14/05/2024
ঈশ্বরের পদচিহ্ন (একটি সত্য ঘটনা )
শুভ্র চ্যাটার্জি
আমি তখন হিমাচল প্রদেশ এর বাদ্দি তে কর্মরত। বাদ্দি সোলান জেলাতে অবস্থিত একটি এক্সাইজ ফ্রী জোন, যেখানে ভারতবর্ষের তাবড় তাবড় কোম্পানির প্ল্যান্ট বিরাজমান।
আমি আমার কোম্পানি র কারখানা সংলগ্ন দোতলা বাংলোতে থাকি ( দোতলা বাংলো একটু সোনার পাথরবাটির মত শোনায় যদিও ) । নিচের তলায় আমার অফিস। ওপরতলায় আমার দুই নেপালি কুক , ডাইনিং হল , প্যান্ট্রি ও আমার বেডরুম । নিচের তলায় আমার চেম্বার ছাড়াও আমার চিফ একাউন্টেন্ট শ্রীবাস্তব, এসিস্টেন্ট শর্মা ও ফ্যাক্টরি ইনচার্জ নরেশকুমারের কোয়ার্টার ও অফিস। আর বিশাল ফ্যাক্টরির পিছন দিকে আমার ড্রাইভার ও কেয়ার টেকারের কোয়ার্টার্স।
একেবারে ঘড়ি ধরে চলা জীবন। সকাল সাড়ে ছটায় চমৎকার বেড টি। সকাল আট টা র মধ্যে চান করে, ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট এর টেবিলে হাজিরা। ঘি বা বাটার মাখান পরোটা, আচার ও শেষে চমৎকার আর এক কাপ চা খেয়ে নিচের অফিসে । আবার দশটার সময় আর এক কাপ চা চেম্বারে। কাঁটা ধরে দুপুর একটায় লাঞ্চ ( যদিও সম্পূর্ণ নিরামিষ )! আবার বিকেল চার টে য় আর এক প্রস্থ চা। আমার কাজ সারতে সারতে সাধারণত সাত টা বেজে যেতো । কখনো কখনো নয়টা অবধি কাজ করতাম। তারপর ওপরে উঠতাম। যেদিন তাড়াতাড়ি হত সেদিন একটু হাঁটতে বেরোতাম ফ্যাক্টরি র চত্বরের বাইরে। বাইরে যদিও কুলি কামিনদের ভিড় ই বেশী । আমার অফিসে এক কসম্মপলিটন আবহাওয়া। শ্রীবাস্তব মুম্বাই এর লোক, শর্মা দিল্লির, এইচ আর অফিসার সোমন আবার দক্ষিণ ভারতীয় । নরেশ জি ও তার ডান হাত মুকেশ কুমার দুই বিশাল দেহী ই হরিয়ানার লোক। আবার কারখানার শ্রমিকরা সবাইই হিমাচলের ভূমিপুত্র। প্ল্যান্ট হেড হিসাবে এদেরকে সামলানো এক নতুন ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা ছিলো। তবে বাংলা বলতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠতাম মাঝে মাঝে। গোটা বাদ্দি তে বাঙালি ছিলো হাতে গুনে কয়েকজন , তাও তার সন্ধান পেয়েছিলাম অনেক পরে। তার মধ্যে একজন ছিলেন রেকিট এন্ড কোলম্যান এর অমিত মুখার্জী। সে যাই হোক, আমাদের ক্লায়েন্ট ছিলো কোলগেট, ডাবর, নিকলাস পিরামল, জ্যোতি ল্যাবরেটরিস (উজালা ) , রেকিট এন্ড কোলম্যান ( কলিন ) , কোক, শ ওয়ালেশ ....এমন অনেক নামী ব্র্যান্ড। কোলগেট অফিসে বন্ধুত্ব হয়েছিল তৎকালীন ভি.পি. র সঙ্গে যিনি ঘটনাচক্রে কপিলদেবের বন্ধু ছিলেন এবং যার ফলশ্রুতি কপিলদেবের বিখ্যাত বিজ্ঞাপন " পামলিভ কা জবাব নেহি .."!
যাই হোক, হয়তো ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে, তবু এগুলো না বললে আমার বর্ণনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রায় প্রতি শনিবার গাড়ি নিয়ে যেতাম কালকা হয়ে চন্ডিগড় । এক শনিবারে চন্ডিগড় এসে একটা বিসনেস লিড পেয়ে পরের সোমবার ই আমার ড্রাইভার কে নিয়ে রওনা দিলাম সকাল সকাল । যাবো নালাগড় । যাই হোক বর্ধমান গ্রূপের বিশাল এলাকা পেরিয়ে একসময় পৌঁছলাম গন্তব্যে। অতঃপর সারাদিন মিটিং ...খাওয়াদাওয়াতে কেটে গেল। বেরোতে বেরোতে প্রায় বিকেল। মিনিট পনেরো আসার পর হঠাৎ ঝুপ করে পাহাড়ে যেন সন্ধ্যে নেমে এলো ....কোথা থেকে উড়ে এসেছে এক ঝাঁক কালো মেঘ ; আর ভালো করে বুঝতে না বুঝতেই নেমে এলো তুমুল বৃষ্টি ! আর সে কি বৃষ্টি ! গাড়ির ওয়াইপার উইন্ডস্ক্রিন পরিষ্কার করতে ব্যর্থ ....খুবই রিস্ক নিয়ে গাড়ি চলছে । এমন সময় আমার টাটা সুমো প্রবল ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়লো। আসার সময় পার হয়ে আসা প্রায় শুকনো পাহাড়ি
ঝোরা কোন এক মন্ত্রবলে এক দুরন্ত পাহাড়ি নদী তে রূপান্তরিত হয়ে সামনের রাস্তা কে প্রায় অদৃশ্য করে বয়ে চলেছে। চিরকালের প্রকৃতি প্রেমী বিশেষ ত পাহাড় প্রেমী আমিও ঐ দৃশ্য দেখে চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার তরুণ শিখ ড্রাইভার তাও সাহসে ভর করে সুমো নিয়ে এগোতে গেলো....
কিন্তু তীব্র জলস্রোতে গাড়ি খাদের দিকে সরে যেতে লাগলো। প্রবল আতঙ্ক তখন আমাদের গ্রাস করেছে.......এমন সময় আমাদের গাড়ি কিসে যেন আটকে গেল ; ড্রাইভার আর আমি গাড়ি থেকে প্রায় লাফ দিয়ে নেমে এসে পরস্পর কে ধরে কোনোরকমে ঐ তীব্র জলস্রোত পেরিয়ে এলাম। দেখলাম একটা বিশাল বোলডারে গাড়ি আটকে আছে । আমার ড্রাইভার বললো ' সাব , আপ পয়দলমে নিকাল যাও জিতনা সকে ....' ! আমি বললাম ওকে ফেলে আমি যাবো না, কিন্তু ওর যুক্তি যে পাহাড়ি বৃষ্টি একটু পর থেমে গেলে জলস্রোত ও কমে যাবে, ও তখন গাড়ি নিয়ে আসবে। গাড়ি ছেড়ে যাওয়া টা ঠিক হবে না। ভেবে দেখলাম, ও ঠিক ই বলছে। বৃষ্টি তখন শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে আমি সামনে দিকে রওনা দিলাম । কিন্তু একটু এগিয়েই চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে , বৃষ্টির মধ্যে রাস্তা, খাদ আলাদা করে বোঝাই দায়। তার ওপর মাথার ওপরের পাহাড়ে কেমন গুম গুম শব্দ মনে আরো আতঙ্ক ধরিয়ে দিচ্ছে! মনে হচ্ছে যে কোন সময় পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়বে পাথর ..! 2008 সালের গোড়া র মোবাইলে টর্চ তো যেমন জোরালো ছিলো না , তার ওপর বৃষ্টির দরুণ মোবাইল বার করাও যাচ্ছে না ...ব্যাগ এর ভেতর থাকা মোবাইল জলের প্রকোপ থেকে বেঁচে আছে কিনা তাই ই বোঝা যাচ্ছে না। তার মধ্যেই মরিয়া হয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু সামান্য পরেই একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়া পরিস্থিতি হলো। নিশ্চ্ছিদ্র অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পড়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম, নিঃসীম অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করে ঝরে পড়া তুমুল বারিধারা ছাড়া আর কিছু নজরে এলোনা। আবার এগোনোর চেষ্টা করে একেবারে দিশা হারিয়ে ফেললাম। সামনে যাবো, না ডান দিকে যাবো না বাঁদিকে যাবো কিচ্ছু বুঝতে না পেরে অসহায় এর মতো দাঁড়িয়ে গেলাম । অথচ এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে থাকাও অসম্ভব। কিন্তু এগোনোর চেষ্টা করতে গিয়ে কিছুই ঠাহর হলো না। আমি রীতিমতো অসহায় বোধ করতে লাগলাম।
নিরুপায় আমি লোকনাথ বাবাকে স্মরণ করতে লাগলাম ( জানি অনেকেই ব্যাঙ্গের হাসি হাসবেন, কিন্তু মাথার ওপর আকাশ ভাঙা বৃষ্টির মধ্যে সম্পূর্ণ অচেনা পাহাড়ি চরাচরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে খাদে পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক যখন গ্রাস করে, যুক্তি তখন কাজ করে না).........!
সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়েও পা থমকে যাচ্ছে, কারণ বুঝছি না ঠিক দিকে নাকি খাদের দিকে যাচ্ছি এতটাই ঘন কালো অন্ধকার। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠলো ...আর সেই আলোতে দেখলাম গজ দশেক দূরে একটা মানুষ যেন হেঁটে যাচ্ছে ! হাতে চাঁদ পেলাম যেন. ... লোকটার চলন লক্ষ্য করে একটু তাড়াতাড়ি পা চালালাম। অন্ধকারের মধ্যেও একটা সাদা অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ডুবন্ত মানুষ যেমন করে খড়কুটোও আঁকড়ে ধরে, তেমন করে আমিও ঐ ছায়া অবয়ব কে ফলো করে এগোতে লাগলাম সমস্ত টুকু মনসংযোগ দিয়ে।
এই ভাবে কতক্ষণ চলেছি জানিনা, হঠাৎ অনুভব করতে লাগলাম, পায়ের তলা থেকে জল স্রোত ভ্যানিস হয়ে গেছে ...পথ চলা টা যেন একটু সহজ হয়ে গেছে ...অন্ধকার টা ও যেন একটু পাতলা হয়ে এসেছে ..! কারণ টা বুঝতে পারলাম, আলো দেখা যাচ্ছে ...একটা দোকান যেন! প্রাণ ফিরে এলাম যেন । মনে মনে লোকনাথ বাবা কে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে খেয়াল হলো : আরে, সামনের লোক টা কোথায় গেল ..! ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দেখতে পেলাম না কাউকে ! প্রচন্ড বিস্মিত আমি হঠাৎ কেমন যেন একটা ধাক্কা খেলাম ..। তাহলে , ঐ ছায়া অবয়ব কি ........!! আজও জানি না ! কিন্তু যা বললাম তার এক বর্ণ ও মিথ্যে নয় । আমার কাছে কোন ব্যাখ্যা নেই , শুধু মনে করি ঈশ্বর ই সেদিন পথ দেখিয়েছিলেন । তাঁর পদচিহ্ন অনুসরণ করেই রক্ষা পেয়েছিলাম বুঝি ..!