25/04/2021
#অলসতার_আশীর্বাদ
#মায়াশিখা_চক্রবর্তী
" এই দ্যাখো , ছেলে এখনো ঘুমোচ্ছে। কি যে করি এই আলসিকে নিয়ে ! বাবুয়া , এই বাবুয়া , ওঠ্ শিগগিরি , আজ তোর ব্যাঙ্গালোর যেতে হবে না ? এবার ফ্লাইটটা ঠিক মিস্ করবি। চাকরিটা তোর আর থাকবে না রে। আমার হয়েছে যতো জ্বালা ! সেই ছোটবেলা থেকে এই ছেলেকে গুঁতো মেরে মেরে সব করিয়ে চলেছি। এক কথা পইপই করে বলে চলেছি , ওরে সোনা , যে সারাক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে , তার ভাগ্যও ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু শুনলে তো আমার কথা। ওরে বাবুয়া , তোর ফ্লাইটা যে চলে গেলো রে ! "
মায়ের বকবকানি থামছে না দেখে বাবুয়া চোখ না খুলেই বললো , " উঃ মা , তুমি তো সেই কোন ছোটবেলা থেকেই আমাকে আলসে বলে আসছো। কিন্তু আজ অবধি কোন কাজটা আমার দ্বারা হয়নি বলো তো ? প্রত্যেকটা ক্লাসে প্রথম না হতে পারি , প্রথম পাঁচজনের মধ্যে তো থাকতাম। তোমার জন্য স্পোর্টসে নাম দিয়ে পুরস্কারও এনে দিয়েছি। তারপর ইঞ্জিনীয়ারিং পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করে একটা ভালো চাকরীও পেয়ে গেছি । আর যতদূর জানি কেউ আমায় খারাপ ছেলে বলেনা। দোষের মধ্যে শুধু একটু আলসেমি করে ঘুমোতে ভালবাসি , তা তুমি কিছুতেই সহ্য করতে পারোনা। প্লিজ্ মা , এখন তো আমি বড় হয়ে গেছি , এখন তো আমাকে একটু আমার মতো থাকতে দাও। " বলেই আবার পাশ ফিরে নাক ডাকতে লাগলো।
ছেলেকে আবার শুয়ে পড়তে দেখে সুনন্দা রাগে গজগজ্ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ছেলের এই আলসেমির জন্য সারাক্ষণ তাঁর বড় দুশ্চিন্তায় কাটে। সবে মাস পাঁচেক হয়েছে বাবুয়া এই চাকরিটা পেয়েছে। সময়মতো ব্যাঙ্গালোর না যেতে পারলে ছেলের নতুন চাকরি বজায় থাকবে তো । একরাশ চিন্তা নিয়ে তিনি ছেলের প্রিয় খাবার লুচি , সাদা আলুচচ্চরি আর মোহনভোগ বানাতে লাগলেন।
আরো ঘন্টাখানেক পর বাবুয়া আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখ খুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে চিৎকার করে উঠলো , " মা-মা , তুমি আমায় ডাকোনি কেনো ? আমার ফ্লাইটটা মিস্ হয়ে গেলো , পরের ফ্লাইটে যেতে হবে। " মায়ের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। স্নান সেড়ে চটপট্ তৈরী হয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো , নাঃ এই ফ্লাইটটা আর কোনমতেই পাওয়া যাবেনা , পরের ফ্লাইটেই যেতে হবে। এবার তার নিজেরও চাকরির জন্য চিন্তা হতে লাগলো।
বাবুয়া গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে মায়ের মুখ দেখে বুঝতে পারলো হাওয়া খুব গরম।খাবার টেবিলে বসার আগে টিভিটা চালিয়ে দিলো খবর দেখবে বলে। তারপর রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বললো , " জানো মা , আমাকে তো কম্পানি ওপেন টিকিট দিয়েছে , তাই কাল রাতে ঠিক করেছিলাম অত সকালে না গিয়ে বেলার ফ্লাইটটায় যাবো। তুমি আমায় তাড়াতাড়ি খাবার দাও , খেয়েই বেড়িয়ে পড়ি। " মায়ের কোনো উত্তর না পেয়ে আবার বললো , " মা , তুমি কি আমার চাকরি নিয়ে চিন্তা করছো ? আরে বাবা কিচ্ছু চিন্তা নেই , চাকরির আমার কিচ্ছুটি হবেনা। তুমি সারাজীবন আমার জন্য ভেবে ভেবে নিজের শরীরটা খারাপ করছো। এবার আমাকে নিয়ে ভাবা একটু ছাড়ো তো , আমি নিজের দায়িত্ব এখন নিজেই নিতে পারবো। "
সুনন্দা কোনো কথা না বলে ছেলের সামনে ঠকাস্ করে খাবারের প্লেটটা রেখে আবার রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাবুয়া বললো , " কি হলো , তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না ? আমি আজ চলে যাচ্ছি এক মাসের জন্যে , কদিন শান্তিতে থেকো। রইলো তোমার খাবার , আমি চললাম। " বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়তেই সুনন্দা দৌড়ে এসে তার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন , " ছোটবেলা থেকে তুই আমায় এতো জ্বালাস কেনো ? তোর বাবা চলে যাবার পর থেকে কতো কষ্ট করে তোকে মানুষ করেছি , তোকে ঘিরে আমার কতো স্বপ্ন। আর তুই যদি এমন করিস আমার কতো চিন্তা হয় বুঝিস না ? " বাবুয়া বললো " কি এমন করেছি আমি , একটু বেলা অবধি ঘমিয়েছি এই তো। জীবনে এটুকু আলসেমিতে বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়না। সবই তো আমি ঠিক ঠিক করি মা , আমার চাকরিরও কিছু ক্ষতি হবেনা তুমি দেখে নিও । " সুনন্দা এবার হেসে বললেন , " আচ্ছা আচ্ছা , খুব হয়েছে। এবার খাবারটা খেয়ে দুর্গা দুর্গা বলে বেড়িয়ে পড়ো তো । "
মায়ের মুখে হাসি দেখে বাবুয়া এবার তার খাবার প্লেটে মন দিলো। সুনন্দাও চায়ের কাপ হাতে ছেলের সামনে বসে খবরটা শুনতে লাগলেন। হঠাৎ একটা খবরে সুনন্দার হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে গেলো , আর বাবুয়ারও হাত থেমে গেলো। দুজনেই টিভির দিকে তাকিয়ে হতভম্বের মতো বসে রইলো।
খবরে দেখাচ্ছে যে প্লেনটায় বাবুয়ার যাবার কথা ছিলো সেই প্লেনটা আকাশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে যায়। পাইলট শত চেষ্টা করেও প্লেন এবং প্লেনের যাত্রীদের বাঁচাতে পারেননি। খবরটা দেখে দুজনে কিছুক্ষণ নির্বাক বসে ছিলো , তারপর সম্বিত ফিরে পেয়ে বাবুয়া বললো , " দেখছো মা , তুমি সব সময় বলো আমার আলসেমি নাকি আমার জীবন শেষ করে দেবে , কিন্তু আজ তো আমার আলসেমি আমায় বাঁচিয়ে দিলো মা । তুমি জোর করে আমায় ঐ প্লেনে পাঠালে এখন তোমার কাছে আমার মৃত্যুসংবাদ আসতো , তাই না মা ? " ছেলের কথায় সুনন্দা শিউরে উঠে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন।