28/08/2024
বাইরে থাকি! অঙ্কন বসু।
----
দেশের অনেকেই ভাবেন (লাস্ট ২২ বছরের কঠোর অভিজ্ঞতা থেকে বলছি) যে আমেরিকায় একটা টাকার গাছ আছে। যে একবার আমেরিকা যেতে পারে, সে সেই গাছটিতে চড়ে অনেক কামাই করে।
সত্যি বলছি, সে গাছটায় চড়া তো দূর অস্ত, সেটার টিকিটিরও দেখা আমি পাইনি এখনো।
অনেকেই ভাবেন আমেরিকায় কষ্ট বলে কিছু নেই, দুঃখ বলে কিছু নেই। এখানে শুধুই মজা।
তাও বলি যে ২২ বছর আগে যখন আসি এখানে, কষ্ট করেই কাটিয়েছি। খুব কষ্ট করে। যাকে বলে দিন আন্তে পান্তা ফুরোয়। সেসব দিনের কথা লিখলে একটা আস্ত ইলিয়াড এন্ড দ ওডিসি হয়ে যাবে। সেসব পরে শোনাব।
সেই দিনগুলোতে যখন সোশ্যাল সাইট গুলো জনপ্রিয় হয়নি বা ছিলই না, হোয়াটসআপ ছিল না - সেসব দিনের কথা মনে পড়ে। তখন ইন্ডিয়া তে কল করতে হলে ফোন কার্ড কিনতে হতো - পাঁচ ডলারে ৩০ মিনিট।
সেসব দিনে দেখেছি ইন্ডিয়াতে যারা ছিলেন, তাঁরা মনে করতেন, যে আমেরিকায় আছে তারই দেশে ফোন করা কর্তব্য। ইন্ডিয়া থেকে কেউ দুটি পয়সা খরচ করে আমেরিকায় কখনো আমার খোঁজ করেননি। (খুব কষ্ট করে মনে করলে দুজনের নাম মনে পড়ছে, যারা হোয়াটসআপ এর আগের যুগে ডাইরেক্ট ফোন করেছেন, তাঁদেরকে ফিজিক্স এর তত্ত্ব অনুসারে বাদ দিলাম )। তবে দুঃখের বিষয় হোয়াটসআপ এসে যাওয়ার পরেও এমন অনেক কাছের মানুষ ও বন্ধু আছেন যারা ২২ বছরে কখনো একটাও ফোন করেননি।
'ওতো বাইরে থাকে'
ও-তো বাইইইইইইরে থাকে! এই কথাটা বড্ডো শুনেছি। আর শুনে আসছিও।
কথাটা লোকে ভালবেসে বলছেন না খোঁটা দিয়ে বলছেন এখনো ভাল বুঝিনা।
আর এই বাইরে থাকে - মানে কত বাইরে সেটাও ঠিক স্পষ্ট হয়না কোনোদিন।
মনের বাইরে?
বাড়ির বাইরে?
শহরের বাইরে?
রাজ্যের বাইরে?
দেশের বাইরে?
ব্রম্ভান্ডের বাইরে?!!
যাইহোক বলতে গেলে অনেক কথা এসে যায়, আজ এক ছোট অভিজ্ঞতা নিয়ে সামান্য লিখছি।
প্রায় ১৫/১৬ বছর আগে শাশুড়িকে দেশে একটা নতুন ফ্লাট কিনে দেওয়া হল।
বিরাট বাড়ি উনি একা আর মেইনটেইন করতে পারছিলেন না। আমরা ভাবলাম, ফ্ল্যাটে আশেপাশে কিছু লোকজন থাকবে - ভাল হবে।
নতুন ফ্ল্যাটে শাশুড়ি এক নতুন বন্ধু পেলেন - মিস্টিমনি দেবী। তিনি উপরের তলায় থাকেন।
আসলে এখানেই ওনার বাড়ি ছিল। প্রোমোটারকে দেওয়ায় ফ্লাট হয়েছে। তিনি শাশুড়ির খুব বন্ধু হয়ে গেলেন।
(বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ শাশুড়ি ও মিস্টিমনি দেবীর নাম পরিবর্তন করে লিখছি!)
সেসময় আমি এক ছোট কয়লা সংক্রান্ত কন্সালটেন্সিতে কাজ করি। খুব ছোট একটা আমেরিকার শহরে থাকি যার জনসংখ্যা পাঁচ হাজার। দেনার জলে মাথা ডুবে থাকে। রোজ ভাবি কিভাবে পরিবর্তন আনব জীবনে। কিভাবে অন্য কোন কোম্পানি জয়েন করবো। যারা ভুক্তভোগী তাঁরা জানেন ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কোন শেষ নেই।
সেই সব দিনে এমন সময় গেছে যখন বছরের পর বছর আমি দেশে যেতে পারিনি। অনেকেই বিশ্বাস হয়তো করবেন না, কিন্তু ইন্ডিয়া যাওয়ার যা খরচ, সেটা করার মতো বিলাসিতা আমার ছিল না। বাইরে থাকি। দেশে যাওয়ার খরচ অনেকটাই।
মিস্টিমনি দেবী এই না আস্তে পাড়ার ব্যাপারটিকে বেশ উত্তেজনার সাথে নিতেন।
'কি রে, মেয়ে বাইরে চলে গেল, দেখবে না আর?'
আমরা অবশ্য যতটা পারতাম করতাম। ফোনে ফোনে যতটা পারা যেত।
আস্তে আস্তে ফোন সহজ হয়ে এল। হোয়াটসআপ স্মার্ট ফোন এসে গেল। পান বিক্রেতা থেকে পানাহার, না না হিরে বিক্রেতা -সব্বাই স্মার্ট হয়ে গেলেন। সঙ্গে শাশুড়িও।
ফ্ল্যাটে ৬ তা ভিডিও ক্যামেরা বসল। ফোনে আপ এসে গেল ২৪ ঘন্টা মনিটর করার জন্যে। 'বাইরে' থেকে যা সম্ভব করতে থাকলাম।
শেষ মেশ আমাদের অবস্থাও একটু সামান্য উন্নতি হল। আমরা বছরে দুই কি মাজে মাঝে তিনবারও দেশে যাওয়া শুরু করলাম বাইরে থাকা সত্ত্বেও।
এমন সময় একদিন শাশুড়িকে ফোন করেছি, দেখলাম মন খারাপ করে বসে আছেন। জানতে পারলাম তাঁর সাধের বন্ধু মিস্টিমনি দেবী ফোন করেছিলেন - বৃদ্ধাশ্রম থেকে।
একটু অবাক হলাম। বৃদ্ধাশ্রম মানেই যে খুব খারাপ একটা ব্যাপার, সেটা আমি অবশ্য ভাবি না। একই বাইরের দেশে নিজেকেও হয়তো একদিন বৃদ্ধাশ্রমেই থাকতে হবে এভাবেই মনকে তৈরি করছি।
জানলাম, মিস্টিমনি দেবীর খুবই ইন্টেলিজেন্ট ছেলে যে বহুকাল কলকাতা থেকেই চাকরি বাকরি করতো, সে এখন 'বাইরে' থাকে। বিয়ের পর বাচ্চা হয়েছে। নতুন সংসার। অনেক ব্যাস্ততা। তিন চার বছর হল আর মাকে দেখতে পারেননি কলকাতায় এসে। আস্তে আস্তে ফোন কল কমতে কমতে শূন্যতে ঠেকেছে। ছেলে বাইরে চলে যাওয়ার পর যোগাযোগ একদম বিচ্ছিন্ন।
ছেলে 'বাইরে' থাকে।
সুতরাং কলকাতার আত্মীয় স্বজন যতদিন পেরেছে দুবেলা ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু শেষমেশ এই কঠিন সিদ্ধান্ত ছেলের থেকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর।
আমি গেছিলাম গত বছরই, দেখা হয়েছিল মিস্টিমনি দেবীর সাথে। আমার দিকে দেখছিলেন - যেন হঠাৎ ভগবান দর্শন হয়ে গেছে ওনার। আমি প্রণাম করেছিলাম। মনে পড়ছিল ওনার মুখটা। খুব খারাপ লাগছিল।
মিস্টিমনি দেবীরও স্বামী হারিয়েছেন কিছু বছর। শাশুড়ির সাথে অনেক সময় কাটিয়েছেন ফ্ল্যাটে। বেশিরভাগটাই সুখের। আনন্দের সময়।
খারাপ লাগছিল। খুবই খারাপ।
খুব কৌতূহল হল, জিজ্ঞাসা করলাম - আচ্ছা, ছেলে বাইরে থাকে মানে কোথায়? অনেক দূর নিশ্চই? তিন চার বছর আসতে পারেনি কলকাতায়?
উত্তরে শাশুড়ি জানালেন, হ্যাঁ অনেক দূরই বটে - ব্যাঙ্গালোর।
ব্যাঙ্গালোর! মনে হল কেউ থাপ্পড় দিল!!
বহু বছর আমেরিকায় আছি বলে অনেক খোঁটা শুনেছি - 'বাইরে' থাকা নিয়ে। ব্যাঙ্গালোরে কেউ থাকলে সেটাকেও 'বাইরে' থাকা বলা যায়, সেটা ভাবতে পারিনি।
বুঝতে পারলাম 'বাইরে' থাকে ব্যাপারটা অনেক বেশি জটিল।
অনেকে আমরা একই বাড়িতে হয়তো সবাই মিলে এক সাথেই থাকি। তবু হয়তো মনের দিক থেকে অনেক বাইরে। অনেকে আবার হয়তো অনেক দূরে দূরেই থাকি। রোজ দেখা হয়না। কিস্তু মনের দিক থেকে তারা খুবই কাছাকাছি।
যারা বাইরে আছি, তারা বুঝি এই বাইরে থাকার কষ্ট, বাইরে থাকার সংগ্রাম।
বন্ধুহারা শাশুড়ি আর নিকটহারা মিস্টিমনি দেবীর কথা ভেবে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সেই মিস্টিমনি দেবী যিনি আমাদের বাইরে থাকা নিয়ে বহু বছর বহু খোঁটা দিয়ে এসেছেন।
মনে পড়ল সেই টাকার গাছটার কথাও। জানা হলনা সেটা এখন বেঙ্গালুরুতে পাওয়া যায় কিনা।
photo credit to AI - Dalle!