28/07/2020
# #নিশা
# #অনন্যা_পোদ্দার
রাত্রে খেতে বসে তনিমা বেশ একটু বিরক্তি নিয়েই বলল নিশাকে, " তোকে কতো বার বলেছি দিদি, তুই আমার বন্ধুদের সামনে বেরোবি না | তাও বেরোস কেন?? "
নিশা আমতা আমতা করে বলল, " আসলে তনু আমি বুঝতে পারিনি রে,, ডিডো টা এমন ছুট দিলো... ওর পিছনে ছুটতে গিয়েই বসার ঘরে চলে গিয়েছিলাম | "
" এটা কোনো কথা হোলো তোর?? ... ডিডো না হয় একটা কুকুর, অবলা জীব, বোধ বুদ্ধি কম | তাই বলে তুই নিজের বুদ্ধি খরচ করবি না?? "
পাশ থেকে অনিমা বলে উঠলেন, " তুই ওরকম করে কেন বলছিস তনু?? .... নিশা তোর বন্ধুদের সামনে গেল তো কী হোলো?? "
"তুমি আর কথা বোলো না তো মা !!... ওই তো তোমার মেয়ের ওই চেহারা !! নাক কাটা, ঠোঁট কাটা, তার উপর গায়ের রঙটাও হয়েছে সেই রকম !!.... ওকে নিজের দিদি বলে পরিচয় দিতেই আমার লজ্জা লাগে | আমার বন্ধুরা কী ভাবলো বলো তো?? ... "
" কী আবার ভাববে?? আর তোর কাছে তোর দিদি বেশি নাকি বন্ধুরা?? "
"তুমি আর ওর হয়ে কথা বোলো না মা?? .... ওর যা চেহারা তা যে কেউ দেখলে ভয় পেয়ে যাবে !! "
অনিমা প্রায় এক প্রকার চিৎকার করে মারতে উদ্যত হলেন তনিমাকে | পাশ থেকে কুনাল বাবু মানে নিশা, আর তনিমার বাবা বলে উঠলেন, " আহা, ওকে মারতে যাচ্ছ কেন?? .... ও তো ঠিক কথাই বলেছে | ওই ভাবে হঠাৎ করে ও বেরিয়ে আসলে লোকজন তো ভয় পাবেই | ".... তারপর নিশার দিকে তাকিয়ে বলেন, " তুই বা কেন যখন তখন বাইরে বেরোস?? "
পুরো ঘটনায় নিশা অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে থাকে | তার অপরাধ, সে বিকলাঙ্গ | অন্ততঃ ছোটো বেলা থেকে সে নিজের পরিচয় এটাই জেনে এসেছে পরিবারের সকলের কাছ থেকে | ব্যতিক্রমী শুধু মা | তার অন্ধকার জীবনের এক চিলতে রোদ্দুরের মতো ঝিলিক মারে তার মায়ের অকৃত্তিম ভালোবাসা |
জন্ম থেকেই তার মুখমন্ডল স্বাভাবিক নয় | তার চেহারায় তার নাকের ও মুখের একটা অংশ পুরো কাটা | তার উপর তার গায়ের রঙটাও বেশ ময়লা | সে শুনেছে, যে, সে যখন মায়ের পেটে ছিলো তখন সূর্যগ্রহণের সময় মা বাথরুমে গিয়েছিলো, তাই নাকি তার চেহারা এতটাই ত্রুটিপূর্ণ, অন্ততঃ ঠাকুমা তো তাই বলে | কিন্তু মা বলে, এটা নাকি বিজ্ঞান | মায়ের গর্ভে থাকাকালীন আম্বিলিকাল কর্ড তার শরীরে এমন ভাবে জড়িয়ে ছিলো যে তার মুখের এক অংশ চাপা পড়ে গিয়েছিলো | ফলে নাক, আর মুখ পূর্ণ রূপে গড়ে উঠতে পারেনি |ঠাকুমার সাথে সাথে তার এই চেহারা বাবার কাছেও গ্রহণযোগ্য ছিলো না | তাই তো আবার তনিমাকে নিয়ে আসা দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে | তনিমা বাড়ির সবার দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে | তার রূপ গর্ব করার মতো !! .... তাই তো বাবার আর ঠাকুমার খুব আদরের ও আহ্লাদের সে |
তবুও দুঃখ নেই নিশার | তার জন্য তার মা আছে | সে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিশাকে সমস্ত লজ্জা আর অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে | কিন্তু যার অদৃষ্টে অপমান লেখা আছে, তাকে কী বাঁচানো যায় এই লজ্জা থেকে??
তাই নিজের দুঃখ গুলিকে সে অশ্রুধারা করে বইতে দেয় না কখনো | তার মা তার জন্য এত কিছু করে | তারও তো কিছু দেবার আছে মাকে?? ... তাই চোখের জল ফেলে মায়ের কষ্টকে আর বাড়ায় না সে | তাই সেই দুঃখ গুলি কথার মুক্তো হয়ে ডায়েরির পাতায় জমা হতে থাকে | কিন্তু লেখার সময় নিশা নিজেকে নিয়ে কিছু লেখে না | তার কষ্টের অনুভূতি গুলিকে তার গল্পের চরিত্রের জীবন কাহিনী দিয়ে ফুটিয়ে তোলে | তার এই বেদনা টুকুও সে কারোর সাথে ভাগ করে না, সন্তর্পনে লুকিয়ে রাখে চুপি চুপি জীবনের কথা বলা সেই ডায়েরিতে
|সেদিন রাতে ছোটো বোনের কাছে চরম অপমানিত হয়ে ঘরে এসে মুখ লুকালো ডায়েরির পাতায় | লিখতে শুরু করলো জীবনের কাহিনী | সারা রাত ধরে লিখে চলল জীবনের গল্পগাঁথা | ভোরের দিকে কখন চোখ লেগে গিয়েছিলো টের পায়নি সে | হঠাৎ ঘুম ভাঙলে সে দেখে, তার মা স্নান করে পুজো দিয়ে তার ঘরে এসেছে ধুপ-ধূনো দিতে | মাকে দেখে তাড়াতাড়ি ডায়েরিটা লুকিয়ে ফেলে নিশা |
মা খুব স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করে, " কাল রাতে পড়ার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলি বুঝি?? সামনে কোনো পরীক্ষা আছে বুঝি?? "
নিশা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে, " ওই আর কী মা,, কলেজে ক্লাসেই একটা পরীক্ষা নেবেন প্রফেসর | "
" ও আচ্ছা | ", বলে মা ঘর থেকে বেরিয়ে যায় |
নিশা উঠে পড়ে, কলেজের জন্য তৈরী হয় | ওড়নাটা কে ভালো করে পেঁচিয়ে নেয় নিজের মুখমন্ডলের উপর | কলেজের সবাই তার চেহারার কথা জানলেও সে তার চেহারাকে কারোর সামনে উন্মোচন করে না, পাছে জগৎ সংসারের ভয় পাওয়া দেখে তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা মানুষটা যদি কষ্ট পায় !! তাই নিজের ভিতরের সেই মানবীকে ভালো রাখতে এই আবরণ টুকুর সাহায্য সে নেয় |
দিন এভাবেই চলছিল | বেশ কিছু মাস পরে কলেজে কিছু বেপরোয়া ছেলে একটি নবাগতা ছাত্রীকে হেনস্থা করতে চাইলে নিশা তার প্রতিবাদ করে | ফলস্বরূপ, তার চেহারা নিয়ে তাকে অপমানিত হতে হয় | তার এটাই যে ভবিতব্য !!
বাড়ি ফিরে এসে সে তার ডায়েরি সমুদ্রে ডুব দিতে উদ্যত হয়, কিন্তু সে সমুদ্রের সন্ধান সে কোথাও পায় না | তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সে পায়না তার জীবনের দিনলিপিকে |
তার খোঁজার ধরণে মা উৎসুক হয়ে বার কয়েক জিজ্ঞেসও করেছিল, " নিশা, তোর কী কিছু হারিয়েছে মা?. "
" না, মা | সেরকম কিছু না, কলেজের একটা খাতা খুঁজে পাচ্ছি না | ওটাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ নোটস ছিল | "
" আমি খুঁজে দেখবো?? "
প্রায় একপ্রকার আঁতকে উঠে নিশা বলে ওঠে, " না, না, মা | তার দরকার নেই | "........অনিমা আর কোনো কথা না বলে চলে যান ঘর থেকে |
শীতকালীন মরসুমের এক সেরা উৎসব বইমেলা | নিশার খুব ইচ্ছে করে বইয়ের ভিড়ে হারিয়ে যেতে | কিন্তু ভয়ে কোনোদিন ওই পথে হাঁটেনি সে | প্রচন্ড ভিড়ে তার লজ্জা যদি উন্মুক্ত হয়ে যায় লোকের মাঝে, তাহলে কতো লোকই না বিব্রত হবে সে মেলায় !! ... তার চেয়ে নিজের ইচ্ছেকে দমন করে রাখাই ভালো |
হঠাৎ সেদিন সকালে, মা ঢুকল নিশার ঘরে | মায়ের হাতে মায়ের মোবাইল ফোনটা ধরা | ঘরে ঢুকে মা বলল, " ফোনে আমার এক বন্ধু আছে, কথা বল | "
" কে মা?? " বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে নিশা | এই এতগুলি বছরে সে তো কোনোদিনই মায়ের কোনো বন্ধু আছে বলে জানেনি !!
মনের মধ্যে দ্বিধা নিয়ে ফোনটা নেয় সে | " হ্যালো|"
" হ্যালো, নিশা, আমি তোমার মায়ের বন্ধু | আমাকে তুমি রুপা মাসীমণি বলে ডাকতে পারো | আমার স্বামী সুবিমল বিশ্বাস একজন পাবলিশার | তাই প্রতি বছর বইমেলায় আমাদের একটা স্টল থাকে | তুমি আজ মায়ের সাথে চলে আসো বইমেলায়, তোমার ভালো লাগবে | "
" কিন্তু আমি তো কোনো ভিড় সমাবেশের মধ্যে যাই না মাসীমণি | "
" কিন্তু আজ আসবে | দেখো নিশা তিনদিন হয়ে গিয়েছে বইমেলা আরম্ভ হয়েছে | আজ চতুর্থ দিন | আজ আরও অনেক বেশি জমাটি হবে বইমেলা | তুমি চলে আসো, আমি হলপ করে বলতে পারি যে তোমার ভালো লাগবে | "
" কিন্তু.... "" আর কোনো কিন্তু নয়, দুপুরে দেখা হচ্ছে তোমার সঙ্গে | "
অনিমা এগিয়ে এসে বলেন, " তুই আর আমি যাব, একসাথে | কতদিন হয়ে গেছে বইমেলায় যাইনি | তুই আর না করিস না নিশা, লক্ষ্মী মা আমার | "
নিশা আর আপত্তি করে না | মায়ের জন্যই না হয় আজ সে বের হবে জনমানবের মাঝে |
বইমেলায় নির্দিষ্ট স্টলে পৌঁছলে নিশাকে দেখে রুপা ছুটে আসেন | বলেন, " এখানে বসো | আর কলমটা রাখো | আজ এটার আর তোমার অনেক পরিশ্রম করতে হবে | "
রুপা মাসীমণির কথা সে কিছুই বুঝতে পারে না | ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে | বইপ্রেমীরা আসতে থাকেন স্টলে | বেশিরভাগ বইপ্রেমীর হাতেই একটি বই দেখা যাচ্ছে | বইটির নাম " জীবনগাঁথা " | নিশা চেয়ার ছেড়ে উঠে টেবিলের দিকে যায় | যে বইয়ের এত জনপ্রিয়তা, সেই বইকে পড়ার ইচ্ছে নিয়ে হাতে নেয় সে | বইয়ের প্রথম পাতা দেখে সে স্থির হয়ে যায় | লেখক পরিচিতি দেওয়া আছে লেখকের ছবি সহ | নিশা স্থির পলকে চেয়ে থাকে লেখক পরিচিতির নির্বন্ধে | হুশ ফেরে যখন তারই বয়সী একটি মেয়ে "জীবনগাঁথা" নিয়ে এসে বলে, " অটোগ্রাফ, প্লিজ | "
নিশা চরম দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পালাতে উদ্যত হয় | তার পথ রোধ করে দাঁড়ায় তার মা আর রুপা মাসীমণি | "আজ পালাবার দিন নয় নিশা | বইমেলায় তোমার এই বই ই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে | নিজেকে জানো | তোমার তুমিকে তুমি না চিনলে কে চিনবে বলো তো?? "
নিশা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে | মা হেসে উত্তর দেয়, " দেখ নিশা | তোর ডায়েরির কোনো পরিবর্তন নেই, এমন কী বইয়ের নামটাও না | তুই যেমন করে সাজিয়েছিলি তোর জীবনগাঁথা কে, ঠিক সেভাবেই প্রকাশ পেয়েছে সে | "
নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে নিশা বলে, " ছবিটা না দিলেও তো পারতে মা | এই চেহারা দেখলে কেউ আর আমার লেখা পড়তে চাইবে না | "
" তোর কলমই তোর পরিচয় | সেখানে চেহারার কোনো ভূমিকা নেই | তুই তোর অন্তর্নিহিত শক্তিতে শক্তিশালী, মনের সৌন্দর্য্যে সুন্দর | তাই এই আবরণ খুলে ফেল | জগৎ কে জানতে দে, চেহারাতে কিচ্ছু থাকে না | মানুষের সৌন্দর্য তার মনে, তার অনুভূতিতে, তার প্রতিভায় | "
অনিমার কথায় নিশা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে | সে কী কোনোদিন ভেবেছে, যে, এমন দিনও হঠাৎ করে আসবে তার জীবনে !!.... তার জীবনের সেই এক চিলতে রোদ্দুর তার জীবনকে কেমন আলোয় ঝলমল করে তুলবে !!!
মায়ের পাশে বসে, নিশা একের পর এক তার লেখা বইতে স্বাক্ষর দিতে থাকে | নিশা তেও যে এমন ভোরের উন্মোচন হবে, তা কী সে জানতো | মায়ের ভালোবাসা, সন্তানের ভালো করা ইচ্ছে এরকম কতো নিশার জীবনেই না ভোরের আলো দেখায় |
স্বাক্ষর দিতে দিতে নিশা ভাবে, এর পরের বইটা তার মাকে নিয়ে, তার মায়ের মতো সেই মানুষ গুলিকে নিয়ে লিখতে হবে যারা এক পলকে হঠাৎ করেই একদিন সন্তানের জীবন আলোকিত করে খুশিতে ভরিয়ে তোলে |
-----------------------------------------------------------
সমাপ্ত