03/07/2024
অর্পিতা একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তার স্বামী সাজ্জাদও তাই। তবে সে অন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়।
ছেলের মা হওয়ার তৃতীয় দিনের মাথায় সাজ্জাদ অর্পিতাকে বললো,"এবার চাকরিটা ছেড়ে দাও।"
অর্পিতা অবাক হয়ে বললো,"চাকরি ছাড়ার কথা আসছে কেনো?"
সাজ্জাদ বিরক্ত হয়ে বললো,"চাকরি না ছাড়লে ছেলের দেখাশোনা করবে কীভাবে?"
"সন্তান দেখাশোনা করার দায়িত্ব কি মা'র একার? বাবার নয়?"
"সব সময় তর্ক ভালো লাগে না। না বুঝে কথা বলবে না।"
"কোন কথাটা না বুঝে বললাম?"
"তুমি তাহলে চাকরি ছাড়বে না?"
অর্পিতা দৃঢ় কণ্ঠে বললো,"না।"
"তাহলে ছেলের কী হবে?"
"সে ভাবনা কি শুধু আমার? তোমার নয়? সন্তান দেখাশোনার জন্য আমাকেই কেনো চাকরি ছাড়তে হবে? তুমিও তো চাকরি ছাড়তে পারো?"
"ননসেন্স!"
"ননসেন্স আমি নই, তুমি ননসেন্সের মতো কথা বলছো। সন্তান যদি দুজনের হয়, তাহলে সন্তান দেখাশোনার কাজ উভয়ের নয় কেনো?"
"তোমার সাথে কথা বলা অর্থহীন। আমরা দুজন কাজে চলে গেলে বাসায় তো আর কেউ থাকে না। তখন বাচ্চাকে দেখবে কে? আমার মা কিংবা তোমার মা দুজনের একজন যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে না হয় ছেলের দেখাশোনার ভার তার ওপর দেয়া যেতো। এখন তো সে উপায় নেই। আর সেজন্যই তোমাকে চাকরি ছাড়ার কথা বলছি।"
জবাবে অর্পিতা যা বললো তার জন্য সাজ্জাদ প্রস্তুত ছিলো না।
অর্পিতা বললো,"আমি ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো।"
কথা শুনে সাজ্জাদ অর্পিতার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলো।
সে বুঝলো, অর্পিতাকে আর কিছু বলে লাভ নেই। সাজ্জাদ রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় অসন্তুষ্ট গলায় বললো,"একটা কথা যদি তুমি আমার শুনতে?"
পেছন থেকে অর্পিতা উত্তর দিলো,"অযৌক্তিক কথা শোনার কোনো প্রয়োজন দেখি না।"
২.
অর্পিতা ছেলেকে সঙ্গে করে ভার্সিটিতে নিয়ে যায়। অধিকাংশ সময় বাচ্চাকে তার সঙ্গে রাখে। তবে ক্লাসের সময় বাচ্চাকে কখনো রাখে কোনো ম্যাডামের কাছে, কখনো কোনো ছাত্রীর কাছে। ক্লাস নেয়া, অফিসিয়াল বিভিন্ন মিটিং এ থাকা এবং ছেলের দেখাশোনা করা সে সমান ভাবে করে যেতে লাগলো। এতে তার পরিশ্রম দ্বিগুণ হতে লাগলো।
এভাবে কেটে গেলো দু বছর।
তারপর এক রাতে সাজ্জাদ অর্পিতাকে বললো,"আমি দ্বিতীয় সন্তান নিতে চাইছি।"
অর্পিতা স্পষ্ট জবাব দিলো,"আমি চাইছি না।"
সাজ্জাদ কিছুটা রেগে গিয়ে বললো,"কেনো?"
"তুমি কি অন্ধ? দেখতে পাও না কেনো এই কথা বললাম? এক সন্তান সামলাতে আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আরেকজন হলে সামলাবো কীভাবে?"
"এজন্যই তো বলছি চাকরি ছেড়ে দিতে। তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।"
"চাকরি তুমি ছাড়লেও তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমাকেই কেনো ছাড়তে হবে?"
"পাগলের মতো কথা বলো কেনো? কোথাও দেখেছো সন্তান দেখাশোনার জন্য বাবা চাকরি ছেড়েছে? সন্তান দেখাশোনার জন্য আজ যদি আমি চাকরি ছেড়ে দিই, তাহলে মানুষে কী বলবে? হাসির পাত্র হবো আমি। কিন্তু তুমি চাকরি ছাড়লে কেউ কিছু বলবে না। কারণ সংসারের জন্য মেয়েরা চাকরি ছাড়ছে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কেউ এতে কিছু মনে করে না।"
"দশজনে অন্যায় করলে সেটা আমাকেও করতে হবে? সংসার দেখাশোনার জন্য শুধুমাত্র মেয়েদেরই চাকরি ছাড়তে হবে, এটা যে অন্যায় সেটা বুঝতে পারছো না?"
তারপর বললো,"সন্তানের জন্য এতোই যদি তোমার ভালোবাসা থাকে, তাহলে তার জন্য চাকরি ছেড়ে ঘরে থাকো। আর নতুবা আমার মতো বাচ্চা নিয়ে তোমাকে ভার্সিটিতে যেতে হবে। যদি তা পারো, তবে দ্বিতীয় সন্তানের মা হতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু দুটোর একটাও যদি করতে না পারো, তাহলে আবার সন্তান নেয়ার কথা মুখেও আনবে না।"
"আমি বাচ্চা নিয়ে ভার্সিটিতে পড়াতে যাবো? এমন উদ্ভট কথা তোমার মাথায় এলো কী করে?"
"আমি বাচ্চা নিয়ে কাজে গেলে উদ্ভট হয় না। আর তুমি গেলে উদ্ভট হয়ে যায়?"
"এভাবে উল্টাপাল্টা কথা বললে তো সংসার করা সম্ভব হবে না। সব সময় ঝগড়া। একটা কথা যদি তুমি আমার শুনতে?"
"উল্টোপাল্টা কথা আমি নই, তুমি বলো। ঝগড়া আমি নই, তুমি করো। আর তোমার সাথে সংসার করার কথা বলছো? গত দুটো বছর ধরে বাচ্চাটাকে নিয়ে কী পরিমাণ অমানুষিক পরিশ্রম করে যাচ্ছি তা দেখার পরও যে পুরুষ স্ত্রীকে সাহায্য না করে তাকে পাগল বলে, সে পুরুষের সাথে সংসার করার কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না।"
"তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো। তুমি কী বলছো বুঝতে পারছো?"
"ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি আমি কী বলছি।"
"এই তোমার শেষ কথা?"
অর্পিতা কথার জবাব না দিয়ে বিছানা থেকে নামলো।৷ এবং ওয়ার্ডরোব থেকে তার কাপড়গুলো নিয়ে লাগেজে ঢোকাতে লাগলো।
দৃশ্যটি দেখে সাজ্জাদ বললো,"কী করছো তুমি?"
"ছেলেকে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। কারণ ছেলেকে যে তোমার কাছে রেখে যাবো তার তো উপায় নেই। ছেলেকে দেখাশোনা করা তো তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।"
"তোমাকে বিয়ে করাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল ছিলো।"
"আমারো তাই।"
তারপরই ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে লাগেজ হাতে অর্পিতা ঐ রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
৩.
চার মাস পরের ঘটনা।
সাজ্জাদ এক দুপুরে ভার্সিটি থেকে বাসে করে বাসায় আসছিলো। হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখতে পেলো, একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্পিতা। বোধহয় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছে। ঝাঁঝাঁ রোদে এক হাতে ছাতা আর অন্য হাতে ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্পিতার কপাল, গলা ঘামে সিক্ত। ছাতা ধরা হাতে শাড়ির আঁচল দিয়ে মাঝে মাঝে সে ঘাম মুছছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। কিছুটা রোগা হয়েছে। বুঝতে সমস্যা হয় না যে, অনেক পরিশ্রম করছে মেয়েটা।
সাজ্জাদ যতোক্ষণ পেরেছে জানালা দিয়ে অর্পিতাকে দেখেছে। অনেকদিন পর অর্পিতাকে ওভাবে দেখে তার মন খানিকটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো। সে ভাবলো, এই বিষণ্ণতা সাময়িক। পরে কাজের চাপে এটা চলে যাবে। কিন্তু সে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, অর্পিতাকে দেখার ঐ দুপুরে জন্ম নেয়া খানিক বিষণ্ণতার পরিমাণ না কমে দিন দিন বাড়তে লাগলো। ঝাঁঝাঁ দুপুরে ছেলেকে কোলে নিয়ে ছাতা হাতে ঘর্মাক্ত ক্লান্ত অর্পিতার দাঁড়িয়ে থাকার ছবিটি বারে বারে তার চোখের সামনে ফিরে আসতে লাগলো। সে হয়তো ক্লাস রুমে পড়াচ্ছে। হঠাৎ দেখতে পায় তার সামনে ভেসে উঠছে অর্পিতার দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটি। সে তখন পড়ানো ভুলে চুপ হয়ে যায়। গাঢ় বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে সে চেয়ারে বসে থাকে। ছেলেমেয়েরা এক সময় জানতে চায়,"স্যার কি অসুস্থ বোধ করছেন?"
সে কোনো রকমে জবাব দেয়,"না আমি ঠিক আছি।"
মুখে যদিও বলে, ঠিক আছি। আসলে সে একেবারেই ঠিক নেই।
একই ঘটনা ঘটে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময়ও। কথা বলতে বলতে আচমকা সে নীরব হয়ে যায়। কারণ তখন তার সামনে ভেসে উঠেছে অর্পিতার দাঁড়িয়ে থাকার ছবিটি। তাকে দীর্ঘ সময় ঝিম মেরে থাকতে দেখে বন্ধুরা জানতে চায়,"কীরে কী হলো? কোনো সমস্যা?"
সে আড়ষ্ট হেসে উত্তর দেয়,"না, কোনো সমস্যা নেই। আমি ঠিক আছি।"
অবশ্য এ কথা বলার কিছু সময় পরই সে পুনরায় নিশ্চুপ হয়ে যায়।
আর যখন একা থাকে তখন এই বিষণ্ণতা আরো গাঢ় হয়ে তাকে ঘিরে ধরে।
ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে বাস যখন ঐ মোড় দিয়ে যায়, সে তাকিয়ে দেখে ঐ জায়গাটাতে, যেখানে অর্পিতাকে দেখেছিলো। সে আবার অর্পিতাকে দেখতে চায়। কিন্তু দেখতে পায় না। তবু আগ্রহ নিয়ে, গাঢ় বিষণ্ণতা নিয়ে সে চেয়ে থাকে।
৪.
এক ছুটির দিনে ঘন বর্ষার দুপুরে অর্পিতা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিল। হঠাৎ সে শুনতে পেলো কে যেনো তাকে শব্দ করে জোরে জোরে ডাকছে,"অর্পিতা, অর্পিতা...।"
কিন্তু এই বৃষ্টির দুপুরে এভাবে চিৎকার করে কে তাকে ডাকবে? সে ভাবলো ভুল শুনছে। বৃষ্টির শব্দের কারণে হয়তো এমন মনে হচ্ছে। কিন্তু সে আবারো শুনতে পেলো,"অর্পিতা অর্পিতা...।"
অর্পিতা কৌতূহল নিয়ে বারান্দায় গেলো। অর্পিতারা দোতলায় থাকে। গিয়ে দেখলো, ঝুম বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সাজ্জাদ। অঝোরে ভিজছে সে।
একজন পুরুষকে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে অর্পিতা অর্পিতা..বলে ডাকতে দেখে আশেপাশের বাড়ির অনেকে, কেউ বারান্দা থেকে, কেউ জানালা থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো।
অর্পিতাকে বারান্দায় দেখে সাজ্জাদ নিচ থেকে গভীর অনুরাগে বললো,"অর্পিতা, কেমন আছো?"
অর্পিতা কিছু না বলে শুধু বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলো।
এরপর সাজ্জাদ বললো,"আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।"
প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার পর অর্পিতা জানতে চাইলো,"এসবের মানে কী?"
"মানে হলো, এখন থেকে ঘরে থেকে সংসার সামলাবো। বাচ্চার দেখাশোনা করবো। কথা দিচ্ছি।"
সাজ্জাদের কথা শুনে বারান্দায়, জানালায় উঁকি দেয়া মানুষগুলো মুখ চেপে হাসতে লাগলো।
কিন্তু অর্পিতার হাসি এলো না। বরঞ্চ রাগ হলো। এই উজবুকটা তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। এতো সহজে কি তাকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে?
অর্পিতা ক্রুদ্ধ স্বরে বললো,"পুরো দুপুর দাঁড়িয়ে থেকে ভিজবে। এবং কান ধরে উঠবোস করবে।"
উত্তরে সাজ্জাদ বললো,"শুধু এক দুপুর কেনো, তুমি বললে বাকি জীবনটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজবো। আর কান ধরে উঠবোস করবো।"
এই বলে সে কান ধরে উঠবোস করতে শুরু করলো।
সাজ্জাদকে বৃষ্টির মধ্যে কান ধরে উঠবোস করতে দেখে আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলোর হাসির মাত্রা বেড়ে গেলো।
এরপর অর্পিতা বললো,"পুরুষ হয়ে চাকরি ছেড়ে ঘরে থেকে সংসার দেখবে, বাচ্চা সামলাবে, মানুষ শুনলে হাসবে যে? তখন খারাপ লাগবে না?"
সাজ্জাদ হাসতে থাকা আশেপাশের বাড়ির মানুষগুলোকে দেখিয়ে অর্পিতাকে বললো,"মানুষের হাসিকে এখন আর ভয় পাই না। প্রমাণ তো দেখতেই পাচ্ছো।"
অর্পিতা হাসতে থাকা মানুষগুলোকে আড় চোখে দেখে সাজ্জাদকে ধমকের সুরে বললো,"হয়েছে, এবার ভেতরে আসো।"
"আরো কিছু সময় কান ধরে উঠবোস করতে দাও। পাপ কিছুটা হালকা হোক।"
অর্পিতার বাবা তখন পেছন থেকে অর্পিতাকে বললেন,"বদমাশটাকে মাফ করে দিলি?"
"ও বদলে গেছে বাবা। ও আর আগের মতো নেই।"
তারপর বৃষ্টিতে সবার সামনে কান ধরে উঠবোস করতে থাকা সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে নির্ভরতার সঙ্গে অর্পিতা বললো,"এই ছেলের সাথে এক জীবন কাটানো যায়। নিশ্চিন্তে।"
ছবি এবং লেখা -সংগৃহীত