26/09/2015
সংস্কৃত সাহিত্য : সনাতন ধর্মের প্রাণভোমরা
(প্রথম পর্ব)
--- অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ইসলাম ধর্ম যেমন কোরান কেন্দ্রিক, খ্রিস্টধর্ম যেমন বাইবেল কেন্দ্রিক,
বৌদ্ধধর্ম যেমন ত্রিপিটক কেন্দ্রিক –
হিন্দুধর্ম কিন্তু তেমনভাবে বেদ কেন্দ্রিক
নয়। যদিও বলা হয় হিন্দুধর্মের প্রধান
ধর্মগ্রন্থ বেদ। তা সত্ত্বেও বলা যায়
হিন্দুধর্ম শুধুমাত্র বেদাশ্রিত নয়। হিন্দুধর্ম
সমৃদ্ধ হয়েছে সংস্কৃত সাহিত্যের বিপুল
ভাণ্ডারের আনুকূল্যে। সেই কারণে হিন্দুধর্ম
না-বলে সনাতন ধর্ম বলাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে
হয়। হিন্দুধর্ম কোনো একটি নির্দিষ্ট
ধর্মগ্রন্থকে ঘিরে গড়ে ওঠেনি।হিন্দুধর্ম
একটি সংকলিত ধারণামাত্র, যা কেউ বুঝি,
অনেকেই বুঝি না।যে অঞ্চলের মানুষের
কাছে যে নির্দেশ গ্রহণযোগ্য বলে মনে
হয়েছে সেটা গ্রহণ করেছে, যার যেটা
খারাপ লেগেছে সেটা বর্জন করেছে। সেই
কারণে কাশ্মীরের হিন্দুধর্ম আর বাংলার
হিন্দুধর্ম এক নয়, গুজরাটের হিন্দুধর্মের সঙ্গে
অন্ধ্রপ্রদেশের হিন্দুধর্মে অনেক অমিল,
কেরলের হিন্দধর্ম আরা মহারাষ্ট্রের
হিন্দুধর্মের বৈসাদৃশ্য প্রচুর। কারণ
হিন্দুধর্মের কোনো প্রবক্তা নেই, হিন্দুধর্মের
স্রষ্টা নেই, একক প্রচারক নেই। ব্যাপক
পরিসরে বলা যায় হিন্দুধর্মের কোনো বিশেষ
একটি ধর্মগ্রন্থই নেই। সংকীর্ণ পরিসরে
অনেকেই বলতে ভালোবাসেন হিন্দুধর্মের
ধর্মগ্রন্থ বেদ, বৃহত্তর তথা সামগ্রিক পরিসরে
যদি ভাবা যায় হিন্দুধর্মের একত্রে
ধর্মগ্রন্থগুলি হল – ঋগবেগ, সামবেদ, যজুর্বেদ,
অথর্ববেদ, মনুসংহিতা, অসংখ্য উপনিষদ,
স্মৃতিশাস্ত্র ইত্যাদি।
বস্তুত বিপুল সংস্কৃত ভাণ্ডারের সমস্ত
নির্দেশাবলি-গল্প-কাহিনিই সনাতন ধর্মের
নিয়ন্ত্রক, এগুলিকে আমি ধর্মসাহিত্য বলতে
পছন্দ করি। বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি।
বেদ থেকেই শুরু করতে হবে। কারণ বেদই
সনাতন ধর্মের প্রধান ও প্রাচীন সংস্কৃত
গ্রন্থ। ঐতিহাসিকরা বৈদিক সাহিত্য কখনও
লিখিত রূপের উপর জোর দেয়নি। বেদ মানেই
শ্রুতি। তার লিখিত রূপ অনেক পরের সময়ের
কথা। ফলে কাশ্মীরে এক রকম, বাংলায় আর-
এক, তামিলনাড়ুতে অন্য রকম রামায়ণ-
মহাভারত পাওয়া গেলেও বেদ নিয়ে সেই
সমস্যা হয়নি। তার লিখিত রূপভেদ নেই, তাই
দরকার হয়নি কোনও ‘ক্রিটিকাল এডিশন’। এই
কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে
উনিশ শতকে উইলসন তাই অনুবাদ করেন
ঋগবেদ। কোনো পাঠান্তর বা পাঠভেদের
বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না তাঁকে। আজও পুনের
ভাণ্ডারকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ঋগবেদের
সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটি গাছের
ছালের উপর ১৪৬৪ সালে লেখা। এটি
ইউনেস্কোর ‘মেমরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-
এর অন্তর্ভুক্ত। আফগানিস্তানের বোখাজকই
শিলালিপির সঙ্গে ঋগবেদের ইন্দো-ইরানীয়
ভাষার মিলের কথাও বলা হয়েছে বারবার।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের
প্রধান রমেশ ভরদ্বাজের মতে, ‘‘বাল গঙ্গাধর
তিলক, জার্মান পণ্ডিত ফেলিক্স জ্যাকোবি
মনে করতেন, ঋগবেদ খ্রিস্টের জন্মের আট
হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল।’’ কিন্তু
ঋগবেদকে যিনি বিশ্বের দরবারে প্রথম
পরিচিত করেন, সেই ম্যাক্সমুলারও তিলকের
মতো এত দূর পিছিয়ে যাননি। তিনি খ্রিস্টের
জন্মের দেড় হাজার বছর আগের কথা
ভেবেছিলেন। আর আর্যভাষাটি যে শুধুই
ভারতীয় ভাষা নয়, সে কথাও ইতিহাসের
দরবারে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। শেল্ডন
পোলক পরিষ্কার লিখে দিয়েছেন, সংস্কৃত
নামক কসমোপলিটান ভাষাটি আফগানিস্তান
থেকে জাভা সর্বত্র চলত। রোমিলা থাপারও
ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে
ঋগবেদের ‘মিত্রাবরুণ’ গোছের দেবতার
অনেক মিল পেয়েছেন। সংস্কৃত ভাষা
সমীহের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা সনাতন ধর্মের
ভাষা, সংস্কৃত ভাষা ব্রাহ্মণের ভাষা,
সংস্কৃত ভাষা মন্ত্রের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা
শাস্ত্রের ভাষা, সংস্কৃত ভাষা
অভিসম্পাতের ভাষা এবং সংস্কৃত ভাষা
আশীর্বাদেরও ভাষা।
সংস্কৃত ভাষা কীভাবে সনাতন ধর্মের সঙ্গে
সম্পৃক্ত হয়ে আছে আমি তারই ব্যবচ্ছেদ করার
চেষ্টা করব -- বেদের ইতিহাস নিয়ে
আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এটা
ঠিক, বেদ ছাড়া ভারতীয় মনের ঐতিহাসিক
বিকাশের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় না। ভারতের
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে বেদ পরতে পরতে
জড়িয়ে আছে। হাজার হাজার সাহিত্য লেখা
হয়েছে, যা ধর্মসাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে
অনেক ক্ষেত্রে এবং সেইসব সাহিত্যের
উপাদানের বীজ সবই বেদে প্রতীয়মান।
ঋগবেদের কাল থেকে বেদাঙ্গ রচনার
অন্তিম পর্ব পর্যন্ত যে সুবিশাল সাহিত্য
কেবল ভারতীয় সংস্কৃতির নয়, বিশ্বসংস্কৃতির
ক্ষেত্রে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগের সূচনা
করেছিল বৈদিক সাহিত্য।যাজ্ঞবল্ক্যের
মতে প্রত্যক্ষ বা অনুমানাদির সাহায্যে যে
জ্ঞান লাভ করা যায় না, সেই অতীন্দ্রিয়
জ্ঞান যার দ্বারা লাভ করা যায়, তাইই বেদ।
বেদ হল প্রাচীন ভারতে রচিত একাধিক
ধর্মগ্রন্থের একটি সমষ্টি। বৈদিক সংস্কৃত
ভাষায় রচিত বেদ সংস্কৃত সাহিত্যের
প্রাচীনতম নিদর্শন এবং প্রাচীনতম হিন্দু
ধর্মগ্রন্থ। বেদকে "অপৌরুষেয়" ("মানুষের
দ্বারা রচিত নয়") মনে করা হয়।হিন্দুরা
বিশ্বাস করেন, বেদ প্রত্যক্ষভাবে ঈশ্বর
কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। তাই বেদের অপর
নাম "শ্রুতি" ("যা শোনা হয়েছে")। অন্য
ধর্মগ্রন্থগুলিকে বলা হয় "স্মৃতি" ("যা মনে
রাখা হয়েছে")। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, বেদ
ব্রহ্ম (সর্বোচ্চ উপাস্য ঈশ্বর) কর্তৃক
প্রকাশিত। বৈদিক ধর্মগ্রন্থ বা শ্রুতি
সংহিতা নামে পরিচিত চারটি প্রধান
সংকলনকে কেন্দ্র করে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
বেদের প্রতিটি পদ মন্ত্র নামে পরিচিত।
কোনো কোনো বৈদিক মন্ত্র আধুনিক কালে
প্রার্থনা সভা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা অন্যান্য
অনুষ্ঠানে পাঠ করা হয়ে থাকে।
ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা ও বিভিন্ন
হিন্দু সম্প্রদায় বেদ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত
পোষণ করে। ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা
বেদকে তাদের প্রধান ধর্মমত (আস্তিক)
হিসাবে গ্রহণ করেছে। অন্যান্য শাখা,
বিশেষত বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম বেদকে তাদের
প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিসাবে গ্রহণ করে না
(নাস্তিক)। অধিকন্তু বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম,
শিখধর্ম, ও ব্রাহ্মধর্ম, এবং দক্ষিণ ভারতের
অনেক অব্রাহ্মণ হিন্দুরা বেদের কর্তৃত্ব
স্বীকার করে না। ইয়েঙ্গার ইত্যাদি কোনো
কোনো দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ তামিল দিব্য
প্রবন্ধম্ বা আলোয়ারদের রচনাকে বেদের
সমতুল্য জ্ঞান করেন।
বেদের বিধিসম্মত ভাগ চারটি। বেদের
চারটি অংশ মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ,
আরণ্যক ও উপনিষদ্। মন্ত্রাংশ প্রধানত পদ্যে
রচিত, কেবল যজুঃসংহিতার কিছু অংশ গদ্যে
রচিত। এটাই বেদের প্রধান অংশ। এতে আছে
দেবস্তুতি, প্রার্থনা ইত্যাদি। ঋক্ মন্ত্রের
দ্বারা যজ্ঞে দেবতাদের আহ্বান করা হয়,
যজুর্মন্ত্রের দ্বারা তাঁদের উদ্দেশে আহুতি
প্রদান করা হয় এবং সামমন্ত্রের দ্বারা
তাঁদের স্তুতি করা হয়। ব্রাহ্মণ মূলত
বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যা। এটি গদ্যে রচিত এবং
প্রধানত কর্মাশ্রয়ী। আরণ্যক কর্ম-জ্ঞান
উভয়াশ্রয়ী এবং উপনিষদ্ বা বেদান্ত
সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানাশ্রয়ী। বেদের বিষয়বস্তু
সাধারণভাবে দুই ভাগে বিভক্ত কর্মকাণ্ড ও
জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে আছে বিভিন্ন
দেবদেবী ও যাগযজ্ঞের বর্ণনা এবং
জ্ঞানকাণ্ডে আছে ব্রহ্মের কথা। কোন্
দেবতার যজ্ঞ কখন কীভাবে করণীয়, কোন্
দেবতার কাছে কী কাম্য, কোন যজ্ঞের কী
ফল ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের আলোচ্য বিষয়। আর
ব্রহ্মের স্বরূপ কী, জগতের সৃষ্টি কীভাবে,
ব্রহ্মের সঙ্গে জীবের সম্পর্ক কী এসব
আলোচিত হয়েছে জ্ঞানকাণ্ডে।
জ্ঞানকাণ্ডই বেদের সারাংশ। এখানে বলা
হয়েছে যে, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর এক, তিনি সর্বত্র
বিরাজমান, তাঁরই বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ
বিভিন্ন দেবতা। জ্ঞানকাণ্ডের এই তত্ত্বের
ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে ভারতীয়
দর্শনচিন্তার চরম রূপ উপনিষদের বিকাশ
ঘটেছে।
এসব ছাড়া বেদে অনেক সামাজিক
বিধিবিধান, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা,
শিল্প, কৃষি, চিকিৎসা ইত্যাদির কথাও আছে।
এমনকি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের
কথাও আছে। বেদের এই সামাজিক বিধান
অনুযায়ী সনাতন হিন্দু সমাজ ও হিন্দুধর্ম রূপ
লাভ করেছে। হিন্দুদের বিবাহ, অন্তেষ্টি
ক্রিয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখনও বৈদিক
রীতিনীতি যথাসম্ভব অনুসরণ করা হয়। ঋগ্বেদ
থেকে তৎকালীন নারীশিক্ষা তথা সমাজের
একটি পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। অথর্ববেদ
থেকে পাওয়া যায় তৎকালীন
চিকিৎসাবিদ্যার একটি বিস্তারিত বিবরণ।
এসব কারণে বেদকে শুধু ধর্মগ্রন্থ হিসেবেই
নয়, প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, অর্থনীতি,
সমাজ, সাহিত্য ও ইতিহাসের একটি দলিল
হিসেবেও গণ্য করা হয়।
অনেকের মতে বেদ অপৌরুষেয়। অর্থাৎ ঈশ্বর
দ্বারা প্রেরিত। এহেন বেদ যখন ঈশ্বর
প্রেরিত, এহেন বেদ যখন সনাতন
ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ – তবে কেন
বেদের উল্লিখিত দেবতারা “দেবতা”
হিসাবে পুজো পায় না ? বেদের দেবতা
কারা? দেবতা কে ? দেবতা কী ? সনাতন
ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদে যে দেবতাদের
উল্লেখ আছে, সেগুলি হিন্দুসমাজে বহুল
প্রচলিত এবং প্রচারিত দেবদেবীদের মতো
নয়। অবশ্য বেদের সূত্রেই ভারতীয় হিন্দু বা
সনাতন ধর্মের দেবদেবীদের আবির্ভাব।
আদিবেদ হিসাবে স্বীকৃত ঋগবেদে কতগুলি
দেবদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋগবেদে
“দেবতা” শব্দ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অল্প কয়েকটি সূক্ত ছাড়া প্রায় ৯০ ভাগ
মন্ত্রে দেবতা বিষয়ক ভাবনাই মুখ্য। এই
মন্ত্রগুলিকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। (১)
স্তুতি এবং (২) প্রার্থনা। স্তুতি বিষয়ক
মন্ত্রে দেবতার নাম, রূপ ও কর্মের উল্লেখ
করে দেবতার স্তব করা হয়েছে। অপরদিকে
প্রার্থনা বিষয়ক মন্ত্রে দেবতার কাছে
প্রার্থনা করা হয়েছে ধন, আয়ু, শক্তি, পুত্র
প্রভৃতি।
যাস্কাচার্য তাঁর “নিরুক্ত” গ্রন্থে ‘দেব’ এবং
‘দেবতা’ দুটি শব্দের একই অর্থ করেছেন।
তিনি ‘দেব’ শব্দের তিনটি তিনটি অর্থ এবং
চারটি ব্যুৎপত্তি দেখিয়েছেন – (১) ‘দা’ ধাতু
থেকে। (২) ণিজন্ত ‘দীপ’ ধাতু থেকে।(৩)
ণিজন্ত ‘দ্যুৎ’ ধাতু থেকে। (৪) ‘দিব’ শব্দ
থেকে। অর্থাৎ দেব বা দেবতা তাঁরাই যাঁরা
(ক) ঐশ্বর্য দান করেন এবং আমাদের ঈপ্সিত
বস্তুগুলি দান করেন। (খ) তেজোময় বলে যাঁরা
পদার্থগুলিকে প্রকাশিত করে। (গ) যাঁরা
সাধারণত দ্যুলোকে অবস্থান করেন। বস্তুত
শৌনকাচার্যের ‘বৃহদ্দেবতা’ এবং
যাস্কাচার্যের ‘নিরুক্ত’ গ্রন্থের
দেবতাকাণ্ডে দেবতাতত্ত্ব সম্বন্ধে বিস্তৃত
আলোচনা আছে। ঋগবেদের সূক্তগুলিতে
ধর্মীয় চিন্তাধারায় অনুসরণ করলে
দেবতাতত্ত্বের সম্বন্ধে এক বিবর্তন লক্ষ
করা যায়। বহুদেবতাবাদ থেকে
অতিদেবতাবাদের মধ্য দিয়ে একদেবতাবাদ
বা একেশ্বরবাদে উত্তরণ ঘটেছে বৈদিক
দেবতাতত্ত্বে। বেদের দেবতাতত্ত্বের
প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি দেবতাই
বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি থেকে কল্পিত
হয়েছেন। প্রাকৃতিক রূপেরই প্রতিরূপ।
অনেক ক্ষেত্রে দেবতা হিসাবে বিষয়বস্তুকে
বোঝানো হয়েছে। এই অর্থে প্রস্তরখণ্ড, ধনুক,
ব্যাঙ ইত্যাদি দেবতা প্রতিপন্ন হয়। বস্তুত
ঋকবেদের দেবতা অর্থে বুঝি পৃথিবী বা
অন্তরিক্ষ বা দ্যুলোকের এমন সব প্রাকৃতিক
বিষয়, যাঁদের মধ্যে শক্তির প্রকাশ দেখে
ঋষিরা তাঁদের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন।
সেই কারণে নানা মুনির নানা মতও আছে।
যেমন – কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে ইন্দ্র
হল ঝড়ের দেবতা। কেউ বলেছেন প্রাচীন
সূর্যদেবতা। কারও মতে বরুণ স্বর্গের দেবতা,
কেউ বলছেন চন্দ্রদেবতা, কেউ-বা বলেন
জলের দেবতা ইত্যাদি। ঋকবেদে কতকগুলি
আদিত্যের নাম আছে, রুদ্র ও বসু শব্দ দুটি
বহুবচনে ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু ১২ জন
আদিত্য, ১১ জন রুদ্র, ৮ জন বসু এমন উল্লেখও
নেই। ঋকবেদে নীচে উল্লিখিত দেবতাদের
নাম পাওয়া যায় – (১) মিত্র, বরুণ, অর্যমা, ভগ,
দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড, সূর্য, সবিতা এবং ইন্দ্র ।
এঁদের ঋকবেদে কোথাও না-কোথাও আদিত্য
বলা হয়েছে। এঁদের মধ্যে আবার অর্যমা, ভগ,
দক্ষ, অংশ, মার্তণ্ড -- এঁদের কোনো প্রাধান্য
নেই।(২) মিত্র, সূর্য, বরুণ, সবিতা, ইন্দ্রের খুব
প্রাধান্য। এ ছাড়া অগ্নি, বায়ু, মরুৎগণ,
বিষ্ণু,পর্জন্য, পূষা, ত্বষ্ঠা, অশ্বিনী ২ জন,
সোম -- এরাও প্রাধান্য পেয়েছেন। (৩)
বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি ও যমেরও কিছু গৌরব
আছে। (৪) কোনো কোনো অংশে ত্রিত,
আপ্তা, অধিব্রধ ও অজএকপাদেরও নাম
পাওয়া যায় । (৫) বিশ্বকর্মা, হিরণ্যগর্ভ,
স্কম্ভ, প্রজাপতি, পুরুষ, ব্রহ্মা -- এই কয়টি নাম
দ্বারা সৃষ্টিকর্তাকে বোঝায়। (৬) ক-জন
দেবীও আছেন। অদিতি ও ঊষা প্রধানা। (৭)
সরস্বতী, ইলা, ভারতী, মহী, হোত্রা, বরুত্রী,
ধীষণা, অরণ্যানী, অগ্নায়ী, বরুণানী,
অশ্বিনী, রোদসী, রাকা, সিনিবালী, গুঙ্গু,
শ্রদ্ধা ও শ্রী -- এঁরা দেবী পদভিষিক্তা। তা
ছাড়া পরিচিত সব নদীরাও দেবীর মর্যাদা
পেয়েছেন ।
পুরাণে আছে, পরমেশ্বরের ইচ্ছায় ও তার
লীলা প্রকাশের বাসনায় দেবতাদের সৃষ্টি
হয়েছে। পরমেশ্বর মহাবিষ্ণুই লীলার জন্য
তিন ভাগে ভাগ হয়েছেন -- ব্রহ্মা , বিষ্ণু
এবং মহেশ্বর । বিষ্ণু পুরাণে আছে –
পরব্রহ্মের প্রথম অংশ ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা রূপে
সকল কিছু সৃষ্টি করে তৃতীয় বারে দেবতাদের
সৃষ্টি করলেন । দেবতারা জ্যোতিষ্মান,
দীপ্তিমন্ত । দেবতাদের প্রধানত স্বর্গবাসী
হিসাবেই দেখানো হয়েছে, অবশ্য
পৃথিবীতেও তাদের অবস্থান আছে। দেবতারা
অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। মানুষ যা
করতে পারে না দেবতারা তা করতে পারেন,
অথবা দেবতারা যা করতে পারেন মানুষ তা
পারে না – এরকম গোছের কিছু একটা।
সাধারণভাবে মরুৎ ঝড়ের দেবতা বাদে
দেবতাদের সংখ্যা হল তেত্রিশ । কিন্তু
যাস্ক প্রভৃতি নিরুক্তকারদের মতে বৈদিক
দেবতা মাত্র তিনজন -- অগ্নি , ইন্দ্র এবং
সূর্য। তবে পুরাণে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর
কথা বলা হয়েছে। বোঝাই যায়, বেদে
উল্লেখিত ৩৩ টি দেবতায় কাজ মিটছিল না।
পুরাণের যুগে এসে তৎকালীন শাসকদের
তত্ত্বাবধানে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ৩৬ টি পুরাণে
৩৩ কোটি দেবতাদের গল্প-কাহিনি বর্ণিত
হল, যা উপকথা এবং রূপকথার মতোই
মনোরঞ্জন করে। পুরাণের পাতায় পাতায়
বর্ণিত হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং শাসকের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তার পরিণতি কী হয় !
বেদের দেবতাদের জন্ম আছে, পূর্বাপর-সম্বন্
ধ আছে । এক দেবতা থেকে আর-এক দেবতার
জন্ম আছে। অনেক বিষয়ে মানুষের সঙ্গে
দেবতাদের মিল দেখা যায়, তাই হিন্দুধর্মের
দেবতাদের মধ্যে মানুষেরই প্রতিরূপ পাওয়া
যায় । সেই কারণে পুরাণের দেবতারা
মানুষের মতো দোষেগুণে (ষড়রিপু = কাম,
ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য ) গড়ে
উঠেছে।
আবার অনেক দেবতা মানুষ থেকেও
জন্মেছেন । তাই আহার-বিহার, যানবাহন বসন-
ভূষণ প্রভৃতি ব্যাপারে অনেক দেবতা মানুষের
কাছাকাছি । মহাভারতের ক্ষেত্রেও যে
বাস্তবতা কিছু রয়েছে তা অনস্বীকার্য।
কিন্তু ঘটনা, চরিত্র ও সময় সম্ভবত ঋগবেদের
পরবর্তী কোনো সময়ে। ঋগবেদের অনেক
দেবতার নামই এখানে দেখা যায়। তবে
কৃষ্ণসহ বেশ কিছু নতুন চরিত্র বা ভগবানের
উদ্ভব হয়, যেগুলি আসলে ঋগবেদের কিছু
দেবতার ভিন্নরূপ বই কিছু নয়। কুন্তিপুত্র
পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই হলেও তাদের জন্ম
পাঁচজন অন্য পুরুষের (যাঁদের দেবতা বলা
হয়েছে) ঔরসে। যুধিষ্ঠির ধর্মের পুত্র, ভীম
বায়ুর, অর্জুন ইন্দ্রের এবং নকুল ও সহদেব যমজ
দেবতা অশ্বীনিকুমারদ্বয়ের পুত্র। সমস্যা হল
ধর্ম নামে কোনো দেবতাকে আমরা ঋগবেদে
পাই না। বাকিদের অবশ্য পাওয়া যায়।
এখানে এই “ধর্ম” সম্ভবত বরুণ। ঋগবেদে আমরা
দেখতে পাই ধর্মসংস্কারের ফলে ইন্দ্র যখন
প্রধান দেবতা হিসেবে প্রাধান্য পেতে শুরু
করে তখন বরুণকে হেয় করা হয়। কিন্তু
প্রথমদিককার ঋকগুলিতে বরুণ প্রধান দেবতা
থেকেই যায়। কারণ সেগুলির পরিবর্তন সম্ভব
ছিল না হয়তো। সম্ভবত ধর্মসংস্কারের জন্য
প্রাচীন দেবতাকে যেহেতু “বরুণ” রূপে
উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি, তাই তাকে নতুন
নামে নতুন রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং
ধর্মদেবতাকে সকল দেবতার ঊর্ধ্বে স্থান
দেওয়া হয়েছে। ঋগবেদে বরুণের সঙ্গে আরও
একজন দেবতাকে আমরা দেখতে পাই -- সে
হল মিত্র। ইন্দ্রের পূর্বে বরুণ এবং মিত্র এই
দুই দেবতাকে ঋগবেদে বেশ উঁচু স্থান দেওয়া
হয়।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় দেবতা
বিষয়ে লিখেছেন – “আমরা আকাশ ও
সূর্য্যদেবতাদিগের কথা বলিয়াছি, এক্ষণে
বায়ু-দেবতাদিগের কথা বলিব। বেশী বলিবার
প্রয়োজন নাই। বায়ু দেবতা,-প্রথম বায়ু বা
বাত, দ্বিতীয় মরুদ্গণ। বায়ুর বিশেষ পরিচয়
কিছুই দিবার নাই। সূর্য্যের ন্যায় বায়ু
আমাদিগের কাছে নিত্য পরিচিত। ইনি
পৌরাণিক দেবতার মধ্যে স্থান পাইয়াছেন।
পুরাণেতিহাসে ইন্দ্রাদির ন্যায় ইনি একজন
দিক্পাল মধ্যে গণ্য। এবং বায়ু বা পবন নাম
ধারণ করিয়াছেন। সুতরাং ইঁহাকে প্রচলিত
দেবতাদের মধ্যে ধরিতে হয়। মরুদ্গণ সেরূপ
নহেন। ইঁহারা এক্ষণে অপ্রচলিত। বায়ু সাধারণ
বাতাস, মরুদ্গণ ঝড়। নামটা কোথাও একবচন
নাই ; সর্ব্বত্রই বহুবচন। কথিত আছে যে, মরুদ্গণ
ত্রিগুণিত ষষ্টিসংখ্যক, একশত আশী। এ দেশে
ঝড়ের যে দৌরাত্ম্য, তাহাতে এক লক্ষ আশী
হাজার বলিলেও অত্যুক্তি হইত না।
ইঁহাদিগকে কখন কখন রুদ্র বলা হইয়া থাকে।
রুদ্ ধাতু চীৎকারার্থে রুদ্ ধাতু হইতে রোদন
হইয়াছে। রুদ্ ধাতুর পর সেই “র” প্রত্যয় করিয়া
রুদ্র শব্দ হইয়াছে। ঝড় বড় শব্দ করে, এই জন্য
মরুদ্গণকে রুদ্র বলা হইয়াছে সন্দেহ নাই।
কোথাও বা মরুদ্গণকে রুদ্রের সন্ততি বলা
হইয়াছে। তার পর অগ্নিদেবতা। অগ্নিও
আমাদের নিকট এত সুপরিচিত যে, তাঁহারও
কোন পরিচয় দিবার প্রয়োজন নাই। কিছু
পরিচয় দেওয়াই হইয়াছে। ঋগ্বেদে আর একটি
দেবতা আছেন, তাহাকে কখন বৃহস্পতি কখন
ব্রহ্মণস্পতি বলা হইয়া থাকে। কেহ কেহ
বলেন, ইনি অগ্নি, কেহ কেহ বলেন, ইনি
ব্রহ্মণ্যদেব। সে যাহাই হউক। ব্রহ্মণস্পতির
সঙ্গে আমাদের আর বড় সম্বন্ধ নাই। বৃহস্পতি
এক্ষণে দেবগুরু অথবা আকাশের একটি তারা।
অতএব তাঁহার সম্বন্ধে বড় বিশেষ বলিবার
প্রয়োজন নাই। সোমকে এক্ষণে চন্দ্র বলি,
কিন্তু ঋগ্বেদে তিনি চন্দ্র নহেন। ঋগ্বেদে
তিনি সোমরসের দেবতা। অশ্বীদ্বয়
পুরাণেতিহাসে অশ্বিনীকুমার বলিয়া
বিখ্যাত। কথিত আছে যে, তাঁহারা সূর্য্যের
ঔরসে অশ্বিনীর গর্ভে জন্মগ্রহণ
করিয়াছিলেন। এই জন্য তাঁহাদিগের
পৌরাণিক নাম অশ্বিনীকুমার। এমন বিবেচনা
করিবার অনেক কারণ আছে যে, তাঁহারা
শেষরাত্রির দেবতা ; ঊষার পূর্ব্বগামী
দেবতা। আর একটি দেবতা ত্বষ্টা।
পুরাণেতিহাসে বিশ্বকর্ম্মা যাহা, ঋগ্বেদে
ত্বষ্টা তাহাই। অর্থাৎ দেবতাদিগের
কারিগর। যমও ঋগ্বেদে আছেন কিন্তু যমও
আমাদিগের নিকট বিশেষ পরিচিত।
যমদেবতার একটি গূঢ় তাৎপর্য্য আছে, তাহা
সময়ান্তরে বুঝাইবার প্রয়োজন হইবে। ত্রিত
আপ্ত্য অজ একপাদ প্রভৃতি দুই একটি ক্ষুদ্র
দেবতা আছেন, কখন কখন বেদে তাঁহাদিগের
নামোল্লেখ দেখা যায়। কিন্তু তাঁহাদের
সম্বন্ধে এমন কিছুই কথা নাই যে, তাঁহাদের
কোন পরিচয় দিবার প্রয়োজন করে। বৈদিক
দেবীদিগের মধ্যে অদিতি পৃথিবী এবং ঊষা
এই তিনেরই কিঞ্চিৎ প্রাধান্য আছে।
অদিতি ও পৃথিবীর কিঞ্চিৎ পরিচয় দিয়াছি।
ঊষার পরিচয় দিবার প্রয়োজন নাই, কেন না,
যাহার ঘুম একটু সকালে ভাঙ্গিয়াছে সেই
তাহাকে চিনে। সরস্বতীও একটি বৈদিক
দেবী। তিনি কখন নদী কখন বাগ্দেবী। গঙ্গা-
সিন্ধু প্রভৃতি ঋগ্বেদে স্তুত হইয়াছেন। ফলতঃ
ক্ষুদ্র বৈদিক দেবীদিগের সবিস্তার বর্ণনে
কালহরণ করিয়া পাঠকদিগকে আর কষ্ট দিবার
প্রয়োজন নাই। আমরা এইখানে বৈদিক
দেবতাদিগের ব্যক্তিগত পরিচয় সমাপ্ত
করিলাম। কিন্তু আমরা বৈদিক দেবতাতত্ত্ব
সমাপ্ত করিলাম না। আমরা এখন বৈদিক
দেবতাতত্ত্বের স্থূল মর্ম্ম বুঝিবার চেষ্টা
করিব। তার পর বৈদিক ঈশ্বরতত্ত্বে প্রবৃত্ত
হইবার চেষ্টা করি।”
আক্ষেপের কথা একটাই – বেশির ভাগ হিন্দু
এই গ্রন্থ পাঠ করা তো দূরের কথা, চোখেও
দেখেনি। সাধারণ মানুষদের কথা ছাড়ুন,
যাদের বেদ পাঠ না করলে ব্রহ্মজ্ঞানই হয়
না, সেই ব্রাহ্মণদের একটা বড়ো অংশই বেদ
ছুঁয়েও দেখেন না। তা সত্ত্বেও বেদ ব্যতীত
সনাতনী বা হিন্দুদের অস্তিত্ব কোথায় !
হিন্দুত্ববাদের দণ্ডমুণ্ডকর্তা এল কে
আডবাণী যখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন
তখন অক্সফোর্ডে নীরদবাবুর (নীরদ সি
চৌধুরী) বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন।
‘আত্মঘাতী বাঙালি’-র দুর্মুখ রচনাকার তাঁকে
জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আপনি ঋগবেদ
পড়েছেন ?’’ উত্তর : ‘না’। হতাশ নীরদবাবু : ‘‘তা
হলে আর হিন্দুধর্ম নিয়ে আপনার সঙ্গে কী
কথা বলব ?’’ (চলবে)