05/09/2024
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
সম্প্রতি বাংলাদেশের চলমান সংকটের মধ্যে নতুন একটি প্রসঙ্গ নেট দুনিয়ায় বহুল আলোচিত হচ্ছে। স্রোতে গা ভাসিয়ে এ বিষয়ে আমিও কিছু বলতে চাইছি।
স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসে আজ যারা জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের পক্ষে মাঠ গরম করছেন তাদের জন্য আমার এই উপস্থাপনা।
আসুন প্রথমে জেনে নিই পৃথিবীর কোন কোন দেশে বিভিন্ন সময়ে তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করা হয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক পরিবর্তন, স্বাধীনতা আন্দোলন, বা আধুনিকীকরণের কারণে পৃথিবীর ইতিহাসে এযাবতকাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য যে কয়েকটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করা হয়েছে সেগুলি হলো-
০১. দক্ষিণ আফ্রিকা
০২. রাশিয়া
০৩. ইরাক
০৪. আফগানিস্তান
০৫. জিম্বাবুয়ে
০৬. মাওরিতানিয়া
০৭. শ্রীলঙ্কা
০৮. মেক্সিকো এবং
০৯. রুয়ান্ডা
এই তালিকায় প্রথমে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো দেশটির বর্ণবাদের অবসান পরবর্তী সময়ের পরিবর্তন। ১৯৯৭ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন জাতীয় সঙ্গীত গৃহীত হয়, যা দেশটির ঐক্য ও বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করে। এই সঙ্গীতটি দু'টি পুরানো সঙ্গীতের মিশ্রণ—"Nkosi Sikelel' iAfrika" এবং বর্ণবাদী আমলের জাতীয় সঙ্গীত "Die Stem van Suid-Afrika"। নতুন সঙ্গীতটি পাঁচটি ভাষায় গাওয়া হয়, যা দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিগত বৈচিত্র্যকে সম্মান জানায়।
তালিকার দ্বিতীয় স্থানে অবস্থানকারী রাশিয়া।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, রাশিয়া ১৯৯১ সালে সোভিয়েত জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করে। তবে, ২০০০ সালে, ভ্লাদিমির পুতিনের আমলে সোভিয়েত সময়ের সুরটি পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়, তবে নতুন কথা সংযোজন করা হয় যা সোভিয়েত আদর্শের পরিবর্তে রুশ জাতীয়তাবাদ ও ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দেয়।
তালিকার তৃতীয়স্থানে রয়েছে ইরাক।
ইরাকের জাতীয় সঙ্গীত কয়েকবার পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৮১ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের শাসনকালে "Ardulfurataini Watan" সঙ্গীতটি গৃহীত হয়। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর নতুন জাতীয় সঙ্গীত গৃহীত হয়—"Mawtini"। এটি ইরাকের স্বাধীনতা ও ঐক্যের বার্তা বহন করে এবং ফিলিস্তিনি কবি ইবরাহিম তুকানের লেখা।
চতুর্থ অবস্থানে আফগানিস্তান।
আফগানিস্তান বিভিন্ন সময়ে তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করেছে। ১৯৭৮ সালে সোভিয়েত সমর্থিত শাসনের অধীনে একটি জাতীয় সঙ্গীত চালু করা হয়েছিল। তবে তালিবানের পতনের পর ২০০৬ সালে নতুন জাতীয় সঙ্গীত চালু হয়, যেখানে পুশতু ভাষা ও ইসলাম ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে লেখা হয়েছে।
পঞ্চম দেশ জিম্বাবুয়ে।
জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় নতুন জাতীয় সঙ্গীত গৃহীত হয়—"Ishe Komborera Africa"। পরবর্তীতে, ১৯৯৪ সালে এটি পরিবর্তন করে "Simudzai Mureza wedu WeZimbabwe" নামে নতুন একটি সঙ্গীত চালু করা হয়, যা দেশের স্বাধীনতা এবং জাতীয় গৌরবকে উদযাপন করে।
ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে মাওরিতানিয়া।
মাওরিতানিয়া ২০১৭ সালে তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করে। দেশের নতুন সংবিধানের সঙ্গে মিল রেখে নতুন জাতীয় সঙ্গীত তৈরি করা হয়। এটি পূর্বের সঙ্গীতের তুলনায় দীর্ঘ ও প্রার্থনামূলক।
সপ্তম স্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা।
শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত প্রথমে শুধুমাত্র সিংহলি ভাষায় গাওয়া হতো। তবে দেশের তামিল জনগোষ্ঠীর জন্য, ২০১৬ সালে তামিল ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। যদিও এটি মূলত ভাষাগত পরিবর্তন, এটি ঐক্য এবং সংহতির প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে।
অষ্টম স্থানে রয়েছে মেক্সিকো।
মেক্সিকোতে ১৮৫৪ সালে দেশের জাতীয় সঙ্গীত "Himno Nacional Mexicano" গৃহীত হয়েছিল। এর পরে কিছু লিরিক পরিবর্তন করা হয়। বিশেষ করে সামরিক ও যুদ্ধ বিষয়ক কথা বাদ দেওয়া হয়েছিল, যা দেশটির শান্তিপূর্ণ ইমেজকে তুলে ধরে।
তালিকার নবম দেশ রুয়ান্ডা :
১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যার পর, দেশটি তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করে। নতুন সঙ্গীত "Rwanda Nziza" (সুন্দর রুয়ান্ডা) গৃহীত হয় ২০০১ সালে, যা নতুন যুগের আশার প্রতীক এবং দেশের পুনর্গঠন ও ঐক্যকে প্রতিফলিত করে।
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের পেছনে সাধারণত ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন, স্বাধীনতা, আধুনিকীকরণ, এবং ঐক্যের প্রতিফলন বড় কারণ হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন দেশ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করেছে যাতে নতুন প্রজন্মের মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং বৈচিত্র্য প্রতিফলিত হয় এবং সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় থাকে।
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে আসা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের বিতর্কে অংশগ্রহনের পূর্বে জানতে হবে এই পরিবর্তনে আবশ্যিকতা ও প্রেক্ষাপট। পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হবে কি না সেই বিষগুলির উপর আলোকপাত করা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
০১. জাতীয় ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সংযোগ
জাতীয় সঙ্গীত একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। যদি সঙ্গীতটি স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থাকে, তাহলে তা পরিবর্তন করা অনেকের কাছে সংবেদনশীল এবং অপ্রত্যাশিত হতে পারে।
তবে, যদি বর্তমান সঙ্গীত অতীতের কোনো বিতর্কিত বা বর্ণবাদী ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
২. জনগণের মতামত
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের বিষয়ে জনগণের মতামত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি সরকার জনগণের মতামত নেয় এবং তাদের সমর্থন থাকে, তবে এটি গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। তবে যদি এটি একতরফা সিদ্ধান্ত হয়, তা হলে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ ও বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। গণভোট বা মতামত জরিপ করা হলে সিদ্ধান্তটি অধিক গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
৩. আধুনিক মূল্যবোধ ও প্রয়োজনীয়তা
দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ৫০ বছরে অনেক পরিবর্তিত হতে পারে। নতুন প্রজন্মের মূল্যবোধ ও ভাবনা যদি পুরানো সঙ্গীতের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ না খায়, তবে নতুন সঙ্গীত জনগণের মধ্যে আরও ভালোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
যদি নতুন সঙ্গীতের বার্তা, ভাষা এবং সুর নতুন যুগের মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে, তবে তা হয়তো অনেকের কাছে প্রশংসিত হবে।
৪. সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা সংকীর্ণ স্বার্থে নেওয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবে, যদি এটি সমাজের সব শ্রেণির মানুষের অন্তর্ভুক্তির ভিত্তিতে নেওয়া হয় এবং সঙ্গীতটি দেশের ঐক্য, শান্তি, ও সম্মিলিত পরিচয়কে প্রতিফলিত করে, তাহলে তা অধিকাংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
৫. সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতা
কোনো দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করতে গিয়ে যদি নতুন সঙ্গীতে কোনো বিশেষ ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে অন্য সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হতে পারে। তাই, যদি নতুন সঙ্গীতটি সকল জনগোষ্ঠীর সম্মান এবং সংবেদনশীলতা রক্ষা করে, তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
৬. শিক্ষা ও প্রচার কার্যক্রম
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের আগে নতুন সঙ্গীতের গুরুত্ব, বার্তা এবং তা কেন পরিবর্তন করা হচ্ছে—এগুলো জনগণের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরা হলে এবং যথাযথ প্রচার চালানো হলে, তা গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
৭. অনুভূতির স্থায়িত্ব
যদি পুরোনো জাতীয় সঙ্গীত দীর্ঘ সময় ধরে জনগণের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত থাকে, তবে এটি পরিবর্তন করা মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। অনেকের কাছে পুরোনো সঙ্গীতের প্রতি আবেগ থাকলে তা পরিবর্তন গ্রহণ করা কঠিন হতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হবে কি না, তা বেশিরভাগই নির্ভর করবে জনগণের সমর্থন, ঐতিহ্য ও বর্তমান সমাজের প্রয়োজনীয়তার উপর। যদি এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, জনগণের মতামত ও সমর্থন নিয়ে এবং সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে সংবেদনশীলতা ও ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করলে এটি বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে।
সৈয়দ শফীক, কলাম লেখক।