27/07/2023
👉 হিন্দুদের বিভিন্ন দল ও মুসলিমদের বিভিন্ন দলসমূহের পার্থক্য
[বিঃদ্রঃ লেখাটি হিন্দু সম্প্রদায়কে অপমানের জন্য নয়। বরং হিন্দুরা অনেক সময়ই কিছু বিষয়কে গোপন রেখে কেবল মুসলিমদের ভেদাভেদের ওপরই দোষারোপ করে; তাই এখানে কেবল তাদের গোপন করা সত্যটিই জবাবের স্বার্থে তুলে ধরার চেষ্টা করা হল।]
মুসলিমদের দিকে প্রায়ই এই অভিযোগ ছুঁড়ে দেওয়া হয় যে, তারা দলে দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু যে সকল হিন্দু এই অভিযোগগুলো করে থাকেন, তারা এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে এড়িয়ে যান যে, তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে কতখানি বিভক্ত!
আমরা যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের মতবাদগুলো তুলনা করি, তবে সেগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ঘোরতর মতবিরোধ লক্ষ্য করতে সক্ষম হব।
তার সামান্য কয়েকটি পয়েন্ট আকারে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
👉 বেদান্তবাদী vs বৈষ্ণব
স্বামী বিবেকানন্দ (বেদান্তবাদী):
প্রশ্ন – ভগবৎকৃপা (i.e কৃষ্ণভক্তির মাধ্যমে কৃষ্ণের কৃপা লাভ) ছাড়া কি মুক্তি লাভ হতে পারে?
উত্তর – মুক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের কোন সম্বন্ধ নেই। মুক্তি আমাদের ভেতর আগে থেকেই রয়েছে।
[স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী/৯ম খণ্ড/০৬. প্রশ্নোত্তর] উৎস - https://www.ebanglalibrary.com/vivekananda/প্রশ্নোত্তর-১-৫/
স্বামী প্রভুপাদ (বৈষ্ণব):
“আর আরেক হতচ্ছাড়া মতবাদ হল, “যত মত তত পথ” (রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের প্রচারিত মতবাদ)… তাই সব মূর্খ হতচ্ছাড়ার দল তাদের নিজেদের মতামত তৈরি করছে। না। এটা কখনই সম্ভব নয়।”
“And another rascal is, “Yes, yata mata tata patha…. So all foolish rascals, they’re making their own opinion. No. That is not possible.”
(Lecture BG 02.08 – London by Swami Prabhupada) source – https://vanisource.org/w/index.php...
“দুর্ভাগ্যবশত, কলিযুগের কারণে কিছু মূর্খ ব্যক্তি কৃষ্ণের পদ্মতুল্য পায়ে নিজেকে সমর্পণ করে না… (এই সকল) নাস্তিকেরা বলে যে, যত মত তত পথ… মূর্খদের এই দর্শন বৈদিক শাস্ত্রের বিধিবিধান সব নষ্ট করে দিয়েছে… কলিযুগের শেষের দিকে কল্কিদেব… অবতরণ করবেন এই সকল নাস্তিকদের হত্যা করতে আর ভগবানের ভক্তদের রক্ষা করতে।”
“Unfortunately, because of Kali-yuga, foolish people do not surrender to the lotus feet of Kṛṣṇa…. Atheistic men generally say, yata mata tata patha… This philosophy of rascals has killed the religious principles mentioned in the Vedas… In the last stage of Kali-yuga, Kalkideva…. will descend to kill all the atheists and will save only the devotees of the Lord.”
(Purport on Srimad Bhagavatam 6.8.19 by A.C Bhaktivedanta Swami Prabhupada) source – https://vanisource.org/wiki/SB_6.8.19?t=hl
👉 বেদান্তবাদী vs আর্য সমাজ
স্বামী বিবেকানন্দ (বেদান্তবাদী):
"'এই জগতের অস্তিত্ব নাই।' একথা বলার অর্থ কী? ইহার নিরপেক্ষ অস্তিত্ব নাই, ইহাই অর্থ। আমার, তোমার ও অপর সকলের মনের সম্বন্ধে ইহার আপেক্ষিক অস্তিত্ব আছে.."
[স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী/২য় খণ্ড/জ্ঞানযোগ/মায়া] উৎস - https://www.ebanglalibrary.com/vivekananda/০১-মায়া/
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (আর্য সমাজ):
"এখন এটা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, যদি আদি শংকরাচার্য ঈশ্বর এবং জীবাত্মাকে অভিন্ন এবং এই জগতকে মায়া (মিথ্যা) মনে করে থাকেন, তবে এটা উত্তম ছিল না..." (সত্যার্থ প্রকাশ)
"Now it must be understood that if it was the belief of Shankar that God and the human soul were identical and that the world was an illusion, it was not good..."
(Satyarth Prakash (The Light of Truth) by Dayananda/P. 347) source - http://www.aryasamajjamnagar.org/chaptereleven.htm
👉 আর্য সমাজ vs বৈষ্ণব
স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (আর্য সমাজ):
"বৈদিক শাস্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কর্তৃত্ব গৃহীত হতে পারে না। যদিও এটা সম্ভব যে, কৃষ্ণ... হয়ত চেয়েছিল দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য বার বার বিভিন্ন সময়ে জন্মগ্রহণ করতে। যদি বিষয়টি এমন হয়, তবে এতে কোনো ক্ষতি নেই... কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষ্ণ কখনই ঈশ্বর হতে পারে না।" (সত্যার্থ প্রকাশ)
"Being opposed to the Veda, it cannot be held to be an authority. Though it is possible that Krishna... might have wished that he would like to be born again and again at different times to protect the good and punish the wicked. if such was the case, there is no harm in it... In spite of all this Krishna could never be God." (Satyarth Prakash (The Light of Truth)/P. 219) source - http://www.aryasamajjamnagar.org/chapterseven.htm
স্বামী প্রভুপাদ (বৈষ্ণব):
"...ভারতে 'আর্য সমাজ' নামে এক শ্রেণির গোষ্ঠী আছে যারা বলে যে, তারা নাকি কেবল আসল বৈদিক শাস্ত্রকে সমর্থন করে আর অন্য সকল বৈদিক সাহিত্যকে প্রত্যাখান করে। এই সকল লোকদের উদ্দেশ্য হল মানুষকে তাদের মনগড়া অর্থ ও ব্যাখ্যা প্রদান করা। মহাপ্রভু চৈতন্যের মতে, এহেন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। সহজ কথায় বললে, তারা আসলে বৈদিকই নয়।"
"...In India there is a class of men known as ārya-samāja who say that they accept the original Vedas only and reject all other Vedic literatures. The motive of these people, however, is to give their own interpretation. According to Lord Caitanya, such interpretations are not to be accepted. They are simply not Vedic."
(Teaching of Lord Caitanya) source - https://prabhupadabooks.com/tlc/24?d=1
আপনি যদি কোনো হিন্দুকে প্রশ্ন করেন, ইসলাম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তা কে - তবে সেও হয়ত সহজেই বলে দেবে যে, ইসলামিক মতাদর্শে সৃষ্টিকর্তাকে বলা হয় "আল্লাহ"। এমনকি তাদের বেশিরভাগই হয়ত এটা জানে যে, ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ বার্তাবাহক হলেন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাঁকে তারা ইসলাম ধর্মের প্রচারক বলে মনে করে; আর অনেক হিন্দু পণ্ডিতও তাই মুসলিমদের "মহাম্মেদান"(Mohammedan) এবং ইসলামকে "মহাম্মেদানিজম" (Mohammedanism) বলে তাদের বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন।
এখানে তাই বিষয়টি একেবারে জলের মত পরিষ্কার যে, ইসলামে সৃষ্টিকর্তা কে - সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। "আল্লাহু আকবার" বললে সব মুসলিম সেই বিষয়ে এক হয়ে যায় যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রকৃত ইলাহ নেই যে উপাসনার যোগ্য হতে পারে, যতই তাদের মধ্যে ফিকহী বিষয়ে মতভেদ থাকুক না কেন।
কিন্তু যদি আমরা হিন্দু গোষ্ঠীগুলোর মতবাদগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখব, ঈশ্বর যে আসলে কে - সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট এবং চূড়ান্ত কোনো ধারণা নেই। হিন্দুদের দাবি অনুযায়ী, তাদের ধর্মে সকল মতবাদ বিদ্যমান বলেই এরূপ অনেক রকম বৈচিত্র্য দেখা যায় ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে। কিন্তু এটা দিয়ে প্রমাণিত হয় না যে, হিন্দু দর্শন সঠিকভাবে সত্য ও সরল পথটি তুলে ধরতে পেরেছে।
হিন্দু দর্শনে লোকমুখে ৩৩ কোটি দেব-দেবীর কথা প্রচলিত। আর বৈদিক বর্ণনা অনুযায়ী এই দেব-দেবী হল ৩৩ সংখ্যক। তবে এই দেবদেবীরা চূড়ান্ত ঈশ্বর নয়।
১) মায়াবাদী দর্শনে আদি শঙ্করাচার্যের অনুসারীদের মতে, জীব আর ব্রহ্মে মূলত খুব বেশি পার্থক্য নেই, যে জিনিসটায় শুধু পার্থক্য, সেটা হল মায়া বা অজ্ঞতা বা বিভ্রম। তাদের মতে, চূড়ান্ত ঈশ্বর এর কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই। ঈশ্বর আর সৃষ্টি আসলে একই জিনিস, কারণ সৃষ্টি আসলে ঈশ্বরের অংশ, তবে সৃষ্টি বলে আসলে কিছু নেই; এগুলো হল আমাদের অজ্ঞতা বা ভ্রম যে, আমরা আলাদাভাবে জগতটা দেখছি যেটার আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই যেকোনো একটি পথেই ঈশ্বরের দিকে যাওয়া যাবে। এই সম্পর্কে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বিখ্যাত তত্ত্ব বা মতবাদ হল "যত মত তত পথ"!
২) অন্যদিকে শিবের উপাসকদের মতে, শিব হল চূড়ান্ত ঈশ্বর আর অন্য সকল কিছু হল তার আওতাধীন।
৩) বৈষ্ণবদের মতে, কৃষ্ণ হল চূড়ান্ত ঈশ্বর আর বিষ্ণু, শিব, অন্যান্য দেবদেবী আর সকল সৃষ্টিই কৃষ্ণের আধ্যাত্মিক দেহের অংশ এবং তাই কৃষ্ণই চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণকারী।
৪) অন্যদিকে আর্য সমাজের স্বামী দয়ানন্দ স্বরস্বতীর অনুসারীদের চিন্তাধারা অর্ধেক হিন্দু আর অর্ধেক মুসলিম টাইপের! তারা মৃত বস্তুর পূজা নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে, কিন্তু সকল সৃষ্টি যে ঈশ্বরের মধ্যে অবস্থিত সেটা বিশ্বাস করে। অথচ তারা কোনো অবতারবাদে বিশ্বাস করে না এবং দেবদেবী, স্বর্গ-নরক এগুলিও রূপক অর্থে গ্রহণ করে এদের বাস্তব অস্তিত্ব তারা অস্বীকার করে। আবার এরা মায়াবাদীদের মত জগতটা যে মিথ্যা, এটাও স্বীকার করে না। তাই মায়াবাদীদের মত, জীব আর ব্রহ্মকে তারা কেবল মায়া দিয়ে পৃথক না করে ঈশ্বরের মর্যাদা জীবের থেকে আলাদা আর অনেক ওপরে বলে বিশ্বাস করে।
অর্থাৎ সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এটাই দাঁড়াচ্ছে যে, হিন্দু মতপথগুলোকে একত্রিত করলে কে যে চূড়ান্ত ঈশ্বর, তার কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তির পক্ষে নেওয়া খুবই মুশকিল!
এহেন বিভেদ থাকা সত্ত্বেও সুচতুরতার সাথে তারা বিভেদ প্রসঙ্গে আঙ্গুলখানা কেবল মুসলিমদের দিকেই তুলে ধরে!!!
=============================