মাথা থেকে হারিয়ে গেলে, সেখানে বিকাশ ঘটে বেঁটে সাহিত্য, বেঁটে দর্শন, বেঁটে বিজ্ঞান, ও বেঁটে শিল্পকলার। গৌণ বিষয়াদি তখন বিরাজ করতে থাকে মুখ্য রূপে। বেঁটে সংস্কৃতিরা পায় উঁচু সংস্কৃতির মর্যাদা।
সংস্কৃতি কী? লর্ড রাগলান বলতেন— মানুষ যা করে, আর বানর যা করে না, তাই সংস্কৃতি। কিন্তু বাংলাদেশে মনে হচ্ছে, বানরদের কাজকর্মই সংস্কৃতির প্রধান শাখা। লোকজন এখানে শরীর ধারণ করছে মানুষের, আর মন ধারণ করছে বানরের (বাস্তবের সুবোধ বানর নয়, কল্পনার নির্বোধ বানর; কারণ আমরা যা করছি, তা জঙ্গলের বানর করে না)। গোশালাকে বলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়, স্ক্রিপচারকে ডাকছি বিজ্ঞান, পাগলামোকে বলছি রাজনীতি। অ্যারিস্টোটল এ সমাজে বড় হলে তাঁকে ডক্টর ইউনূসের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে হতো। বার্ট্রান্ড রাসেলকে দেখা যেতো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কোনো আহাম্মকী পদে। রবীন্দ্রনাথকে খাতির রাখতে হতো শাহবাগ থানার ওসির সাথে। অর্থাৎ কালচারাল ডোয়ার্ফিজম এখানে প্রকট। প্রতিভাবানরা টিকে থাকার তাগিদে প্রতিভা কমিয়ে ফেলছে। উঁচু সংস্কৃতি কদর হারিয়ে পরিণত হচ্ছে বেঁটে সংস্কৃতিতে। আর এই ফাঁকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বিসিএস গাইড, স্পোকেন ইংলিশ, জায়েদ খান, হিরো আলম, আহমদুল্লাহ, আয়মান সাদিক, সেলেব্রিটিজম, মোটিভেশোনাল স্পিচ, বিটিএস, এসব। এ জঙ্গলে এগুলোই এখন মেইনস্ট্রিম জাইগান্টিক এনিম্যাল।"
—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
পৃষ্ঠা ১৩-১৫, বই: মূর্তিভাঙা প্রকল্প