07/12/2022
ইতিহাস একটি জাতির আয়না। এ আয়নায় জাতি তার অতীতকে দেখে। অতীতের সুদিনের জন্য গর্ব করে। অথবা কৃত ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়; শিক্ষা নেয় ঘুরে দাঁড়ানোর। তাই ইতিহাসশাস্ত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক শাস্ত্র। সুতরাং ইতিহাসপাঠের জরুরত বর্ণনাতীত।
তবে এক তিক্ত সত্য হচ্ছে, অধিকাংশ পাঠক ইতিহাসপাঠে আগ্রহী থাকে না। আদতে ইতিহাসশাস্ত্র কিছুটা তাত্ত্বিক ও তথ্যভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র হওয়ায় এবং অনেকক্ষেত্রে রসকষহীন হওয়ায় অনেক পাঠকই এখানে মজা পায় না। তবে সচেতন ও প্রকৃত জ্ঞানপিপাসু পাঠক মাত্রই ইতিহাসপাঠে অভ্যস্ত। ইতিহাসপাঠের প্রয়োজনীয়তা কেবল ইতিহাস জানার জন্যই নয়, বরং এমন অনেক শাস্ত্র আছে, যার প্রকৃত ও যথাযথ অনুধাবন ইতিহাসপাঠের ওপর নির্ভরশীল। ইতিহাসকে বাদ দিয়ে অন্য শাস্ত্রে দখল অর্জন করা দুষ্কর। এই যেমন :
••• মহাগ্রন্থ কুরআনকে যথাযথভাবে বুঝতে গেলে ইতিহাস জানা জরুরি। কুরআনের এমন অনেক আয়াত আছে, যেগুলোর নাজিলের ইতিহাস (আসবাবে নুজুল) না জেনে যথাযথভাবে তা উপলব্ধি করা অসম্ভব। মূলত পুরো কুরআনকে বুঝতে নাজিলের ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। নতুবা কুরআনের অনুধাবন হবে ভাসাভাসা, কোথাওবা ভুল।
••• একই কথা হাদিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখন-কেন কথাটি বলেছেন, তা জানাও ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি হাদিসের অবতারণার কারণ ও প্রেক্ষাপট না জেনে সঠিক অনুধাবনে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাছাড়া হাদিসের মান যাচাইয়ের ক্ষেত্রে রাবিদের জীবনেতিহাস জানাও জরুরি— 'রিজালশাস্ত্র' নামে স্বতন্ত্র এক শাস্ত্রই তো আছে, যেখানে রাবিদের জীবনেতিহাস আলোচিত হয়।
••• সঠিকভাবে ফিকহি মাসআলা-মাসায়েল উদঘাটন করার জন্যও ইতিহাসের প্রয়োজন পড়ে। ফিকহের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে কিয়াস। বিভিন্ন নস ও অতীতের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখেই একজন ফকিহ কিয়াস করে থাকেন। নতুবা সঠিক মতে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। তাছাড়া কুরআন-হাদিসের এমন অনেক নস আছে, যা দেখে আপাতত দৃষ্টিতে যেটা মনে হবে, অতীত প্রেক্ষাপটসহ বিস্তারিত জানলে ঠিক তার উল্টোটা হবে। অধিকন্তু অনেক আয়াত-হাদিসই মানসুখ হয়ে গেছে। মানসুখের ইতিহাস না জেনে কেবল টেক্সট পড়েই মাসআলা বের করতে গেলে বাধবে বিশাল গোলযোগ।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, ইতিহাসশাস্ত্র আরও অনেক শাস্ত্রের যথার্থ অনুধাবনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও ইতিহাসশাস্ত্রের কিছু উপকারিতা নিম্নরূপ :
••• আমাদের গৌরবের ইতিহাস জেনে আমরা উৎসাহিত হই। আমরা প্রেরণা পাই গৌরব ফিরিয়ে আনার। আমরা নির্দেশনা পাই সম্মানের পথে চলার। ইজ্জত ফিরে পাওয়ার কর্মকৌশল জানতে পারি।
••• আমাদের ভুলগুলো দেখতে পাই। আমরা বুঝতে পারি, কোন ভুলে কী হয়েছে আমাদের। তখন আমরা সতর্ক হতে পারি। মুমিন একই গর্তে দুইবার দংশিত হয় না। ইতিহাসপাঠে আমরা সেসব চোরাগর্ত সম্পর্কে ধারণা পাই এবং দ্বিতীয়বার পা দিই না সেখানে।
••• ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা আমাদের শত্রুদের কর্মকৌশল দেখতে পাই। আমাদের শত্রুরা কীভাবে আমাদেরকে বোকা বানিয়েছে, কোন উপায়ে পদানত করেছে আমাদেরকে, তা বুঝতে পারি ইতিহাস পাঠ করেই।
••• ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা দূরদর্শী হই। পরিস্থিতি বোঝার সূত্র পাই। অতীতকে মিলিয়ে বর্তমানের হাল-হাকিকত উপলব্ধি করতে পারি সহজে।
••• দ্বীনের জন্য আমাদের পূর্ববর্তীদের কুরবানির চিত্র দেখতে পাই ইতিহাসের মধ্য দিয়েই। তাই ইতিহাসের জ্ঞান আমাদের ভেতর দ্বীনি আবেগ জাগ্রত করে। দ্বীনের পথে চলার ও চলতে গিয়ে প্রাপ্ত কষ্ট সহ্য করার জজবা তৈরি করে।
সুতরাং ইতিহাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রকে উপেক্ষা করে জ্ঞানসাধনায় সফল হওয়া অসম্ভব।
- Din Muhammad Sheikh