02/11/2022
আজ বসন্ত।
***********
আজ যখন দ্বিতীয় পিরিয়ডে আমি ক্লাশ করাচ্ছিলাম তখন অলোক সরকারের ফোন এল। হ্যালো বলার অপেক্ষা না করে ওপ্রান্ত থেকে উচ্ছ্বসিত অলোক বলল, আমরা সুপ্রিম কোর্টে জিতে গেছি।
দুপুরের মধ্যে খবরটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেল। জীবনে আমরা অনেক জিতে যাওয়ার খবর শুনে উচ্ছ্বসিত হয়েছি, রাস্তায় বাজি পুড়িয়েছি... সে সমস্ত জিতে যাওয়ার থেকে এ জয় যে কোন পার্শ্ব শিক্ষকের জীবনে এ মুহূর্তের সব থেকে বড় জয়। এটাও বলা যায়, ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।
তাই আজ অনেকদিন পর যেন কবিতারা ফিরে এল আমার কাছে। কবিতা লিখতে ইচ্ছা করছে, বলতে ইচ্ছা করছে, পড়তে ইচ্ছা করছে। সে রকমই একটা কবিতা "ছন্নছাড়া" যার সঙ্গে আমাদের জীবনের বড় মিল...
গলির মোড়ে একটা গাছ দাড়িয়ে
গাছ না গাছের প্রেতচ্ছায়া..
আঁকাবাঁকা কতগুলো কাঠির কঙ্কাল
শূন্যের দিকে এলোমেলো তুলে দেওয়া
রুক্ষ রুষ্ট রিক্ত জীর্ণ
লতা নেই পাতা নেই ছায়া নেই ছাল- বাকল নেই
নেই কোথাও এক আঁচড় সবুজের প্রতিশ্রুতি
এক বিন্দু সরসের সম্ভাবনা...
বিগত এগারো বছরে পার্শ্ব শিক্ষকদের জীবনের সঙ্গে এই পাতা ঝরা শুকনো গাছের উপমাটা কতটা সঠিক তা একমাত্র তারাই জানে।
প্রশ্ন আসবে, তাহলে কি আমরা এগারো বছর আগে খুব ভালো ছিলাম? নিশ্চয়ই ছিলাম না কিন্তু সেদিনও আমাদের স্বপ্ন ঝরে যায় নি, আমাদের আশা সেদিনও গাছের সবুজ পাতার মতো ছিল। আর আমাদের যিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আজ তিনিই আমাদের প্রতিপক্ষ। আমাদের শেষ স্বপ্নটুকুকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে তিনিই আজ ছুটেছেন সুপ্রিম কোর্টে। তিনি মনে করেছিলেন মেরুদণ্ড ভাঙা হতাশায় ন্যুব্জ গরীব পার্শ্ব শিক্ষকরা সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত যেতেই পারবে না। তিনি কোন অবস্থাতেই আমাদের ন্যায্য অধিকার দিতে চান না। তাই হাইকোর্টের দুটি বেঞ্চে আমাদের দাবীকে মান্যতা দিলেও সরকার মানতে রাজি নয়। একজন শিক্ষক তার জীবনের কুড়ি বছর যদি শিক্ষকতা করেন, তাকে নিঃস্ব ভিখারি করে ছুঁড়ে ফেলতে চায় প্রতিহিংসা পরায়ণ সরকার। তার বিরুদ্ধে ছিল আইনি লড়াই। পথের আন্দোলনকে স্বৈরাচারী শাসকের মতো দমন করতে পারলেও আাইনের অসম যুদ্ধে আজ আমরাই জয়ী। সব থেকে বড় কথা এই জয় কেবল যারা কর্মরত আছেন তাদেরই নয়, এর ফলে উপকৃত হবেন যারা ইতিমধ্যে ভিখারির মতো অবসর নিয়েছেন তারা, এমনকি মৃত পার্শ্ব শিক্ষকের পরিবারও। শুধু কর্মরত পার্শ্ব শিক্ষকরা নন, তারাও নিশ্চয়ই এই জয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ধন্যবাদ ও আশীর্বাদ দেবেন সমন্বয় সমিতির 11 man army দের এবং তাদের সেনা নায়ককে। নিঃসন্দেহে এ কথা বলতেই হবে, যো জিতা ওহি সিকন্দর।
তার মানে কি আমরা সকলে EPF পেয়ে গেলাম! তা হয়তো নয়। এ সরকার কোন কোর্টকে মানে না। তবে অবশ্যই আমাদের দাবীকে বৈধতা দিল। আমরা আবার একটা বিশ্বাস ফিরে পেলাম, দাবী যদি ন্যায্য হয়, যুদ্ধ শেষে আসবে জয়। এই জয় নতুন করে যুদ্ধের প্রেরণা দেবে। আমিও বিশ্বাস করি যুদ্ধ এখানে শেষ হল না, যুদ্ধ আমাদের করতেই হবে এবং একদিন আমরা জয়ী হবই। EPF এর পথ ধরেই আসবে বেতন কঠামো। তবুও যে কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই কবিতার শেষটুকুর মতো মনে হচ্ছে আজকের দিনটা...
"ফিরে আসতেই দেখি
গলির মোড়ে গাছের সেই শুকনো বৈরাগ্য
বিদীর্ণ করে বেরিয়ে পড়েছে
হাজার হাজার সোনালী কচি পাতা
মর্মরিত হচ্ছে বাতাসে বাতাসে,
দেখতে দেখতে গুচ্ছে গুচ্ছে উথলে উঠছে
ফুল
ঢেলে দিয়েছে বুকের সুগন্ধ
উড়ে এসেছে রঙ বেরঙের পাখি
শুরু করেছে কলকন্ঠের কাকলি,
ধীরে ধীরে ঘন পত্রপুঞ্জে ফেলেছে স্নেহার্দ্র
দীর্ঘ ছায়া
যেন কোন শ্যামল আত্মীয়তা।
অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে দেখলুম
কঠোরের প্রচ্ছন্নে মাধুর্যের বিস্তীর্ণ
আয়েজন।
প্রাণ আছে, প্রাণ আছে.. শুধু প্রাণই
আশ্চর্য সম্পদ
এক ক্ষয়হীন আশা
এক মৃত্যুহীন মর্যাদা। "
হ্যাঁ, শামীম আখতার প্রমাণ করেছেন পার্শ্ব শিক্ষকদের আশা, স্বপ্নের এখনো মৃত্যু ঘটে নি, এখনো প্রাণ আছে। শুধু বেঁচে থাকার জন্য প্রাণ যথেষ্ট কিন্তু আশা, স্বপ্ন এবং সম্মান নিয়ে বাঁচতে সকলকে এগিয়ে এসে যোদ্ধাদের হাত শক্ত করতে হবে।
সে দায় আমাদের।