13/07/2017
ফরিদা বলছিলেন, ‘ভালা থাকিবার লাগি আসিছিলাম। এখন আর বাঁচিবার উপায় নাই, বাবাজি!’
বেতবুনিয়া বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দূরে দক্ষিণপাড়া গ্রাম। মাটির রাস্তা দিয়ে যেতে বাঁ দিকের পাহাড়ের নিচে ফরিদার বাড়ি। গত মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে যখন সেখানে গেলাম, তখন সেই ভাঙাচোড়া বাড়িটি মেরামতের কাজ করছিলেন ফরিদার ভাই ও এলাকার স্থানীয় দুজন। বাড়িটির ওপরের পাহাড়ে ধসের চিহ্ন। ওপরে থাকা বাঁশঝাড় ধসে এসে পড়েছে বাড়িটিতে। মাটিসুদ্ধ বাঁশের মোথাগুলো পড়ে আছে।
সে রাতের কথা বললেন ফরিদা। এ বাড়িতে তখন ছেলে, নাতনি, তাঁর জামাইসহ ছয়জন ছিলেন। প্রবল বর্ষণ তখন। রাত দুইটার দিকে নাতজামাই সবাইকে ডেকে ওঠান। পাহাড় ভেঙে পড়ার ঘটনা টের পেয়েছিলেন তিনি। তাঁরা ঘর থেকে বের হতে না হতেই দড়াম করে পাহাড়ের অংশ বাড়িটির ওপরে পড়ে। তবে এ পরিবারের ভাগ্য ভালো, কেউ হতাহত হননি। ফরিদা অবশ্য বললেন, ‘মরণের কিছু বাকি নাই। এ ঘর ক্যামনে তুলতাম?’ তিনি বলেন আর কাঁদেন।
এ কান্না পাহাড়ের সবখানেই। আর এ অবস্থাতেই একটি মাস পেরিয়ে এলেন তিনি। আজ বৃহস্পতিবার এক মাস পূর্ণ হবে ভয়াবহ সেই দুর্যোগের।
ফরিদা বেগমের পরিবার এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা হিসেবে পেয়েছেন ৪০ হাজার টাকা। তবে এ দিয়ে সেই বাড়ি তো হবে না। এরপর আছে ঋণের বোঝা। সবকিছু মিলিয়ে দুশ্চিন্তার পাহাড় তাঁর মাথায়।
রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের হিসাব, এই কাউখালী উপজেলায় ফরিদার মতো এমন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১৮ হাজার। জুনের পাহাড়ধসে এ উপজেলায় মারা গেছেন ২১ জন। রাঙামাটির শহরের পর এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শহরে সেনাসদস্যসহ নিহত ৭৩। পুরো জেলায় ১২০।
‘এহানে থাকতে ভালো লাগে না, বাড়িতে ভয় লাগে’
পাহাড়ধসে রাঙামাটি সদরে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শহরে এসব মানুষকে আশ্রয় দিতে খোলা হয়েছিল ১৯টি কেন্দ্র। বিভিন্ন সরকারি অফিস এবং বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে এসব কেন্দ্র খোলা হয়। এখন আছে ১৪টি কেন্দ্র।
রাঙামাটিতে ঢোকার মুখে রাঙাপানি এলাকায় মনঘর নামের একটি প্রতিষ্ঠানে খোলা হয়েছে দুটি আশ্রয়কেন্দ্র। এর একটি বৌদ্ধ ভাবনা কেন্দ্র। এখানে আছে ৬৮টি পরিবার। সবাই আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। এর মধ্যে আছে বাঙালি তিনটি পরিবার। অন্যরা পাহাড়ি। গত মঙ্গলবার শেষ বিকেলে যখন ভাবনা কেন্দ্রে ঢুকছি, তখন সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর ত্রাণবাহী গাড়িটি। প্রতি দুই বেলা বাজার দিয়ে যান সেনাসদস্যরা। এখানে রান্না হয়। ১৩ জুনের পর দু-এক দিন অন্য একটি প্রতিষ্ঠান দুবেলা খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াতো এখানকার আশ্রিত ব্যক্তিদের। পরে পাহাড়িরা নিজেদের খাবার নিজেরাই করে খেতে চান। এরপর সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই ব্যবস্থা হয়।
এই ভাবনা কেন্দ্রের একজন জ্ঞানপ্রিয় চাকমা বলেন, ‘সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনা খুব ভালো। তাদের বাজারের তালিকায় পাহাড়িদের প্রিয় শুঁটকি, নাপ্পিও (শুঁটকির চূর্ণ) থাকে।’
এখানে দুবেলা বাজার দিয়ে যায়। সকালে শুধু শিশুদের জন্য নাশতা থাকে। বড়রা নিজেদের সামর্থ্যমতো কিনে খান খাবার। এখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবার জন্য এভাবে আশ্রয় নিয়ে থাকা বিরল অভিজ্ঞতা। তানুভিম চাকমা (৭০) বললেন, ‘কখনো যে এ অবস্থাতে পড়ব তা ভাবিনি। মনে হয় এক যুদ্ধের মধ্যে পড়ে গেছি আমরা।’ স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পাঁচজন কোনোমতে বাড়ি থেকে বের হতে পেরেছিলেন। তবে বাড়িটি এখন কাঠামোসর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রায় এক মাস হতে চলল। এটি বৌদ্ধভিক্ষুদের সাধনার জায়গা। সেখানে এভাবে থাকতে মন চায় না। তবে কোথায় যাবেন, এমন ভাবনা যখন মাথায় আসে তখন কোনো দিশা পান না জয়া চাকমা। রাঙাপানি মধ্যপাড়ার বাসিন্দা এ নারীর বাড়িটি এখন মাটিতে মিশে আছে। পাশের খাড়া পাহাড় ভয়াল মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে। নিজের বাড়িটি তবু দেখতে যান মাঝেমধ্যে। কিন্তু সেখানে গিয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হন বারবারই। বললেন, ‘এখানে থাকতে ভালো লাগে না। কিন্তু বাড়িতে তো ভয় লাগে। সেখানে তো থাকব কী করে?’
এখানেই সন্ধান মেলে তিন বছরের রাজ্জুনি চাকমার। বাবা উজ্জ্বল কান্তি চাকমা ও রাজ্জুনি মাটিচাপা পড়েছিলেন। উজ্জ্বল কান্তি বললেন, ‘মেয়েটির মুখও ঢেকে ছিল। আমি মাটিচাপা পড়ার পর মেয়েটিকে খুঁজতেছিলাম। তাড়াতাড়ি মুখ থেকে মাটি সরায়ে ফেলি। ওর সারা শরীর মাটিতে তখন। এরপর তাকে তোলা হয়।’ শিশুটি বেশ প্রাণবন্ত। কিন্তু বাড়িতে যাওয়ার কথা বললে মুখ তার মলিন হয়, জানান মা শেফালি চাকমা।