25/01/2024
বড় আপার স্বামী যেদিন আমাকে বাড়িতে একা পেয়ে ধর্ষণ করে সেদিন আমি সবার আগে মাকে কথাটা বলেছিলাম। মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলেন, 'এ কথা আর কাউকে বলো না। তোমার বোনের সংসার ভেঙে যাবে।'
আমি নির্বাক হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে ছিলাম। ভাবলাম বড় আপাকে বলি, কিন্তু বড় আপাকে বলার পর তিনি উল্টা আমাকে দোষ দিয়ে বললেন,
'তোর চাল চলনই ভালো না, সে কারণেই তোর দুলাভাইয়ের মাথা ঠিক ছিল না।'
বাবা তখন দেশের বাড়ি ছিলেন না। তিনি সেনাবাহিনীর লোক। ভাবলাম বাবাকে বলবো, কিন্তু মা আমায় বলতে দিলেন না। সেদিনই গভীর রাতে মা আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে হাতে তিনটা ওষুধ দিয়ে বললেন,
'এগুলো খেয়ে নে।'
সকাল থেকে এত কেঁদেছি যে আমার আর কথা বলার মত শক্তি ছিল না। তারপরও বেশ কৌতুহলী হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
'এগুলো কিসের ওষুধ মা?'
'ইমার্জেন্সি পিল, আর ব্যথার ওষুধ সাথে একটা গ্যাস্টিকের ওষুধ।'
'কেন?'
'যদি তোর পেটে বাচ্চা এসে যায়!'
আমি তখনও নির্বাক হয়ে ছিলাম। মা নিজেই আমাকে ওষুধগুলো খাইয়ে রুম থেকে চলে গেলেন। একটা মেয়ে ধর্ষণ হলো অথচ সমাজের ভয়ে, সংসার ভাঙার ভয়ে দুজন মানুষ সব জেনে চুপ করে রইল। শুধু তারাই চুপ রইল না, আমার মুখও বন্ধ করে দিলো।
ঐ ঘটনার সতেরো বছর পার হয়ে গেল।
আপা মায়ের সাথে বসে কান্না করছে। দুলাভাই আর আমার স্বামীও নিশ্চুপ বসে আছেন। বড় আপা কান্না করতে করতে চোখ লাল করে ফেলেছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে চোখের মনি ফেটে এখনি রক্ত বের হবে। আপা, মায়ের হাত ধরে বলল,
'মা, আমার মেয়েটার এখন কী হবে? ঐ শয়তানটা কী শাস্তি পাবে না?'
আপা আর দুলাভাইয়ের বড়ো মেয়ে রেশী; বয়স পনেরো প্লাস। আজ সকালে সে তার চাচাতো ভাইয়ের দ্বারা ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে। আপার কথা শুনে আমি বললাম,
'সেকিরে আপা কী বলিস এসব? ছেলেটাকে শাস্তি দিবি? তাহলে তো লোক জানাজানি হবে, তোর মেয়ের বদনাম হবে, তোর ভাসুরের ছেলের ক্ষতি হবে। তারচেয়ে বরং চেপে যা।'
আপা রাগী কণ্ঠে বললেন,
'কী বলছসি মিতু? একটা জানোয়ার আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করল, আর তুই বলছিস তাকে ছেড়ে দিতে? এই তোর নীতি, বিবেক?'
আমি খানিক তাচ্ছিল্য করে বললাম,
'তোর তো দেখছি বিবেক, নীতি চারপাশ থেকে বেয়ে ছেঁয়ে পড়ছে। তা তোর এ নীতি সতেরো বছর আগে কোথায় ছিল? সেদিন তোর বিবেক কোথায় লুকিয়েছিল? যেদিন সতেরো বছরের একটা মেয়েকে তোর স্বামী রেপ করেছিল। তখন মেয়েটি তোর আর আমার মায়ের কাছে এমনি কান্না করে করে, তোর স্বামীর শাস্তি চেয়েছিল? তুই তো নিজের সংসার ভাঙার ভয়ে মেয়েটাকে বদনামের কথা বলে চুপ করিয়ে দিয়েছিলি। তোর বরকে শাস্তি দেয়ার বদলে মেয়েটাকে কিছু ব্যথার আর বাচ্চা না হওয়ার ওষুধ দিছিলি। তোর লজ্জা করেনি একজন রেপিস্ট এর সাথে সংসার করতে?'
আপা, দুলাভাই, মা আর আমার বর, আমার দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি আবার বললাম উপরওয়ালা ছাড় দিলেও ছেড়ে দেন না। তোর স্বামীর পাপ তার মেয়ের উপর বর্তেছে। তাছাড়া তোর স্বামীর বংশ মনে হয় বংশগত রেপিস্ট। দেখিস না তোর স্বামী একজনকে রেপ করেছে, তার ভাতিজাও রেপিস্ট। খোঁজ নিয়ে দেখ হয়তো তার বাবা দাদাও তেমন ছিল।'
আমি আর কোনো কথা বললাম না। চুপ করে নিজের রুমে চলে এলাম। আমার স্বামী আমার পিছু পিছু আসল। জানি তার মনে এখন অনেক প্রশ্ন? তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললাম,
'মাহিম, আমি আমার জীবনে দুজন চমৎকার মানুষ পেয়েছি। একজন আমার বাবা আর একজন তুমি। তুমি, সবসময় জিজ্ঞেস করতে আমি কেন আপা দুলাভাইর সাথে কথা বলি না? কারণ দুলাভাই যে মেয়েটাকে রেপ করেছিল সে মেয়েটা কে, আশাকরি তুমি বুঝতে পারছো। আমি তোমাকে আর বাবাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। বাবা তো বেঁচে নেই এখন আমার এত বড় সত্যিটা লুকানোর জন্য তুমি যে শাস্তি দিবে তার জন্য আমি প্রস্তুত।'
মাহিম কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমি জানি ও কী করবে? ঘন্টা কয়েক এদিক ওদিক হেঁটে তারপর বাড়ি ফিরে বলবে মিতু খিদে পেয়েছে। বেশি কষ্ট পেলে ও এমনটা করে। আজকেও তার অন্যথা হলো না। খেতে খেতে বলল,
'মিতু, রেশীর জীবনটা কী নষ্ট হয়ে যাবে?'
'তুমি তো এ শহরের বর্তমান মেয়র। তুমি কী পারো না তাকে শাস্তি দিতে?'
'আমি সে ব্যবস্থা করে এসেছি। তবে তোমার দুলাভাইকে আমি তোমার পায়ের কাছে ফেলে ছাড়ব।'
আমি কিছু না বলে ওর প্লেটে আরেক টুকরো মাছ তুলে দিলাম।
আমাদের এ শহরে কিছু ঘটনা ঘটে, যা বারবার ঘুরে ফিরে আর। যারা বারবার ইতিহাসের পাতা ঘেটে ইতিহাসকে বারংবার উন্মোচিত করে। পুনঃপুনঃ একই ঘটনা ঘটে। এ কারণেই এ শহরের শেষ নেই।
©️
রে_শেষ_নেই
নতুন নতুন সব গল্প পেতে ফলো করুন।