14/11/2022
_____ জলিল উদ্দিনের একমাত্র মেয়ের নাম চিত্রা। অল্প বয়স। মায়াবী চোখ।
তিন বছর আগে চিত্রা ক্যান্সারে মারা যায়। মারা যাবার আগে তার রক্তের দরকার পড়ল। মোট ছয় ব্যাগ। রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। দূর্লভ রক্ত। কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। রক্তরক্ত করতে করতে তিনি পাগল হলেন। উদভ্রান্তের মত ছোটাছুটি করেও কাজ হল না।
রংপুর মেডিকেলের দুইজন ছাত্র রক্ত সংগ্রহে নেমে পড়ল। পুরো রংপুর বিভাগ খুজে চারজন রক্তদাতাকে খুজে বের করল। চারজন মিলে ভাগা দিয়ে ছয় ব্যাগ রক্ত দিল।
রক্ত দিয়ে লাভ হল না। যে রাতে রক্ত পেল, সেই রাতেই চিত্রা মারা গেল। রাতে পূর্ণিমা ছিল। পূর্ব আকাশে দুধের মত ধবধবে সাদা চাঁদ।। জলিল উদ্দিন পাগলের মত হয়ে গেলেন। সারারাত হাসপাতালের বাইরে ঘাসের উপর গড়াগড়ি করে কাঁদলেন।
তিন বছর পার হল। এই দীর্ঘ সময় জলিল সাহেব গা ঢাকা দিয়েছিলেন। দেখা হলেও খুব একটা কথা বলতেন না। মাঝেমাঝে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডে দেখা হয়। ঢাকা,-খুলনা-চট্টগ্রাম দেশময় ঘুরে বেড়ান। দৌড়ের উপর ব্যস্ততার সাথে জিজ্ঞাসা করেন,
-কেমন আছো ডাক্তার?
হাসিমুখে জবাব দিই। একবার জিজ্ঞাসা করলাম,
-চিত্রা মামনি....
উনি শেষ করতে দিলেন না। অতি ব্যস্তপায়ে চলে গেলেন। যাবার সময় ফিসফিস করে বললেন,
-হু ইজ চিত্রা?
-কি আশ্চর্য! আপনার মে...
-চিত্রাকে ভুলে গেছি। যে মেয়ে বাবাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়, তাকে তার বাবাও ফাঁকি দিবে। সিম্পল ম্যাথ।
জলিল সাহেবের উপর মেজাজ খারাপ হল। এরপর থেকেযতবার দেখা হয় ততবার আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যপথে হাঁটা দিই। উনি আগ্রহ নিয়ে মাঝেমাঝে ডাকেন,
-ডাক্তার সাহেব?
দীর্ঘদিন জলিল সাহেবের খোঁজখবর নেই। গতকাল হঠাৎ দেখা দিলেন। হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-আপনাকে খুঁজে পেতে যথেষ্ট কষ্ট হয়েছে। আগামীকাল, আসতেই হবে।
চিঠিতে কিছু লেখা নেই। ধবধবে সাদা পাতা। কোনায় ছোট্ট করে হাতে লেখা, '১৪ অক্টোবর '।
১৪ অক্টোবর তারিখের বিশেষত্ব আছে। এইদিন চিত্রা মারা যায়। জলিল সাহেব এই বিশেষ দিনে একমাত্র কণ্যাকে হারিয়ে ঘাসের উপর গড়াগড়ি করেছিলেন।
আজ ১৪ অক্টোবর।
প্রান্তর জুড়ে পূর্ণিমা। আকাশে টাইলসের মত সাদা চাঁদ। জলিল সাহেবের বাড়ির আঙ্গিনায় বিশাল টেবিল পাতা হচ্ছে। খানাপিনার ব্যাপক আয়োজন চলছে। দুইজন রাধুনী ইটের চুলোয় আয়েশি ভঙ্গিমায় রান্না করছে। দশফুটি চামচ দিয়ে মাংস নাড়ানাড়ি করছে।
জলিল সাহেবও ছোটাছুটি করছেন। একবার দুই মিনিট সময় করে পাশে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন,
-ডাক্তার সাহেব, মেয়ের জন্য রক্ত নিয়েছিলাম ছয় ব্যাগ। মেয়ে বাঁচে নাই। সেই রক্ত তো শোধ দিতে হবে। তাই না?
-জ্বি!
-তিন বছরে শোধ দিয়েছি। পার ইয়ার দুই ব্যাগ। সারাদেশ ঘুরে ঘুরে ক্যান্সার আক্রান্ত মেয়েদের দিয়েছি।
-ছেলেদের দেননি কেন?
-ইচ্ছা হয় নাক।
-সবাই ক্যান্সারের প্যাশেন্ট?
-ইয়েস ডাক্তার!
-চিত্রার কথা কিছু বলুন!
জলিল সাহেব আবার বিরক্ত হয়ে বললেন, 'হু ইজ চিত্রা? আই ফরগট হার!'
জলিল সাহেব আবার ছোটাছুটি শুরু করলেন। ভদ্রলোককে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি রক্তের ঋণের কথা স্মরণ রেখেছিলেন। গত তিন বছরে ছয়জন মেয়েকে নিজের দূর্লভ রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সহজ ব্যাপার নয়।
রাত নয়টা।
জলিল সাহেবের বাড়ির সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘাসের আঙ্গিনায় টেবিল পাতা হয়েছে। লম্বা ভাড়ার টেবিল। টেবিল ভরা বিভিন্ন পদের রান্না। টেবিলের একদিকে জলিল সাহেব বসেছেন। তার পাশে আমরা বসেছি। টেবিলের অন্য পাশে ছয়জন মেয়ে। সবাই ক্যান্সার আক্রান্ত। হাড্ডিসার শরীর। চোখ গর্তে ঢুকে গেছে। কিন্তু চোখেমুখে হাসি। হাসিমুখের মেয়েগুলো সবাই চিত্রার বয়সী!
জলিল সাহেব উল্লসিত হয়ে বললেন,
মামনিরা ডাক্তার সাহেবদের পরিচয় দাও!
প্রথমজন বলল,
-আমি চিত্রা। খুলনা।
আমরা ধাক্কা খেলাম।
পরেরজন বলল,
-আমিও চিত্রা। চট্টগ্রাম। আনোয়ারা।
আমরা বড়সড় ধাক্কা খেলাম। তৃতীয়জন বলল,
-আমার নামও চিত্রা। বাসা কুড়িগ্রাম। রাজারহাট।
এতবড় ধাক্কা নেবার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। ছয়জন ছোট ছোট মেয়ে একসাথে বসে আছে। সবার ক্যান্সার। বিচিত্রভাবে সবারই নাম এক। জলিল সাহেবের উপর একটা রাগ ছিল। কেন তিনি চিত্রার কথা বলতেন না?
আশ্চর্য ব্যাপার হল তিনি মেয়েকে ভোলেন নি। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে নিজের মেয়ের নামে একই ব্ল্যাডগ্রুপের মেয়েদের খুঁজে খুঁজে একত্র করেছেন। কি বিচিত্র!
রাত বারোটা বাজছে।
আকাশে দুধের মত ধবধবে সাদা চাঁদ। জোঁছনায় ভেসে যাচ্ছে বিজন প্রান্তর। জলিল সাহেব তার বাড়ির উঠোনে চিত্রাদের নিয়ে খোশগল্প করছেন।
-অক্টোবর,২০১৬
লিখেছেন, রাজীব হোসাইন সরকার
ছবি প্রতীকী