বাক্

বাক্ Contact information, map and directions, contact form, opening hours, services, ratings, photos, videos and announcements from বাক্, Magazine, .
(20)

25/04/2021

#অলসতার_আশীর্বাদ
#মায়াশিখা_চক্রবর্তী

" এই দ্যাখো , ছেলে এখনো ঘুমোচ্ছে। কি যে করি এই আলসিকে নিয়ে ! বাবুয়া , এই বাবুয়া , ওঠ্ শিগগিরি , আজ তোর ব্যাঙ্গালোর যেতে হবে না ? এবার ফ্লাইটটা ঠিক মিস্ করবি। চাকরিটা তোর আর থাকবে না রে। আমার হয়েছে যতো জ্বালা ! সেই ছোটবেলা থেকে এই ছেলেকে গুঁতো মেরে মেরে সব করিয়ে চলেছি। এক কথা পইপই করে বলে চলেছি , ওরে সোনা , যে সারাক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে , তার ভাগ্যও ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু শুনলে তো আমার কথা। ওরে বাবুয়া , তোর ফ্লাইটা যে চলে গেলো রে ! "
মায়ের বকবকানি থামছে না দেখে বাবুয়া চোখ না খুলেই বললো , " উঃ মা , তুমি তো সেই কোন ছোটবেলা থেকেই আমাকে আলসে বলে আসছো। কিন্তু আজ অবধি কোন কাজটা আমার দ্বারা হয়নি বলো তো ? প্রত্যেকটা ক্লাসে প্রথম না হতে পারি , প্রথম পাঁচজনের মধ্যে তো থাকতাম। তোমার জন্য স্পোর্টসে নাম দিয়ে পুরস্কারও এনে দিয়েছি। তারপর ইঞ্জিনীয়ারিং পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করে একটা ভালো চাকরীও পেয়ে গেছি । আর যতদূর জানি কেউ আমায় খারাপ ছেলে বলেনা। দোষের মধ্যে শুধু একটু আলসেমি করে ঘুমোতে ভালবাসি , তা তুমি কিছুতেই সহ‍্য করতে পারোনা। প্লিজ্ মা , এখন তো আমি বড় হয়ে গেছি , এখন তো আমাকে একটু আমার মতো থাকতে দাও। " বলেই আবার পাশ ফিরে নাক ডাকতে লাগলো।
ছেলেকে আবার শুয়ে পড়তে দেখে সুনন্দা রাগে গজগজ্ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ছেলের এই আলসেমির জন্য সারাক্ষণ তাঁর বড় দুশ্চিন্তায় কাটে। সবে মাস পাঁচেক হয়েছে বাবুয়া এই চাকরিটা পেয়েছে। সময়মতো ব্যাঙ্গালোর না যেতে পারলে ছেলের নতুন চাকরি বজায় থাকবে তো । একরাশ চিন্তা নিয়ে তিনি ছেলের প্রিয় খাবার লুচি , সাদা আলুচচ্চরি আর মোহনভোগ বানাতে লাগলেন।
আরো ঘন্টাখানেক পর বাবুয়া আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে চিৎকার করে উঠলো , " মা-মা , তুমি আমায় ডাকোনি কেনো ? আমার ফ্লাইটটা মিস্ হয়ে গেলো , পরের ফ্লাইটে যেতে হবে। " মায়ের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। স্নান সেড়ে চটপট্ তৈরী হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো , নাঃ এই ফ্লাইটটা আর কোনমতেই পাওয়া যাবেনা , পরের ফ্লাইটেই যেতে হবে। এবার তার নিজেরও চাকরির জন্য চিন্তা হতে লাগলো।
বাবুয়া গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে মায়ের মুখ দেখে বুঝতে পারলো হাওয়া খুব গরম।খাবার টেবিলে বসার আগে টিভিটা চালিয়ে দিলো খবর দেখবে বলে। তারপর রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বললো , " জানো মা , আমাকে তো কম্পানি ওপেন টিকিট দিয়েছে , তাই কাল রাতে ঠিক করেছিলাম অত সকালে না গিয়ে বেলার ফ্লাইটটায় যাবো। তুমি আমায় তাড়াতাড়ি খাবার দাও , খেয়েই বেড়িয়ে পড়ি। " মায়ের কোনো উত্তর না পেয়ে আবার বললো , " মা , তুমি কি আমার চাকরি নিয়ে চিন্তা করছো ? আরে বাবা কিচ্ছু চিন্তা নেই , চাকরির আমার কিচ্ছুটি হবেনা। তুমি সারাজীবন আমার জন্য ভেবে ভেবে নিজের শরীরটা খারাপ করছো। এবার আমাকে নিয়ে ভাবা একটু ছাড়ো তো , আমি নিজের দায়িত্ব এখন নিজেই নিতে পারবো। "
সুনন্দা কোনো কথা না বলে ছেলের সামনে ঠকাস্ করে খাবারের প্লেটটা রেখে আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাবুয়া বললো , " কি হলো , তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না ? আমি আজ চলে যাচ্ছি এক মাসের জন্যে , কদিন শান্তিতে থেকো। রইলো তোমার খাবার , আমি চললাম। " বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়তেই সুনন্দা দৌড়ে এসে তার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন , " ছোটবেলা থেকে তুই আমায় এতো জ্বালাস কেনো ? তোর বাবা চলে যাবার পর থেকে কতো কষ্ট করে তোকে মানুষ করেছি , তোকে ঘিরে আমার কতো স্বপ্ন। আর তুই যদি এমন করিস আমার কতো চিন্তা হয় বুঝিস না ? " বাবুয়া বললো " কি এমন করেছি আমি , একটু বেলা অবধি ঘমিয়েছি এই তো। জীবনে এটুকু আলসেমিতে বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়না। সবই তো আমি ঠিক ঠিক করি মা , আমার চাকরিরও কিছু ক্ষতি হবেনা তুমি দেখে নিও । " সুনন্দা এবার হেসে বললেন , " আচ্ছা আচ্ছা , খুব হয়েছে। এবার খাবারটা খেয়ে দুর্গা দুর্গা বলে বেড়িয়ে পড়ো তো । "
মায়ের মুখে হাসি দেখে বাবুয়া এবার তার খাবার প্লেটে মন দিলো। সুনন্দাও চায়ের কাপ হাতে ছেলের সামনে বসে খবরটা শুনতে লাগলেন। হঠাৎ একটা খবরে সুনন্দার হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে গেলো , আর বাবুয়ারও হাত থেমে গেলো। দুজনেই টিভির দিকে তাকিয়ে হতভম্বের মতো বসে রইলো।
খবরে দেখাচ্ছে যে প্লেনটায় বাবুয়ার যাবার কথা ছিলো সেই প্লেনটা আকাশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে যায়। পাইলট শত চেষ্টা করেও প্লেন এবং প্লেনের যাত্রীদের বাঁচাতে পারেননি। খবরটা দেখে দুজনে কিছুক্ষণ নির্বাক বসে ছিলো , তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে বাবুয়া বললো , " দেখছো মা , তুমি সব সময় বলো আমার আলসেমি নাকি আমার জীবন শেষ করে দেবে , কিন্তু আজ তো আমার আলসেমি আমায় বাঁচিয়ে দিলো মা । তুমি জোর করে আমায় ঐ প্লেনে পাঠালে এখন তোমার কাছে আমার মৃত্যুসংবাদ আসতো , তাই না মা ? " ছেলের কথায় সুনন্দা শিউরে উঠে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

19/04/2021

#পরিবর্তন
#শাশ্বতী_দত্ত

আমার এ গল্পের প্রেক্ষাপট অর্ধশতক পূর্বের এক পল্লীগৃহ।
গৃহস্বামিনী ক্ষীরোদাবালার চার পুত্র, তিন পুত্রবধূ ও সাতটি নাতি নাতনি লইয়া ভরা সংসার। ক্ষীরোদার তিনটি কন্যাও আছে তবে তারা নিজ নিজ শ্বশুরালয় আলো করিয়া আছেন।
শ্বশুরবাড়ির শতেক দায়িত্ব থেকে রেহাই পাইতে মাঝেমাঝেই বাপেরবাড়িতে আসিয়া ওঠেন তাঁরা। আর বাপেরবাড়ি আসা মানেই ঝাড়া একটি মাসের ধাক্কা। বৌদিগের তখন নিঃশ্বাস ফেলিবার অবসরটুকুও মেলে না। ননদিনীরা বিদায় লইলে পর উহাদের তাপিত প্রাণ জুড়ায়, ইহা বলাই বাহুল্য।
দুই বৎসর পূর্বে ক্ষীরোদার স্বামী পরলোকগমন করিবার পর হইতে তিনি আঁশ, নিরামিষ লইয়া অতিরিক্ত স্পর্শকাতর হইয়া পড়িয়াছেন। সৃষ্টির সমুদয় সংসার তাহার কাছে অপবিত্র বোধ হয়। গৃহের নিকটস্থ পুষ্করিণী হইতে স্নান করিয়া ফিরিবার কালে পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ভূমি স্পর্শ করিয়া চলেন। এটুকু সংস্পর্শও এড়াইয়া চলিতে পারলে তিনি সবিশেষ খুশি হইতেন তাহা বলাই বাহুল্য।
গৃহ প্রাঙ্গণে আসিয়া অঙ্গনের তুলসীমঞ্চের পার্শ্বে রক্ষিত গোমাতার বিষ্ঠা স্পর্শপূর্বক দেহকে শুদ্ধ করিয়া তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। রান্নাঘরের কোনরূপ জাগতিক দ্রব্য তিনি পারতপক্ষে স্পর্শ করেন না। বধূরা পালা করিয়া আমিষ ও নিরামিষ হেঁশেল সামলায়।
তিনি চারবেলা খাইয়া ধন্য করেন। দ্বিপ্রাহরিক অন্নগ্রহণের পর কাপড় ছাড়িয়া সর্বাঙ্গে গঙ্গোদক ছিটাইয়া নিজেকে পুনরায় শুদ্ধ করেন।
হেঁশেলের কোন কিছু হাত দিয়া স্পর্শ না করিলেও দৃষ্টি দিয়া তিনি সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁহার দৃষ্টি এড়াইয়া এ সংসারে কিচ্ছুটি হইবার জো নাই।
মাথাটি তাহার নিদাঘদিনের তপ্ত ভূমির মত সর্বদাই উত্তপ্ত।
যৌবনে দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্বামীর বিক্রম ও প্রতাপে কিঞ্চিৎ ম্রিয়মাণ হইয়া থাকিলেও বর্তমানে স্বাধীন বিধবা হইয়া অবদমিত ক্রোধ মাঝে মাঝেই পুত্র, বিশেষত পুত্রবধূদিগের উপরে বর্ষিত হয়।

আজ তেমনই একটি উত্তপ্ত দিন। ঘটনাটি বিবৃত করিলেই পুরা ব্যাপারটি পরিষ্কার হইয়া যাইবে।

আজ পয়লা বৈশাখ।
আজিকার দিনে গৃহিণী স্নান আহ্নিক সরিয়া নতুন পট্টবস্ত্র পরিয়া পালঙ্কে উপবেশন করেন। সকলে আসিয়া একে একে প্রণাম করিলে আশীর্বাদ করেন এবং নাতি নাতনিদিগের হাতে একটি করিয়া কাঁচা টাকা দেন। কর্তা রেলে চাকরি করিতেন, গৃহিণী পেনশনভোগী। কাজে কাজেই অর্থের জন্য পুত্রদের দ্বারস্থ হইতে হয় না।
পুত্রেরা সুউপায়ী ও মাতৃ অনুগত। সংসারযাত্রা নির্বাহের জন্য তাহাদেরও মাতার টাকার প্রয়োজন নাই।
প্রতিবারের মত এই বারেও ফুলিয়া হইতে এক শাড়ি ব্যবসায়ী আসিয়া সকলের পছন্দমত আধুনিক ছাঁদের রংবাহারি সব কাপড় দিয়া গিয়াছে। বধূদিগের কাপড় গৃহিণী নিজে পছন্দ করিয়া কিনিয়া দিয়াছেন।
নাতিনাতনীদের জামাকাপড় আর পুত্রদের পাঞ্জাবি পাজামার জন্য গৃহিণী পৃথকভাবে টাকা দিয়াছেন।
তাঁহার হুকুম, সকলের জন্য সম মূল্যের ও সমান ডিজাইনের পোষাক কিনিতে হইবে। একান্নবর্তী সংসারে সকলে সকলের সমান হইয়া না থাকিলে মনোমালিন্যের কালো মেঘ আসিয়া নির্মল আকাশ ছাইয়া ফেলিতে বিলম্ব করিবে না!
ক্ষীরোদার জ্যেষ্ঠ পুত্রটি একটু সিধাসাদা গোছের। ক্ষীরোদার ধারণা বিক্রেতারা সকলেই উহাকে ঠকায়, হয় ওজনে নয় মূল্যে।
মেজজন উকিল এবং খুব হুঁশিয়ার তাই বাজারের ভার তাহার উপরে ন্যস্ত।
বেলা নয়টার সময় রান্নাঘরের সমুখে বাজারের থলি রাখিয়া ঘর্মাক্ত কলেবর রবীন কহিলেন, "দেখে নাও বৌদি, সব ঠিকঠাক এনেছি কিনা।
এই সব্জির থলিতে মোচা,এঁচোড়, নারকেল, কুমড়ো, সজনেডাঁটা আলু আর পটল আছে। মাছের ব্যাগে কাতলা, চিংড়ি, পুঁটিমাছ আর ঐ শালপাতার ঠোঙায় কচি পাঁঠার মাংস।"
রান্নাঘরের অদূরে ছোঁয়াচ বাঁচাইয়া একখানি জলচৌকির উপর বসিয়া আছেন পৃথুলা ক্ষীরোদা।
শ্যেন দৃষ্টিতে সব দেখিয়া বড় বধূকে বলিলেন, "বড়বৌমা সব ঘরের আলমারিতে সিঁদুর আর চন্দনের ফোঁটা দিয়েছ তো?
ওটা আমাদের পারিবারিক প্রথা।"

জয়ন্তী ঘাড় নাড়িয়া সায় দিতেই পুনরায় বলিলেন, "পুঁটিমাছ দুটো ধুয়ে হলুদ সিঁদুর আর তেল দিয়ে উনুনের পাশে রেখে অগ্নিদেবতাকে আগে নিবেদন করবে। তারপর জোড়হাতে প্রণাম করে রান্না বসাবে।"
এত বছর ধরিয়া এইসব নিয়ম পালন করিতেছেন জয়ন্তী, তবুও প্রতিবার শাশুড়ি একবার করিয়া
স্মরণ করাইয়া দেন।
ক্ষীরোদা পুনরায় কথা কহিলেন,
-"তা তুমি একা কেন, মেজ আর ছোটবৌমাকে দেখছি না যে!"
-"ছোট দরজায় দরজায় আমপাতা আর শোলার কদমফুল লাগাচ্ছে মা।
মেজ আজ কিছু ছুঁতে পারবে না।"
দেবরের কান বাঁচাইয়া অতি মৃদুস্বরে কথাটা বলিলেন জয়ন্তী।
ঋতুচক্রের স্বাভাবিক নিয়মে মেজবৌয়ের যে কোন হাত নাই তাহা বুঝিয়াও ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিলেন ক্ষীরোদা।
-"সেকি! মেজবৌমা আর দিন পেল না! বচ্ছরকার দিনে যত অনাসৃষ্টি কাণ্ড। ছোটজন তো পটের বিবি, এম.এ পাশ করা বিদুষী মেয়ে। যত শৌখীন কাজে তার উৎসাহ। আমার নিরামিষ হেঁশেলের কিছুই তো সে পারবে না! আঁশ নিরামিষ সব তুমি একা হাতে করতে গেলেতো খেতে খেতে বিকেল চারটে বাজবে!
দাও দেখি বঁটিটা, মোচাটা ছাড়িয়েই নাহয় সংসারের উপকার করি!"
গজগজ করতে থাকেন শাশুড়ি।
এমন সময় হাতে আমপাতা আর কদম ফুল লইয়া রান্নাঘরে আসিয়া দাঁড়াইল ক্ষীরোদার বড় ছেলের ঘরের বড় নাতিটি।
-"কাকিমা এসব ছোঁবে না মা, আমাকেই টাঙাতে বলল। কিভাবে টাঙাব?"

এইবার জয়ন্তীর মুখ শুকাইল।
শাশুড়ি যতই গঞ্জনা দিন, ছোটজা আসিয়া হাতে হাতে সাহায্য করিলে রান্নার কাজ শেষ করিতে বিলম্ব হইত না।
ছেলের কথায় বোঝা গেল সেও ঋতুমতী হইয়াছে।
শাশুড়ি কথাটা শুনিতে পাইলে কুরুক্ষেত্র করিবেন।

মাছ ধুইতে দ্রুতপদে পুকুরঘাটের দিকে যাইবার সময় ঝি নিস্তারিণী তাহাকে থামাইল।
-"বড়বৌদি, কাপড়টা ছেড়ে ফেল গো, রক্ত লেগেছে।"

মাথায় হাত দিয়া বসিলেন ক্ষীরোদা।
তিন বধূ কি যুক্তি করিয়া আজ তাঁহাকে বিপদে ফেলিল!
নববর্ষের দিন কিনা বাড়ির তিন তিনটি বৌ অশুদ্ধ হইয়া বসিয়াছে! এত রান্না এখন কে করে! তিনি তো মরিয়া গেলেও আঁশ হেঁসেলে ঢুকিবেন না।
ঝি কিছু একটা বলিতে আসিতেছিল, তাঁহার রোষদৃষ্টি দেখিয়া থামিয়া গেল।

বেলা দশটা বাজে।
মাছ মাংস সবজি এখনো রান্না ঘরের শানবাঁধানো মেজের উপর পড়িয়া আছে।
উনানের গনগনে আঁচ ইন্ধনের অভাবে নিভিয়া আসিলেও ক্ষীরোদার ক্রোধানল ক্রমবর্ধমান।

গোলমালের ভিতর সুযোগ বুঝিয়া ক্ষীরোদার পোষা বিড়ালটি মাছের থলিটা লইয়া সরিয়া পড়িবার উপক্রম করিতেছিল, ঝি রে রে করিয়া ছুটিয়া আসায় রণে ভঙ্গ দিয়াছে।
সূর্যদেব ধীরে ধীরে মাথার ওপর উঠিতেছেন দেখিয়া ক্ষীরোদা দীর্ঘকাল পর নিরামিষ উনানে অগ্নিসংযোগ করিলেন।
অনভ্যাসে কয়লার ধোঁয়ায় চক্ষুজ্বালা করিয়া জল পড়িতে লাগিল। মনে মনে বধূদিগের মুণ্ডুপাত করিতে করিতে পাখার বাতাস করিতে লাগিলেন।
ঝি আসিয়াছিল সাহায্য করিতে, ক্ষীরোদা নিরস্ত করিয়াছেন। তাহার ছোঁয়া তিনি খাইবেন না।

ছেলেরা মায়ের দুর্দশা দেখিয়া ছুটিয়া আসিয়াছে।
কিন্তু ঐ অবধি। পুত্রেরা একেকজন লেখাপড়ায় যতই দিকপাল হউন ক্ষীরোদা তাহাদের আস্ত ঢ্যাঁড়শ তৈরি করিয়াছেন। গৃহকর্মে তাহারা নিতান্তই অপারগ। মেজজন আসিয়া বঁটি পাতিয়া বসিয়াছিল, হাত কাটিয়া রক্তারক্তি হওয়ায় ক্ষান্ত দিয়াছে।
কনিষ্ঠ পুত্র তো গৃহেই নাই।
রাগের চোটে ক্ষীরোদা জলভর্তি মাটির হাঁড়ি দুম করিয়া উনানে বসাইবা মাত্র হাঁড়ি ফাটিয়া সব জল উনানে।
জয়ন্তী আড়াল হইতে সব দেখিতেছিলেন। এইবার আগাইয়া আসিলেন।
ছল ছল চোখে বলিলেন,
-"আমাকে দিন মা, করে দিই।
নাহলে আজ কারুর খাওয়া জুটবে না।"
-"না জোটে উপোস করবে। তবু অশুচি অবস্থায় আমি তোমাদের ভাঁড়ার ছুঁতে দেব না।"
ফুঁসিয়া উঠিলেন ক্ষীরোদা।

-"মা, অনেক তো হল! এবার জেদ ছাড়ুন।
প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা আমরা সবাই। মেয়েদের এটা না হলেতো সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যেত।
ভেবে দেখুন, এতে মেয়েরা অপবিত্র হয় না।
স্বয়ং মা কামাখ্যাও অম্বুবাচীর সময়ে ঋতুমতী হন, তাই বলে কি তিনি তখন অপবিত্র হয়ে যান?"
বাড়ির ছোটবৌ অপালা বরাবরই প্রতিবাদী।
-"তুমি থামো ছোটবৌমা।
শাস্তরে লেখা আছে মেয়েদের এইসময় কোন কাজে হাত দিতে না দিয়ে ঘরে বন্ধ করে রাখতে হয়।"
-"ঠিক, শরীর এসময় অপটু থাকে, ভারী কাজ শারীরিক কারণেই হয়ত করা উচিৎ নয়। এমনি নিষেধ করলে কেউ শুনবে না, কাজ করতে গিয়ে অজান্তেই নিজেদের শরীরের জননঅঙ্গের ক্ষতি করে ফেলবে। তাই ধর্মের অনুশাসনে বেঁধে মানানোর চেষ্টা হয়েছে।
কিন্তু যখন কাজ না করে উপায় নেই তখন তো করতেই হবে মা!
এই দেখুন না, আগে এইসময় মেয়েরা বাইরে বেরোত না, এখন তো স্কুল কলেজ যাচ্ছে। আরও কিছুদিন পর হয়ত অফিসেও যাবে।"
ছোট বৌমার কঠোর যুক্তিজাল কাটিতে না পারার দরুন নাকি নিজের অসহায়তার দরুন জানা নাই ক্ষীরোদা সেদিন নরম হইলেন। বধূরা অবশেষে রান্নাঘরে প্রবেশের অনুমতি পাইল।

পড়ন্ত বেলায় ক্ষীরোদা রান্নাঘরের বারান্দায় ছেলেদের আসন হইতে একটু দূরে নিজের পিঁড়িটি পাতিলেন।
জয়ন্তী অবাক।
-"আপনিতো রোজ নিজের ঘরে বসে খান, আজ এখানে বসলেন যে!"
হাসলেন ক্ষীরোদা।
-"বচ্ছরকার দিন, আজ সবাই একসাথে বসেই খাই।
বৌমারা, তোমরাও সবার পাতে পাতে দিয়ে নিজেরা এবার বসে পড়ো।অনেক বেলা হয়েছে।"
ছেলেদের মুখে হাসি।
ছোটছেলে চেঁচাইয়া উঠিল, "গ্রেট মাতৃদেবী।
আপনিও তাহলে আধুনিকা হলেন।"
মুগের ডাল আর মোচার ঘন্ট দিয়া ভাত খাইতে খাইতে ক্ষীরোদা হাসিলেন।
ছেলেদের পাতে পাতে তখন ধোঁয়া ওঠা কচি পাঁঠার মাংস পড়িতেছে।
সমাপ্ত

17/04/2021

#পথের_হ্যাজার্ড
#স্বাতী_মুখার্জী

ভদ্রলোক তোকে অত গুলো কথা শোনালেন তুই কিছু বললি না?

অর্চিতাকে বলল ওর ছোটো পিসি।

অর্চিতা বলল,"ছাড়ো।"

পিসি বলল, " কেন?"

ঘটনাটা ঘটেছে অটোতে। বসার সিট নিয়ে ক্যাঁচাল। অর্চিতা লাস্ট স্টপেজে নামবে , লোকটা তার আগে। এটা শুনেই অর্চিতা বলল, "আমাকে তাহলে ঢুকে ভেতরটাতে বসতে দিন, " তাতে লোকটা বিচ্ছিরি ভাবে ঝগড়া করে গেলো। যে লাইনে ভদ্রলোক আগে ছিলেন , অতএব উনি ওনার পছন্দের সিট টাতে বসবেন। অর্চিতা নেহাতই আনকালচার্ড সিস্টেম না বোঝা পাবলিক তাই এটা বলতে পারলো।"

অহেতুক কথা । এবং বাড়তি কথা। সিটের অ্যাডজাস্টমেন্ট হবে না এটা বলার জন্যে এত কথা কেউ বলে না সাধারণত। "না আমি এখানেই ঠিক আছি," এইটুকু বলেই ছেড়ে দেয়। এত ফালতু কথায় অর্চিতা প্রচণ্ড রেগে গেল এবং চুপ করে গেলো ওনার অ্যাগ্রেসিভ কথা বলার ধরণে। সুবিধেটা অনেকে বোঝে না। বুঝতে চায় না। এঁড়ে তর্ক করে যায়। কাজেই অর্চিতা এবং তার পাশের জনকে মাঝপথে নামতে হলো। সেখানে তাঁর গন্তব্যে তিনি থার্ড পোজিশান থেকে ধীরে সুস্থে নামলেন। অর্চিতাদের আবার উঠতে হলো অটোতে।

অফিসে যাওয়ার তাড়াহুড়োর সময় এই টুকু দেরিও খুব গায়ে লাগে। সহ্য ই করলো অর্চিতা। দশ মিনিট বেশি সময় হাতে নিয়ে বেরোনোর সুশিক্ষাটা আরেকবার দিলো নিজেকে মনে মনে।

এখন একটা হাই তুলে পিসিকে বলল, "ওনাকে কিছু বললে উনি বুঝতেন না পিসি, কাজেই আমি অহেতুক কথা খরচ করবো কেন?"

পিসি বলল, "তাহলেও। "আনকালচার্ড সিস্টেম না বোঝা পাবলিক সব" বলছিলো বললি না? এত বাজে কথা শুনে চলে এলি?"

অর্চিতা নাক কুঁচকে একটু হাসলো, "হ্যাঁ গো পিসি। শুনেই চলে এলাম। যে একজন অপরিচিত কে এত খারাপ কথা বলতে পারে সামান্যতেই তার নিজের ভেতরে কোনো না কোনো বিষয় অসন্তোষ বা টেনশান আছে শিওর। পথের ঝঞ্ঝাট হ্যাজার্ড এগুলো। এসব থাকবেই গো পিসি।"

13/04/2021

#ভূতের_ভবিষ্যৎ
#শুভ্র

অনেক দিন পর ছুটি পেয়ে, সেদিন
রাতে বাড়িতে ফিরছিলাম। আমাদের এলাকায় যখন বাস থেকে নামলাম, তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা-একটা হবে। বাস স্ট্যান্ডে দেখলাম, তখনও এখানে সব চায়ের দোকান বন্ধ হয়নি।

বাড়ির দিকে চলা শুরু করতেই খেয়াল হল, আস্তে আস্তে চারিদিকে নির্জন জনহীন হয়ে পড়ছে। বাস স্ট্যান্ড থেকে বাড়ি প্রায় মিনিট পাঁচেক। পায়ে চলার পথ বেশ ভালো। রাস্তার পাশেই এক জায়গায় এক অন্য সম্প্রদায়ের সৎকার স্থান। শ্মশানও বলা যেতে পারে। লোকমুখে জায়গাটার হাল্কা বদনাম আছে।

আশেপাশের বাসিন্দাদের অনেকেই নাকি ওখানে ভয়ে হার্ট ফেল করে মারা গেছেন। এত রাতে এখান দিয়ে যাচ্ছি, তাই ছেলেবেলায় সরল মনে শেখা, রাম নাম জপতে জপতে চলেছি। মনে মনে। কারণ বড়বেলায় এটা বুঝেছি, যতই ভয় লাগুক না কেন। ভুত সামনে এসে দাঁড়ালেও, চীৎকার করে ও নাম জপা যাবে না। আশেপাশের জীবিতদের কেউ শুনে ফেললেই, নিজের মনের মতন করে রঙ ছুঁড়ে মারবে। সে'সকল বোদ্ধাকে কিছু বলাও বৃথা। তাই মনে মনেই ভক্তিকে পুষে রাখলাম। আর সময়কে দুষে অস্ফুটে আওড়ালাম, 'সাধারণেরই তো যত জ্বালা'।

এদিকে যতই বাড়ির কাছাকাছি আসছি, আমার বুকের ভিতরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে একজন সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো, 'দাদা দেশলাই হবে?'
আমি মাথা নাড়িয়ে জানালাম, 'নেই।' বলে এড়িয়ে যেতে চাইলাম। আমার অজান্তেই অস্ফুটে মনের রাম,মুখে চলে আসায়। লোকটি বলল,
'তা হলে কী ওই ভগবানের নামে সকল ভূত ভেগে যাবে বলেই মনে করেন!' আমার তো ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। তাও বললাম, 'হ্যাঁ। মানে শুনেছি তো তাই...' । হটাৎ খেয়াল হল, ততক্ষণে আরও অনেকেই ভীর করে মজা দেখতে শুরু করেছে।
ভয়ে পালাতে যাবো, ততক্ষণে সবাই পাশ থেকে এক সাথে 'রাম রাম' জপতে শুরু করে দিয়েছে।
সে এক অদ্ভুত পরিবেশ। অত রাতে, এত জনে, এক সাথে, চারপাশে ... ভ...

ঠিক যখন চারপাশের দৃশ্য ঘোলাটে হতে শুরু করেছে। তখনই , একটা হুঙ্কারে ওরা থমকে চুপ করে গেল। এক ছায়ামূর্তি বলে উঠলেন,
"ওকে ছেড়ে দে। তা নইলে তোদের সব ক'টা কে আজ নিজের হাতেই মানব জন্মের দিকে ঠেলে দেবো।" অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম, আশপাশের ভীড় হালকা হতে শুরু করল। আওয়াজও বন্ধ হল। আবার আগের মতন চারপাশটা শান্তও হয়ে গেল।

সাহস করে নাম জপা শুরু করে কাছিমের মতন করে একটু এগোনোর পর। শুনতে পেলাম সেই স্বর ধীর স্বরে কাদের বলছে, "জেনে রাখ, মানুষদের জগতে সবাই হাসে পাগলকে দেখে। ক্যানো জানিস!? কারণ, পাগল না হতে পারার দুঃখে। তাই ও যেমন আমাদের সামনে, ওদের ভগবানের নাম নিয়ে ভয় দ্যাখানোর চেষ্টা করেছে।‌ তেমনই ওকে ছেড়ে দে ওদের জগতে। ওর আজকের বীরত্বের গপ্পো শুনে হাসুক লোকে, দেখে ওকে। জ্বলুক সবে পাগল না হওয়ার দুঃখে। যত লড়বে ওরা অহং কারণে। তত দল ভারী হবে আমাদের এখানে। হেঁ হেঁ হেঁ..."

কিছুক্ষণ সব চুপ। মুহূর্তে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি, আর কেউ নেই! ফিরে দেখলাম, আমাদের বাড়ি সামনেই। বাড়ির দিকে এগোতে পা বাড়াতেই, কেউ কানের পাশে ফিসফিসিয়ে বলে গেল,
'তুই, নাম জপা চালিয়ে যা, আমি তোর সঙ্গে আছি।'

(সমাপ্ত)

04/04/2021

#একঝাঁক_রক্তযোদ্ধা •
#শম্পা_দেবনাথ

রাতুল , একবার নেমে আয়। দরকার আছে। "
রাস্তা থেকে ডাক দেয় বনি।
বনিকে বরাবরই পছন্দ রাতুলের। এক পাড়ায় থাকে। পরোপকারী বেশ। কিন্তু হঠাৎ বনি ডাকতে এল? কি ব্যাপার ? বনির ডাকে এমন সাত -পাঁচ ভাবতে ভাবতে দুটো সিঁড়ি টপকে টপকে তিনতলা থেকে নামতে লাগল রাতুল।
" কি ব্যাপার ম্যাডাম , হঠাৎ দর্শন। " রাতুল একটু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল।
" এই তোর ব্লাড গ্ৰুপ কি রে ? " বনি বেশ উত্তেজিত।
" কেন , তা জেনে কি করবি ?"
" বল না, দরকার আছে। "
" আমার AB +... কিন্তু কেন। "
" আরে , বিজয়দাকে চিনিস তো ! যার মোড়ের মাথায় ছোট্ট মুদির দোকান , খুব খারাপ অবস্থা। অনেক রক্ত দরকার। কিছুটা ওরা জোগাড় করতে পেরেছে। আমরাও দশজনকে টার্গেট করেছি। যারা রক্তদান করে থাকে। ওরা দিচ্ছেও। কিন্তু আরো লাগতে পারে। তোর গ্ৰুপ লেগে যাবে। তুই তৈরী থাকিস। ঠিক আছে ? এটা জানাতেই এলাম। দু-এক দিনের মধ্যেই তোকে ফোন করব। আজ আসি ।" রাতুলের উত্তর শোনার অপেক্ষা না করেই হাওয়ায় যেন ভেসে চলে গেল বনি।

রাতুল একটি পঁচিশ বছরের তরতাজা যুবক। আজ পর্যন্ত কোথাও রক্ত দেয় নি। ওর সূঁচ ফোটাতে ভীষন ভয়। ছেলেবেলায় ইঞ্জেকশন নিতে গিয়ে তুলকালাম করত। বাড়ি থেকে দু-তিন জনকে যেতে হত সামলাতে। বনির কথায় কি করবে ভাবতে গিয়েই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব , ও পারবে না‌। রক্ত দেখলেই ওর মাথা ঘুরতে শুরু করে। তার ওপর সিরিঞ্জ , ওরে বাবা! বনি হয়ত ভীষন হতাশ বা অসন্তুষ্ট হবে। কিন্তু ওর দ্বারা রক্ত দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। রাতুল ভাবে , তার থেকে বরং কোনো একটা অছিলায় দূর্গাপুর পিসির বাড়ি পালিয়ে যাওয়া ভালো।

সকাল থেকে বনি রাতুলকে ফোন করেই চলেছে। আজ রাতুলকে রক্ত দিতে আসতে বলতেই হবে। বিজয়দাকে বাঁচাতেই হবে। ওর বৌ-বাচ্চা না হলে পথে বসে যাবে। আর কয় ইউনিট রক্ত পেলেই ডাক্তারবাবু আশার আলো দেখতে পাবেন বলেছেন‌। কিন্তু রাতুলের ফোনটা সুইচ অফ বলছে কেন? গতকাল বনি রাতুলকে মেসেজ করে সব ডিটেলস দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন রাতুল সাড়া দিচ্ছে না কেন ?

দুপুরে রাতুলের বাড়ি গিয়ে ফিরে আসে বনি। রাতুল পরশু দূর্গাপুর চলে গেছে শুনে ভীষন অবাক হয়। হাসপাতালে শূন্য হাতে ফিরতে ফিরতে ভাবে, আর কার থেকে এখন রক্ত জোগাড় করবে। বিজয়দার বৌ তো বনির আশায় বসে আছে। কি যে করবে এখন ! রাতুল তো বলে দিতেই পারত। কেউ তো কারো থেকে জোর করে রক্ত নিতে পারে না। দু হাতে মুখ ঢেকে হাসপাতালের এক বেঞ্চে বসে পড়ে বনি। গলায় একটা কষ্ট জমাট বাঁধছে। চোখ দুটো ভীষন জ্বালা করছে।

হঠাৎ্ বনির কাঁধে একটা হাতের আলতো ছোঁয়ায় বনি চোখ তুলে তাকায়। রাতুল ধপ করে পাশে বসে পড়ে।
" ফোনটা সুইচ অফ হয়ে গিয়েছিল রে। তুই ভাবিস না। বিজয়দা ভালো হয়ে যাবে। আমি রক্ত দিয়ে এলাম। কাল আমার দুই বন্ধু আসবে রক্ত দিতে। তুই খুশী তো বনি ? আমার ভয়কে তোর জন্যই জয় করতে পারলাম। আমি কিন্তু ভীষন খুশী। "

বনি রাতুলের হাতটা জোরে চেপে ধরে। চোখে খুশীর আলো।

××××××××××××××××××××××

পলাশবাবু মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে প্রয়াত হলে ওনার স্ত্রী বন্দনা রায় ক্রমশঃ শুচিবায়ুগ্ৰস্থ হয়ে পড়েন। অবশ্য এই বাতিক ওনার আগেও ছিল। তবে এখন তা তুঙ্গে। একমাত্র মেয়ে পৃথা মায়ের এই আচরণে বিরক্ত হলেও ভয়ে কিছু বলে না।
রাত দিন ওর ধোয়াধুয়ির ঠ্যালায় রায় বাড়ি উত্তপ্ত।

মাঝখানে বড় উঠোন এবং তার চারিপাশে ঘর-বারান্দা, দোতলা মিলে প্রায় পনেরটা ঘর। অনেকেই নিজেদের ভাগটুকু ভাই বা বোনকে বিক্রি করে অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে উঠে গেছে। পুরো বাড়িতে আপাততঃ চারটি পরিবারের বাস। রায়বাড়ির বাচ্চাগুলো পারতপক্ষে বন্দনা দেবীর ঘর মাড়ায় না। নীচের কলতলাটা বেশীরভাগ সময়ই বন্দনা দেবীর দখলে থাকে। উঠোনে যদি কোনো মুচি বা মেথর ঢোকে , তা কখনো বন্দনা দেবীর শ্যেণদৃষ্টি এড়ায় না। সঙ্গে সঙ্গে নেমে উনি ঝাঁটা-বালতি নিয়ে নেমে পড়েন। এবং শেষে গোবর জল ছিটিয়ে রায়বাড়িকে পরিশোধন করেন।

পলাশ বাবু যখন অসুস্থ ছিলেন তখন সাহায্যকারী হিসেবে বন্দনা দেবীর হাজার অসুবিধা স্বত্ত্বেও তিনি তার মনোনীত লোকজন ছাড়া ঘরে ঢুকতে দিতেন না। "কোনো অজাত- কুজাত আমার ঘরে ঢুকবে না। আমি একাই পারব। "

করোনার অতিমারীর কারণে জীবন যাপন কিছুটা হলেও বিপর্যস্ত। বছরের শেষের দিকে জীবন তার কিছুটা হলেও ছন্দ ফিরে পেয়েছে। এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন পৃথার এক ভয়ঙ্কর আ্যকসিডেন্ট হয়। নীচের কলতলায় পা হড়কে আছড়ে পড়ে পৃথা। একটা ইঁটের কোনায় পেটে চরম আঘাত পায় সে এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ে। কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

পেটের আঘাত এতটাই তীব্র যে অন্ত্র থেকে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং রক্ত দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। পৃথার রক্তের গ্রুপ " ও নেগেটিভ "। এই রেয়ার গ্ৰুপের ডোনার পাওয়া খুব সহজ হয় না। তবুও ব্লাডব্যাঙ্ক থেকে কিছুটা জোগাড় হয়। তারপরেও আরো রক্তের প্রয়োজন হয়। পৃথার মিষ্টি স্বভাবের জন্য বন্দনাদেবীর পূর্বে উপেক্ষা স্বত্বেও পাড়ার সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বন্দনা দেবী হাসপাতালে গনেশ মূর্তির কাছে হাতজোড় করে বসে। স্বামী অকালে চলে গেছেন। এখন যদি একমাত্র সন্তানের কিছু হয় তাহলে তিনি কি নিয়ে বাঁচবেন ! এদিকে রক্তের জন্য আত্মীয়-স্বজন, পাড়া সবাই ছোটাছুটি করছে। কিছুতেই ' ও নেগেটিভ ' রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা কি তাহলে ? না না , এমন অমঙ্গলের কথা মাথাতে আনতে চান না তিনি। সর্বশক্তিমানের কাছে চোখের জলে দয়া ভিক্ষা করে চলেন বন্দনা দেবী।

" মাসীমা , আমি কার্তিক। আপনি তো জানেন আমরা জাতে ছোট। কিন্তু আমার ' ও নেগেটিভ ' গ্ৰুপ। আর এই যে আমার এক ভাই, ওর ও ঐ গ্ৰুপ। পৃথাদিদির জন্য আমাদের রক্ত নেবেন মাসীমা ? আপনাদের থেকে জাতে ছোট ঠিকই। কিন্তু রক্তের রঙ তো একই। তাই না মাসীমা ? "

আজ বড়দিন। পৃথা সুস্থ পুরোপুরি। বন্দনা দেবী একটা যিশুখ্রীষ্টের ছবিতে মালা পড়িয়েছেন। পাড়ার ছেলেগুলোকে দিয়ে সারা বাড়িতে টুনি লাগিয়েছেন। উঠোনে পাত পেড়ে আজ রাতে খাওয়া ও গান বাজনা চলছে। বন্দনা দেবীর রান্নাঘরে পাড়ার সালমা , ফিরোজা বিরিয়ানী বানাচ্ছে। কেক বানিয়েছে রোজি। কার্তিক ও ওর ভাই পরিবেশনের কাজে সাহায্য করছে।
রায়বাড়িতে আজ সত্যিকারের মানববন্ধন।

××××××××××××××××××××××××××××××
( পাড়ার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গল্পদুটি খুবই সাধারণ। শুধু মাত্র সামাজিক মেসেজ দেওয়ার জন্যই লেখা। )

30/03/2021

#কল
#শুভ্র

কতগুলো লোক। একটা সরু গলির ভিতর। দুই বাড়ির মধ্যিখানে একটা কলপাড়ের ধারে, তর্কাতর্কি থেকে ঝগড়া বেঁধেছে। তারপরেই একটা মারামারির শব্দ শোনা গেল। তারপরেই হঠাৎ গোলমাল থেমে গিয়ে, একটা হাসির রব উঠল।

খানিক বাদেই জানা গেল কাহিনি। পাশাপাশি দুই বাড়ি। একটি পুরানো একতলা বাড়ি। একটি ফ্ল্যাট বাড়ি। ফ্ল্যাট বাড়ির এক বাসিন্দা কৈকেয়ীদেবী। তাঁর নাতি এবং মেয়ের সাথে থাকেন।
এখন সমস্যা হল, উনি বাকী প্রয়োজনীয় জল ফ্ল্যাটে পেলেও। শুধু ঠাকুরের জল নিতে আসেন রাস্তার কলে। কারণ অজানা। এভাবে জল নিতে নিতে একদিন কৈকেয়ী দেবী অনুভব করলেন, রাস্তার কলে দশজনের মাঝে ঠাকুরের জল নেওয়ার থেকে ভালো হত, যদি তাঁর ঘরে একটি আলাদা জলের সংযোগ থাকত।

এখন, কৈকেয়ী দেবীর ঘরে জলের কলের দরকার। কিন্তু তা আনতে গেলে বিভিন্ন কারণে, সোজা পথে তা সম্ভব না।

তাই অভয় বাবুর সাথে শলাপরামর্শ করে, ওনার সাহায্যে, অন্য পথে জলের কল আনতে পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু বাতাসে ভাসতে থাকা ধর্মের কল মোক্ষম সময়ে বেজে ওঠায়, ওনাদের জলের কলের সেই পরিকল্পনা ভেসে যায়। এরপর দশজনের সামনে নিজেকে নির্দোষ এবং বিরোধী দলনেতাকে দোষী সাব্যস্ত করতে, অভয় বাবু একদিন, এক কৃত্তিম কলহ কাহিনীর রচনা করেন। কলে জল পড়ছে। কলের ধারে নাটুকে ঝামেলা চলছে।এমন সময়ে, তাড়াহুড়ো করে অভিনয় করতে গিয়ে, অভয় বাবু জলের কলের ধারের ভেজা মাটিতে পা পিছলে পড়ে যান।

ধপাশ্ করে ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ পেয়ে। পাশের বাড়ির ভিতর থেকে মুখ লুকিয়ে, কৈকেয়ী দেবী জোর আওয়াজে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কি হয়েছে'? উত্তর পেলেন, 'সবাই হাসছে, অভয় বাবু পড়ে গ্যাছে'।
'কাকু পড়ে গিয়েছে'! শুনেই কৈকেয়ী দেবীর নাতি পিন্টু, দৌড়ে এল অভয় বাবুকে তুলতে। পাঁচ মিনিটে ঘটনাস্থলে সে এসে হাজির, কিন্তু, অভয় কাকু কোথায়? কেউ পাশ থেকে বললেন, 'এদিকে তো নেই, লজ্জায় বাড়িতে ঢুকে পড়েছে বোধহয়'।

বাড়ির ভিতরেও খুঁজে পাওয়া গেল না। ওনার স্ত্রী বললেন, 'এখানে তো আসেনি। ‌আমি তো ভাবলাম মাসিমার বাড়িতে মুখ লুকিয়েছে বুঝি'। বাইরেও নেই, ভেতরেও নেই। তবে কি ডাক্তারের কাছে গেল নাকি, উবে গেল!? ওনার দলের ছেলেদের তরফ থেকে প্রায় হুলিয়া জারি করা হবে। এমন সময় অভয়বাবুর স্ত্রী হটাৎ 'ওগো' 'ও মা গো' বলে চিৎকার করে উঠলেন।‌ অবশেষে অভয় বাবুর খোঁজ শেষ হল।

মাসিমা জানতে চাইলে ,' কোথায় রে অভয়? কোথায়'? নাতি বললে, 'বাথরুমের ভিতর। বসে আছে সেথায়'। সেখানে গিয়ে দ্যাখা গেল, অভয়বাবু বাথরুমের বন্ধ কলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে কাঁদছেন! উপস্থিত সকলের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হল, "উনি বোধহয় সকলের নামে দলের দাদার কাছে নালিশ করবার জন্য, মনে মনে অভিমান জমিয়ে তুলছিলেন..."।

কৈকেয়ী দেবীর বড় আদুরে প্রতিবেশী অভয় বাবু। সে 'ধরা' পড়ে গেছে বুঝে, আর সাগরেদরা সেখান থেকে চম্পট দিলেও। কৈকেয়ী দেবী আর তাঁর নাতি যাননি। হয়ত প্রিয় সঙ্গীকে ছেড়ে যেতে পারেননি।
বাথরুমে বসেই মুখ ঘুরিয়ে কৈকেয়ী দেবী আর পিন্টুকে এগিয়ে আসতে দেখে, অভয় বাবু গর্জে উঠলেন, 'ঘাটে যাওয়ার বয়সে পৌছেও, আপনার এত লোভ কেন? আপনার জন্যেই...'

কৈকেয়ী দেবী বললেন, 'আমি কি অত জানি বাবা? শুনেছিলাম ভোটের আগে-পরে কিছু কিছু সময় কোনো কোনো নেতারা এসব সুযোগ নাকি দ্যায়। পাড়ার দত্ত বাবুরা নিয়েছেন, তোমরাও নিয়েছ। তাই আমিও আমি ভাবলাম, আমারো যদি এই ফাঁকে একটা কিছু হয়ে যায়। কিন্তু...'
- '....হ্যাঁ ওটা জানেন নেতারা সুযোগ দ্যায়। আর এটা জানেন না, বিরোধীরা কেস্ দ্যায়'।

(সমাপ্ত)

20/03/2021

#বাড়তিকথা
#সুদীপা_জি.চক্রবর্তী

মেয়েকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে, মিল্ক বুথ থেকে দুধের প‍্যাকেট নিয়ে হেলেদুলে ছন্দসী যখন বাড়ি ফিরল, কল‍্যাণ তখনও বিছানায়। অন্য দিন এই সময় উঠে হালকা যোগব্যায়াম সারে, খবরের কাগজে চোখ বোলায়। কিন্তু আজ সেসবের ধার মাড়ায়নি।

ছন্দসী খুব গুছিয়ে সংসার করে। আগের দিন রাতেই পরের দিনের মেয়ের টিফিন, সকালের জলখাবার, কল‍্যাণ এর অফিসের লাঞ্চ, জোগাড় করে রাখে অনেকটাই। কুটনো, বাটনা সবটাই করে রাখে। ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে যাতে চট করে সেরে ফেলতে পারে সবটুকু। ঘর গোছানো, ঠিকে কাজের লোকের পেছনে তদারকি, সব পরিপাটি ভাবে করে ছন্দসী। টিপটপ যাকে বলে।

আজ তাল কেটেছে কোথাও। বিছানায় অর্ধশায়িত কল‍্যাণের গোমড়া মুখ দেখেই বুঝেছে সে। শোওয়ার ঘরে ঢুকে বাইরের শাড়ি ছাড়তে ছাড়তে আলতো প্রশ্ন ছোঁড়ে।

~ আজ অফিস যাবে না? এখনো শুয়ে আছ যে বড়!

~ নাহ্, আজ ডুব মারব ভাবছি‌। ভালো লাগছে না।

~ শরীরটা খারাপ?

~ আরে না। এমনিই। ভালো লাগছে না।

কল‍্যাণ কোলবালিশ জড়িয়ে আবার শুয়ে পড়ল। ছন্দসী আর কথা বাড়ালো না। গরম চায়ের কাপ হাতে এসে বরং আবার খোঁচানো যাবে। এহেন মুখ গোঁজের কারণসমূহ জানতে হবে ব‌ইকি।

অদিতি দি ওদিকে কাজে এসে গেছে। তাকেও এক কাপ চা ধরিয়ে দুজনের দু কাপ নিয়ে ছন্দসী ফের ঘরে এলো। কল‍্যাণ আগের মতোই শুয়ে আছে। নট নড়নচড়ন।

~ নাও চা টা ধরো দেখি।

~ হুমম, দাও।

~ এবার বলো তো তোমার হয়েছেটা কী? এভাবে শুধু শুধু অফিস কামাই করার লোক তো তুমি ন‌ও। ঝেড়ে কাশো তো। একদম এড়িয়ে যাবে না।

~ না মানে, ইয়ে... ওই গতকাল ইরার জন্মদিন ছিল। তাই টিফিন আওয়ার্সে আমাদের কয়েকজনকে রসমালাই খাওয়ালো। বাড়ি থেকে নিজে বানিয়ে এনেছিল।

~ তা ভালো তো। এর সাথে তোমার অফিস কামাইয়ের কী যোগ?

~ আছে গিন্নি। সবাই ইরার বানানো রসমালাই খেয়ে খুব তারিফ করছিল। আমিও করলাম। বলার মধ্যে শুধু বলেছি, ' আ সুইট ফ্রম এ সুইট লেডি! ওয়াও!'। ব‍্যস এই নিয়ে সবাই জল টল ঘোলা করে ছাড়ল। ইরা তো কটমট করে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকাল। আর বাকিরা হো হো করে সে কি হাসি! ছুটির সময় তো সমীর, পার্থরা বলেই ফেলল, ' মুখার্জি দা..পেটে পেটে এত! অত সুইটনেস লুকিয়ে রেখেছিলেন ইরার জন‍্য! এলেম আছে মশাই!'
আচ্ছা আমি কী এমন বললাম বলো ছন্দা?

~ দেখো, আজকাল সব কথারই হাত পা বেরোয় বুঝলে। কে কিভাবে তোমার কথাটাকে নেবে সেটা বোঝা খুব মুশকিল। তুমি যেটা মিন করতে চাওনি, সেটাই লোকজন বেশি করে গায়ে টেনে নেবে। তাই সবচেয়ে ভালো উপায় হল, বাড়তি কথা না বলা। মেপে সমঝে বাক‍্যালাপ বুঝলে। বাকিরা যখন বাহ!, খুব ভালো, এসব বলছিল তখন তুমিও সেরকম কিছু বলতে পারতে। মেইন ব‍্যাপারটা ছিল ইরার বানানো রসমালাই এর প্রশংসা করা। কিন্তু তুমি তো বাড়তি কতগুলো কথা বলে অযথাই হ‍্যাটা হয়ে এলে। আর সেই দুঃখে আবার অফিস‌ও যাবে না বলছো।

~ তা কি করব? অফিস যাব? ওরা আবার হাসাহাসি করবে।

~ আলবাত যাবে। আর আজ তুমি ওদের খাওয়াবে। তুমি স্নানে ঢোকো। আমি ভাত বসিয়ে চট করে একটু গুড়ের পায়েস বানিয়ে দিচ্ছি। অফিসে গিয়ে বলবে, 'ইরার জন্মদিনে শুধু ইরাই কেন খাওয়াবে? আমরাও ট্রিট দিতে পারি। তাই আমার ঘরের সুইট লেডি এই সুইটডিস টি পাঠিয়ে দিলেন।' কেমন?
যেমনটি বললাম ঠিক তেমনটি বলবে।

~ অ্যাঁ ?

~ অ্যাঁ নয়, বলো হ‍্যাঁ। যে বাড়তি কথাগুলো বলে এসেছো, সেগুলো ম‍্যানেজ করতে.. জোড়াতালি মারতে এই বাড়তি কথা কটাও যে বলে আসতে হবে!
নাও আর দেরি না করে সবকিছু ঝেড়ে টেড়ে তৈরি হ‌ও।

গুনগুন করতে করতে ছন্দসী রান্নাঘরে ঢোকে। পায়েস এর জন্য দুধ জ্বাল দিতে বসিয়ে ভাবে, বেচারা কল‍্যাণটা সত্যিই কিছু মিন করে কথাগুলো বলেনি। এমনিই বলে ফেলেছে। তবু হাসিঠাট্টার খোরাক হল। একটু ব‍্যালেন্স করে কথা বললেই পারে... তা না! অল্প বলবে। অবজার্ভ করবে বেশি। কতগুলো অতিরিক্ত কথা খরচ করে ছড়িয়ে একাকার করা কিন্তু মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কী বলেন?...

17/03/2021

#জীবন_নাস্তানাবুদ
#শুভ্র

যে হারিয়ে যায়,সে বোধহয় বোঝে না সে হারিয়ে গেছে।
এই যেমন বিকালে বাড়ির বাইরের রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে একটি পার্কে ঢুকলাম। দেখলাম, হরেক রকম মানুষ। সবাই বেশ হাসিখুশি। হাসিখুশি মানুষদের মাঝে গোমরা মুখে থাকা যায় না। আমিও তাই হাসিখুশি হয়ে গেলাম। কিন্তু, মজার ব্যাপার হচ্ছে হাসি-খুশি থাকার মধ্যেও,সবার মুখে ক্যামন যেন 'বাধ্যতা'র ছাপ মনে হল। যেমন বলি, একটু দূরে ঘাসের উপর একটি বাচ্চা ছেলেকে দেখলাম, একা একা বল নিয়ে লোফালুফি খেলছে।

কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, বাচ্চাটার মনে আনন্দ নেই! কারন তার বাবা-মা কেউ, তার সাথে খেলছে না। সে হয়ত ভাবছে, তাকে খেয়াল করার কেউ নেই। অথবা হয়ত ভাবছে, বাড়িতে শাসন করে আর পার্কে পাত্তাও দিচ্ছে না। উল্টো দিকে কিন্তু দেখলাম, সেই বাচ্চাটির অভিভাবক যারা। তাঁরা কিন্তু তাদের সন্তান কে নজরের বাইরে যেতে দিচ্ছেন না। তা়ঁরা একটু পর পর তাকে দূরে যেতে বাধা দিচ্ছেন।

তাদের সন্তানের থেকে দৃষ্টি ঘুরালাম। এখানে সব মানুষরা হাসিখুশি। শুধু তাদের সাথে থাকা বাচ্চাগুলো হাসিখুশি না। আমি একজনকে বললাম...

- 'ভাই যদি আপনি কিছু মনে না করেন, আমি একটি প্রশ্ন করি?'
-' হুম ..!'
-' এখানে সবাই হাসতে বাধ্য হচ্ছে ক্যানো?'
- 'হা হা হা.. (হেসে বলল),
গবেষকদের গবেষণায় মনের কান্তি
হারিয়ে গেল বুঝি!
কোথায় গেলো কোথায় গ্যালো
কোণাকাঞ্চি খুঁজি।
আমরা করি গেরস্থালি
নিজের জমি চাষ।
নিজের জন্য ভেবে ভেবে
আজ নিজেরই ক্রীতদাস।'

এরই ফাঁকে দেখলাম। কথা বলার ফাঁকে, তাঁর ছোট্ট খুকি এসে বাবার হাত ধরল। তার আরেক হাতে আলোক-চিত্রগ্রাহক যন্ত্র। বুঝতে পারিনি কথা গুলি শুনতে শুনতে, কখন আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে দিয়েছে। সন্ধ্যার গোধূলী লগ্নে তা মিশে,এক অদ্ভুদ পরিবেশ তৈরী হয়েছে।

ফেরার আগে,সেই ছোট্ট মেয়েটিকে বললাম।আমাকে তোমাদের ছবি তুলতে দেবে? সহাস্য রাজী হল সে। মেয়েটির মুখে হাসি দেখার ইচ্ছায়,লোকটিকে বললাম,
- 'আপনি চোখ ট্যারা করুন তো। ছবি তুলব।বাবা কে ট্যেরা হতে দেখে মেয়ের মুখে হাসি ফুটলো। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর হাসিমুখের ছবিটা তুলে রাখলাম।

যখন ফিরছি,তখন অদৃশ্য কেউ ফিঁসফিঁসিয়ে মনে মনে বলল-
'পথহারা দেব বলেছেন:
জীবন হল 'বৃত্ত' খনি
নিয়মে চললে রাজা রাণী।
অধিক সন্ন্যাসী বুদ্ধি কেড়ে খায়
জীবন তখন বেলাগাম হয়।।
জীবনকে যদি বৃত্তে রাখ
থাকবে স্বস্তি সুখ।
বর্গক্ষেত্র আয়তকারে
জীবন নাস্তানাবুদ।'

12/03/2021

#পরিবর্তন
#অর্পিতা_চৌধুরী

আজকাল চুর্নীর আর কিছু ভালো লাগে না। বড়ো একঘেঁয়ে জীবন যাপন করছে। আগে তবুও টুকটাক সিনেমা, শপিং মল, বছরে একবার বেড়ানো হচ্ছিল গত এক বছর ধরে সব বন্ধ! ওর তো মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, কারণে অারণে মাথা গরম করে ফেলে। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে। তারা নিজেদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। বাড়িতে শুধু ওরা দুজন, ও আর ওর বর সৌগত।

ও গৃহবধূ, নিজের আলাদা জগৎ গড়ে ওঠে নি, সৌগত কর্পোরেট জীবন কে ইস্তফা দিয়ে বছর কয়েক আগে একটি বেসরকারি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছে। চিরকালই পড়াশোনায় অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ও,এতদিন নিজের ছেলে মেয়েকে পড়িয়েছে। আর এখন ছাত্র ছাত্রী ওর টপ প্রায়োরিটি। এখন আবার অনলাইন ক্লাস চলছে বাড়িতে। যখন পড়ানো থাকে না তখন আবার বসে বসে নোটস, প্রশ্ন পত্র তৈরি এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

এই নিয়ে স্বামী স্ত্রীর ঝামেলা বেঁধে যায়। আজই যেমন চূর্নী বলছিলো," চলো না গো একটু নিচের ফ্ল্যাটে আড্ডা দিয়ে আসি", আসলে নিচের ফ্ল্যাটে ওদের অনেক দিনের চেনা একটি পরিবার থেকে, চূর্ণী কে বোনের মতো দেখেন ওই স্বামী স্ত্রী।

সৌগত কে নড়ায় কার সাধ্য, শুরু করে একগাদা অজুহাত। কি হবে গিয়ে, কি কথা বলবো,ইত্যাদি। চূর্নীকে বলে, " তুমি যাও ঘুরে এসো, আমার চুপ চাপ বসে থাকতে বেশি ভালো লাগে।" বোঝো ঠ্যালা, ও একা গিয়ে করবে টা কি? ওরাই বা কি ভাববে?

খুব রাগ হয় চূর্ণীর, সে নিজে হৈ চৈ ভালোবাসে, গল্প করতে বসলে সময়ের খেয়াল থাকে না। সেই মানুষের দিনের পর দিন মুখ বুঁজে কাটানো যে কী শাস্তি সে আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

একদিন ওকে উদাস মুখে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে সৌগত বলে ওঠে," সত্যি তোমার যদি একটু মিশুকে প্রকৃতির ছেলের সঙ্গে বিয়ে হতো খুবই ভালো হত। অনেক আনন্দে থাকতে পারতে!" কথাটা শুনে চুর্নী র একটু খারাপই লাগে, ও কখনোই এটা বলতে পারবে না যে সৌগত ওর খেয়াল রাখে নি, বা বাচ্চাদের প্রতি কণা মাত্র অবহেলা দেখিয়েছে! অত্যন্ত কর্তব্য পরায়ণ, ঠিকের মানুষ ও। নিজের মনে থাকতেই যা একটু ভালোবাসে।

ওদের বিয়ের প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল, চিরকালই সৌগত চুপ চাপ প্রকৃতির ছেলে, বেশি কথা বলা ধাতে নেই। অগত্যা ফোনেই মন রঞ্জন খোঁজে চূর্ণী। সৌগত সবই লক্ষ্য করে, কিন্তু কিছুই করতে পারে না। এই বয়েসে স্বভাব পরিবর্তন করা কি সম্ভব? নিজের স্কুল বা কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে পর্যন্ত তেমন ভাবে যোগাযোগ রাখে না। চূর্ণী সত্যি ভেবে পায় না একটা মানুষ কি করে এই ভাবে একাকিত্ব উপভোগ করতে পারে! ওর কথা ভেবে যদি একটু নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করত সৌগত, তাহলে এতো টা একাকিত্ব গ্রাস করতো না ওকে!

অনেক ভেবেই চূর্ণী শরণাপন্ন হলো ওদের নিচের ফ্ল্যাটে র দাদার, একেবারে নাছোড় বান্দা হয়ে পড়ল, " একটা ব্যবস্থা কর দাদা, ওকে একটু মিশুকে প্রকৃতির করে দাও কারোর সঙ্গে মেশে না, কথা বলে না, এভাবে থাকলে এবার আমি পাগল হয়ে যাবো!"

সেই দাদা এসে সৌগত কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করালেন। বললেন" শোনো তুমি তোমার তিন, চারজন বন্ধুদের মাসে দু, তিন বার ফোন করে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করো। দেখবে আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে যাবে। সৌগত অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করে, কিন্তু কি কথা বলবো? দাদা বলেন, এই যেমন শরীর কেমন আছে, ছেলে মেয়ে কি পড়ছে, এই রকম আর কি...

সৌগত তাই করে। কিন্তু মাসখানেক যাওয়ার পর ও বুঝতে পারে ওর দ্বারা এসব হবে না, ওর বন্ধুরাও কেমন যেন ওর প্রশ্ন করার আগেই উত্তর দিয়ে দেয়, যেন ওরা জানে সৌগত কি কি জিজ্ঞেস করবে ওদের! চূর্ণী বোঝায়, " আরে এত অস্থির হলে চলে, এতদিনের ছাড়াছাড়ি, সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে একটু সময় তো দিতেই হবে, তাই না?"

বিরক্তি চেপে বসে থাকে সৌগত। জোর করে পাচন গেলা একেই বলে, ধূর! আরো কয়েক মাস গেলো, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক জমছে না বলেই মনে হলো ওর। ও আপ্রাণ চেষ্টা করে কথা চালিয়ে যেতে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কথারা সব ফুরিয়ে যায়। ভগবান জানেন লোকে এত গল্প কি করে করে?

মাঝে মাঝে এত লজ্জা করে ওর , ছি ছি চূর্ণী ওকে কী যে বিপদে ফেললো, বেশ তো ছিল নিজের মতো। সবার দ্বারা কি সব হয়? নিজেকে একটা জোকার মনে হয়!

চূর্ণী দেখে এভাবে ঠিক হবে না,তাই আবার সেই দাদার কাছে যায়, ওনার পরামর্শে ঠিক করা হয় সপরিবার বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানানো হবে দোলের দিন। একসাথে খাওয়া দাওয়া, গল্প আড্ডা দেওয়া যাবে। চূর্ণী দাদা কেও সস্ত্রীক আসতে বলে দিলো ওইদিন।

দোলের দিন সকাল থেকেই চূর্ণী নানা রকমের খাবার তৈরি, ঘর সাজানো নিয়ে ব্যস্ত, সৌগত যত টা পারছে সাহায্য করছে। দুজনেই বেশ চাপা উত্তেজনা অনুভব করছে! কত বছর পর আবার পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হবে! কেমন সব চেহারা হয়েছে কে জানে?

বিকেলে যথা সময়ে দরজায় টুং টাং। চূর্ণী তৈরিই ছিল, ছুটে গিয়ে দরজা খোলে, আড় চোখে সৌগতর দিকে তাকায়, দেখে খুশিতে চিক চিক করছে কর্তার মুখ! ব্যাস আর কি চাই, ও তো এটাই চেয়েছিল! সবার সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রাণ খুলে আনন্দ করুক সৌগত।

দরজা খুলতেই ওরা হৈ হৈ করে ঢুকে পড়ল।একসঙ্গে সৌগত কে জড়িয়ে ধরে হো হো করে হাসতে হাসতে বলতে থাকে," তুই যে চুপ চাপ থাকতেই ভালবাসিস তা কি আমরা সবাই জানি না? যা করেছি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই করেছি, স্রেফ তোকে নিয়ে একটু মজা করব বলে, বুঝলি?"

শুরু হয়ে যায় প্রচুর হাসি ঠাট্টা, ইয়ার্কি, ওদের বৌরাও চূর্ণী কে মুহূর্তে আপন করে নেয়। জমজমাট পরিবেশ দেখে ওদের মনে আনন্দ আর ধরে না! ও দেখে সৌগত দিব্যি ওদের সঙ্গে গল্পে মশগুল হয়ে গেছে, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু, আগের সৌগতর সঙ্গে মেলাতে পারে না!তাহলে মানুষ চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে!

আবেগাপ্লুত চূর্ণী এক ফাঁকে রবীন্দ্র সংগীত এর গান চালিয়ে দেয়," হায় মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায়, সবার দেখা যদি হলো সখা প্রাণের মাঝে আয়!"

সমাপ্ত।

Address


Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when বাক্ posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to বাক্:

Shortcuts

  • Address
  • Alerts
  • Contact The Business
  • Claim ownership or report listing
  • Want your business to be the top-listed Media Company?

Share