04/06/2024
চাহিদা
পূর্ব প্রকাশের পর
মাহিকে রিক্সা করে আসতে দেখে চট করে গেইটের আড়ালে চলে গেল সুমন। মাহির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম! শ্যামলা মুখে আলগা পাউডার ঘামে লেপটে আছে , অনভ্যস্ত বেনী অবহেলায় কাঁধে ঝুলে আছে ! উড়াধুরা বেমানান একটা টপসের কারনে বুকের খাঁজ সুস্পষ্ট ! দ্রুত শহুরে হয়ে ওঠার তাড়নায় সালোয়ারের বদলে ঢাকা কলেজের উল্টা দিক থেকে কেনা টাইট জিনসই আজকাল বেশিরভাগ সময়ে তার পরনে থাকে ! তারপরও তাকে কখনও আবেদনময়ী লাগেনা - বড় সরল আর মিষ্টি লাগে !
একবার- শুধু একবারের জন্য এই শ্যামলবরণ মেয়েটির মুখ থেকে ‘ভালবাসি’ শব্দটা শোনার জন্য পৃথিবীর সব সুখ অনায়াসে দিয়ে দেয়া যায় ! মেয়েটির রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে পুরো দিন পার করে দেয়া যায় ! মাহির ঔদাসিন্যে সুমনের কখনও ক্লান্তি আসেনা !
শুধু মাহি যখন দুদিন বা তিনদিনের জন্য ঢাকার বাইরে চলে যায় তখন দলা পাকানো কষ্টে বুকটা ভার হয়ে থাকে! সেই সময়টা সুমন ভালোমতো খায়না, ঘুমায়না, কথা বলেনা ! সুমনের বেশিরভাগ বন্ধু নারী সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দিন ফোনে কথা হবার পরই ভালবাসার চেয়ে একটা “ভালো বাসা “খোঁজে! বন্ধুর বাসা বা কোন কাজিনের খালি বাসায় বদ্ধ কামরায় সময় কাটানোর সাথে সাথে যৌনতার অনুশীলনে প্রেম ফিকে হতে থাকে ! এক মাসের মধ্যেই যে যার পথ দেখে ! এসব বন্ধু সুমনের অবস্থা দেখে তাকে উপহাস করে ! তুড়ি বাজিয়ে বলে, “মাইয়া কোন ব্যাপার?
আজ শুইলাম, কাল টিস্যু পেপার !!!
এসব কথা সুমনকে বিচলিত করেনা বরং তার প্রেমকে আরও গভীর করে - তার সংকল্পকে আরও সুদৃঢ় করে !
সুমন আবার রিক্সায় বসা মাহির দিকে তাকায়! গায়ের রং উজ্জ্বল করার অভিপ্রায়ে গতকাল বোধহয় শরীরে কাঁচা হলুদ মেখেছিলো মাহি! রিক্সার পা দানিতে রাখা কোমল পায়ে এখনও ছোপ ছোপ হলুদের দাগ! তার পায়ের পাতা ছুঁয়ে দেয়ার বহুদিনের ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করে সুমন ! মাহির জন্য সোনার একটা নুপুর কিনে রেখেছে! পরিয়ে দেবার সাহস হয়নি!
মাহি রিক্সা ওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে ইউনিভারসিটিতে ঢোকে-মুখের ভাব অন্যমনস্ক, নজর মোবাইলের দিকে ! রিক্সা ওয়ালা পলিথিনের প্যাকেটে টাকা রাখতে যাবে এমন সময় সুমন উপস্থিত !
মাহি সত্তর টাকা ভাড়া মিটানোর জন্য একটা পঞ্চাশ আর একটা বিশ টাকার নোট দিয়েছে - সুমন একশ টাকা দিয়ে রিক্সা ওয়ালার কাছ থেকে নোট দুটা কিনে নেয় ! নোট হাত নিয়ে গন্ধ শোকে - খুব পরিচিত একটা অপরিচিত গন্ধ ! তেল,লোশন, বডি স্প্রে মেলানো গন্ধ ! নোট দুটো গালে চেপে রাখে ! গত পাঁচ মাস ধরেই বেশিরভাগ দিন মাহির দেয়া টাকা সে জমিয়ে রাখে ! এলাকার বেশিরভাগ রিক্সাওয়ালাই এখন সুমনকে চিনে রেখেছে - সুমন সামনে এসে দাঁড়ালেই পান খাওয়া কালো দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,”আজ পাঁচ টাকা বাড়ায় দিয়েন মামা!”
মাঝে মাঝে সুমনের মনে হয় মাহিকে ভালবাসার কথাটা বলে দেবে কিন্তু মাহি তার সামান্য কথাতেই মহা বিরক্ত হয় - এই কথা শুনে না জানি কি করে বসে !
সুমন ক্যানটিনে ঢুকে দেখে মাহি তার ক্লাসের কিছু ছেলেমেয়ে নিয়ে কেন্টিনে কফি খাচ্ছে ! এই সময়টা কেন্টিনে উপচে পরা ভীড় - ধীরগতির দু’টা মান্ধাতা আমলের সিলিং ফ্যান গরম কমানোর বদলে গরম আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে ! মাহি খুব ঘামছে ! মাহির সামান্য একটু কষ্ট সুমন সহ্য করতে পারেনা,সে দৌড়ে গিয়ে ফেস টিস্যু কিনে এনে মাহির দিকে এগিয়ে দেয় !
“এটা কি ? তোমাকে কি বলেছি আমার টিস্যু লাগবে ? আজাইরা ঢং দেখাবা না তো! “মাহি কঠিন স্বরে বলে ! ওর পাশের ছেলেমেয়ে গুলো পিত্তি জ্বালানি হাসি দেয় ! আগে এমন হলে সুমনের ফরসা চোখমুখ লজ্জা অপমানে টকটকে লাল হয়ে যেত - এখন আর সে এসব গায়ে মাখে না !
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, যেখানে প্রেমের সম্বন্ধ সেখানেই নত হবার গৌরব! সে কত শতবার যে নত হয়েছে! এক তরফা ভালবাসার কষ্ট সে তো নিজেই মাথা পেতে নিয়েছে, প্রতিবারই তার মনে হয় এটাই বোধহয় মাহির শেষ খারাপ ব্যবহার - এরপর সে নিশ্চিত ভুল বুঝতে পারবে ! কিন্তু মাহি বদলায়নি !
সুমন জানে মাহির দেয়া কষ্টের চেয়ে মাহির না থাকার কষ্ট অনেক বেশি প্রবল ! তার আশেপাশে মাহির অস্থিত্বটাই সুখের ! এর চেয়ে বেশি চাহিদা থাকলে হয়তো মাহিকে চিরতরে হারাতে হবে !
(চলবে)